বেতনের সরকারি অংশ পাচ্ছেন না কম্পিউটার/আইসিটি শিক্ষকরা
কয়েক জন সৃষ্টপদে নিয়োগ প্রাপ্ত শিক্ষক, যাদের সাথে আমার কথা হয়েছে এদের একজন সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলার বঙ্গ বীর এম এ জি ওসমানী উচ্চ বিদ্যালয়ের আইসিটি শিক্ষক শাহ জামান। তাঁর কষ্টের কথাগুলো এভাবেই আমাকে বলেন, স্ত্রী এবং বাচ্ছাদের নিয়ে অনেক কষ্টে আছি, একরকম অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছি। আমরা একই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করি, আমার সহকর্মীদের ঘরে ঈদের আনন্দ আর আমার ঘরে ছিল কান্না। ছেলে-মেয়েদের জামা-কাপড় কিনে দেওয়ার টাকা-পয়সাও আমার হাতে ছিল না। ২০১৩ সালে আমার নিয়োগ কিন্তু এখনো আমার বেতনের সরকারি অংশ পাইনা। একই উপজেলার পিয়াইনগোল কলিমুল্লা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক সাইফুল ইসলাম, বাড়ি নেত্রকোণায়। তিনিও দুই বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেন কিন্তু বেতনের সরকারি অংশ পান না। টাকার অভাবে বোনের বিয়ে আটকে আছে।
কিছুদিন আগে সিলেট সদর উপজেলার হাজী আব্দুস সাত্তার উচ্চ বিদ্যালয়ে ২০১৩ সালে নিয়োগ প্রাপ্ত আইসিটি শিক্ষকের সাথে দেখা হয়, তাঁর প্রশ্ন আমরা এক দিন ছুটি নিলে স্কুলের প্রায় যাবতীয় কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। আর আমাদের বেতনের সরকারি অংশ নেই। আমাদের বেতন সরকার কবে দিবে? প্রতিষ্ঠানের সকল শিক্ষক যখন নতুন পে-স্কেল নিয়ে আনন্দ করে, মিষ্টি বিতরণ করে আমি তখন মন মরা হয়ে বাইরে চলে যাই। আর কত দিন বিনা বেতনে সরকারের কাজ করতে হবে? লেখাপড়া করে দেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েছি। কিন্তু আমার পাশের দিন মজুর পায় দৈনিক ৫০০ টাকা, আমি পাই ১০০ টাকা। পরিবারকে সহযোগিতা তো দূরের কথা আমার নিজের পকেট খরচও আমি ইনকাম করতে পারছি না। লেখা-পড়া করেছিলাম সুন্দর জীবনের প্রত্যাশায় আজ তা দুঃস্বপ্নে পরিণত। ১৩/১১/১১ এর প্রজ্ঞাপণ বাতিল করে সরকার কবে এমপিও দিবে?
শিক্ষা মন্ত্রণালয় বেসরকারি বিদ্যালয় সমূহে বিধিমোতাবেক সৃষ্টপদে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের বেতনের সরকারি অংশ দিচ্ছে না। গত ১৩ নভেম্বর ২০১১ এর পরে পাঠ দানের অনুমতি প্রাপ্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয় সমূহে জানুয়ারি ২০১৪ পর্যন্ত কতজন কম্পিউটার, বিজ্ঞান এবং শাখা শিক্ষক নিয়োগপ্রাপ্ত আছে মন্ত্রণালয় জানুয়ারি ২০১৫ সাল পর্যন্ত অনেক বার তালিকা করে। সব শেষ তালিকা করে ২৬ অক্টোবর ২০১৫। বার বার তালিকা গ্রহন করে এবং বার বার প্রজ্ঞাপন জারী করে বিষয়টি মন্ত্রণালয় বুঝতে পারেনি, আবার আর্থিক সংশ্লেষ সহ তালিকা চায়। কি যে বুঝতে পারেননি তা শিক্ষক বা শিক্ষামন্ত্রণালয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট লোকজনও বুঝতে পারেন না। কাল ক্ষেপনের এই অভিনব কৌশলোর শিকার দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পেশায় নিযুক্ত শিক্ষকগণ।
এমপিও ভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমূহে ১৯৯৪ সালে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সরকারি ভাবে বেসরকারি কম্পিউটার শিক্ষক নিয়োগ হয়েছিলেন। এর পর থেকে এমপিও ভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদানের অনুমতি পেয়ে শিক্ষক নিয়োগের পরপরই তাদের এমপিও হতো। ১৩ নভেম্বরের প্রজ্ঞাপণ এই সকল শিক্ষকদের এমপিও স্থগিত করে দেয়।
এমপিও ভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সৃষ্টপদে নিযোগপ্রাপ্ত নন এমপিও ভুক্ত শিক্ষকদের একটি প্রতিনিধি দল গত ১৯ সেপ্টেম্বর দিনাজপুর সার্কিট হাউজ মিলনায়তনে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর সাথে দেখা করেন। মাননীয় মন্ত্রী জনাব, নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, অর্থের বরাদ্দ অপ্রতুল থাকায় নতুন করে এমপিও দেয়া যাচ্ছে না। অর্থ মন্ত্রণালয় অর্থ ছাড় দিলেই এমপিও দেয়া সম্ভব। এটা কোন স্বান্তনা মূলক কথা হতে পারে না। বিমাতা সূলভ আচরণ কথাটির সাথে আমরা পরিচিত হই ১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে, আর কান্না না করলে একজন মা তাঁর বাচ্চাকে বুকের দুধ পান করান না তা দেখেছি মাতৃদুগ্ধ পান কালে। দুবেলা রুটি রুজির জন্য অভুক্ত শিক্ষক রাস্তায়-রাস্তায় এমপিও চাই এমপিও চাই করছে। গণতান্ত্রিক দেশে একই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এক কর্মী বেতন পাবে অন্য জন পাবে না এমন হতে পারে না।
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্মচারিদের বেতন ভাতাদির সরকারি অংশ প্রদান এবং জনবল কাঠামো সম্পর্কিত নিদের্শিকা (৪ফেব্রয়ারি, ২০১০ এ প্রণীত, মার্চ ২০১৩ পর্যন্ত সংশোধিত) অনুসারে বেসরকারি কলেজ ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে প্রভাষক ও বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে সহকারি শিক্ষক এর নিয়োগ যোগ্যতা হিসাবে কম্পিউটার বিজ্ঞানে/কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং এ ¯œfতক ডিগ্রি নির্ধারণ করা আছে। একই সাথে ০৬ মাস বা ০১ বছরের কম্পিউটার বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত যে কোন বিষয়ে ডিগ্রি/সমমান অর্জন কারিদের নিয়োগ লাভের সুযোগ ছিল। গত ১৪/০৬/২০১৫ তারিখের প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এ বিষয়ের নূন্যতম যোগ্যতা রাখা হয়েছে কারিগরি বোর্ড হতে ০৩ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন কম্পিউটার ডিগ্রি। ৬ষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ে এমন কোন জটিল বিষয় নেই যার জন্য এ বিষয়ের শিক্ষককে ০৩ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন কম্পিউটার ডিগ্রি বা কম্পিউটার বিজ্ঞানে ¯œfতক ডিগ্রি অর্জন করতে হবে। তাছাড়া বাংলাদেশের ১০ টি ¯œfতকোত্তর কলেজে ¯œfতকোত্তর পর্যায়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়টি পড়ানো হচ্ছে। এই সকল প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের অনেকের এ বিষয়ের শিক্ষক হবার স্বপ্ন ছিল। ১৪/০৬/২০১৫ এর প্রজ্ঞাপণ তাদের এ স্বপ্ন ভেঙ্গে দেয়।
৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মিলনায়তনে আয়োজন করা হয়, টেকসই সমাজ গঠন, শিক্ষকদের ক্ষমতায়ন” শীর্ষক আলোচনা সভা। কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার থেকে বের হয় র্যা লি। আইসিটি শিক্ষকরা এ ধরণের কর্মসূচি থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখেন। তারাও শিক্ষক, তবে একই প্রতিষ্ঠাানের অন্য শিক্ষকরা তাদের এমপিও হওয়ার আগে শিক্ষক হিসাবে মানতে নারাজ।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত তথ্য ও যোগাযোগ বিষয়টি শিক্ষা ব্যবস্থার সকল ধারায় বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়েছে। বর্তমানে উল্লেখিত শ্রেণি সমূহে আইসিটি বিষয়টি বাধ্যতামূলক করেছে। কিন্তু সরকার এবিষয়ে কোন পদ সৃষ্টি করছে না এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয় কম্পিউটার এর সৃষ্ট পদের এমপিও বন্ধ করে রেখেছে। আইসিটি বা কম্পিউটার বিষয়ে বেসরকারি বিদ্যালয় গুলোতে সরকারি বিধি মোতাবেক নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকরা মাসের পর মাস বেতন পাচ্ছে না।
সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য একদিকে যেমন প্রকল্প গ্রহন করছে অন্যদিকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে এ বিষয়ের শিক্ষক নিয়োগ প্রয়োজন। এ বিষয়ে সরকারের শিক্ষক নিয়োগের পরিকল্পনা আছে কি নেই এ বিষয়টিও স্পষ্ট নয়। পাশাপাশি এর সাথে সংশ্লিষ্ট কম্পিউটার বিষয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের বেতনের সরকারী অংশও দিচ্ছে না মন্ত্রণালয়। সামান্য বেসরকারি বেতন দিতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানগলো আর্থিক সমস্যার কথা বলছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের জন্য চারটি বিষয় সমান গুরত্ব পেয়ে আসছে। দেশের মানব সম্পদ উন্নয়ন, জনগনের সম্পৃক্ততা, সিভিল সার্ভিস এবং দৈনন্দিন জীবনে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যাবহার। উল্লেখিত চারটি বিষয়ের মধ্যে প্রথম তিনটিতেও তথ্যপযুক্তির প্রয়োজন আছে। সম সময়ে স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশগুলোর দিকে তাকালে অবাক হতে হয় এই জন্য যে তারা আজ মধ্যম আয়ের দেশই নয় উন্নত দেশে পরিণত। ই-লার্নিং, ই-কর্মাস, ই-গর্ভন্যান্স, ই-সার্ভিস, আউটর্সোসিং ইত্যাদি ক্ষেত্রে তারা অনেক বেশি এগিয়ে। প্রতিবেশী দেশ ভারত তথ্যপযুক্তি ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। আমরা এখনো আইসিটিক্ষেত্রে কুড়িঁয়ে কুড়িঁয়ে হাঁটছি।
কম্পিউটার শিক্ষকদের কাজের পরিধির দিকে তাকালে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের তালিকা করা, পরীক্ষার ফলাফল তৈরী করা, নোটিশ লেখা, ভোটার তালিকা তৈরী ও হালনাগাত করা, প্রশংসা পত্র তৈরী করা, শিক্ষকদের অগ্রগমনপত্র লেখা। ই-মেইল প্রেরণ ও গ্রহন, ওয়েব ভিজিট করে প্রজ্ঞাপণ প্রিন্ট করা, বিদ্যালয়ের নিজস্ব ওয়েব সাইট নিয়মিত আপডেট করা। মাল্টিমিডিয়া ক্লাস নেয়া, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসে অন্য বিষয়ের শিক্ষকদের সয়ায়তা করা, শিক্ষক বাতায়ন থেকে মাল্টিমিডিয়া ক্লাস ডাউনলোড এডিটিং বিতরণ ও রিপোর্টিং করা। মাল্টিমিডিয়া ও কম্পিউটার যন্ত্রাংশের মেরামত, সফ্টওয়ার ব্যবস্থাপনা করা। জে.এস.সি. ও এস.এস.সি. রেজিস্টেশন, অনলাইনে ফরম পূরণ, ফটো এডিটিং সহ আরো নানাবিধ কাজ একজন কম্পিউটার শিক্ষক করে থাকেন এবং পাশাপাশি তার ক্লাসগুলোও পরিচালনা করেন। রাত বিরাতেও এই পদে কর্মরত শিক্ষকগণ কাজ করেন। বর্তমান আইসিটির যুগে একজন কম্পিউটার শিক্ষকের কাজের পরিধি এত ব্যাপক ও গুরুত্বপূর্ণ হওয়া স্বত্বেও এরা এমপিও বঞ্চিত।
শিল্প বিপ্লবের সভ্যতা ছিল যান্ত্রিক। যারা যন্ত্রের উপর নির্ভর করেছে, একসময়ের তারাই পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করছে। একুশ শতকে এসে আমরা যে অধুনান্তিক সভ্যতার জন্ম দিতে যাচ্ছি তা হলো প্রযুক্তি নির্ভর সভ্যতা। আঠার ঊনিশ শতকের শিল্প বিপ্লব বিশ একুশ শতকের প্রযুক্তি বিপ্লবে বার্তা বহন করে। গণতান্ত্রিক বিশ্বায়নে যেকোন ব্যক্তি এই প্রযুক্তি ব্যাবহার কবে সব চেয়ে বেশি সম্পদশালী হতে পারে। উইলিয়াম হেনরি বিল গেটস, স্যার টিমোথি জন টিম বার্নস লি, মার্ক জাকারবার্গ তারই উজ্বল উদাহারণ।
মাননীয় প্রধান মন্ত্রী, মাননীয় অর্থমন্ত্রী, মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, সচিব অর্থ, সচিব শিক্ষা এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বিাভন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা কর্মচারী, শিক্ষানুরাগী মাননীয় এমপি-মন্ত্রী, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সহ দেশের সুশিল সমাজের কাছে কম্পিউটার/আইসিটি বিষয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের এমপিও না হওয়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখার আবেদন জানাচ্ছি। আশা করছি তাঁরা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়টি নিয়ে ভাববেন। মাননীয় প্রধান মন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা আপনার বাণী, ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে হলে নতুন প্রজন্মকে প্রস্তুত হতে হবে। ডিজিটালাইজেশনে নতুন প্রজন্মকে প্রস্তুত করার কারিগর কম্পিউটার/আইসিটি শিক্ষকরা নিদারুণ অর্থকষ্টে আছে। আপনার সরকারের আমলে দেশ আইসিটিতে এগিয়ে যাচ্ছে কিন্তু মাধ্যমিক বিদ্যালয় গুলোতে এবিষয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের বেতনের সরকারী অংশের ছাড় করণে কার্যকরি পদক্ষেপ প্রয়োজন।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:১৯