(১ম পর্ব)
আবেদা খাতুনের অনেক স্বপ্ন। এই যেমন তার সন্তানরা মানুষের মত মানুষ হবে। একদিন তাদের সব দুঃখ ঘুচে যাবে। আবেদাকে আর মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হবে না। অন্যের বাড়ি বান্দি খাটতে হবে না। মাতুব্বর বাড়ি যেয়ে বাড়া ভানতে হবে না। একদিন তার সন্তান দেশের সেরা শিক্ষিত হবে। ভাল চাকরি করবে। সারাদেশে তা জানাজানি হবে। তখন আবেদা খাতুনের কোন দুঃখ থাকবে না। আবেদা খাতুন ফরিদপুর জেলার এক অভাগী। তার স্বামী আছে, সন্তান আছে, ঘর-সংসার আছে। কিন্তু সে ঘরে স্বচ্ছলতা নেই। অভাব লেগেই আছে। এবেলা খাওয়া জোটে তো ওবেলা উপোস থাকতে হয়। স্বামী রহমত হাঁপানির রোগী। কাজ করতে পারেন না। নিজের বলতে তাদের কোন জমি নেই। অন্যের জমিতে দিনমজুরি করে কোনমতে সংসার চলে। কাজ না থাকলে সংসারের সবার উপোস থাকতে হয়। অথচ এই রহমতের এক সময় সব ছিল। মাঠ ভরা জমি ছিল, গোয়াল ভরা গরু ছিল, গোলা ভরা ধান ছিল, বাড়ির পালানে খড়ের বিশাল পালা ছিল। দূর থেকে দেখে যে কেউ আন্দাজ করে নিতে পারতো বাড়িটি কোন স্বচ্ছল পরিবারের। সকালে-বিকেলে দিনমজুররা ধানের আঁটি এনে ধপাস-ধপাস করে বাইর বাড়ি ফেলতো। কাঁচা ধানের গন্ধে চারদিক ভুর হয়ে যেত। সে গন্ধ অমৃতের মতো মনে হতো আবেদার কাছে। বিকেলে আবার কখনো জোছনা রাতে কাঁচা ধানে মলন চলত। এতটুকু ফুরসত ছিল না আবেদা খাতুনের। তবু তার কাছে খাঁটুনি মনে হতো না। দিনমান খেটেও কেমন যেন এক অনাবিল সুখ বয়ে যেত তার শিরদাড়া বেয়ে। আবেদা সে সুখের কথা কাউকে বুঝাতে পারতেন না। এ সুখ একান্তই তার নিজের। মুখে সারাক্ষণ লেগে থাকত হাসির ঝিলিক। সন্ধ্যে হলেই তার শাশুড়ি ছোটদের নিয়ে গল্পের আসর বসাতেন উঠোনে। লাল পরী, নীল পরী, শেওড়া গাছের ভুত...কত্তসব গল্প জমাতেন আবেদা খাতুনের শাশুড়ি বেতাগী বিবি! অন্যদিকে আবেদা খাতুন ব্যস্ত থাকতেন রান্নাঘরে। এত্তগুলো মানুষের রান্না করতে তার অনেক রাত হয়ে যেত। কাজের মানুষ আর বাড়ির সবাইকে খাবার দেয়াও কম খাটুনির নয়। সব শেষ করে আবেদার ফ্রি হতে হতে রাত দশটা, বারটা বেজে যায়। যখন ঘুমাতে যেতেন আবেদা স্বামীর সাথে কত্ত সুখ-দুঃখের গল্প হতো তার। কখন কোন ফাঁকে কেটে যেত রাত, মসজিদ থেকে ভেসে আসতো আজানের ধ্বনি কিছুই টের পেতেন না আবেদা। আহা, কি সুখেরই না ছিল সেই সব দিনগুলি!
আজ আবেদা খাতুনের সে সুখ নেই। তার দু’চোখ ভরা শুধুই জল। আজ তার সন্তানরা থাকে অনাহারে, অর্ধাহারে। একথা ভাবতেই কষ্টে তার বুক ভেঙ্গে যায়। যেন মুহূর্তেই হিমালয় থেকে হিমবাহ গলে নেমে যায় তার বুকের মাঝখান দিয়ে। স্বচ্ছল গৃহস্থ পরিবারের মেয়ে আবেদা। তার এত কষ্ট সয় না। কখনো মনে হয় সংসার ছেড়ে চলে যাবে বাবার বাড়ি। বাবার সাথে একচোট বোঝাপড়া করে আসে এমন অকর্মা জামাইয়ের সাথে কেন বাবা তাকে বিয়ে দিয়েছেন। আবেদা ভাবেন, তা কি করে হয়! বাবা তাকে যখন এ সংসারে বিয়ে দিয়েছিলেন তখন তো এত অভাব ছিল না। এত অনটন ছিল না। এ অবস্থা তিনি নিজ চোখেই তো দেখেছেন। তাহলে বাবার কি দোষ!
নিজেই কপাল থাপড়ান আবেদা! কোন উপায় পান না । ভাবেন নারীর জীবনে বিয়ে তো একটাই হয়, তাহলে কি করে তিনি এই সংসার ফেলে যাবেন! এতদিন যার সাথে কেটে গেছে তার সুখ-দুঃখের দিন, যে তার জীবনের অর্ধেকটা বয়ে নিয়ে চলেছেন তাকে ছেড়ে কি করে তিনি বাবার সংসারে যাবেন!
আবেদা খাতুন সংসারকে আবারও আপন করে নেন। ভাবেন স্বামীর উপার্জনে সংসার না চললে তিনি নিজেই নামবেন উপার্জনে। তবে তা হবে বৈধ, সৎ এবং শ্রমঝরা। আবেদার স্বামী রহমত মাঝে মাঝেই ‘বিদেশে’ যান। কানাইপুর হাটে যান। সম্বল তার দুটি হাত, একটি কাঁচি আর গায়ের জোর। কখনো যান টেপাখোলা হাটে। এখানে গৃহস্থ পরিবারের কর্তারা আসে, শক্ত সামর্থ দেখে বেছে বেছে দিনমজুর নিয়ে যায়। কখনো তারা দূরে কখনো কাছের কোন গায়ে দিনমজুরি করেন। দিনমজুরদের ভাষায় অন্য গাঁয়ে যেয়ে কাজ করার নামই বিদেশ। রহমতের বয়স বেশি, তাকে কোন গৃহস্থ পরিবারের কর্তা নিতে চায় না। হাটবেলা থেকে হাট শেষ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেন তিনি। নাহ! কেউ তাকে দিনমজুরিতে নেয় না। ব্যর্থ মনে রাতে টলতে টলতে রহমত বাড়ি ফিরে যান। তাকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে ওঠেন আবেদা খাতুন Ñ ‘কি অইছে কাম পান নাই?’
‘নারে বউ, আমার মত বুড়ারে কে কামে নিবি!’- বলতে বলতে রহমতের চোখ ছলছল করে ওঠে। হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন তিনি। স্বামীকে এভাবে কাঁদতে দেখে স্থির থাকতে পারেন না আবেদা ! তার চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় কান্না ঝরে পড়ে, নীরবে-নিভৃতে। রহমত তা দেখতে পান না।
ছিন্ন আঁচলে রাতের আঁধারে দু'চোখ মুছে আবেদা স্বামীকে সান্ত্বনা দেনÑ ‘আপনি কাইনদেন না তো। আল্লায় যা করে তাই অবেনে।’
‘আমার সোনারা ঘুমাইছে?’ Ñ রহমত জানতে চান।
আবেদা ছোট্ট উত্তর দেন -‘হ’।
‘ওরা না খায়ে ঘুমাইছে, না?
আবেদা খাতুন আবারও চোখ মুছে বলেন- ‘হ, খাবার পাবি কহানে? ছোট্ট ছাওয়ালডা খাবার চায়ে কত্ত কানছে!’
‘তুমি কি কইছো?’
‘আমি কইছি তোর বাপ কাম করতি বিদেশ গেছে। আর কয়ডা দিন কষ্ট কর বাবা। বিদেশেতে তোর বাবা টাহা পাঠাবেনে। সেই টাহা দিয়ে আমি তোরে ভাল ভাল মাছ কিনে দিবানি।’
‘তা শুনে ও কিছু কয় নাই?’
‘হ কইছে’
‘কি কইছে?’
‘কইছে বাজান আমার আসার সময় মিষ্টি আলু কিনে আনবেনে। আমি সেই আলু আগুনি পোড়া দিয়ে খাবানি! পোড়া আলু আমার কাছে খুব মজা লাগে, মা!’
‘আহারে আমার বাছাধন! সহালে ঘুম থেকে উঠলে আমি ওরে কি জবাব দিবানি?’
‘আপনি আর কাইনদেন নাতো। ছাওয়ালরে আমি বুঝাবানি। এহন আসেন তো ইট্টু কিছু খায়ে নেন।’
‘খায়ে নেব? কি খাব? আমিতো তোমাগারে চাল-ডাল-টাকা পয়সা কিছু দিয়ে যাইতে পারি নাই। খাবার পালে কই?’
‘কথায় কয় না গরিবের বন্ধু আল্লাহ! আল্লার দুনিয়ায় হাত থাকলি না খায়ে কেউ মরে না।’
‘আরে খাবার পালে কহানে? কও না!’
‘হারুণগের পালানে থেইকা বৈকালে এক চালন কলমি শাক তুলিছিলাম। সেই শাক ইট্টু নুন আর পানি দিয়ে সেদ্ধ করে দিছিলাম। তাই খায়ে ছাওয়ালপান ঘুমাইছে। সহালের জন্যি ইট্টুহানি রাহিছিলাম। চলেন তার ইট্টু মুহে দেবেন। সেই সহালে একমুট বাসি ভাত মুহে দিয়ে হাটে গেলেন। এতক্ষণে আপনার অনেক খিদে লাগিছে।’
রহমতের দু'চোখ বেয়ে গরম অশ্র“ গড়িয়ে পড়তে থাকে। স্ত্রীকে তা বুঝবার দেন না। কিন্তু এক সময় হু হু করে কেঁদে ওঠেন রহমত। আবেদা খাতুন খেই হারিয়ে ফেলেন। আবারও তার স্বামী কাঁদছে! একজন স্ত্রীর সামনে এভাবে তার স্বামী কাঁদলে কোন নারী সহ্য করতে পারেন!
সাখিনা খাতুন তার স্বামীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন- ‘আপনি না পুরুষ মানুষ! আপনার চোহি পানি দেখলি আমি কেমনে সহ্য করি। দোহাই চোহির পানি মোছেন।’
( বাকি অংশ আগামীকাল)

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




