somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

#আমার_দেখা_রাতগুলি - ০২

০২ রা অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রাতের একটা রহস্য বলি। সবকিছু বেশী বেশী মনে হয়। হয়ত পাশ দিয়ে একটা কুকুর হেটে গেলো, কুকুরটাকে একটু বেশী বড় মনে হয়। হয়ত কেউ একজন শাদা কাপড় ছড়ায়ে রেখেছে। মনে হয়, এই বুঝি কোন এক বুড়ি এই শাদা কাপড় পড়ে দৌড় দিলো। বহু দিন গ্রামের পথে পথে আমি রাত জেগেছি। বিষয়গুলার সাথে আমি পরিচিত। দূর থেকে হালকা চাঁদের আলোয় আমি চিনলাম, তার নাম আয়নাল।

পাশেই খালের উপর একটা মাছ ধরার ভেল জাল আছে। জাল তার নিজের না। মালিক দিনের বেলায় মাছ ধরেন। আর রাতের বেলা আয়নাল মাছ ধরেন। রাতে মাছ ধরা পড়ে বেশী। কিন্তু কারো এত বড় সাহস নাই যে কামাইরাখালের পুলের কাছে রাতে মাছ ধরবে। এই সুযোগে আয়নাল বিনা পুঁজিতে মাছের ভাগ পাচ্ছে।

আয়নালের নির্দিষ্ট কোন পেশা নাই। সব ধরণের কাজ করে। ধান কাটা, মাটি কাটা, মাছ ধরা, রাজমিস্ত্রীর জোগালী হিসাবে কাজ করা, সব কাজেই তিনি পটু। বয়স ত্রিশের মত। অনেক উচা লম্বা। সেই রকম কালো এবং মেদহীন সুঠাম দেহ। তাকে আমি ভাই ডাকি। আয়নাল ভাইকে আমি যে কারনে এত ভালো করে জানি তা হইলো, তিনি খুব ভালো বাঁশি বাজান। আয়লান ভাই যেই সুরে বাঁশী বাজান তা কোন গানের সাথে মিলে না। কিন্তু প্রাণের উপর দাগ কেটে যায়।

আয়নাল ভাই আমাকে দেখলেন, আমিও তাকে দেখলাম। কারো কোন কথা হইলো না। আমি বাড়ী চলে আসলাম। বেশ কয়েকদিন পর আমাদের বাড়ীতে কি যেন একটা কাজ হচ্ছে। বেশ কয়েকজন মানুষের সাথে আয়নাল ভাইও আছেন। আমরা কেউই ঐ বিষয়ে কোন কথা বল্লাম না। কিন্তু তার চেহারা দেখে আমি বুঝলাম, কিছু একটা বলতে চাইছেন। সুযোগ বুঝে এক ফাঁকে আমাকে বল্লেন
- তুমি এত রাইতে রাস্তায় হাটো কেন?
আমি একটা মুচকি হাসি দিলাম। বল্লাম
- অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করি। এরপর একটু হাটাহাটি করতে ভালো লাগে।
আমাকে উপদেশ দেওয়ার ভঙ্গিতে বল্লেন
- ছোড ভাই, একটা কথা মনে রাখবা। দিনের দুনিয়া আর রাইতের দুনিয়া একই দুনিয়া। দিনে মনুষের মনে ভয় থাকে না, রাইতে মানুষের মনে ভয় থাকে। এই একটাই পার্থক্য। তবে ভয় যদি কাটাইয়া উঠতা পারো, রাইতের মত সুন্দর দুনিয়ায় আর কিছু নাই।

একটা কথা কিছুতেই মনে আটক রাখতে পারলাম না। জিজ্ঞাসা করেই ফেল্লাম
- আয়নাল ভাই, ঐ বাঁশঝাড়ে তো হিন্দু বাড়ীর মানুষজন ভোগ দেয়। এইটা খাইলেন কী মনে কইরা?
এইবার আয়নাল ভাই হাসলেন। প্রাণ খুলে হাসলেন। লম্বা মানুষের দাঁতও লম্বা হয় নাকি? ভদ্রলোকের হাসি সুন্দর। হাসতে হাসতে বল্লেন
- ছোড ভাই, খাওনের কোন হিন্দু মুসলমান নাই। রাইতে মাছের ভেলে বইসা থাকি। মাঝেমাঝেই খিদা লাগে। তাই যা পাই তাই খাই, কিছু আর বাদ দেই না।

আয়নাল ভাই একটু ব্যখ্যাও করলেন। বল্লেন, মিষ্টি যে খাও। মিষ্টি কারা বানায়? বল্লাম, কেন হিন্দুরা বানায়! এবার আয়নাল ভাই জ্ঞানী মানুষের মত হাসলেন। বল্লেন, এই মিষ্টি বানানের দুধ কার কাছ থেইক্কা কিনে? আমি বল্লাম, কেন, মুসলমানদের কাছ থেকে! হঠাৎ করেই আয়নাল ভাই বড় সমস্যার সমাধাণ করে ফেলার মত করে বল্লেন, তার মানে খাওনদাওনের কোন ধর্ম নাই ছোড ভাই।

আয়নাল ভাই মিটমিট করে হাসলেন। বল্লেন
- মানুষ কত বেকুব দেখো। নিজে খাইতে পায় না। অথচ দুইটা সাগর কলা, আধা কেজি জিলাপি, আধা কেজি বাতাসা এইসব কিন্না ঠিকই ভোগ দিতে পারে। বেকুবতো আর গাছে ধরেনা ছোড ভাই, বেকুব মাইনসের পেটেই ধরে।

রাতের বেলা পথে ঘাটে হাটার মজাটা অবশ্য শুরু হয় আমার আরো শৈশবে। মা'র পিঠিপিঠি ছোট যে বোন। তিনি সানু খালা। আমা দেখা সব চেয়ে প্রানবন্ত একটা মানুষ। খালাম্মা প্রায়ই আমাদের বড়ী আসতেন। খালাম্মা বাড়ীতে বেড়াইতে আসলেই সন্ধার পর তার সঙ্গী, সাথী বাড়তে থাকতো। আমি অবাক হইতাম, এত এত মানুষ খালাম্মাকে কিভাবে চিনে? আমার বেশ মনে আছে, খালাম্মা ড্রয়ের থেকে আব্বার পাঞ্জাবী, লুঙ্গি বের করতেন। নিজে পড়তেন, আমাদের বাসায় একটা মেয়ে থকতো, হাজেরা নাম। তাকেও পাঞ্জাবী, লুঙ্গি পড়াইতেন। এরপর বড় একটা বিশাল থালা হাতে করে এই বাড়ী, ঐ বাড়ী ঘুরতেন। খালাম্মার পিছন পিছন আমরা সারা বাড়ীর লোকজন হাটতাম। আহারে সেইদিন আর কোন পড়াশোনা নাই। ফিক ফিক হাসি, দৌড়াদৌড়ি। কী মজা। এই বাড়ী, ঐ বাড়ী ঘুরে ঘুরে ভাত, তরকারী সব এই বিশাল থালায় নিতেন। সবার বাড়ী যখন ঘুরা শেষ। তখন সব বাড়ীর ছেলেপেলে খালাম্মার পিছনে অলরেডী জড়ো হওয়াও শেষ। এরপর আমাদের উঠানে বসে এই ভাত তরকারী একসাথে মাখায়ে আমরা সবাই খাইতাম। এর পর শুরু হইতো রাতে হাটার অনুষ্ঠান।

সারা বাড়ীর ছেলেপেলে আমরা খালাম্মার পিছন পিছন হাটতাম। খালাম্বার হাতে থাকতো আমার বড় আব্বার হাতের একটা ছড়ি। আর হাজেরার হাতে থাকো আমার দাদার হাতের একটা ছড়ি। বড় আব্বা আর দাদা মারা গেছেন আগেই। তাদের ছড়িগুলা প্রাণ পেয়ে যেতো খালাম্মা আমাদের বাড়ী আসলেই। কত জোৎস্না রাতের এমন দল বেধে হাটার স্মৃতিযে আমার মনে গাঁথা আছে তার কোন হিসাব নাই। আমি ঠিক জানি না গ্রামে যারা বড় হয়েছেন, আমার মত। তাদের শৈশব এতটা আনন্দঘন ছিলো কি না। খালাম্মার সাথেই একবার ভরা পূর্ণিমায় বের হয়েছি হাটতে। আমরা কম করে হলেও বিশ পচিশজন মানুষ। আবারো এই কামাইরাখালের পুলের কাছের এক স্মৃতি। অধিকারীর বাড়ী আর কামাইরাখালের পুলের একটা তে-মাথা আছে। খালাম্মাই প্রথম আমাদেরকে দেখাইলেন।
- ঐ দেখ, ভূতের বাচ্চাগুলা কী করতেছে!

খালাম্মা বিষয়টা এমন ভাবে বল্লেন যেন চিড়িয়াখানায় গিয়ে কেউ একজন খাচায় আটকানো বাঘ দেখায়ে বলছে, ঐ দেখ এইটা বাঘ।
শৈশবের স্মৃতি, আমি আজও স্পষ্ট দেখতে পাই। মানুষের মত দেখতে। বড়জোর এক হাত হবে উচ্চতায়। দুইটা প্রাণী। চাঁদের আলো আর গাছের ছায়ায় কেমন যেন একটা ঘোরের মত তৈরী হয়েছে তিন মোহনাটায়। একটা প্রাণী আরেকটাকে ঘোমটা পড়ায়ে দিচ্ছে। আবার এরা সুন্দর করে নাচানাচিও করছে।

মজার বিষয় হইলো সেইদিন আমাদের সাথে আমার বড় ভাই শরীফ ছিলেন। তিনি সহাস দেখায়ে কয়েকবার বলেওছিলেন
- খালাম্মা যাই? একটা দৌড়ানি দিয়া আসি?
কিন্তু তিনি গেলেন না। উল্টা বাড়ীতে আসার পর জ্বরে কাঁপতে শুরু করলেন। শরীফ ভাইকে আমি কোন দিন বলি নাই যে সেই জ্বীনের বাচ্চার নাচানাচি রহস্য আমি ভেদ করে ফেলেছি। ঘটনাটা ছিলো ৯০ সালের দিকে। আর রাতে হাটাহাটির নেশা আমার ৯৬ সালের দিকে।

সেদিন হঠাৎ করেই মনে হইলো আচ্ছা খালাম্মা যে ভূতের বাচ্চার নাচানাচি দেখাইছিলেন! দেখিতো আজ ভাগ্য ভালো হইলে সেই ভূতের বাচ্চাদের দেখা পাইয়াও যাইতে পারি। রাত যখন প্রায় বারোটা তখন আমি নিশ্চিৎ হইলাম যে বাড়ীর সবাই ঘুমায়ে গেছে। টেবিলের উপর হারিকেনটা আস্তে করি ডিম করলাম। তারপর দড়জাখানা শব্দহীন ভাবে ভেজায়ে দিলাম। হাটা শুরু করলাম কামাইরাখালের পুলের দিকে। মনে মনে ভাবা শুরু করলাম, আচ্ছা ভূতের বাচ্চাগুলা কি এখনো বাচ্চাই আছে? নাকি সাইজে একটু বড় হইছে? ভাগ্যের কী কাকতালীয় মিল। সেইদিনও ভরা পূর্ণিমা। সমস্ত এলাকায় আমিই একমাত্র মানুষ রাস্তায় হেটে হেটে এই পূর্ণিমা দেখছি। আর দড়জা এঁটে ঘুমিয়ে গেছে পাড়া।

দূর থেকে খেয়াল করলাম, হ্যাঁ ঠিক একই জায়গায় ঘোমটা পড়ানীর খেলা চলছে। গত ছয় বছর আগের স্মৃতিতে আর এই দৃশ্যতে কোনই তফাৎ নাই। তাফাৎটা শুধু আত্মবিশ্বাসে। খুব মনযোগ দিয়ে আমি এই খেলা দেখছি। রাত বড় অদ্ভুৎ একটা সৃষ্টি বিধাতার। সব কিছুতেই কেমন যেন রহস্য থাকে। এক হাতের মত উচ্চাতার দুইটা শিশুর মত দেখতে। এরা যেন জামাই-বউ খেলা খেলছে। একজন ঘোমটা পড়ছে, আরেকজন ঘোমটা খুলে দিচ্ছে। কিন্তু বিষয়টা তা নাও হইতে পারে। কারন চাঁদের আলোয় কোন কিছুই দূর থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়না। আবার জায়গাটাতে গাছের ছায়াও পড়েছে একটু।

আমি ভাবলাম, আমি মারা গেলে কে কে কাঁদবে? মা'র মুখটা শুধু মনে পড়লো। আমি ধীরে ধীরে হাটা শুরু করলাম শৈশবে দেখা সেই ভূতের বাচ্চাদের দিকে। চাঁদের আলোর চাইতেও বেশী মনোরম মনে হচ্ছে উতলা বাতাস। আহারে জীবন এত সুন্দর! এত রহস্যময় সুন্দর!

#আমার_দেখা_রাতগুলি
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১:৩৭
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের বিধান হতে হলে কোন কথা হাদিসে থাকতেই হবে এটা জরুরী না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৫



সূরাঃ ৫ মায়িদাহ, ৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
৩। তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত, রক্ত, শূকরমাংস, আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে যবেহকৃত পশু, আর শ্বাসরোধে মৃত জন্তু, প্রহারে মৃত... ...বাকিটুকু পড়ুন

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×