চারিদিকে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা। এখানে সেখানে ফোন। কেউ নেই। কোথাও কেউ নেই। হঠাৎ হাফাতে হাফাতে ফিরে এলো ড্রাইভার। চোখে মুখে ঘোর অন্ধকার।
- তোর স্যার কোথায়? স্যারকে কোথায় রেখে এলি?
কোন উত্তর নেই। ড্রাইভার আইনুদ্দিনের চোখে শুধু পানি। মুখের ভাষার চেয়েও যে পানি কখনো কখনো শক্তিশালী!
অবশেষে খবর এলো। কিছুক্ষণ আগে বীর বেশে যে মানুষটি বেরিয়ে গেছেন তিনি আর ফিরবেন না। কোনদিন না। এমনকি তার লাশও না। তবু চেষ্টা করা হলো। অনিশ্চিৎ। দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা এলো। রাত্রি নামল। অবশেষে আত্মীয় ও শুভাকাঙ্খিদের প্রচেষ্টায় লাশ ফিরে পাওয়ার একটি ব্যবস্থা হলো। তবে এক শর্তে। কঠিন সে শর্ত। তবু তাতেই রাজি হলেন মৃতের পরিবার।
রাত বাড়ছে। কিশোরী মেয়েটি তখনও এ-ঘর ও-ঘর ছুটছে। কখন বুঝি বাবাকে দেখতে পাই। হঠাৎ সেই আলো। গেরুয়া গাড়ির আলো। যে গাড়িতে ভর করে দানবের মতো ছুটে বেড়ায় মিলিটারি বাহিনী। বাড়ির উঠোনে এসে থামল তারা। সাহস করে তাকাল মেয়েটি। গাড়ীর জানালায় চোখ পড়ল। যেখানে নিথর পড়ে আছে দুটো লম্বা-ফর্সা পা।
বাবার পা দুটো জড়িয়ে ধরল মেয়েটি। কান্নায় বুক ভেঙে যায়। তবু মনে পড়ে গেল শর্তের কথা। বন্দুকের নলের মুখে তখন কেবলই চাপা-বোবা কান্নার ছটফটানি। সামাল দিতে না পেরে মেয়টির বড় বোন ডুকরে কেঁদে উঠল। আর হায়েনার মতো চিৎকার করে উঠল খুনিরা। না, কাঁদা যাবে না।
রাজধানী জুড়ে কারফিউ। দোকানপাট বন্ধ। কাফনের কাপড় তবে মিলবে কোথায়? মিলল না। কোথাও মিলল না। একটি নতুন সাদা শাড়ীতেই দাফন হলো তার।
বীর সেনা কবরে চলে গেলেন। এখন তবে নাম বলি। তিনি কর্নেল জামিল। সেদিন মৃত্যুর মুখে দাড়িয়ে বঙ্গবন্ধু এখানে সেখানে ফোন করে কাউকে পাননি। অথবা কেউ ছুটে আসেননি। এসছিলেন একজনই। তিনি কর্নেল জামিল। বঙ্গবন্ধুর টেলিফোন পেয়ে গণভবন থেকে সরাসরি ৩২ নম্বরের দিকে ছুটেছিলেন তিনি। স্ত্রী আনজুমান আরা বলেছিলেন, তুমি কি যাবেই? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, বন্ধুবন্ধু বিপদে আর আমি যাবো না? যাওয়ার সময় তার শেষ বাক্য ছিল আমার মেয়েদের দেখে রেখো। পথে যেতেই বেরিকেড। সিপাহীরা বলল, স্যার যাবেন না। কর্ণেল জামিল তখন বলল, আমাকে যেতে দাও। এটা আমার নির্দেশ। সিপাহীরা সরে গেলেও কয়েক গজ এগুতে না এগুতেই আবার থামতে হলো। জীবনের পথ শেষ হলো। গাড়ীর ভেতরেই কর্নেল জামিলকে গুলি করে মারল কর্ণেল হুদা (ড্রাইভারের তথ্য অনুসারে)।
স্বামীর চল্লিশার দিন স্ত্রী আনজুমান আরা জানতে পারলেন তিনি আরেক সন্তানের মা হতে চলেছেন। এই খবর জানা হলো না কর্নেল জামিলের। চার মেয়ের নিরাপত্তার কথা ভেবে একটি আশ্রয়ের জন্য পরবর্তীতে সরকারের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন এই মা। জীবন যুদ্ধে কখনো হেরে যাননি। সে আরেক গল্প, মহাকাব্য। সর্বশেষ বৃহত্তর কুষ্টিয়ার এমপিও হয়েছেন তিনি। গেল ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত চার কন্যাকে রেখে স্বামীর কাছে অনন্যপুরিতে চলে গেছেন আনজুমান আরা।
আগস্টে বঙ্গবন্ধু ও তার শহীদ পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা-শোকের কমতি নেই। পোশাক বেয়েও ঝরে পড়ে সেই শ্রদ্ধা! ঝড় ওঠে টকশোতে। জেনারেল শফিউল্লাহ কিংবা মেজর জিয়াদের কুলাঙ্গারি ভূমিকা নিয়ে মুখে ফেনা তোলেন কিছু লোক। কর্নেল জামিলকে মনে করেন ক’জন? বঙ্গবন্ধুকেই বা বছর জুড়ে মনে রাখেন কে?
শোকের মাসে সুবোধ জাগ্রত হোক বাঙালির। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সত্যিকারের বিশ্বাসীরা জেঁগে উঠুক বীরের মতো। জাতির জনকের আদর্শ চির অমলিন থাক বাঙালি হৃদয়ে। বেঁচে থাক কর্নেল জামিলের মতো বীর সেনারা।
(কর্নেল জামিলের মেয়ে আফরোজা জামিল কঙ্কা আপার ইন্টারভিউ করতে গেছিলাম সেদিন। গত বছরও কথা হয়েছিল। অসাধারন একজন মানুষ। লেখার মধ্যে এ-ঘর ও-ঘর ছুটে বেড়ানো কিশোরী মেয়টি তিনিই)
ভিডিও রিপোর্টটি দেখতে চান?
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই আগস্ট, ২০১৭ বিকাল ৪:২৬