somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিস্ময়ের আর এক নাম লাদাখ

২৬ শে জুন, ২০১৫ সকাল ১১:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জম্মু-কাশ্মীর শব্দ দুটো শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে— সন্ত্রাসবিধ্বস্ত রাস্তাঘাট, আতঙ্কিত মানুষ, সাম্প্রতিক পাথর-কাণ্ডের নানা রক্তাক্ত ছবির পাশাপাশি সুসজ্জিত ডাল লেকে নৌকা বিহার, ঘোড়ায় চড়ে গুলমার্গ-সোনমার্গ দর্শনের আনন্দ-চিত্র। যদিও ছবিগুলো ইদানীং-এর নয়, বহু বছর ধরে বাস্তব এই চিত্রগুলি পর্যটকদের মনে ছাপ ফেলে এসেছে। কেননা সৌন্দর্যের সঙ্গে সন্ত্রাসের সহাবস্থানে দীর্ঘদিন ধরেই জর্জরিত ভূ-স্বগর্।
এ হেন জম্মু-কাশ্মীরের অন্যতম একটি অংশ যা ভ্রমণপিপাসুদের কাছে চিরকালের আকর্ষণীয়, সেই লাদাখকে জানার এবং দেখার একটা অদম্য কৌতূহল ছিল আমার মনে। লাদাখ নামটা বরাবরই কেমন যেন মোহিত করত আমায়। এখানে হিমালয়ের একেবারে ভিন্ন রূপ যা অন্যত্র দেখতে পাওয়া যায় না বললেই চলে। এমন একটা জায়গায় যেতে কার না ইচ্ছে হয়? আর সেখানে যাওয়ার সুযোগটা এসে গেল হঠাৎ করেই। বাবার এলটিসি পাওনা ছিল আর সেটা নিতেই হত জুলাইয়ের মধ্যে। অতএব আর কী, ট্র্যাভেল এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ, প্যাকেজে চোখ বুলিয়ে নেওয়া, ওদের লিস্টে নাম ঢুকিয়ে দেওয়া এবং কাউন্টডাউন ফাইনাল দিনের জন্য


শুধুই চওড়া রাস্তা। পাহাড়ও নগ্ন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে।

নির্দিষ্ট দিনে মালপত্তর বোঝাই করে বাবা, মা এবং আমি, তিনজনে বেরিয়ে পড়লাম। কলকাতা থেকে দিল্লি বিমানবন্দরে পৌঁছলাম রাত প্রায় ১২টায়। এখান থেকে লে যাওয়ার বিমান পর দিন সকাল সাতটায়, অতএব সারা রাত কাটল বিমানবন্দরেই। সকালে নির্দিষ্ট সময়ে ছাড়ল বিমান। আমাদের দলের সকলেই এই বিমানে ছিলেন, যদিও তখনও কারও সঙ্গে আলাপ হয়নি। সকাল ৮টা ১৫ মিনিট। বিমানের জানলার বাইরে মেঘ সরতেই কেমন যেন ম্যাজিক... হঠাৎই ও-পারে বরফে ঢাকা সারি সারি পাহাড়। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য! ‘ভারতের ছাদ’ লাদাখ আমাদের পায়ের তলায়!
ঘড়ির কাঁটা ৮টা বেজে ২০ মিনিট ছুঁইছুঁই। বিমান অবতরণ করল ভারতের সর্বোচ্চ সিভিলিয়ান এয়ারপোর্ট লে-তে, যার পোশাকি নাম ‘কুশক বাকুলা রিনপোচে টার্মিনাল’।
ট্যুর এজেন্সির অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার বান্টিদা, আমাদের ২২ জনের পুরো দলটাকে ভাগ করে দিলেন চারটি স্করপিও গাড়িতে। বাইরে কনকনে হাওয়া, কিন্তু গরম জামাকাপড় স্যুটকেস বন্দি, ভরসা হাফহাতা একটা সোয়েটার। গাড়িতেই আলাপ হল দুই বন্দ্যোপাধ্যায় দম্পতির সঙ্গে। এক বন্দ্যোপাধ্যায়-কাকু-কাকিমা এবং আর এক বন্দ্যোপাধ্যায়-দাদু-ঠাকুমা (যদিও ঠাকুমা না বলে তাঁকে জেঠিমা বলাই ভাল)। গাড়ি চলতে শুরু করল, আর শুরু হল আমাদের লে শহর দর্শন।

সাধারণ পাহাড়ি শহরে যেমন পাহাড় আর খাদ একসঙ্গে থাকে, এখানে সেটা প্রথমে চোখে পড়বে না। শুধুই চওড়া রাস্তা এবং সাদামাঠা একটা শহর। মাঝে মাঝে মন্দির তৈরি করে তাতে জপযন্ত্র স্থাপন করা। এ জিনিসটা লাদাখের সর্বত্র দেখতে পাওয়া যায়, কী গুম্ফায়, কী রাস্তায়! মিনিট কুড়ি পর পৌঁছে গেলাম হোটেলে। ছিমছাম পরিবেশ, দূরে পাহাড়, তিব্বতি নিশান লাগানো পতাকা উড়ছে। ম্যানেজার রাজু সাহা অপেক্ষা করছিলেন আমাদের জন্য। পুরুষদের হলুদ এবং মহিলাদের সাদা উত্তরীয় দিয়ে বরণ করলেন। গুম্ফাতেও দেখেছি, বুদ্ধদেবের মূর্তির শরণার্থীরা এই ধরনের উত্তরীয় রেখে যান।
লে-লাদাখের পাহাড় নিয়ে দু-চারটে কথা বলি। সাধারণ পার্বত্য অঞ্চলে যেমন সবুজ বনানী ও পাহাড় একসঙ্গে চোখে পড়ে, লে-তে সেটি নেই বললেই চলে। আশ্চর্যজনক ভাবে এখানে গাছপালার পরিমাণ কম। যার প্রধান একটি কারণ এখানে বৃষ্টিপাত নেই বললেই চলে। লাদাখের অধিকাংশ ঘরবাড়িই মাটির তৈরি। কারণ জলের অভাবে সিমেন্টের তৈরি ইমারতে ফাটল অনিবার্য। এমনকী বাড়ির ছাদ, ঘরের মেঝে, দেওয়াল সবই মাটির। প্রকৃতির বিচিত্র খেয়ালে এখানে বৃষ্টিপাত কম। যদি সে খেয়ালের পরিবর্তন হয় তা হলে এই মৃন্ময়ী রূপের কী পরিণতি হবে। লাদাখের পাহাড়ও নগ্ন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। তার শরীরে শুধুই মৃত্তিকা আর প্রস্তরের রুক্ষ প্রলেপ। সে পায়নি সবুজ প্রগলভতার চপল প্রেম।


হেমিস গুম্ফা

ভবিষ্যতের পর্যটকদের উদ্দেশে বলে দেওয়া ভাল, লাদাখে পৌঁছে প্রথম দিন নিজেকে একেবারে অলস করে রাখবেন এবং সারা দিনটা ঘুমিয়ে কাটাবেন। লাদাখের প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে যুঝতে গেলে অন্তত একটা গোটা দিন শক্তি সঞ্চয় করতেই হবে।
দ্বিতীয় দিন সকালে একই গাড়িতে চেপে বেরিয়ে পড়লাম সাইটসিয়িং-এ। এ বারও আমাদের সঙ্গী দুই বন্দ্যোপাধ্যায় দম্পতি। বাকি দিনগুলোতেও এঁরাই আমাদের নিকটবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। হোটেল থেকে একটু দূরেই লে মার্কেট, বসতি এবং তার পরেই হাইওয়ে। এই হাইওয়ে দেখলে কলকাতার রেড রোড লজ্জায় মুখ ঢাকবে। কারণ অবশ্যই গাড়ির গতি। ট্র্যাফিক সিগনালের ভ্রূকুটি না থাকায় আমার প্রায় সমবয়সী চালক স্থানীয় যুবক শিবম গাড়ি ছোটাত হাই স্পিডে। অবশ্য এর জন্য বকুনিও খেতে হয়েছে ওকে। কারু নামক একটি মিলিটারি এলাকা পেরিয়ে চলতে লাগলাম লে শহরের অন্যতম দর্শনীয় স্থান ‘হেমিস গুম্ফা’র উদ্দেশে। লে থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত হেমিস গুম্ফা শহরের অন্যতম প্রসিদ্ধ মনাষ্ট্রি। দু’পাশে পাহাড় আর মাঝখানে সরু রাস্তা দিয়ে স্করপিও এগিয়ে চলল, সঙ্গে শিবমের পেন ড্রাইভে তিব্বতি গান। ভাষা মানুষকে নিকটে আনে ঠিকই, কিন্তু সুর মানুষের আত্মাকে মেলায়। লাদাখের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখলে অনেক সময়ই টেলিভিশনে দেখা আফগানিস্তানের কথা মনে পড়ে যায়, রুক্ষতা বোধ হয় দুই স্থানকে মিলিয়ে দিয়েছে। যদিও লাদাখের মতো শান্তিপ্রিয় অঞ্চল ভূ-ভারতে কমই আছে। খাড়াই সিঁড়ি বেয়ে উঠলাম গুম্ফার দরজায়। প্রবেশমূল্য ৫০ টাকা। কোনও অফিস ঘর থেকে টিকিট দেওয়া হয় না। এক জন বাচ্চা লামা চেয়ারে বসে টিকিট দিচ্ছে। প্রবেশ করলাম ১৬৩০ খ্রিস্টাব্দে রাজা সেনগে নামগিয়াল দ্বারা নির্মিত হেমিস গুম্ফায়, যাকে তিব্বতি ভাষায় বলা হয় ‘চ্যাং চুব স্যাম লিং’। ‘ওঁম মণিপদ্মে হুম’ খোদিত জপযন্ত্র ঘুরিয়ে শুরু হল আমাদের গুম্ফা দর্শন। প্রথমেই প্রবেশ করলাম মিউজিয়ামে। অন্দরমহলে ছবি তোলা নিষিদ্ধ। ক্যামেরা, মোবাইল লকারে রেখে খালি পায়ে মিউজিয়ামের মধ্যে ঢুকলাম। শীতল ছোঁয়া চারপাশে। বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন শিল্পকলা, অতীত যুগের ব্যবহার্য পোশাক-পরিচ্ছদ, আসবাব এবং অস্ত্রের সুসজ্জিত ভাণ্ডার এই সংগ্রহশালা। স্বর্ণাক্ষরে (আলঙ্কারিক বিশেষণ নয়, প্রকৃত অর্থেই সোনার অক্ষরে লেখা) লিখিত প্রজ্ঞা-পারমিতা গ্রন্থ, প্রাচীন লাদাখের পুস্তক, গান্ধার শিল্পের নিদর্শন স্বরূপ বৌদ্ধ ধর্মসাধকদের মূর্তি, হাতির দাঁতের গহনা, বিশালকায় শঙ্খ, ঘণ্টা, বন্দুক, তীর, ধনুক, ব্যাঘ্রচর্ম, এই সব কিছু দেখলে তারিফ না করে থাকা যায় না। সংগ্রহশালার মধ্যে সংরক্ষিত উচ্চ শিল্পকলা করে তোলে মন্ত্রমুগ্ধ। সোনালি বর্ণের জাদু ভাবতে বাধ্য করায় কোন মন্ত্রবলে মানুষ এই চিত্রকলা অঙ্কনে সক্ষম হয়েছিল। সংগ্রহশালায় রক্ষিত তিনটি জমি সংক্রান্ত প্রাচীন দলিল দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাদের নিপুণ এবং সূক্ষ্ম শিল্পকর্মের জন্য। অতীত যুগে রঙের এমন আশ্চর্য কারুকাজ এ যুগের মডার্ন আর্টকে লজ্জা দেয়। সংগ্রহশালা দেখা শেষ করে আমরা এলাম প্রার্থনা সভায়। গুরু পদ্মসম্ভবা এখানকার উপাস্য দেবতা, দলাই লামার (বর্তমান) বেশ কিছু ছবি সব গুম্ফাতেই দেখা যায়। এখানেও তার ব্যতিক্রম নেই। লাদাখের প্রতিটি গুম্ফার উপাসনা কক্ষে ক্যামেরা নিয়ে যাওয়া যায়। তবে ফ্ল্যাশের ব্যবহার নিষিদ্ধ। এর কারণ, সোনার তৈরি মূর্তিগুলি ফ্ল্যাশের আলোয় ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এই হেমিস গুম্ফাতেই নাকি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ‘থাংগকা’ অর্থাৎ বুদ্ধদেবের একটি পেনটিং আছে যেটি দৈর্ঘ্যে প্রায় দ্বিতল বাড়ির সমান। প্রতি বারো বছর অন্তর এটি এক বারের জন্যই জনসমক্ষে আনা হয় এবং ২০১৬ সালে এটিকে ফের দেখতে পাওয়া যাবে।


মৈত্রেয়ী বুদ্ধ

হেমিস গুম্ফা দেখা শেষ করে রওনা দিলাম থিকসে গুম্ফার উদ্দেশে। ইন্টারনেট থেকেই জেনেছিলাম থিকসে সৌন্দর্যের দিক থেকে অতুলনীয়। কাছে গিয়ে উপলব্ধি করলাম কথাটি কতখানি সত্য। প্রায় বারো তলা সমান উঁচু মনাষ্ট্রিটি পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত। স্বয়ং বিশ্বকর্মাও বোধ করি বিস্ময় প্রকাশ করবেন এই অসামান্য সৃষ্টি দেখে। গাড়ি গুম্ফার প্রবেশপথে পৌঁছে গেলেও মূল উপাসনা কক্ষগুলিতে প্রবেশ করার জন্য অনেকটা খাড়াই পথ উঠতে হয়।
পঞ্চদশ শতকে লে শহর থেকে প্রায় কুড়ি কিলোমিটার দূরে রাজা পলদন শেরাব এই গুম্ফা নির্মাণ করেন। গুম্ফার মধ্যে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় দশটি উপাসনা কক্ষ আছে। মূল উপাসনা কক্ষে প্রায় ১৫ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট ‘মৈত্রেয়ী বুদ্ধ’র মূর্তি স্থাপিত আছে। সমগ্র পৃথিবীর মানুষ যদি শান্তি এবং ঐক্যের মেলবন্ধনে আবদ্ধ হয়, তখনই বুদ্ধের এই মৈত্রেয়ী রূপ পরিস্ফুট হয়, যেটি আজকের এই হিংসাত্মক বাতাসে অলীক ছাড়া আর কিছুই নয়। খুব সকালে অথবা দুপুরের দিকে এলে এই উপাসনা গৃহে আরতি দেখার সুযোগ পাওয়া যায়। আমরা অবশ্য সে অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হয়েছিলাম। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল, ১৯৭০ সালে দলাই লামার থিকসে গুম্ফা দর্শনকে চিরস্মরণীয় করে রাখতেই তৈরি হয়েছিল ‘মৈত্রেয়ী বুদ্ধে’র বিশালাকায় মূর্তি। গুম্ফার ভিতরের সরু গলি সূর্যের একচিলতে আলোয় হয়ে ওঠে রহস্যময়, ছোট উপাসনা কক্ষে আঁধারে ঢাকা দেবীর ভয়ঙ্করী মূর্তি দেখলে চমকে যেতে হয়। ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎই আবিষ্কার করলাম অনেক বাচ্চার কলরব। গলির মধ্যে ঢুকে দেখি, আরে! এ যে খুদে লামাদের বিদ্যালয়। মুণ্ডিতমস্তক বছর আট-দশের বেশ কিছু লামা গোল হয়ে বসে নিজেদের মধ্যে না জানি কী আলোচনা করছে। আমি সামনে যেতেই একজন মাথা নিচু করে অভিবাদন জানাল। আমিও প্রত্যুত্তর দিলাম। ওমা! পরক্ষণেই লামাটি হাত তুলে আমায় বলল, গো। আমি মৃদু হেসে বেরিয়ে এলাম। গুম্ফার ছাদে উঠে জীবনের অন্যতম সেরা অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলাম। যত দূর চোখ যায় তত দূর বিস্তৃত লাদাখের এক নয়নাভিরাম দৃশ্য। রোজকার দেখা পৃথিবীটার বাইরেও যে বিশাল একটা জগৎ আছে, যেখানে মেঘ কথা বলে পাহাড়ের সঙ্গে; তাকে দেয় গোপন চিঠি; তাদের ভালবাসার ছায়া পড়ে মাটিতে; সেই ছায়ার তলে লাদাখের মানুষ ঘুমোয় নিশ্চিন্তে। এটাই সভ্যতা।
থিকসে গুম্ফার পর আমাদের গন্তব্য ‘সেই প্যালেস’। লে শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণে থিকসের অতি নিকটের এই প্যালেসের নির্মাতা রাজা দেলদান নামগিয়াল। নির্মাণ সাল ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দ। সেই প্যালেসের উপরে ওঠা অত্যন্ত কষ্টের। আমি প্রথম দিকে দৌড়ে ওঠা শুরু করেছিলাম বলে শেষের দিকে ক্রমশ শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। সেই প্যালেসের মধ্যে প্রায় ১২ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট শাক্যমণি বুদ্ধের তাম্র এবং স্বর্ণ নির্মিত একটি অনন্যসুন্দর মূর্তি রয়েছে। সমগ্র লাদাখে এমন মূর্তি প্রায় নেই বললেই চলে।


সেই প্যালেস

‘সেই প্যালেস’-এর সামনেই রয়েছে একটি সুন্দর টলটলে জলাশয়। নদী এবং পাহাড়ের ওপর হিমবাহগলিত জলকে অন্য পথে প্রবাহিত করে সমগ্র লাদাখে জল সরবরাহ করা হয়। হাইওয়ের পাশে বয়ে চলা ড্রেনের এই জল কিন্তু দূষিত অথবা পঙ্কিল নয়। লে শহরের মধ্যে গাছের বেড়ে ওঠার কারণ এই জল। সরকারও রীতিমতো পুরস্কারের ব্যবস্থা করেছেন স্থানীয় মানুষকে সবুজের অভিযানে শামিল করতে।

এর পর সিন্ধুঘাট দর্শন। সিন্ধু নদীর তীরে নির্মাণ করা হয়েছে মুক্ত মঞ্চ এবং ছিমছাম অথচ সুন্দর একটি ঘাট। পাহাড়ের পাদদেশে অনেকটা সমতল, আর তারই মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে সিন্ধু নদী। কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া আমাদের শরীরের ভিতরটা পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিচ্ছিল। অথচ এই ঠাণ্ডার মধ্যে বেশ কিছু স্থানীয় যুবক-যুবতী নৃত্যগীতের আসর বসিয়েছে। চালক শিবমের কাছে জানা গেল এ আসলে ওদের অনুশীলন। প্রতি বছর জুন মাসে এই জায়গায় লাদাখের সব থেকে বড় উৎসব ‘সিন্ধুদর্শন’-এর আয়োজন করা হয়। রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরাও আসেন যোগদান করতে। যদিও সময়ের অভাবে আমরা এই বিরল অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হয়েছিলাম।


শান্তিস্তূপ

সে-দিন দুপুরটা হোটেলে বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে বেরিয়ে পড়লাম ‘শান্তিস্তূপ’-এর উদ্দেশে। পাহাড়ের উপরে অবস্থিত এই শান্তিস্তূপের একেবারে সামনে পর্যন্ত গাড়ি পৌঁছে যায়। ১৯৮৩ সালে দলাই লামা এবং এক জাপানি ভিক্ষুর সহায়তায় ‘শান্তিস্তূপ’ নির্মিত হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী স্তূপটিতে আসার জন্য সিঁড়ি নির্মাণ করান। এই স্তূপটির মধ্যে বহু বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ও পুঁথি সযত্নে সিল করা আছে। কথিত আছে, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যদি কোনও সাঙ্ঘাতিক বিপদের সম্মুখীন হয়, আর সেই বিপদের মোকাবিলা করতে যদি ব্যর্থ হয় মানবজাতি, তা হলে তাঁর অনুগামীরা উদ্ধার করবে সেই সব পুঁথি, খুঁজে পাবে সঠিক পথের দিশা।
শান্তিস্তূপ দেখার পর আমরা নেমে এলাম লে মার্কেটে। মার্কেটটি বেশ বড় এবং আধুনিক সরঞ্জাম থেকে শুরু করে খাবারের দোকান— সব কিছুই পাওয়া যায় এখানে। তবে উপচে পড়া ভিড় শুধু এসটিডি বুথগুলিতে। কেননা জম্মু-কাশ্মীরে নিরাপত্তাজনিত কারণে অন্য রাজ্যের প্রিপেড মোবাইল ফোনের জন্য সিগনাল একেবারেই অচল। লে শহরের অন্যতম একটি নিদর্শন যা ট্যুর লিস্টে না থাকায় আমাদের দেখা হয়ে ওঠেনি সেটি হল ‘লে প্যালেস’ অথবা ‘ল্যাচেন ফালকার’। লে প্যালেসটি সপ্তদশ শতকে ধর্মরাজ সেনগে নামগিয়াল দ্বারা নির্মিত। লাসার বিখ্যাত ‘পোটালা প্যালেস’-এর ক্ষুদ্র সংস্করণ হল লে প্যালেস। ১৮৩০ সালের পর রাজপরিবার লে প্যালেস ছেড়ে ‘স্টক প্যালেস’-এ গিয়ে বসবাস শুরু করেন। পাহাড়ের উপর অবস্থিত এই লে প্যালেসটি প্রায় নয় তলা উচ্চতাবিশিষ্ট। বর্তমানে এর অধিকাংশই ধ্বংস হয়ে গেছে। মধ্যযুগীয় তিব্বতি সংস্কৃতির এক অসাধারণ নিদর্শন এই লে প্যালেস। প্যালেসের ঠিক উপরেই একটি বিজয় স্তম্ভ আছে, যেটি কাশ্মীরিদের বিরুদ্ধে লাদাখি সৈন্যদের যুদ্ধজয়ের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।

পরের দিন ম্যানেজার রাজুদা’র নির্দেশমতো উঠে পড়লাম ভোর সাড়ে ৫টায়। আজকের গন্তব্য প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত প্যাংগং লেক। দিনের দিন যাওয়া, লেক পরিদর্শন এবং ফেরা। অতএব সকাল-সকাল রওনা হওয়া ভাল মনে করে সকাল ৭টার মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম সকলে। খাওয়াদাওয়ার জন্য প্যাক করে নেওয়া লাঞ্চ ছিল সঙ্গে। আবহাওয়া পরিষ্কার ও মেঘমুক্ত আকাশ। কারু পর্যন্ত নির্বিঘ্নেই আসা গেল। আর ঠিক পুলিশ চেকপোস্টের সামনেই দেখতে পেলাম পাহাড়ের অতি পরিচিত একটি দৃশ্য। সার সার গাড়ি লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্যাংগং যাওয়ার পথে চাংলা পাস-এ ধস নেমেছে, তাই প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরেই গাড়ি থামিয়ে দিয়েছে সেনা বাহিনী। অতএব আমাদের চারটি গাড়িও সামিল হল ওই লাইনে। কিছুক্ষণের মধ্যেই অবশ্য বান্টিদা জানিয়ে দিলেন যে এই ভাবে প্রতীক্ষা করার অর্থ লাদাখে একটি দিনের অপচয়। অতএব শিডিউলে সামান্য কিছু পরিবর্তন হল। পরের দিন আমাদের যাওয়ার কথা ছিল নুবরা ভ্যালি, যা লে শহর থেকে প্রায় ১৩০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত এবং সেখানেই রাত্রিযাপন করতে হয়। নির্দেশমতো আমরা সকলেই হোটেলে ফিরে এলাম এবং এক রাতের জামাকাপড় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম নুবরা ভ্যালির উদ্দেশে। মেঘমুক্ত আকাশের গায়ে ধীরে ধীরে জমতে শুরু করল মেঘের আস্তরণ।
লে শহর ছাড়িয়ে ক্রমশ উপরে উঠতে শুরু করলাম। পাহাড়ের গা দিয়ে রাস্তা, যত উপরে উঠছি কমে আসছে সবুজের সংখ্যা। চোখের সামনে শুধু সাদা বরফের হাতছানি। গাড়ির মধ্যে থেকে ভেসে আসছে কালজয়ী গান— ‘ইয়ে সামা, সামা হ্যায় ইয়ে প্যায়ার কা, কিসিকে ইনতেজার কা, দিল না চুরালে কাঁহি মেরা, মৌসম বাহার কা...’। জীবনে এমন কিছু দিন থাকে যে দিনের স্মৃতি রোমন্থনে আত্মহারা হয়ে পড়েন অনেকেই, এমন কিছু দৃশ্য থাকে যা হাজার দৃশ্যের ভিড়েও বিকিরণ করে তার দ্যুতি।


নুবরা উপত্যকা

প্রায় ১৮ হাজার ৩৮০ ফুট উঁচু খারদুংলা পাস পেরিয়ে আমরা নামতে শুরু করলাম নীচের দিকে। এই পাসকে ঘিরেও অনেক গল্প আছে, ঘটনা আছে, তবে সেটি ফেরার সময়। ১৫ হাজার ফুট নীচে একটি জায়গায় নামার পর বরফের অঞ্চল শেষ হল। অত্যন্ত দুর্গম রাস্তা এবং সামনে মিলিটারি ট্রাকের কনভয়, এই দুইয়ের জন্য গাড়ির গতি ছিল শ্লথ। এ দিকে চালকও গাড়ি চালিয়ে ক্লান্ত। তারও খিদে-তেষ্টা মেটাতে হবে, আর প্যাকেটের লাঞ্চে আমাদেরও পেট খুব একটা ভরেনি। অতএব ছোট্ট দোকানে নুডলস দেখে কি আর লোভ সামলানো যায়? নিজের বাড়ির বিছানায় বসে অথবা হস্টেলের রুমে নুডলস খেয়েছি বহু বার, কিন্তু জীবনে কখনও ভাবিনি লাদাখের মতো জায়গায় একটা পাথরের উপর বসে এমন আয়েশ করে নুডলস খেতে পারব। আহা সে যেন অমৃত।
একের পর এক পাহাড় পেরিয়ে নুবরা ভ্যালির দিকে এগিয়ে চলল গাড়ি। এই যাত্রা একটা সময়ের পর প্রচণ্ড ক্লান্তিকর এবং একঘেয়ে মনে হবে। খারদুংলা পাস অতিক্রম করার সময় সামনের গাড়ির ধোঁয়া আর পাহাড়ি রাস্তায় প্রতি মুহূর্তে বাঁক নেওয়া গাড়ির ঝাঁকুনিতে প্রাণ হয়ে উঠছিল ওষ্ঠাগত। অবশেষে সাড়ে ছ’ঘণ্টা যাত্রা শেষে আমরা পৌঁছলাম শ্যক নদীর তীরবর্তী এবং নুবরা উপত্যকার অন্তর্গত দিসকিত গ্রামে। হোটেলে মালপত্তর রেখেই আমি আর বাবা বেরিয়ে পড়লাম স্থানীয় বাজার দেখবার জন্য। আসল উদ্দেশ্য যদিও এসটিডি করা। আধুনিক সভ্যতা পুরোপুরি দাগ কাটতে পারেনি লাদাখের এই অঞ্চলে। ঘরবাড়িগুলি দেখলেই দারিদ্র্যক্লিষ্ট সমাজের ছবি ফুটে ওঠে। বনজঙ্গলে ঘেরা এই গ্রামের রাস্তায় বিকেলের সোনালি রোদ যেন এক মায়াবী স্বপ্ন দেখাচ্ছিল আমাদের চোখে। অবাক হলাম এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায় কেন্দ্রীয় বিদ্যালয় দেখে। এ যেন প্রাচীন যুগের এক শহর। এসটিডি বুথ, জামাকাপড়ের দোকান আর হোটেল বাদ দিলে এখানে সময় যেন থমকে গেছে। বিশাল পাহাড় দেখলে ভয় লাগে, বরফ দেখলে আতঙ্ক জাগে। এখানে সন্ধে সাতটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ থাকে, বাকি রাত নিকষ আঁধার। ভেবে অবাক হই, হস্টেলে রাত দুটো পর্যন্ত যখন টিভি রুম গমগম করে, এই অঞ্চল তখন আঁধার বিছানো শয্যায় পরম নিশ্চিন্তে রাত কাটায়।


বিস্ময় মরুভূমি দুই কুঁজবিশিষ্ট উট

পর দিন সকালে সমস্ত মালপত্র প্যাক করে গাড়িতে উঠে রওনা হলাম লাদাখের অন্যতম বিস্ময় ‘কোল্ড ডেজার্ট’ দেখবার জন্য। হোটেল থেকে মিনিট কুড়ির মধ্যেই প্রকৃতির এই বিচিত্র খেয়াল। একই জায়গায় বরফসজ্জিত পাহাড়, ছোট্ট একটি নদী এবং বিস্তৃত সাদা বালির একটি মরুভূমি। অদ্ভুত বিস্ময়! এত বালি কোথা থেকে যে এখানে এল— এ প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। ইচ্ছে করলে এখানকার বিরল প্রজাতি দুই কুঁজবিশিষ্ট উটগুলিতে চেপে ক্যামেল রাইডিং করা যায়। স্থানীয় লোকেরা উট নিয়ে মরুভূমির মধ্যেই বসে থাকেন।
বিস্ময় মরুভূমি দেখে পুনরায় হোটেলে রওনা দিলাম। সেই ক্লান্তিকর পথের সঙ্গে আবার দেখা হল। ধীরে ধীরে উঠতে শুরু করলাম খারদুংলা পাসের দিকে। এর পরেই যাকে বলে ক্লাইম্যাক্স জমতে শুরু করল। খারদুংলা পাসের একটু আগে থেকেই দেখা গেল সার সার গাড়ি দাঁড়িয়ে। পাহাড়ের উপর জমা বরফ ধীরে ধীরে ফাটতে শুরু করেছে রৌদ্রের কামড়ে। তুষারপাতের পর সূর্যের হাসি মুখ এই সব অঞ্চলে একেবারেই কাম্য নয়।স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বরফের চাঁই কী ভাবে ছোট ছোট টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ছে। সামনের রাস্তা বন্ধ। একটি বিশালাকার চাঁই আধভাঙা অবস্থায় পড়ে আছে। তার কখন নীচে নামার সাধ হবে কেউ জানে না। অক্সিজেনের ঘাটতিটা বেশ অনুভব করতে পারছি। এই সময় চেঁচিয়ে কথা বলা অথবা হাসাহাসি করা একেবারেই অনুচিত। এরই মধ্যে আমরা বরফে নেমে ছবি তুলতে শুরু করলাম। গাড়ি একটু একটু করে এগিয়েও থেমে যাচ্ছে। আমাদের সকলের অবস্থাই সঙ্গিন। পেটে মারাত্মক খিদে। সঙ্গে জলের বোতল ছিল কিন্তু গাড়ির রেডিয়েটারের পেটে সেটা চলে যাওয়ায় আমাদের জিভ শুকনো। এ যেন বরফের এক দেশ। আমাদের আগের ট্যুরের একটি গাড়ি ঠিক এই খারদুংলা পাসেই সারা রাত আটকে গেছিল। বাইরে মাইনাস ১৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের কামড় এবং রাতে অক্সিজেনের বিপুল ঘাটতিতে বেঁচে থাকাটাই প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়ে যায়। আমাদের মনেও দানা বাঁধছে অজানা আশঙ্কা। যদি গাড়ি আর না এগোয়? খারদুংলা পাস, সমুদ্রতল থেকে যার উচ্চতা প্রায় ১৮ হাজার ৩৮০ ফুট, পৃথিবীর সব থেকে উঁচুতে যানবাহনের উপযোগী রাস্তা। হোমিওপ্যাথি ওষুধ এবং কর্পূরের গন্ধ শুঁকে খানিক আরাম মিলল। জায়গাটি সম্পূর্ণ ভারতীয় সেনা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাদেরই তৈরি একটি ক্যান্টিনে ঢুকে পড়লাম।
এখানেও ভরসা সেই নুডলস। তার পরেই ঘটল বিপত্তি। ক্যান্টিনের মেঝে মার্বেলের তৈরি আর তাতে ছড়ানো বরফ। একেবারে মরণ ফাঁদ। বাবা আচমকাই নুডলসের বাটি হাতে সাঙ্ঘাতিক ভাবে পড়ে গেলেন, ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকায় বড় রকমের চোট অবশ্য লাগল না। কোনও রকমে নুডলস আর বিস্বাদ চা খেয়ে চলে এলাম গাড়িতে। এখানেও অপেক্ষা করছে বিপদ। বাহাত্তর বছর বয়সী বন্দ্যোপাধ্যায়-দাদুর প্রায় অচৈতন্য অবস্থা। অক্সিজেনের ঘাটতি তাঁকে অসহায় করে তুলেছে। আমাদের দলের সঙ্গেই ছিলেন বয়স্ক মহিলাদের একটি দল। তাদের মধ্যে একজন কাঁদতে কাঁদতে বিলাপ করছেন, কেন এই ভয়ঙ্কর জায়গায় তিনি এসেছেন! আসলে লাদাখে আসতে হলে ৬০-৬৫ বছর বয়সের আগে আসাটাই উচিত। এর পরে সকলের শরীর এখানকার প্রাকৃতিক বৈষম্যের সঙ্গে লড়াই করবার ক্ষমতা রাখে না। কোনও রকমে ওষুধ খাইয়ে দাদুর জ্ঞান ফেরানো হল। ইতিমধ্যে চলতে শুরু করেছে গাড়ি। আমরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম ক্রমশ নীচের দিকে নেমে।


বরফ আর বরফ


প্যাংগং লেক চাঙ্গলা শীর্ষ
হোটেলে পৌঁছেই দাদুকে নিয়ে যাওয়া হল সেনা হাসপাতালে। সদা হাস্যময়ী ঠাকুমাকে দেখে খুব খারাপ লাগছিল। পরে অবশ্য একদিন থাকার পর আর কৃত্রিম উপায়ে অক্সিজেন নিয়ে দাদু ফিট হয়ে উঠেছিলেন। পরের দিন আমরা পুনরায় রওনা হলাম প্যাংগং লেকের উদ্দেশে। লে শহর থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই লেক প্রকৃতির এক অনন্য বিস্ময়। এই লেকটির পঁচাত্তর ভাগ চিন এবং পঁচিশ ভাগ ভারতের অন্তর্গত। যাত্রাপথে চোখে পড়ল অজস্র মিলিটারি ক্যাম্প, শ্যুটিং স্কোয়াড, হেলিপ্যাড ইত্যাদি। প্রাকৃতিক বিপর্যয় আর শতাধিক জীবন-মরণ সমস্যা নিয়েও ইণ্ডিয়ান আর্মি বিনিদ্র রাতের পর রাত দেশকে সুরক্ষা দিয়ে চলেছে। যাত্রাপথেই আবার এল বরফের রাজ্য। এ বারের গিরিপথটির নাম চাংলা পাস। উচ্চতা প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার ফুট।

চাংলা পাস অতিক্রম করে ধীরে ধীরে নামতে শুরু করলাম। ছোট ছোট জলাশয়গুলি ঢাকা পড়েছে বরফের চাদরে। অবশেষে এসে পৌঁছলাম প্যাংগং লেকের ধারে। লেক বলতে আমরা যা বুঝি এটি আয়তনে তার কয়েকশো গুণ বড়। প্যাংগং লেকের জলের নীল রং, বুঝি সাগরকেও লজ্জা দেবে। সেই সঙ্গে সবুজের আভা লেকটিকে করে তুলেছে মোহময়ী। হিমেল বাতাস বইছে চারপাশে। ইচ্ছে হলে লেকের পাশে ক্যান্টিনে আহার সেরে নেওয়া যায়। সবটাই অবশ্য তাঁবুর মধ্যে। লেকের জলে অনাবিল আনন্দে খেলে বেড়াচ্ছে বকজাতীয় পাখি। পাহাড়ের কোলে ধাক্কা খাচ্ছে জলরাশি। সুন্দরী প্যাংগং যেন বড় লাজুক, ধীর, নম্র, এঁকেবেঁকে চলে গেছে বহু দূরে, চোখে তার দুষ্টু ইশারা। কিছু কিছু নাম আছে যা শুনলেই আমাদের বুকের ভেতরটা কেমন যেন ভারী হয়ে আসে। কিছুটা ভয় হয়, আবার কিছুটা কৌতূহল জাগে। আমাদের পরবর্তী গন্তব্যস্থল এমনই একটি জায়গা। যা ছিল সংবাদপত্রের শীর্ষ শিরোনামে— কার্গিল। কার্গিল একটি জেলা। লে শহর থেকে প্রায় আড়াইশো কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই কার্গিল। লে থেকে কার্গিল যাওয়ার রাস্তাটি প্রথম দিকে যতটা সুন্দর, শেষের দিকে ততটাই ভয়ঙ্কর। শোনা যায় এই রাস্তার মধ্যে এমন একটি জায়গা আছে যেখানে চৌম্বক শক্তির একটি অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে, বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে ‘ম্যাগনেটিক হিল’। ওই অঞ্চলে যদি গাড়ি ইঞ্জিন বন্ধ অবস্থাতেও থাকে, তা হলেও সেটি আপনাআপনি ঘণ্টায় কুড়ি কিলোমিটার বেগে চলতে শুরু করে। আমাদের সে দিনের চালক ছিল কার্গিলেরই স্থানীয় যুবক আব্বাসভাই। শহরটায় ঢুকতেই দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তি নিমেষে উধাও হয়ে গেল। হোটেলের বারান্দা থেকেই দেখা যাচ্ছিল এক বিশাল পাহাড়, যা কার্গিল শহরটাকে প্রায় অর্ধেকটা ঘিরে রয়েছে।


কার্গিল
আব্বাসের মুখ থেকে শোনা গেল রোমাঞ্চকর এক সত্য ঘটনা—
এক বসন্তকালের দুপুরে কার্গিলেরই কিছু স্থানীয় বাসিন্দা ভেড়া চরাতে পাহাড়ের উপর ওঠেন রোজকার মতো। হঠাৎই তারা লক্ষ করেন বেশ কিছু সেনা জওয়ানকে, যাদের পোশাক ভারতীয় সৈন্যদের সঙ্গে মেলানো যায় না। তা হলে এরা কারা? সন্দেহ জাগতেই তারা কার্গিলের মিলিটারি ক্যাম্পে খবর দেয়, সবিস্তারে বর্ণনা করে তারা যা দেখেছে। সেনারা অবশ্য তাদের কথায় বিশেষ পাত্তা দেয় না। কাটতে থাকে দিন। অবশেষে এল জুন-জুলাই মাস। সেই পাহাড় ডিঙিয়ে প্রবেশ করল পাকিস্তানি সেনা। কার্গিল শহরের বুকে আছড়ে পড়ল একের পর এক কামানের গোলা। স্‌প্লিনটারের দুরন্ত গতি ভেদ করল শরীর। নির্মম মৃত্যু ঘটল এক জনপদের। কার্গিল সাক্ষী হয়ে রইল এক ধিক্কারজনক সংঘর্ষের।
এখানকার স্কুল-কলেজ সবই এখন প্রায় নতুন। বাজারের অধিকাংশ দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। এখন অবশ্য মানুষ ক্রমশ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে।
সন্ধেবেলায় ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছি। একটু দূরেই কার্গিল শহর তখন ধীর, স্থির, শান্ত। এখন সেখানে শুধুই নীরবতা। সে এক অদ্ভুত অনুভূতি। পাহাড়ের গায়ে মিলিটারিদের বাংকারে জোনাকির মতো আলো। জীবনে ক’জনের কার্গিলে সন্ধে কাটানোর অভিজ্ঞতা হয়েছে জানি না, যাঁদের হয়েছে তাঁরাই উপলব্ধি করবেন বুকের মধ্যে জমা সেই রোমাঞ্চকে।

কার্গিল থেকে শ্রীনগরে পৌঁছতে হলে মাঝে পড়ে দ্রাস সেক্টর এবং জোজিলা পাস। এই রাস্তায় সকাল সাড়ে ৭টার পর আর গাড়ি যাওয়ার অনুমতি দেয় না ভারতীয় সেনা। আমাদের সকলের কাছেই নির্দেশ ছিল যেমন করেই হোক রাত তিনটে নাগাদ কার্গিল থেকে বেরোতেই হবে। সেইমতো উঠে পড়লাম রাত দুটো নাগাদ। নিকষ আঁধারের মধ্যে রাত সওয়া তিনটের সময় শুরু হল যাত্রা। জীবনের সেরার সেরা অভিজ্ঞতা ছিল এই যাত্রা। সারি সারি গাড়ি চলেছে কার্গিল শহরের বুক চিরে, ডান দিকে নদী এবং নদী পার হলেই পাহাড়। আর সেই পাহাড়ের ওপারেই যে দেশ তার নাম পাকিস্তান। আব্বাসভাই নদীর ওপর একটি ব্রিজ দেখিয়ে বলল, এই ব্রিজ পার হয়ে নদীর ওপারে গিয়ে আধ ঘণ্টা চললেই পৌঁছে যাওয়া যাবে পাকিস্তানে। রাস্তার কিছুটা অংশ ঘেরা পাঁচিল দিয়ে। আব্বাসভাই জানাল, যুদ্ধের সময় নির্মিত হয় এই পাঁচিল। ভোরের আলো তখন সবে ফুটতে শুরু করেছে। সেই ব্রাহ্ম মুহূর্তে আমরা প্রবেশ করলাম দ্রাস সেক্টরে, ভারত-পাক যুদ্ধের অন্যতম সাক্ষী এই অঞ্চল। দ্রাস সেক্টর জুড়ে লোকবসতির পাশাপাশি রয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাম্প। এখানেও লোকবসতির মাঝে উঁচু পাঁচিল লক্ষ করা যায়। আমি কি কল্পনার দেশে আছি, না বাস্তবের সম্মুখীন হয়েছি নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।


দ্রাস সেক্টর

দ্রাস সেক্টর পার করে ধীরে ধীরে এগিয়ে চললাম বিখ্যাত জোজিলা পাসের দিকে। আব্বাসভাই, শিবমের মতো দৃঢ় মানসিকতার চালক না হলে এই পাসে গাড়ি চালানো অসম্ভব। সারা বছর এই অঞ্চলটি ঢাকা থাকে বরফে। হিমবাহের আধিক্য এখানে বেশি। পিচের সব থেকে বড় শত্রু হল বরফ। তাই বরফের আঘাতে রাস্তাঘাট হয়ে পড়েছে নগ্ন, জীর্ণ, শীর্ণ। বড় বড় গর্ত কাটিয়ে কী করে যে দু’চারটে লরিও চলেছে, তা পরম বিস্ময়ের।
লাদাখ থেকে ধীরে ধীরে আমরা প্রবেশ করছি শ্রীনগরে। রুক্ষ, ধূসর পাহাড়ের যে রূপ আমরা লাদাখে দেখেছি এখন তা বদলে গেছে। এখন শুধুই সবুজের মেলা। এ পাহাড় যেন কত দিনের চেনা। কোমল তার ছোঁয়া। তবু ভুলব না লাদাখের সেই অপূর্ব অভিজ্ঞতা। ভারতের বুকে এমন বিস্ময়কর জায়গা আছে, না গেলে বিশ্বাসই করতে পারতাম না।

চলতি পথের পরিচয়
ভ্রমণ মানে কি শুধুই সেই জায়গার সঙ্গে পরিচয়? দেখা, ঘোরা, আনন্দ, মজা? নাকি এর বাইরেও আছে কিছু? প্রকৃতির বুকে সেরা সম্পদ যে মানুষ, তাই ঘুরতে গিয়ে সেখানকার মানুষের সঙ্গে যত ক্ষণ না আত্মীয়তার সেতু গড়ে ওঠে তত ক্ষণ পর্যন্ত সব ভ্রমণই অসম্পূর্ণ রয়ে যায়! আমাদের লাদাখ ভ্রমণের বৃত্তে ছেদ পড়ত যদি না আমরা মিশতাম সেখানকার মানুষের সঙ্গে, যদি না জানতাম তাদের কাহিনি!
খারদুংলা পাসের বিপদসঙ্কুল পরিস্থিতিতেও দলের বন্দ্যোপাধ্যায় কাকু-কাকিমা চলে গিয়েছিলেন কাছের সেনা ছাউনিতে। তাঁদের মুখ থেকেই জানতে পারি সেখানকার এক সেনাকর্মী সম্পর্কে। এই ভদ্রলোক ওড়িশাবাসী হলেও কলকাতায় কিছু বছর থাকার সুবাদে বাংলা ভাষায় যথেষ্ঠ দক্ষ। তিনি কাকু-কাকিমাকে শুনিয়েছিলেন কী অসহনীয় কষ্ট আর প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করে তাঁদের থাকতে হয়। সংবাদের শিরোনামে হয়তো একটি কার্গিল যুদ্ধের খবর আসে, কিন্তু সেনাদের প্রাত্যহিক জীবনও সেই যুদ্ধের মতোই ভয়াবহ।


খারদুংলা পাস
লে থেকে সিয়াচেন সীমান্ত রক্ষার জন্য ভয়ঙ্কর শীতেও যাত্রা করতে হয় সেনাবাহিনীকে। বরফে ঢাকা এই ভয়াবহ রাস্তা শুধুমাত্র পায়ে হেঁটে বাইশ দিন ধরে অতিক্রম করে এই সেনানীরা। একসঙ্গে ন’জন পরস্পরের সঙ্গে দড়ি বেঁধে চলেন। ভাগ্যের কি নিষ্ঠুর পরিহাস, সে গল্পও উনি বলেছিলেন! কখনও অসাবধনতা বশতঃ বরফের আস্তরণে ঢাকা খাদের গর্তে পা ঢুকে যায় কোনও কোনও জওয়ানের। এক জনের খাদে পড়ে যাওয়া মানে তার দেহের সঙ্গে লাগানো দড়িতে বাঁধা সকল জওয়ানেরও অনিবার্য মৃত্যু। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও সেই জওয়ান দলের আর সকল সৈন্যদের চেঁচিয়ে হুঁশিয়ার করে দেয়। বলতে থাকে দড়ি কেটে দিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার জন্য। সংযোগ ছিন্ন হওয়া মাত্র সেই জওয়ান তলিয়ে যায় বরফের মৃত্যু ফাঁদে। খাদের অতল গহ্বরে। দু-তিন দিন কেটে যায়, হয়তো মৃতদেহের খোঁজও পায় না কেউ। খোঁজ পেলেও অনেক সময়েই তার দেহ ফেরে না বাড়িতে!

এ সব কথা শোনার পর কারই বা মন ভাল থাকে! আমাদেরও একই দশা। তবে এর মধ্যেই সেই মজার মানুষটির সঙ্গে সময় কাটাতে কাটাতে কখন যেন মনটা আবার ভাল হয়ে গেল। আমাদের ভাড়া করা প্রথম গাড়ির চালক শিবম। এ বার তার কথাই শোনাব। সত্যিই এক আশ্চর্য মানুষ এই শিবম। গাড়ি চালানো বোধহয় ওর রক্তে ছিল, না-হলে বেঙ্গালুরুর পড়াশুনো ছেড়ে কেউ লাদাখে ফিরে আসে! আমি জিজ্ঞেস করাতে ও উত্তর দিয়েছিল ও-সব জায়গা নাকি ওর পছন্দ হয়নি। তার চেয়ে লাদাখই ওর আপন জন। এখানকার হাইওয়েগুলো বিদেশি সিনেমায় দেখানো হাইওয়েকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারে। সেই রকম রাস্তা পেয়ে লাদাখের ‘হিরো’ শিবম স্করপিও ছোটাত মনের আনন্দে। আবার দুর্গম পাহাড়ি রাস্তায় চালাবার সময় তার সতর্ক চোখ বিপদ সম্বন্ধে ছিল সজাগ।
একটা মজার ব্যাপার দেখে আমরা সবাই খুব হেসেছিলাম, শিবমের গুরু একজন অভিজ্ঞ চালক এবং তিনিও আমাদের ভাড়া করা চারটি গাড়ির একটি চালাতেন। শিবম হয়তো পাগলের মতো ছুটে এগিয়ে গেল অনেকটা, এ দিকে ওর গুরু পিছনে পড়ে গেল; আপনা-আপনি শিবমের গাড়ির গতি কমে যেত। ও অপেক্ষা করত কখন দেখা মিলবে গুরুর। আবার গুরু যদি আগে এগিয়ে যেত, তা হলেও শিবম অস্থির হয়ে পড়ত, কখন সে গুরুর কাছাকাছি পৌঁছাবে! অমনি বেড়ে যেত গাড়ির গতি। সঙ্গীত কোনও ভাষা বা দেশের গণ্ডিতে যে আবদ্ধ থাকে না শিবমকে দেখে সেটা বুঝেছিলাম। আমাদের গাড়ির মধ্যে মান্না দে-র একের পর এক গান বাজছে। শিবম আপন মনেই স্টিয়ারিং-এ তাল ঠুকে যাচ্ছিল, কালজয়ী সঙ্গীত এই কারণেই বিশ্বজনীন ও জনপ্রিয়।
পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালাবার অন্যতম শর্তই হল পাশ দিয়ে চলা গাড়ির কোনও রকম বিপদ হলেই এগিয়ে আসা। পাহাড়ি রাস্তায় সাধারণত যে গাড়িগুলো চলে তার সব চালকই একে অন্যের পরিচিত। প্যাংগঙ্গ লেক যাওয়ার সময় আমাদের সামনে দুটো গাড়ি চলছিল যাদের দুই চালক এক জন শিবমের বড়দা এবং অন্য জন মেজদা। আবার খারদুংলা পাস অতিক্রম করার সময় উল্টো দিক থেকে আসা গাড়ির চালক শিবমের আপন চাচা। আবার কখনও রাস্তায় দেখা হয়ে গেল নিজেরই এক তুতো ভাইয়ের সঙ্গে। সেও বেরিয়ে পড়েছে গাড়ি নিয়ে। দেখেশুনে মনে হবে এদের পুরো পরিবারই বোধহয় একই রাস্তায় এক সঙ্গে গাড়ি চালাচ্ছে! বড়ই মজার বিষয়। শহরের রাস্তায় যানজট হলে যে কুরুচিকর ভাষার প্রয়োগ আপাত ভদ্র চালকরা করে থাকেন, তাঁরা এই অঞ্চলে আসলে লজ্জায় মুখ লুকোবেন। কোনও গাড়ি রাস্তায় সমস্যায় পড়লে যে ভাবে পিছনের গাড়ির চালকেরা এগিয়ে এসে পরিস্থিতির সামাল দেয় তা সত্যিই শিক্ষণীয়।
কার্গিলে আমরা মাত্র একটি রাত থাকলেও তার অভিজ্ঞতা সত্যি-ই চিরস্মরণীয়। কার্গিল বাজারের মধ্যে একটি এসটিডি বুথে ঢুকে আমরা গল্প জুড়ে দিয়েছিলাম দোকানের কমর্চারীদের সঙ্গে। তারা খুব আক্ষেপের সঙ্গে জানায় যুদ্ধের এত বছর পরেও উন্নয়নের যে গতির প্রয়োজন ছিল তার থেকে তারা বঞ্চিত। বার বার ভারতীয় সৈন্যদলে অন্তর্ভুক্তির পরীক্ষা দিয়েও তাঁরা কৃতকার্য হতে পারছেন না। দৃঢ়তার সঙ্গে তাঁরা জানালেন, পৃথক রাষ্ট্র গড়ার দাবি তাঁদের নেই, কিন্তু উন্নয়নের স্রোতকে ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখেন তাঁরা।
কার্গিলে পা-রাখা মাত্রই স্বাভাবিক ভাবেই আমরা কার্গিল যুদ্ধ সম্পর্কে তথ্য জোগাড়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। আমাদের হোটেলের কাছেই এক স্থানীয় ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি নিজে ব্যবসায়ী এবং তাঁর বোন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। যুদ্ধের সময় শহরের বাড়ি-ঘর সব ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দূরে একটি নিরাপদ স্থানে সকলে আশ্রয় নিয়েছিলেন। শহরের বুকে তখন একের পর এক কামানের গোলা এসে পড়ছে। কিছু মানুষ ক্ষয়ক্ষতির পরিণাম দেখতে ছুটে যেত সেই স্থানে, এই ভেবে যে, গোলা যখন এক বার ফেটে গেছে তখন আর ভয় নেই। কিন্তু সেই গোলা থেকে নির্গত স্‌প্লিন্টার শরীরে সামান্য ছেদ করে প্রবেশ করত আর মুহূর্তের মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে শরীরে বিপরীত দিকে সৃষ্টি করত বিরাট এক গর্ত। সংঘর্ষের নিষ্ঠুরতম নিদশর্ন। আশেপাশের দোকানের জানলার কাচের উপর ছিটকে দলা পাকা মাংসের খণ্ড! ইস্ ভাবলেই কেমন গায়ে কঁটা দিয়ে ওঠে!

বীরভূমের রুকবুদ্দিন।
লে থেকে কার্গিল যাওয়ার পথে এক জায়গায় আলাপ হয়েছিল এক বাঙালি শ্রমিকের সঙ্গে, তাঁর বাড়ি বীরভূম জেলার রামপুরহাটে। নাম রুকবুদ্দিন। পিচ রোলারের চালক। রাস্তার উপর ‘রোলার’ গাড়ির উপর তাঁর সংসার। কী নেই সেই গাড়ির মধ্যে? বিছানা, বালিশ, লেপ, স্টোভ— সব কিছু। রাতের নিদারুণ শীত আর সকালের রৌদ্রের তেজে তাঁর চামড়া শুকিয়ে গেছে। দেখে কষ্ট হয়; এক মুঠো ভাতের জন্য কী পরিশ্রম-ই না করতে হয় মানুষকে। সেপ্টেম্বরে যখন বরফ পড়া শুরু হয়, তখন সে চলে আসে বাড়িতে। আবার জুন মাস থেকে কাজ শুরু হয় লাদাখে। আমাদের সঙ্গে কথা বলতে পেরে রুকবুদ্দিনের সে কি উচ্ছ্বাস। আমাদের লিকার চা তৈরি করে সে খাওয়াবেই। তাড়া থাকায় তাঁকে কোনও রকমে শান্ত করা গেল।
সমুদ্রে মধ্যে একটা অস্থিরতা আছে, সে বড় চঞ্চল, পাহাড় স্থানু। সে বছরের পর বছর শুধু ধ্যানমগ্ন, কিন্তু পাহাড়ে জীবন গতিময়। সে গতি ইঁদুর দৌড়ে জেতার জন্য নয়, অসুস্থ প্রতিযোগীদের জন্যও নয়, সে গতি হল জীবন যুদ্ধের গতি। ‘সারভাইবাল অফ দ্য ফিটেস্ট’, কঠোর সাধনা আর পরিশ্রমই পাহাড়ে বেঁচে থাকার এক মাত্র মূলমন্ত্র। শিবম, আব্বাস এদের কাছ থেকে শিখেছি, জীবনের প্রতিটা পথের বাঁকে পড়বে জোজিলা, খারদুংলা পাসের মতোই ভয়ঙ্কর সব বাধা। স্টিয়ারিং-এ হাত থাকবে শক্ত করে ধরা, তবেই তো এগোবে জীবনের স্করপিও। বরফের চাঁই আর ল্যাণ্ডস্লাইডের মতোই একের পর এক সমস্যা এগোনোর রাস্তায় আনবে প্রতিবন্ধকতা। মাথা গরম করলে চলবে না, অপেক্ষা করতে হবে। সকলে মিলে মোকাবিলা করতে হবে সমস্যার। গর্তে চাকা বসে যাওয়া গাড়ির মতোই বিপদের গহ্বরে ডুবে যাওয়া মানুষের দিকে বাড়িয়ে দিতে হবে সাহায্যের হাত। ভারতীয় সেনাবাহিনী যদি বিনিদ্র রাত পাহারা দিতে পারে সীমান্ত, আমাদেরও জাগতে হবে সমস্ত রকম কুসংস্কার আর অনৈতিকতার বিরুদ্ধে। লাদাখ ভ্রমণ নিছকই ছুটি কাটানো নয়, এ যেন এক মহা জীবনের দর্শন, এক নতুন পথের আলোকবর্তিকা।

সৌজন্যেঃ শুভম ABP
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুন, ২০১৫ দুপুর ১২:৩১
৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×