আমি রোহান
অবশেষে তৃণা যখন চোখ মেলে তাকালো তখন আমার বুক থেকে একটা বিশাল ভার নেমে গেলো।গত তিনরাত ধরে আমার চোখে ঘুম নেই। হঠাৎ করে খুব ক্লান্ত লাগলো। মনে হলো সারা জীবনের ঘুম যেন আমার চোখে নেমে এসেছে। অবশেষে আমার কষ্ট সফল হয়েছে। আমি আবার তৃণাকে বাঁচিয়ে তুলতে পেরেছি। এই আনন্দ যতটা না আমার গবেষণার সফলতায়, তার চেয়ে অনেক বেশী আমি আবার আমার তৃণাকে ফিরে পেয়েছি সেই আনন্দে। হয়তো এই তৃণা রক্ত মাংশের তৃণা নয়। হয়তো তার চোখ দু’টির পেছনে তীক্ষ্ম ব্যক্তিত্বের সেই মেয়েটির মস্তিষ্কটি নেই, কিন্ত সেখানে তিনশ ট্রিলিয়ন আর পি এম এ যে কপোট্রনটি ঘুরছে, সেখানে আছে সত্যিকারের তৃণার সব স্মৃতি। তার শৈশব, কৈশোর, যৌবনের স্মৃতি যেখানে আমার জন্য ছিলো তার অসীম ভালোবাসা।আমি জানি, এই তৃণাও আমাকে ঠিক ততটাই ভালোবাসবে যতটা আমার তৃণা আমাকে বাসতো। এই ভালোবাসাকে আমি হারাতে চাই না। এই ভালোবাসা পাবার জন্য আমি চরম স্বার্থপর হতে পারি। তাইতো আমি আমার ল্যাবরেটরীর সকল নিয়ম ভেঙ্গে এমন এক রোবট তৈরী করছি যেটা সত্যিকারের তৃণার সব স্মৃতিকে ধারন করে।
তৃণার দুর্ঘটনার খবরটা আমি যখন পাই, তখন আমি আমার ল্যাবরেটরীতে কাজ করছিলাম। খবারটা শুনে আমার মনে হয়েছে পুরো পৃথিবী যেন দুলছে। আমার মনে আছে, আমি তখন কি করছি, কি বলছি তা আমি বুঝতে পারছিলাম না। ঘন্টা খানেক পর আমি নিজেকে আবিষ্কার করি আপাদমস্তক ব্যান্ডেজে মোড়ানো তৃণার পাশে। ডক্টর বলছিলেন একমাত্র মস্তিষ্কটাই অক্ষত আছে। তৃণা তখন ডিপ কোমায়। বাঁচার কোন সম্ভাবনাই নেই। আমি সাথে সাথে ঠিক করে ফেলি , আমাকে কি করতে হবে।তৃণাকে আমি মরতে দিবো না। তাকে বাঁচিয়ে রাখবো।একজন মানুষের অস্তিত্ব তার স্মৃতিতে। তাই আমি ঠিক করি আমি তৃণার স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখবো। ব্রেইন ইন্টারফেসিং আর মেমোরি ডিজিটাইজিং এর উপর আমার প্রায় শ’খানেক মৌলিক গবেষনা আছে। আর ঠিক সেই মূহুর্তে আমি রোবোটিক ইমোশনের উপর একটা কাজ করছিলাম। তাই তৃণার মস্তিষ্কের সব স্মৃতিকে ডিজিটাল ফর্মেটে নিয়ে সেই স্মৃতি একটি কপোট্রনে লোড করে হুবহু তৃণার মতো দেখতে একটি মেয়ে রোবট বানিয়ে ফেলতে আমার তেমন কষ্ট হয় নি।একদম সত্যিকারের মানুষের মতো একটি রোবট। যার আবেগ আছে, রাগ আছে, ঘৃণা আছে আর আমার জন্য অসীম ভালোবাসা আছে।অবশ্য আমার অধীনে কাজ করা রিসার্চ এসিস্টেন্ট ছেলেটি আমাকে এই ব্যাপারে যথেষ্টই সাহায্য করেছে।
তৃণা চোখ মেলে তাকালো। ঠিক যেন ঘুম থেকে উঠেছে। তার ফটোসেলের চোখ দেখে কে বলবে এটা তৃণার চোখ নয়। তৃণার সেই দুষ্টুমি ভরা চাহনী এই কৃত্রিম চোখে আনতে আমাকে কি পরিমান বেগ পেতে হয়েছে। আমি আবেগে কেঁদে ফেলি। এটা আমার তৃণা। যে আর কোনদিন আমাকে ছেড়ে যাবে না।
আমি তৃণা
রোহানকে সমাধিতে নামিয়ে দিয়ে এলাম। ঘরের দরজাটা খুলেই নিজেকে খুব একা একা লাগলো। শেষদিকে বেচারা খুব বুড়িয়ে গিয়েছিলো। যাবারই কথা। আট চল্লিশ বয়সে একটা মানুষ স্বাভাবিক ভাবেই অনেক দুর্বল হয়ে পরে। তাই গত কয়েকটা বছর আমি প্রায় সারাক্ষনই তাকে নিয়ে ব্যাস্ত ছিলাম। আমি যে রোহানকে এতোটা ভালোবাসি তা আমি নিজেই জানতাম না। এখন সব কিছু কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। এই অনুভুতি আমার মাঝে আসার কথা নয়। আমি রোবট।যদিও আমি তৃণাকে নিজের মাঝে নিয়ে বেঁচে আছি। তারপরও বলবো রোহানই আমার মাঝে তার প্রতি সত্যিকারের তৃণার ভালোবাসা সৃষ্টি করেছিলো।
রোহান নামের এই মানুষটাকে আমি এতো ভালোবাসি কেন? এই প্রশ্ন আমি নিজেই নিজেকে করি। আমি আমার শৈশবের স্মৃতি হাতরাই , সেখানে তো এই মানুষটি নেই। আমার কৈশোরেও অনেক ছেলে আমার প্রেমে পড়েছে, তবুও তাদের কাউকেই আমি এতোটুকু জায়গা দেই নি। কিন্ত এই মানুষটার ব্যাপারে আমার সবকিছু কেমন জানি এলোমেলো হয়ে যায়।
আমি আয়নায় নিজেকে দেখি। গত বিশ বছর ধরে আমি এই একই চেহারা নিয়ে বেঁচে আছি। রোহান ধীরে ধীরে বুড়িয়ে গেছে।প্রকৃতির নিয়মে সে ঠিকই চলে গেছে। কিন্তু আমি রোবট। আমার বার্ধক্য নেই। রোগ নেই, মৃত্যু নেই। আমি এখন কি নিয়ে বাঁচবো। রোহান নামের মানুষটার প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা নিয়ে আমাকে অনন্তকাল একা বেঁচে থাকতে হবে। আমি রোবট। আমি নিজেকে ধ্বংসও করতে পারবো না। কি করে আমি বাঁচবো। একদিকে রোহানের শূণ্যতা আর একদিকে তার প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা।ভয়ঙ্কর কষ্ট হতে থাকে আমার। আমাকে এই কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে অনন্তকাল।কারন রোহান নামের মানুষটা তৃণা নামের এই রোবট টার মাঝে ভালোবাসা দিয়েছে তার স্বার্থে। তার তৃণাকে ফিরে পেতে। মানুষ কেন এতো স্বার্থপর হয়।
পরিশেষ
তৃণা নামের একটি রোবটাকে প্রতিদিনই দেখা যায় এক তোড়া ফুল নিয়ে মিউনিসিপালিটির সমাধিস্থলটিতে একটি সমাধির সামনে স্থির বসে থাকতে। গত সত্তর বছর ধরে সে এই একই কাজ করে চলেছে।একদিনও ভুল করেনি।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১০ রাত ১০:২৮