somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার বড় কাকা

১৮ ই এপ্রিল, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার বড় কাকা। একজন সরল মানুষ-সহজ মানুষ ছিলেন।বাবার কাছে এবং দাদির কাছে শুনেছি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানীরা কাকাকে মারার জন্য লাইনে দাড় করিয়েও কেন যেন মারেননি।কেউ কেউ বলেন কাকার সরলতা।কিন্ত্ত কাকা বোকা ছিলেন না।কাকার মুখে ছিলো একটা ইন্নোসেন্ট ভাব।সেখানে কোন ধূর্ততা ছিলোনা।পাকিরা কাকাকে নিয়ে সারা গ্রাম টহল দিলো।কাকা বিভিন্ন লোকের বাড়ীতে নিয়ে গেছেন।বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে টুচিয়ে রক্তাক্ত করেছে।তারপরও বেঁচে গেলেন কি ভাবে কে জানে। তারা কাকাকে ছেড়ে দিলো।অথচ তখন আমাদের গ্রামের দক্ষিণ কবর স্থানের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ।কাকা নাকি ভুলিয়ে ভালিয়ে ওদের উত্তর পারার কোন এক লোকের বাড়ি দেখিয়ে দিলেন যে বাড়িতে কেউ ২০ বছর বাস করেনা। ওরা মনের আনন্দে সেই ঘর পুড়িয়ে আলমনগরের বিল পেরিয়ে চলে গেল।নবীনগর।
বড় কাকা কিছুদিন আগে মারা গেলেন ব্রেইন স্ট্রোক করে।মৃত্যুগুলো এত কঠিন কেন হয় আমি বুঝতে পারিনা।

কয়েক বছর আগে কাকাকে নিয়ে আমি বার্ডেম হাসপাতালে।ডায়াবেটিস ছিলো ।সামান্য কাটা থেকে ইনফেকশান। ডায়াবেটিস হলে যা হয় আর কি।তখন কাকার বড় ছেলে এবং মেজো ছেলেকে বিদেশ পাঠাতে গিয়ে টাকা পয়সার একটা বিশাল টানাপোড়েনে পড়েছিলেন।বার্ডেমের চিকিৎসক কাকাকে পায়ে ৬ বার অপারেশন করেছিলেন।এবং কোন রকম অবশীকরণ ছাড়াই।অবশ করতে গেলে তখন পা*চশ টাকা দিতে হত শুধু অবশ করার জন্য।তো এটাকাটা মেনেজ করা অনেক কঠিন ছিলো।কাকাকে যখন একেকবার অপারেশন করতে পাঠানো হত তখন কাকা হাতে পায়েধরে বলতেন আমারে মাইরা ফালা তবুও আর কষ্ট দিস না।আমি দেখেছি ডাক্তার কিভাবে উনার পা'কে ছুরি দিয়ে পুছিয়ে পুছিয়ে কেটেছে।সেন্সলেস না করে।দূর থেকে উনার আর্তি শুনেছি।শিশুদের মত হাত কপালে তুলে।ডাক্তার সাব আমি আর সহ্য করতে পারছিনা।যতবার উনাকে আমি অপারেশন কক্ষে পাঠাতে বলেছি ততবার উনার শরীর ভয়ে কুকড়ে উঠেছে।এক একটা চিৎকার আজো আমার কানে বাজে ।একজন অবুঝ শিশুর মত সেকি আহাজারী।উনার চিৎকারে ডাক্তারও বিরক্ত।কি ধমক।এভাবে করলে তোমার কাকাকে চিকিৎসা করাতে পারবনা।এত চেচামেচি।৬ বার অপরেশনের পর ডাক্তার বললেন যে তোমার কাকাকে এখানে ভালো করা যাবেনা।রামপুরা ফুটকেয়ার হাসপাতাল আছে একটা ওখানে নিয়ে যাও।তো ওখানে নিতে গেলে অনেক টাকার দরকার টাকা ম্যানেজ করা !কিভাবে করব।আবার এদিকে ফুফির বাসায় ওনাকে নিয়ে থেকে থেকে বিরক্তি ধরিয়ে দিয়েছি।কাকার বড় ছেলে,আমার বাবা,কাকি সবাই বলছে আর টাকা পাঠাতে গেলে জমিজামা বিক্রি করে ফকির হয়ে যাবে।বাড়িতে নিয়ে আয়।হায়াৎ থাকলে বাঁচবে।যা যা খেতে চায় খাইয়ে দিই মরে যাক।কাকার সাথে থেকে আমিও উনার দাবিদাওয়া কথাবার্তায় যারপর নাই বিরক্ত।এমনও সময় গেছে মনে হয়েছে কাকাকে রেখে আমি পালিয়ে আসি।কিংবা গলা টিপে মেরে ফেলি।সাহস হয়নি।শরীর রাগে ফেটে যাবার অবস্থা ।বাড়িতে ফোন দিলাম।যেকরেই হোক যেভাবেই হোক টাকা পাঠাও ।না হলে আগুনে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারব।কাকার বড় ছেলেটাতো আমাকে প্রায় দমক- নিছেন কেড়ে হাসপাতালে?অবশেষে রামপুরায় ভর্তি করালাম।৪৭ দিন পর রিলিজ পেলাম।মোটা বিল।টাকা ম্যানেজের সে একঝামেলা!তো যা বুঝলাম।ডায়াবেটিসের এরকম ঝামেলায় যারা পড়েন তাদের পায়ে ভালোরকম ব্লাড সার্কেলুশান না থাকার কারণে ক্ষতটা শুকায় না।কাকার হাটুর কিছুটা নিচে পর্যন্ত ভালো সার্কোলেশন ছিলো।বার্ডেমের ডাক্তার ব্যাপারটা আগেই জানতো।সে যদি আমাকে আগেই খুলে বলতো ঘটনাটা যে তোমার কাকার পায়ের ব্লাড সার্কোলেশন টেষ্ট করে দেখো '''''''''।তাহলে উনাকে আমি ৬ বার কচুকাটা করতে দিতাম না। বুঝলাম বাংলাদেশে বার্ডেমর চেয়েও ভাল হাসপাতাল আছে।সেখানে টাকার খরচ বেশি।ডাক্তারগুলো সব বার্ডেম থেকই যায়।ওখানে গিয়ে ভালো চিকিৎসক হন।সেবার ভালো হয়ে বাড়িতে আসি।জমি বিক্রি করে সবঝামেলা মিটাতে হয়।
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আবার আরেকটা পায়ে ইনফেকশান সামান্য কানি নখ থেকে।সারারাত বাড়িতে পড়ে কাঁদেন কেউ কাকার কাছে যায়না।বিষ খেতে চান কেউ সেটাও দেয়না।সিলেট থেকে আমি গেলাম।চিটাগাং থেকে ছোট।আবার সেই রামপুরা হাসপাতাল।দুইবার অপারেশন।দুই মাস হাসপাতাল।লম্বা একটা বিল।আবার টাকার ঝামেলা।বাড়িতে ফোন দিলাম কাকার বড় ছেলেকে টাকা ম্যানেজ কর ।সুদে টাকা আন।জমিজামা যা আছে বিক্রি কর।জমির মালিকানা এখনো তোর বাবার।এবারো কিছুটা সুস্থ হয়ে বাড়ি আসলেন।
বাঁচলেন পাঁচ মাস আটাস দিন।যেদিন কাকা স্ট্রোক করলেন সেদিন আমি বাড়িতে ফোন করেছিলাম।কেউ আমাকে জানায়নি কাকার অসুস্থতার কথা।আবার যদি আমি কোন গণ্ডগোল করি,সেই ভয়ে।সারারাত মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করলেন।সকলে মিলে খতম করলেন।কোরআন পড়লেন।আর দোয়া করলেন সহজ মৃত্যুর জন্য।কেউ ডাক্তার ডাকলেন না।সকালে মারা গেলেন।অফিস যেতে না যেতেই ফোন।কাকার বড় ছেলেটার।আব্বা আর নেই।কান্না।
বাড়ি যাব।পথে বাস নষ্ট।গোকর্ণঘাট থেকে লঞ্চে গেলে শেষ দেখাটা দেখতে পাবোনা।উপায় স্পিডবোট।গিয়ে দেখি জানাজা পড়া হয়ে যাবে যাবে।একজন কে যেন আমার বাবা কিংবা ছোট কাকা কিংবা আমার মৃত কাকার বড় ছেলে বলছে' উনি কেমন লোক ছিলেন?
সমবেত লোকেরা বলছে তানে 'উনি ভাল লোক ছিলেন'।কাকাকে আমি কবরে নামাবার আগে কবরটার উচ্চতা দেখি।দেখি দৈঘ্য,প্রস্থ।নিজ হাতে কবরে নামিয়ে উঠে যাবার আগে ইচ্ছে হল কাকার মুখটি শেষবারের মত দেখতে।মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে দেখি কাকা চেয়ে আছেন।সেই চোখে
নেই কোন অভিমান,কোন জিজ্ঞাসা,কোন চাওয়া।উদাস দৃষ্টি।লোকেরা বলল মুখটি ঢেকে দিতে।আমি পারছিলাম না।এই বুঝি শেষ দেখা!আমি উপরে উঠে এলাম।বাঁশের কাঠিগুলো মাঝখান থেকে দিতে দিতে কাকাকে একেবারে ঢেকে দিলাম।
বাড়ি থেকে আমি পরদিনই চলে আসি।রাতে সবাই মিলে বসে সলাপরামর্শ করে।পাঁচদিনের দিন ভোজ করতে হবে।কত খরচ হবে?কম করে হলেও পঞ্চাশ হাজার টাকা।আমাকে কে যেন বলে কিরে অনুষ্ঠানে আসবি না?আমি কিছু বলতে পারিনা।ইচ্ছে হয়েছিলো চ' আধ্যক্ষরের বুলেট ছাড়ি।শেষে ঠোঁটটাকে দাঁত দিয়ে চেপে ধরে থাকি শক্ত করে।

হ্যাঁ আমার বড় কাকা ভাল লোক ছিলেন।ছোটবেলায় কাকাকে নিয়ে নৌকা করে কোথায় যেন যাচ্ছি
।নৌকায় একটা বড় বোয়াল মাছ পড়লো লাফ দিয়ে।কাকা মাছটি আমার হাতে দিলেন ভাল করে ধরে রাখতে।বললেন ভাতিজা তোর মাকে বল ভাল করে রান্না করতে।
আমার কাকা অনেক ভাল লোক ছিলেন।
আরেকবার শালুক তুলতে গিয়ে কাকার সাথে প্রতিযোগিতা করে পারছিলাম না।তাই যখন কাকা শালুক তুলতে ডুব দিত আমি কাকার শালুকগুলো আমার এদিকে এনে রেখে দিচ্ছিলাম।কিছুক্ষণ শালুক তুলতে তুলতে কাকা দেখলেন উনার শালুক খুব একটা বাড়ছে না।বরঞ্চ আমার শালুক উনার চেয়ে বেশি।কাকা বললেন ভাতিজা তোর আর আমার শালুক একসাথে কর।দুইজনে যা তুলতে পারি সেইগুলো পরে ভাগ করে সমান করে নেব।ঠিক আছে ?আমি মাথা নাড়িয়ে বলেছি ঠিক আছে।
আমার কাকা কত ভাল লোক ছিলেন!
আমি মিষ্টি খেতে পছন্দ করতাম।কাকা আমাকে মাথায় করে গ্রামের বাজারে নিয়ে যেতেন মিষ্টি খাওয়াতে।একদিন দোকানদারকে বললেন এককেজি মিষ্টি দিতে ।আমি কতগুলো খেয়ে আর পারছিলাম না।ভয়ে ছিলাম যদি কাকা ধমক দেয়?আমার কষ্ট দেখে কাকা দোকানদারকে প‌্যাকেট করে দিতে বললেন মিষ্টিগুলো।আমাকে বললেন ঘরে নিয়ে যা পরে খাস।

আমি মাঝেমাঝে দুঃস্বপ্ন দেখি।কাকা অপারেশন থিয়েটারে।কাকার পায়ে অপারেশন।সেন্সলেস না করেই পায়ের অপারেশন হচ্ছে।আর কাকা চিৎকার করছে।অবুঝ শিশুর মত।
ডাক্তার সাব ও ডাক্তার সাব!ও মারে ।ওওওও------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই এপ্রিল, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:৪৩
১৭টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাদির হত্যাকান্ড ও সরকারের পরবর্তি করণীয়!

লিখেছেন আহলান, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৫১

হাদির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। সে দেশকে ভালোবেসে, দেশের মানুষকে ইনসাফের জীবন এনে দিতে সংগ্রাম করেছে। তাকে বাঁচতে দিলো না খুনিরা। অনেক দিন ধরেই তাকে ফোনে জীবন নাশের হুমকি দিয়ে এসেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মব রাজ্যে উত্তেজনা: হাদির মৃত্যুতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪২

রোম যখন পুড়ছিল নিরো নাকি তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল; গতরাতের ঘটনায় ইউনুস কে কি বাংলার নিরো বলা যায়?



বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদটি সবসময় ছিল চ্যালেঞ্জিং।‌ "আল্লাহর... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্টেরিম সরকারের শেষদিন : গঠিত হতে যাচ্ছে বিপ্লবী সরকার ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২২


ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়াকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার আন্তঃদেশীয় প্রকল্পটা সফল হতে অনেক দিন লেগে গিয়েছিল। বাংলাদেশে সে তুলনায় সংশ্লিষ্ট শক্তিসমূহের সফলতা স্বল্প সময়ে অনেক ভালো। এটা বিস্ময়কর ব্যাপার, ‘রাষ্ট্র’... ...বাকিটুকু পড়ুন

মব সন্ত্রাস, আগুন ও ব্লাসফেমি: হেরে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:৫২


ময়মনসিংহে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন মানুষকে ধর্মীয় কটূক্তির অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। মধ্যযুগীয় এই ঘটনা এই বার্তা দেয় যে, জঙ্গিরা মবতন্ত্রের মাধ্যমে ব্লাসফেমি ও শরিয়া কার্যকর করে ফেলেছে। এখন তারই... ...বাকিটুকু পড়ুন

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×