somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বর্ণবৈষম্য ও জাত-পাত ---------- উদ্ভব বিকাশ ও মোচনের নানা দিক

২৭ শে আগস্ট, ২০১৬ রাত ১১:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জাতিবর্ণ ব্যবস্থা (Caste System) বলতে কী বোঝায়?
জাতিবর্ণ ব্যবস্থা ভারতীয় অঞ্চলের একটি বিশেষ সামাজিক সম্পর্ক। জাতিবর্ণ ব্যবস্থা হল এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে সমাজের সদস্যদের পেশার ভিত্তিতে নানা গোষ্ঠীতে ভাগ করা হয়েছে। তবে বিষয়টি এমন নয় যে কোন একটি সময়ে হটাৎ করে এটি শুরু হয়েছে। এরও একটি নির্দিষ্ট ইতিহাস আছে। বলা যায় সমাজে প্রাথমিকভাবে শ্রেণি বিভাজন দেখা দেবার পর কয়েকশ বছরের বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে ভারতীয় অঞ্চলে জাতিবর্ণ প্রথার ভিত্তিতে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার উদ্ভব হয়েছিল। আর্য সভ্যতার কোন একটি ঐতিহাসিক পর্যায়ে বর্ণ প্রথার উদ্ভব হয়। বর্ণ প্রথায় সমাজের সদস্যদের সামাজিক কাজের ভিত্তিতে চারভাগে ভাগ করা হয়; যথা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র। ব্রাহ্মণদের কাজ হল যাগ যজ্ঞ করা, ক্ষত্রিয়দের কাজ হল সমাজকে বহিঃশত্রুর হাত থেকে রক্ষা করা বা যুদ্ধ করে রাজ্যের বিস্তার ঘটানো, বৈশ্যদের কাজ হল ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালনা করা এবং শূদ্রদের কাজ হল এই তিন বর্ণের সেবা করা।
প্রাথমিকভাবে খ্রীষ্টপূর্ব ১৫০০ শতক থেকে বর্ণ ব্যবস্থার যে বীজ দেখা দেয় তা আর্য অনার্য গোষ্ঠীগুলির মধ্যে সংগ্রাম ও আত্তীকরণের মধ্যে দিয়ে নানা ভাঙন ও গঠনের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলে। ফলে এমন উদাহরণও পাওয়া যায় যেখানে যোগ্যতার ভিত্তিতে নিম্ন বর্ণের সদস্য উচ্চবর্ণে উন্নীত হয়েছে আবার তার উল্টোটাও ঘটেছে। তবে এই প্রথাকে দৃড় করবার লক্ষ্যে (নির্দিষ্ট বর্ণে) জন্মের ভিত্তিতে পেশা নির্ধারণ ও অসবর্ণ বিবাহ বন্ধ করবার একটি প্রচেষ্টা উচ্চবর্ণের (তৎকালীন সময়ের শোষকশ্রেণির) দিক থেকে বরাবরই চালু ছিল এবং বিভিন্ন শাস্ত্র ও সংস্কৃতিতেও তার প্রকাশ ঘটেছে। যাইহোক আরোও পরবর্তী সময়ে বিশেষতঃ চতুর্থ শতক থেকে যে জাতিবর্ণ ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে সেটি সপ্তম শতক নাগাদ একটি কঠোর সামাজিক বিভাজনের রূপ নেয়। জাতিবর্ণ ব্যবস্থায় বর্ণগুলিকে বিশেষতঃ শূদ্রবর্ণকে পেশার ভিত্তিতে আবার বহু জাতিতে (caste) ভাগ করা হয়েছে যেমন কামার, কুমোর, তাঁতী, জেলে, গোয়ালা ইত্যাদি। এই ব্যবস্থার বিশেষ বৈশিষ্টগুলি হল;
১) প্রতিটি জাতির জন্য পেশা নির্দিষ্ট।
২) জাতির বাইরে বিবাহ নিষিদ্ধ।
৩) জাতি পরিচয় ঠিক হয় জন্ম দিয়ে।
এই প্রথায় শূদ্রজাতির নীচে থাকে আর একটি বিরাট জনসমষ্টি যাদের অতিশূদ্র আখ্যা দেওয়া হয়। সমাজে এদের স্থান থাকে প্রায় দাসের স্তরে, ধর্মীয় আইনে এরা কোন ধরনের সম্পত্তির মালিক হতে পারে না, এদের দায়িত্ব হল গোটা গ্রামের সেবায় সবচেয়ে কষ্টকর কাজগুলি করা এবং একইসাথে অস্পৃশ্য বলে গ্রামের বাইরে বাস করা। বর্তমানে এরাই দলিত বলে পরিচিত। তাই জাতিবর্ণ ব্যবস্থার যে বিশেষ বৈশিষ্টটি মনোযোগ দিয়ে বোঝা দরকার তা হল যে এই সমাজে একজন কাপড় বোনে সেই কারণে তার পরিচয় তাঁতী নয়, সে তাঁতী এই কারণে যে সে তাঁতী জাতির ঘরে জন্ম নিয়েছে এবং সেই কারণে জন্মের মধ্যে দিয়ে তার পেশাও নির্দিষ্ট হয়ে গেছে। এই ব্যবস্থায় ব্রাহ্মণ সন্তান বিদ্যাচর্চায় অনুৎসাহী হলেও সে ব্রাহ্মণই থাকে এবং সে কখনই কৃষিকাজ সহ শূদ্রদের জন্য নির্দিষ্ট পেশার কাজে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। তেমনি এই ব্যবস্থায় শূদ্র ও অতিশূদ্র জাতিগুলির বিদ্যাচর্চার কোন অধিকার নেই।
জাতিবর্ণ ব্যবস্থা ও শ্রেণি ব্যবস্থার সম্পর্কটি কেমন?
মানব সমাজের ইতিহাসে দেখা যায় যে কোন সমাজের মানুষের উৎপাদন করার ক্ষমতা একটি নির্দিষ্ট স্তরে পৌছনোর পর সেইসব সমাজে একটি পর্যায়ে শ্রেণি বিভাজন দেখা যায়। শ্রেণি বিভক্ত সমাজ বলতে বোঝায় এমন একটি সমাজ ব্যবস্থা যেখানে সমাজের সমস্ত সদস্যরা একইভাবে সামাজিক উৎপাদনে যুক্ত থাকে না, ভিন্ন ভিন্ন অংশ ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে সামাজিক উৎপাদনে যুক্ত থাকে।
শ্রেণি বলতে বোঝায় একই সমাজের এক একটি গোষ্ঠী যাদের মধ্যেকার পার্থক্য বোঝা যায় নিম্নোক্ত বৈশিষ্টগুলি দিয়ে;
১) ঐতিহাসিকভাবে নির্ধারিত সামাজিক উৎপাদন ব্যবস্থায় তাদের অবস্থান,
২) উৎপাদনের উপায় তথা জমি ও উৎপাদন চালানোর যন্ত্রপাতির সাথে তাদের সম্পর্ক (মালিকানা বা মালিকাহীনতা),
৩) সমাজের উৎপাদিত সম্পদের উপর ভোগ দখলের পরিমাণ,
৪) যে উপায়ে সেই ভোগ দখল ঘটে থাকে।
শ্রেণি সমাজের বৈশিষ্ট হল যে সমাজের প্রতিটি সদস্য কোন একটি শ্রেণির অন্তর্ভূক্ত হয়েই জীবন ধারণ করতে পারে। শ্রেণি ব্যবস্থার অন্তর্বস্তু হল এমন একটি অপেক্ষাকৃত স্থায়ী ব্যবস্থা যেখানে সমাজের এক বা একাধিক গোষ্ঠী সামাজিক উৎপাদনে তাদের অবস্থানের ভিত্তিতে বা উৎপাদন উপায়ের সাথে সম্পর্কের ভিত্তিতে অপর এক বা একাধিক গোষ্ঠীর তৈরী করা উদ্বৃত্ত নিয়মিতভাবে আত্মসাৎ করে থাকে।
শ্রেণি ব্যবস্থার এই সংজ্ঞার দিকে তাকিয়ে বলা যায় যে জাতিবর্ণ ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে প্রাক্‌ পুঁজিবাদী যুগের একটি শ্রেণি ব্যবস্থা যেখানে উচ্চবর্ণের মানুষেরা অর্থনীতি বহির্ভূত নিয়মে (Extra economic coercion), অর্থাৎ কোন বিনিময়ের নিয়ম ছাড়াই শূদ্র ও অতিশূদ্র জাতিগুলির সদস্যদের শ্রমের ফসল আত্মসাৎ করে থাকে। কিন্তু যদি উল্টো প্রশ্ন করা যায় যে প্রাক্‌ পুঁজিবাদী যুগে এই ধরনের শ্রমের আত্মসাতের জন্য জাতিবর্ণ প্রথা কী আবশ্যিক। তার উত্তরে বলা যায় যে বিশ্বের সমস্ত জায়গায় শ্রেণি ব্যবস্থা দেখা দিলেও আর কোথাও সেটি জাতিবর্ণ প্রথার রূপ নিয়ে হাজির হয় নি। জাতিবর্ণ ব্যবস্থার মৌলিক বৈশিষ্ট তথা বংশানুক্রমিকভাবে পেশা নির্দিষ্ট হওয়ার এই নিয়ম কেবল এই উপমহাদেশের বিশেষ বৈশিষ্ট।
হিন্দু শাস্ত্রে কী জাতিবর্ণ ব্যবস্থা অনুমোদিত?
হিন্দু ধর্মে যেসব গ্রন্থগুলি মৌলিক হিসাবে বিবেচনা করা হয় সেগুলিতে জাতিবর্ণ ব্যবস্থা কেবল অনুমোদিতই নয়, বলা যায় সেগুলিতে এই ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করবার জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। উপনিষদেই প্রথম বর্ণপ্রথার উল্লেখ পাওয়া গেছে। মনু সংহিতা, গীতা এগুলিতে সরাসরি জাতিবর্ণ প্রথাকে মহিমান্বিত করা হয়েছে। উপনিষদে বর্ণ ব্যবস্থাকে যুক্তিসিদ্ধ করতে আনা হয়েছে জন্মান্তরবাদ ও কর্মফলের তত্ত্ব। মনু সংহিতাতে ব্রাহ্মণ্যবাদকে শক্তিশালীভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। দ্বিজদের দাসত্ব করানোর লক্ষ্যে শূদ্রদের জন্য নানা ধরনের শাস্তির বিধান আছে। আরোও বলা হয়েছে যে শূদ্ররা কখনই ধন সম্পদ সঞ্চয়ের অধিকারী হবে না কারণ ধনসঞ্চয়কারী শূদ্ররা ব্রাহ্মণদের পীড়ণ করে।
আবার গীতায় ভগবানের মূল বক্তব্য হচ্ছে ধর্মশাস্ত্রে সমর্থিত চতুর্বর্ণ প্রথাকে নিজের সৃষ্টি হিসাবে দেখিয়ে সেগুলিকে মহিমান্বিত করা। গীতার প্রধান ভাষ্যকার শংকরাচার্য তার গীতাভাষ্যের উপক্রমণিকাতে বলেছেন যে বিপন্ন চাতুর্বর্ণের পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যই শ্রীভগবান অবতার রূপে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
উৎপাদন শক্তি ও সমাজের বিকাশে জাতি-বর্ণ প্রথার ভূমিকা কেমন?
আমরা আগেই বলেছি যে জাতিবর্ণ প্রথা ভারতীয় অঞ্চলের একটি নির্দিষ্ট শ্রেণি ব্যবস্থা আর শ্রেণি ব্যবস্থার উদ্ভব হয় সামাজিক উৎপাদনের বিকাশ একটি নির্দিষ্ট স্তরে যাবার পর বিশেষতঃ উদ্বৃত্ত উৎপাদন করার ক্ষমতা অর্জনের পর। সামাজিক উৎপাদন বিকাশের দৃষ্টিকোণ থেকে আদিম সাম্যবাদী সমাজের তুলনায় শ্রেণি ব্যবস্থা যে বৈশিষ্টমূলক ভূমিকাগুলি পালন করে তা হল;
১) সামাজিক শ্রমবিভাগের ভিত্তিতে উৎপাদনের বিকাশ,
২) উদ্বৃত্ত উৎপাদনের অপেক্ষাকৃত স্থায়ী ব্যবস্থা,
৩) সমাজের অনেক সদস্যের তৈরী উদ্বৃত্ত এক জায়গায় (ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের হাতে) জড়ো হওয়া যা উৎপাদন বিকাশের ক্ষেত্রে বড় ধরনের উদ্যোগের সম্ভাবনা তৈরী করে। বিশেষতঃ এই কারণে প্রাচীন ভারতে মগধ রাষ্ট্র লৌহ শিল্পের বিকাশ ও জঙ্গল কেটে কৃষির বিস্তারের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়।
বর্ণ ব্যবস্থা যেহেতু অন্তর্বস্তুতে একটি শ্রেণি ব্যবস্থা তাই বিকাশের নির্দিষ্ট স্তরে এই বিভাজন তৎকালীন সময়ে সামাজিক উৎপাদনের বিকাশে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পরবর্তী বিকাশের ক্ষেত্রে জাতিবর্ণ ব্যবস্থার অন্যান্য বৈশিষ্টগুলি যেভাবে প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা পালন করে তা হল;
ক) এক বিরাট সংখ্যক গোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত মানুষের ব্যক্তিগত দক্ষতা বিকাশের ক্ষেত্রে বাঁধা তৈরী করে যেহেতু এই ব্যবস্থায় জন্মের ভিত্তিতে পেশা নির্দিষ্ট হয়ে যায়,
খ) এই ব্যবস্থার ফলে একটি অপেক্ষাকৃত ছোট অঞ্চল যেমন একটি গ্রাম স্বয়ং সম্পূর্ণ হয়ে উঠতে পারে কারণ উচ্চ জাতিগুলির জীবন ধারণের জন্য সমস্ত প্রয়োজনীয় উপাদান (তা সে ভোগ্যবস্তুই হোক বা পরিষেবা হোক) বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত নিম্ন জাতিবর্ণের সদস্যরা সরবরাহ করে থাকে। এর ফলে স্বতস্ফূর্তভাবে পণ্য বিনিময় প্রথার বিকাশ ও পণ্য বিনিময় প্রথার গতিশীল চরিত্রের মধ্যে দিয়ে সামাজিক উৎপাদনের বিকাশ ব্যাহত হয় এবং এই সামাজিক স্থবিরতা দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারে।
অতীতে ভারতীয় অঞ্চলে এমন সময় গেছে যখন পণ্য উৎপাদন, ব্যবসা বাণিজ্য খুব উচুস্তরে পৌছেচে আবার পরবর্তীতে জাতিবর্ণ প্রথা দৃড় হওয়াতে এমন সময় এসেছে যখন সেই বিকাশ থমকে গেছে, সমাজ অপেক্ষাকৃত স্থবির হয়ে গেছে এবং গ্রামগুলি অপেক্ষাকৃত স্বয়ং সম্পূর্ণ হয়ে ওঠায় পণ্য উৎপাদন ও ব্যবসা বাণিজ্যের মাধ্যমে উৎপাদন ও প্রযুক্তির বিকাশ অবরুদ্ধ হয়েছে। ফলে কঠোর জাতিবর্ণ ব্যবস্থা ও ব্রাহ্মণ্যবাদী মতাদর্শের ভিত্তিতে যে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা এই উপমহাদেশে গড়ে উঠেছে তার মধ্যে সামাজিক গতিশীলতার উপাদানগুলি সহজে ক্রিয়াশীল হয়ে উঠতে পারে নি। দৈহিক কাজের পেশাগুলিকে ঘৃণার চোখে দেখা ও নিম্ন জাতিবর্ণের মানুষের জ্ঞান চর্চার সুযোগ না থাকার ফলে সমাজের এক বিশাল অংশের মানুষের নানা ধরনের দক্ষতা ও সৃষ্টিশীলতার অপচয় ঘটেছে। বিশেষতঃ এই জাতিবর্ণ ব্যবস্থা পণ্য উৎপাদন ও পণ্য বিনিময় প্রথা তথা ব্যবসা বাণিজ্য বিস্তারের পথে বাঁধা তৈরী করে সমাজের পরবর্তী বিকাশে বিশেষতঃ সামন্ত ব্যবস্থা থেকে পুঁজিবাদী সমাজে পৌছনোর ক্ষেত্রে বিশেষ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে।
জাতিবর্ণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রাচীনকালে কী সংগ্রাম হয়েছে?
যে কোন সমাজেই যে পরিমাণে শ্রেণি বিভাজন ঘটতে থাকে তার সাথে সাথে শ্রেণি সংগ্রামেরও আবির্ভাব ঘটে। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই ভারতীয় অঞ্চলের জাতিবর্ণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধেও প্রাচীনকাল থেকেই নানা ধরনের সংগ্রাম জারী ছিল। খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম শতক থেকে সমাজের কারিগর ও ব্যবসায়ী শ্রেণিগুলি ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র, অপ্রয়োজনীয় যাগযজ্ঞ ও কৃষির বিকাশের পক্ষে ক্ষতিকর পশু নিধন প্রথার বিরোধিতা করতে শুরু করে। এর প্রকাশ ঘটে বৌদ্ধ, জৈন ও লোকায়ত ধর্মের মধ্যে দিয়ে। পরবর্তীতে মগধ রাষ্ট্র গড়ে ওঠার মধ্যে দিয়ে মূলতঃ শূদ্র শ্রম ব্যবহার করে উৎপাদনের বিকাশ ঘটে। লোহার ব্যবহার প্রচলিত হওয়াতে জঙ্গল কেটে কৃষিকার্যের বিস্তার ঘটে। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মও জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং তা ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রতিযোগী হয়ে ওঠে। এর প্রভাবে পরবর্তীতে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রেরও কিছু সংস্কার ঘটে। অন্যান্য ধর্ম থেকে কিছু কিছু উপাদান গ্রহণের ফলে যাগযজ্ঞ, দান ও পশুনিধন অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বের অবস্থানে চলে যায়। ব্রাহ্মণরাও কৃষির বিস্তার ও পরাজিত উপজাতিদের মূলতঃ শুদ্র হিসাবে (কিছু কিছু ক্ষেত্রে অল্প সংখ্যক সদস্যকে ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় মর্যাদা প্রদান ও কিছু দেব দেবীকে হিন্দু দেবতা হিসাবে গ্রহণ) আত্তীকরণ করে উৎপাদন বিকাশে কিছুটা সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
জাতিবর্ণ ব্যবস্থা পোক্ত হয়ে ওঠার পর সংগ্রামের একটি দিক ছিল বিভিন্ন নিম্ন জাতির জাত ব্যবস্থায় উপরের স্তরে ওঠার সংগ্রাম যেহেতু এই ব্যবস্থায় ব্যক্তি তার দক্ষতার ভিত্তিতে উপরে উঠতে পারে না। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল গোটা জাতিবর্ণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নিম্ন জাতিবর্ণের শ্রমজীবি মানুষ বিশেষতঃ কারিগর ও ব্যবসায়ীশ্রেণির সংগ্রাম। তৎকালীন সময়ে এই ধরনের সংগ্রাম ধর্মীয় আকারেই গড়ে উঠতে পারত। ১২০০ সাল থেকে ১৭০০ সাল জুড়ে যে ভক্তি আন্দোলনের বিকাশ ঘটে তা আসলে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় বিদ্রোহ। ভক্তি আন্দোলনে নেতৃত্ব যাদের মধ্যে থেকে উঠে আসে তারা হল মূলতঃ কামার, ছুতোর, তাঁতী জাতিভূক্ত। রবিদাসের মত অস্পৃশ্য জাতির মধ্যে থেকেও এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ ছিল। ছিল কিছু ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের প্রতিবাদী মানুষও। এই আন্দোলনের অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী ধারার নেতৃত্বে ছিল তুকারাম, নামদেব, কবীর ও গুরুনানক যারা প্রকাশ্যে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। অপরদিকে রামানুজ, চৈতন্যের মত নরমপন্থীরাও ঈশ্বরের কাছে সবাই সমান এরকম ধারণা সামনে এনে জাতিবর্ণের মতাদর্শকে আক্রমণ করে্ন। এই আন্দোলনের ভাবধারা বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষায় প্রচারিত হওয়াতে অনেক জায়গাতেই আঞ্চলিক ভাষায় সাহিত্য সংস্কৃতির প্রভূত বিকাশ ঘটে যা আবার পরবর্তীতে বিভিন্ন জাতি গঠনের প্রক্রিয়ার সহায়ক হয়। তবে জাতিবর্ণ প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হলেও ঐ ব্যবস্থাকে ভেঙে নতুন ব্যবস্থা গড়বার কোন তত্ত্ব ভক্তি আন্দোলনকারীদের হাতে ছিল না এবং তার ফলে এই আন্দোলন পরবর্তীতে তার ব্যাপ্তি হারিয়ে ফেলে এবং একটি পর্যায়ে তার মধ্যেও নানা রক্ষণশীলতার আবির্ভাব ঘটে।
ব্রিটিশ আমলে কী জাতিবর্ণ প্রথা বিলুপ্ত হয় নি?
ব্রিটিশরা এদেশে আসার আগে বাইরে থেকে আসা যেসব শক্তি ভারতে শাসন চালিয়েছে তারা কোন নতুন উৎপাদন সম্পর্কের প্রতিনিধি ছিল না এবং ধীরে ধীরে তারা ভারতীয় অঞ্চলেরই অধিবাসী হয়ে উঠেছে। তারা সবাই (যেমন পাঠান, মোগল, তুর্কী) জাতিবর্ণ ব্যবস্থার অন্তর্ভূক্ত না হলেও সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিনিধি ছিল। তাই তারা এই ব্যবস্থাকে ভাঙার কোন তাগিদ অনুভব করে নি, কেবল তাই নয় উদ্বৃত্ত তথা খাজনা আদায় করবার পক্ষে বিশেষ সুবিধাজনক ব্যবস্থা হিসাবে এটিকে তারা নানাভাবে রক্ষা করেছে, ব্রাহ্মণ, রাজপুত সহ সমাজের উচ্চবর্ণের সাথে নানা ধরনের সম্পর্ক তৈরী করে নিয়েছে এবং প্রয়োজনে তাদের আঞ্চলিক রাজা ও রাজ কর্মচারী হিসাবে নিয়োগ করেছে।
ব্রিটিশ শাসকরা ছিল এমন একটি শক্তি যারা অন্য ধরনের উৎপাদন তথা পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কের প্রতিনিধি যেখানে কিনা সামন্তপ্রথার ধ্বংসস্তুপের উপর পুঁজিবাদী ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই তারা এখানকার অধিবাসী হয়ে ওঠেনি এবং তাদের মূল লক্ষ্য ছিল এদেশে তৈরী হওয়া উদ্বৃত্ত তাদের নিজের দেশে পাঠানো যা তাদের দেশের শিল্পের বিকাশে পুঁজির যোগান দিতে পারে। মজার ব্যাপার হল ব্রিটিশ শক্তি তাদের এই উদ্দেশ্য সফল করার জন্য জাতিবর্ণ ভিত্তিক সামন্ততন্ত্রকে ধ্বংস নয়, তার রূপটির কেবল একটু অদল বদল করে নিয়ে সযত্নে রক্ষা করল।
ফলে সমাজের যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব একটি পর্যায়ে নিশ্চয়ই এই জাতিবর্ণ প্রথাকে ভেঙে চুরমার করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পত্তন ঘটাতে পারতো, সেই বিকাশের পথ অবরুদ্ধ হয়ে গেল যখন ব্রিটিশ শক্তি এখানে তার উপনিবেশ গড়ে তুললো। নিম্নবর্ণভূক্ত যেসব কারিগর-কৃষক-ব্যবসায়ী শ্রেণি জাতিবর্ণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অতীতে ভক্তি আন্দোলনের মত সংগ্রাম গড়ে তুলেছিল এবং ভবিষ্যতে আরও বিকশিত সংগ্রাম গড়ে তোলার পর্যায়ে ছিল তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হল চরম শোষণ ও নিপীড়ণ। আর এই প্রক্রিয়াতে ব্রিটিশ শক্তি যাদের পাশে পেল তারা মূলগতভাবে উচ্চবর্ণভূক্ত সম্প্রদায়ের মানুষ এবং মাড়োয়ারী, গুজরাটী ও পার্সী সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকে উঠে আসা একগুচ্ছ দালাল ব্যবসায়ী শ্রেণি। ফলে বলা যায় যে ব্রিটিশ শাসনে যেমন একদিকে প্রতিক্রিয়াশীল ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তি নতুনভাবে প্রাণ ফিরে পেল তেমনি ব্রিটিশ শক্তিও তার পাশে পেয়ে গেল তাদের স্বার্থরক্ষাকারী বেশ কয়েকটি সামাজিক শক্তিকে।
ব্রিটিশ শক্তি এখানে শাসন চালানোর জন্য সেই ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আমল থেকেই বিভিন্ন হিন্দুশাস্ত্র পড়াশোনা করে জাতিবর্ণ ব্যবস্থাটিকে বুঝে নেয় এবং বিভাজনের ভিত্তিতে শাসন চালানোর ক্ষেত্রে সেটিকে ব্যবহার করে। বিচারব্যবস্থা, আইন সহ বিভিন্ন সরকারী ক্ষেত্রে তারা এই জাতিবর্ণের বিভাজনটিকে যত্ন সহকারে রক্ষা করে। যেমন মন্দিরে শূদ্র ও অতিশূদ্রদের প্রবেশের নিষেধাজ্ঞার উপর তারা কোন হস্তক্ষেপ করেনি। গ্রামীণ ক্ষেত্রে তারা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, রাতওয়ারী ইত্যাদি ব্যবস্থা চালু করে এবং এইভাবে আগে আইনী মালিকানার অস্তিত্ব না থাকলেও জমির সাথে কৃষকের যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক ছিল, তার ছেদ ঘটায় এবং বিপুল পরিমাণে খাজনা আদায়ের উদ্দেশ্যে জমির মালিকানা তুলে দেয় সেইসব মানুষের হাতে যারা আগে ছিল হয় কেবল উদ্বৃত্ত আদায়কারী অথবা যারা কৃষিকার্যের সাথে সম্পর্কহীন উচ্চবর্ণীয় সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্ত। এছাড়াও উচ্চবর্ণের মধ্যে থেকে সুদখোর মহাজন সহ নানা মধ্যবর্তী স্তরের শোষকদের উদ্ভব হয় যারা ব্রিটিশ শক্তির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিল। এইভাবে কৃষিকাজের সাথে যুক্ত নিম্ন জাতিবর্ণের এক বিশাল সংখ্যক মানুষকে ভূমিহীন দরিদ্র কৃষক বা ভাগচাষীতে রূপান্তরিত করা হয়। ফলে ব্রিটিশ ভারতে জমিদার, জোতদার, চা বাগানের মালিক, আমলা, কেরানী, স্কুল কলেজের শিক্ষক – এই অংশগুলি মূলতঃ তৈরী হয়েছে উচ্চবর্ণ থেকে আগত মানুষদের নিয়ে। নিম্নবর্ণের কারিগরশ্রেণির একটি অংশকে কারখানার সাধারণ শ্রমিকে রূপান্তরিত করা হয়। আর অতিশূদ্র তথা দলিতদের একটি বড় অংশকে রেল, সেনাবাহিনী, সহরের রাস্তা নির্মাণ, কারখানার অদক্ষ শ্রমিক হিসাবে নিয়োগ করা হয়। খনি ও চা বাগান ইত্যাদি ক্ষেত্রে দলিত ও আদিবাসীদের নিয়োগ করা হয়। এরাই পরবর্তীতে হয়ে ওঠে সমাজের আধুনিক শ্রমিকশ্রেণি।
এইভাবে ব্রিটিশ আমলে কিছু অদল বদল ঘটিয়ে মূলগতভাবে জাতিবর্ণ ব্যবস্থাটির মৌলিক কাঠামোটিকে অক্ষুণ্ণ রাখা হয়। আবার পরিবর্তন বলতে যা বোঝায় তা হল; পুরাতন সমাজে বিভিন্ন নিম্ন জাতিবর্ণের জন্য যে পেশা নির্দিষ্ট ছিল তা হয়তো অন্যান্য পেশার আবির্ভাবের কারণে পরিবর্তিত হয়েছে, কিন্তু নিম্ন জাতিবর্ণের জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা মূলতঃ এক ধরনের কায়িক শ্রম থেকে অন্য ধরনের কায়িক শ্রমে যুক্ত হওয়া বোঝায়। যেমন কোথাও জেলেরা ক্ষেতমজুরে, তাঁতীরা নির্মান কর্মীতে, দলিতরা হাসপাতাল বা বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী অফিসের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীতে, আদিবাসীরা চা বাগানের শ্রমিকে রূপান্তরিত হয়েছে। তবে ব্রিটিশরা যে জমিদারী ব্যবস্থা গড়ে তোলে সেখানে জমিদার, জোতদার, তালুকদার ইত্যাদি শ্রেণিগুলির বড় অংশ উচ্চবর্ণের হলেও ছোট জমিদার, নানা ধরনের মধ্যস্বত্তভোগী শ্রেণি ও ধনী কৃষকদের একটি অংশ গড়ে ওঠে তৎকালীন শূদ্রজাতির মধ্যে থেকে।
ব্রিটিশ শাসনকালে এবং বিশেষতঃ ব্রিটিশের প্রত্যক্ষ শাসন শেষ হওয়ার পরে জাতিবর্ণ প্রথা মূলগতভাবে বজায় থাকলেও জাতিপ্রথা ও শ্রেণি সম্পর্কের বেশ কিছু তারতম্য ঘটেছে যার ফলে শূদ্রজাতির মধ্যে থেকেও একগুচ্ছ শোষকশ্রেণির আবির্ভাব হয়েছে। গ্রামাঞ্চলের সামন্ত শোষকশ্রেণি আজ আর কেবল উচ্চবর্ণজাত ব্রাহ্মণ, রাজপুত, ভূমিহার সম্প্রদায়ভূক্ত নয়, বিভিন্ন রাজ্যে পতিদার, প্যাটেল, মারাঠা, জাট, যাদব, কুর্মী, ভোক্কালিগা, লিঙ্গায়েত, কাম্মা, রেড্ডি ইত্যাদি নিম্ন জাতিবর্ণের একটি অংশও আজ গ্রামাঞ্চলের শাসক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। অনেক গ্রামাঞ্চলে শূদ্রবর্ণ থেকে আগত এই অংশই দলিত ও অতিশূদ্র মানুষের প্রধান নিপীড়ক হয়ে উঠেছে আর তার ফলে এই জাতিগুলির মধ্যে শ্রেণি বিভাজন ঘটেছে। তাই আজকের দিনে কেবলমাত্র নিম্ন জাতিবর্ণের মানুষের ঐক্যের আহ্বান শ্রেণি সমঝোতার পথ তৈরী করে কারণ এতে নিম্ন জাতিবর্ণের শোষিত নিপীড়িত শ্রমজীবি মানুষের নেতা হয়ে ওঠে নিম্ন জাতিবর্ণের শোষক ও শাসকেরা। কোথাও কোথাও নিম্ন জাতিবর্ণের এই অংশগুলি কেবল শোষণই চালায় না, জাতিবর্ণ প্রথার সমর্থনকারী শাসক হিসাবেও সুপ্রতিষ্ঠিত।
জাতিবর্ণ প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রামের কথা উঠলেই গান্ধী ও বিবেকানন্দর নাম সামনে আসে। এরা কী সত্যিই এই প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন?
সবাই একথা জানেন যে জাতির পিতা গান্ধীজী অন্তত মুখে অস্পৃশ্যতার বিরোধিতা করেছিলেন কিন্তু একথা খুব কম মানুষই জানার সুযোগ পান যে গান্ধীজী জাতি-বর্ণ ব্যবস্থার একজন উগ্র সমর্থক ছিলেন। একদিকে গান্ধীজী যেমন এই ব্যবস্থার সারবস্তুকে বুঝতেন তেমনি একইসাথে গান্ধীজী মনে করতেন যে জাতিবর্ণ ব্যবস্থা ভারতীয় সমাজের অন্তরাত্মা, তাই প্রত্যেকের নিজের নিজের জাতি(Caste)-র জন্য নির্দিষ্ট পেশাতেই যুক্ত থাকা উচিত, না হলে ভারতীয় সমাজ ভেঙে পড়বে। ১৯২১ সালে গুজরাটের ‘নবজীবন’ পত্রিকায় তিনি লিখছেন, “জাতি-বর্ণ ব্যবস্থাকে ভেঙে ইউরোপের মত সমাজ ব্যবস্থা প্রবর্তন করার অর্থ হল হিন্দুদের বংশানুক্রমিক পেশার নীতিটাকেই বিসর্জন দেওয়া যা কিনা জাতিবর্ণ ব্যবস্থার আত্মা। বংশানুক্রমিক পেশার নীতিটি হল একটি সর্বজনীন নীতি। একে বদলানোর অর্থ হল নৈরাজ্য সৃষ্টি করা। যদি প্রতিদিন একজন ব্রাহ্মণ শূদ্রে ও একজন শূদ্র ব্রাহ্মণে রূপান্তরিত হয় তাহলে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। জাতিবর্ণ ব্যবস্থা হল সমাজের একটি স্বাভাবিক নিয়ম। যারা জাতিবর্ণ ব্যবস্থা ভাঙতে চান আমি তাদের সবার সর্বৈব বিরোধী।” (আম্বেদকর রচনাবলী, খন্ড-১২, বোম্বে, ১৯৭৯-৯৩)
১৯৩৬ সালে জাতিবর্ণ প্রথা রক্ষায় নিবেদিত প্রাণ গান্ধীজী বলেছিলেন “একজন ভাঙ্গি বা মেথর সমাজের জন্য সেই কাজই করে যা একজন মা তাঁর সন্তানের জন্য করে থাকেন। মা তার সন্তানকে সুস্থ রাখতে তার ‘গু-মুত’ পরিস্কার করেন। একইভাবে একজন মেথরানিও সমাজের স্বাস্থ্য রক্ষা করতে সকলের পায়খানা সাফ করে…..।” ভাবতে অবাক লাগে যিনি দলিতবর্গের মানুষকে তাদের বংশানুক্রমিক পেশায় যুক্ত থাকার পক্ষে ওকালতি করেছেন তিনিই আবার জাতির পিতা।
এরপর আসে বিবেকানন্দের কথা। তিনি গান্ধীজীর মতো ধূর্ত রাজনীতিবিদ ছিলেন না, জাতিবর্ণ ব্যবস্থার অন্তর্বস্তুকে হয়তো সেভাবে অনুধাবন করতে পারেন নি, এবং তার ফলে নানা সময় নানা উক্তি করেছেন যার মধ্যে অনেক উক্তিকে আপাতভাবে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের বিরোধী বলে মনে হয়। বাস্তবত জাতিবর্ণ প্রথা নিয়ে বিবেকানন্দ যা বলেছেন তার সাথে সমাজ বিজ্ঞানকে বোঝার তো কোন প্রশ্নই নেই, বাস্তবত এই প্রশ্নে তিনি মূলতঃ ব্রাহ্মণ্যবাদী অবস্থান গ্রহণ করেছেন। জাতিবর্ণ ব্যবস্থা হচ্ছে এই উপমহাদেশের শ্রেণি ব্যবস্থার একটি বিশেষ রূপ যে রূপটি আর কোথাও দেখা যায় নি। বিবেকানন্দ দেশ বিদেশ ঘুরেও বুঝতে পারেননি যে জাতিবর্ণ প্রথা ভারতীয় অঞ্চলের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট। শ্রেণি ও জাতিবর্ণের মধ্যেকার পার্থক্য বিবেচনা না করে তিনি ভেবেছেন যে সারা পৃথিবীতেই চারিবর্ণ অবস্থান করে। বিবেকানন্দর বাণী ও রচনা-র নিম্নোক্ত উদ্ধৃতিটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য; “…জাতি বিভাগ অনন্তকালের জন্য থাকিয়া যাইবে। সমাজের প্রকৃতিই এই বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত হওয়া। …জাতি বিভাগ প্রাকৃতিক নিয়ম। ….জাতি বিভাগ ভালো জিনিস জীবন সমস্যা সমাধানের ইহাই একমাত্র স্বাভাবিক উপায়। লোকে নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণিবিভাগ করিবে; ইহা অতিক্রম করিবার উপায় নাই। যেখানেই যাও, জাতি বিভাগ থাকিবেই।” জাতিবর্ণ ব্যবস্থার মৌলিক বিষয়টি তথা সামাজিক আইন হিসাবে জন্মের ভিত্তিতে কর্ম বা পেশা নির্ধারণ যে শ্রেণি ব্যবস্থার অতিরিক্ত একটি বিষয় এবং তা যে সর্বজনীন নয়, ভারতীয় উপমহাদেশের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট এটি তার বোধগম্য হয় নি।
অপরদিকে বুঝে বা না বুঝে তিনি যে জাতিবর্ণ ব্যবস্থার পক্ষে ছিলেন তা পরিস্কার হয়ে যায় যখন তিনি বলেন, “জ্ঞানোন্মেষ হলেও কুমোর কুমোরই থাকবে, জেলে জেলেই থাকবে, চাষা চাষই করবে। ‘সহজং কর্ম কৌন্তেয় সদোষমপি না ত্যজেৎ’– এইভাবে শিক্ষা পেলে এরা নিজ নিজ বৃত্তি ছাড়বে কেন? জ্ঞানবলে নিজেদের সহজাত কর্ম যাতে আরোও ভালো করতে পারে, সেই চেষ্টা করবে।….”
এখন তো বর্ণাশ্রমের আইন নেই। তাহলে একথা কী বলা যাবে যে আজও জাতিবর্ণ প্রথা টিকে আছে?
এটা ঠিক যে আজ আর রাষ্ট্রীয় আইন করে বর্ণাশ্রম প্রথা চালানো হয় না। কিন্তু জাতিবর্ণ প্রথা টিকে আছে বা নেই এটা বোঝার উপায় হচ্ছে সমাজকে মানসিক শ্রম ও কায়িক শ্রম, সম্পত্তির মালিকানা ও মালিকাহীনতা, ধনী ও দরিদ্র, শিক্ষিত ও অশিক্ষিত – এই ভিত্তিতে ভাগ করলে সেটা মূলগতভাবে উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণ এই ভাগের সাথে মিলে যায় কিনা তা পরখ করে দেখা। বর্তমান ভারতীয় সমাজকে বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে এই প্রথা আজও প্রকটভাবে বিদ্যমান। আসলে কয়েক হাজার বছর ধরে নিম্ন জাতিবর্ণের কয়েক পুরুষকে কঠোর কায়িক শ্রম ও সেবামূলক কাজে আবদ্ধ রাখার ফলে খালি সমাজ কাঠামোতেই নয়, এই ধরনের বিভাজন মতাদর্শগতভাবেও একটি স্থায়িত্ব পেয়েছে। এর ফলে উচ্চবর্ণের মানুষেরা যেমন কায়িক শ্রমের কাজকে ঘৃণার চোখে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে তেমনি নিম্ন জাতিবর্ণের বেশিরভাগ মানুষ উচ্চপদে চাকুরী, শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক ক্ষেত্রটিকে উচ্চবর্ণীয় মানুষের স্বাভাবিক বিচরণক্ষেত্র বলে মনে করে।
ভারতীয় সমাজ এখনও এতটাই জাতিবর্ণ প্রথায় বিভক্ত যে বিশেষ কোন পরিসংখ্যানের সাহায্য না নিয়েই চোখ বুজে বলে দেওয়া যায়; ক্ষেতমজুর বা ভূমিহীন চাষী নিম্ন জাতিবর্ণের, চায়ের দোকান বা হোটেলের শিশু শ্রমিক নিম্ন জাতিবর্ণের, রিক্সা চালক নিম্ন জাতিবর্ণের, মুটে, রাস্তার ঠেলাওয়ালা বা রেলের কুলী নিম্ন জাতিবর্ণের, পাতাল রেল ও রাস্তা নির্মানকর্মী নিম্ন জাতিবর্ণের, বাড়ীর ঝি বা চাকর নিম্ন জাতিবর্ণের। আবার হাসপাতালের ডাক্তার উচ্চবর্ণের, কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বা গবেষণাগারের বিজ্ঞানী উচ্চবর্ণের, আমলা ও সরকারী বা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তি উচ্চবর্ণের, প্রতিষ্ঠিত সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক বা কবি উচ্চবর্ণের। খালি তাই নয় জাতিভেদ প্রথার অস্তিত্ব যে এখনও শক্তিশালীভাবে টিকে আছে যখন দেখা যায় যারা চুল কাটে তারা প্রায় সবাই জাতিগতভাবে নাপিত, যারা জুতো সেলাই করে তারা সবাই প্রায় জাতিগতভাবে মুচী, যারা তাঁত বোনে তারা সবাই প্রায় জাতিগতভাবে তাঁতী, যারা মাটির জিনিস তৈরী করে তারা সবাই প্রায় জাতিগতভাবে কুমোর, যারা শ্মশানের কাজে যুক্ত তারা সবাই প্রায় জাতিগতভাবে ডোম। তবে আজকের অর্থনীতিতে নির্দিষ্ট জাতির সমস্ত সদস্য তাদের জাতিগতভাবে নির্দিষ্ট পেশার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে না। তাই সমস্ত নাপিত চুল কাটে না, বা সমস্ত তাঁতী তাঁত বোনে না ইত্যাদি।
সংরক্ষণ ব্যবস্থা কী?
কোন একটি সমাজ ব্যবস্থায় কোন এক বা একাধিক বিশেষ সামাজিক (ধর্মীয়, জাতিগত, বর্ণগত, সম্প্রদায়গত, লিঙ্গগত) পরিচয় বিশিষ্ট গোষ্ঠী যদি সমাজের আধুনিক পেশা ও সুযোগ সুবিধা (শিক্ষা, চাকুরী, ব্যবসাবাণিজ্য, সম্পত্তির মালিকানা) থেকে নিয়মিতভাবে বঞ্চিত হয় তবে সেই বঞ্চনাকে ব্যক্তির সমস্যা হিসাবে বিবেচনা করা যায় না, সেই বঞ্চনার পেছনে নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক কারণ থাকে। এরকম একটি সমাজে বিভিন্ন সামাজিক সুযোগ সুবিধা অর্জনের ক্ষেত্রে ব্যক্তির সমানাধিকারের নীতি প্রয়োগ করলে ঐতিহাসিক কারণে পিছিয়ে থাকা গোষ্ঠী চিরকালই পিছিয়ে থাকে এবং তা গণতন্ত্র বিকাশের পরিপন্থী। সংরক্ষণ হল এরকম একটি ব্যবস্থা যেখানে এই ধরনের গোষ্ঠীগুলির জন্য বিশেষ সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা যাতে তারা জনসংখ্যার অনুপাতে সমাজের বিভিন্ন পেশাতে প্রতিনিধিত্ব অর্জন করতে পারে। কোন রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক হতে হলে এই ধরনের উদ্যোগ তার জরুরী অঙ্গ হতে হবে। না হলে একদিকে যেমন ওই গোষ্ঠীগুলির গণতন্ত্র রক্ষিত হয় না, তেমনি এই ধরনের গোষ্ঠীর সদস্যদের দক্ষতা দেশের উৎপাদনের বিকাশের ক্ষেত্রে অব্যবহৃত থেকে যায়। তাই আমাদের দেশে সংরক্ষণ প্রথাকে ভাবা যেতে পারে যে এটি জাতিবর্ণগত অসাম্য দূর করতে একটি বিশেষ প্রয়োজনীয় রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ এবং এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী কারণ বর্তমান সমাজ তার সাধারণ গতির মধ্যে দিয়ে এই অসাম্য দূর করতে অক্ষম।
তাই এই ধরনের সংরক্ষণের কর্মসূচী কেবল জাতিবর্ণ ব্যবস্থার জন্যই প্রযোজ্য নয়, ঐতিহাসিক কারণে বঞ্চিত সমাজের নারীজাতির ক্ষেত্রেও এরকম উদ্যোগ গ্রহণ করতে হয়। একই কারণে মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্রে কালো মানুষদের জন্য এরকম উদ্যোগের উদাহরণ আছে এবং তা কিছু কিছু বেসরকারী ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
জাতিবর্ণের ভিত্তিতে সংরক্ষণ কী জাতিবর্ণ ব্যবস্থাকে আরোও শক্তিশালী করে না?
দেশ জুড়ে বিশেষতঃ শাসকদের মধ্যে এরকম একটি শক্তিশালী প্রচার আছে যে সংরক্ষণ প্রথা জাতিবর্ণ ব্যবস্থাকে দুর্বল করার বদলে আরোও শক্তিশালী করে। এটি আসলে অত্যন্ত শক্তিশালী একটি ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রচার। মনে রাখতে হবে যে জাতিবর্ণ ব্যবস্থার মৌলিক ভিত্তি হচ্ছে জন্মের ভিত্তিতে পেশা নির্ধারিত হওয়া। জাতিবর্ণ প্রথার টিকে থাকে এই ভিত্তির উপর, সেটা কারোর ব্যক্তিগতভাবে জাতিবর্ণভেদ প্রথা মানা বা না মানার উপর নির্ভর করে না। যে ধরনের নানা উদ্যোগ গ্রহণ করলে জাতিবর্ণ প্রথা দুর্বল হতে পারে সংরক্ষণ হচ্ছে এই ধরনের নানা উদ্যোগের একটি।
বর্তমানে এমন কিছু তথাকথিত প্রগতিশীল অংশকে দেখা যাচ্ছে যারা বলতে চায় সংরক্ষণ দেওয়ার অর্থই হল জাত পরিচয়ের বিষয়টিকে সামনে আনা যেহেতু সংরক্ষণ দেওয়া হচ্ছে জাত পরিচয়ের ভিত্তিতে। এর ফলে জাত পরিচয় মুছে গিয়ে একটি সমসত্ব সমাজ তৈরী হতে পারছে না। বাস্তবত ভারতীয় সমাজে বিবাহ সহ প্রায় প্রতিটি সামাজিক বিষয়ে জাতিবর্ণের পরিচয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এই সংস্কৃতি টিকে আছে জাতিবর্ণ ব্যবস্থার উপর ভিত্তি করেই। আর এই সাংস্কৃতিক অসাম্য টিকে রয়েছে জাতিবর্ণ ব্যবস্থার ভিত্তিতে পেশাগত ক্ষেত্রে ও অর্থনীতি্র ক্ষেত্রে যে অসাম্য রয়েছে তার উপর নির্ভর করেই। তাই জন্মের ভিত্তিতে পেশা নির্ধারণ যেমন জাতিবর্ণ ব্যবস্থার অন্তরাত্মা তেমনি এটিকে ধ্বংস করেই একমাত্র এই ব্যবস্থার তার সাথে সাথে এই মতাদর্শের বিলুপ্তি সম্ভব। চাকুরী ও শিক্ষায় সংরক্ষণ এই ধ্বংসের কাজে একটি মাত্রায় এই ভূমিকা পালন করে।
নিম্নবর্ণের মানুষেরা দুর্বল বলেই কী সংরক্ষণ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে?
আসলে সংরক্ষণ নিয়ে এরকম একটি ধারণা এমনকি সংরক্ষণের পক্ষে থাকা এবং বিপক্ষে থাকা একটি অংশের মানুষের মধ্যে জনপ্রিয়। সংরক্ষণ বিরোধীরা কেবল মনে করে যে নিম্ন জাতিবর্ণের মানুষেরা যেহেতু দুর্বল তাই তাদের অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করা যেতে পারে বা প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের জন্য বিশেষ সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু চাকুরী ও উচ্চশিক্ষায় সংরক্ষণ দিলে তা জাতির উন্নতির পক্ষে বিপজ্জনক।
আসলে আমাদের দেশে ব্রাহ্মণ্যবাদী মতাদর্শ এতটাই শক্তিশালী যে এই মতাদর্শের থেকে যথেষ্ট সাবধান না হলে প্রগতিশীল মানুষও এর খপ্পরে পড়তে বাধ্য। বোঝার জন্য একটি পুঁজিবাদী সমাজের কথাই ধরা যাক। সেই অসাম্যভিত্তিক সমাজে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে পুঁজিপতিশ্রেণি ও উচ্চমধ্যবিত্তরাই শক্তিশালী এবং শ্রমিকশ্রেণি দুর্বল। কিন্তু তাতে কী এমনটা বোঝায় যে ঐ সমাজে শ্রমিকদের কিছুটা সুযোগ সুবিধা দিলেই একমাত্র শ্রমিকশ্রেণি উন্নতি করতে পারবে। অবশ্য মার্কসের হাতে সমাজ বিকাশের বিজ্ঞান আবিস্কার না হওয়া পর্যন্ত এরকম একটি ধারণা সমাজে জনপ্রিয় ছিল। উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের আবিস্কার এইসব ধারণাকে ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করেছে। এই আবিস্কারের পর প্রমাণিত হয়ে গেছে যে পুঁজিপতিশ্রেণি কেবল শ্রমিকশ্রেণির তৈরী উদ্বৃত্তমূল্যই আত্মসাৎ করে না, এমনকি সমাজ বিকাশের নিরিখেও তারা হয়ে উঠেছে প্রতিক্রিয়াশীল। একমাত্র শ্রমিকশ্রেণিই সমাজকে নেতৃত্ব দিলে আবার সামাজিক উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ ঘটতে পারে। তাই আধুনিক বুর্জোয়া সমাজে শ্রমিকশ্রেণিই সর্বাপেক্ষা প্রগতিশীল ও মতাদর্শের দিক থেকে সবচেয়ে অগ্রণী শ্রেণি।
এই বিষয়টি মাথায় রেখে এবং কোন যান্ত্রিকতার শিকার না হয়ে আমাদের জাতিবর্ণ প্রথার সমস্যাটিকে বুঝতে হবে। জাতিবর্ণ ব্যবস্থা হচ্ছে ভারতীয় অঞ্চলের সামন্ততন্ত্রের একটি বিশেষ রূপ যা আমরা আগেই আলোচনা করেছি। রূপের দিক থেকে বিভিন্ন হলেও যে কোন সামন্ত ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট হল সমাজের কৃষক সহ অন্যান্য শ্রমজীবি মানুষের তৈরী উদ্বৃত্ত অর্থনীতি বহির্ভূত নিয়মে আত্মসাৎ করা বা অন্য কথায় বলা যায় উদ্বৃত্ত আত্মসাতে মূলগতভাবে বাজারের স্বাধীন প্রতিযোগিতার নিয়ম কার্যকরী না হওয়া। অনেক দেশে যেমন জমির উপর মালিকানাকে কাজে লাগিয়ে এই উদ্বৃত্ত আত্মসাৎ করা হয়েছে তেমনি প্রাক্‌ ব্রিটিশ ভারতে জমির উপর ব্যক্তি মালিকানা ছাড়াই জাতিবর্ণ ব্যবস্থার মাধ্যমে এই উদ্বৃত্তের আত্মসাৎ ঘটেছে। বর্তমানে নানা পরিবর্তনের ফলে এই উদ্বৃত্ত আত্মসাতের যে রূপটি টিকে রয়েছে তাকে বলা যেতে পারে আধা সামন্ততন্ত্র যা আসলে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক নীতি ও জাতিবর্ণ ভিত্তিক সামন্ততন্ত্রের মিলিত ফল। এখন এই দেশকে যদি একটি গণতান্ত্রিক দেশে পরিণত করতে হয় তাহলে নিশ্চয়ই এই আধা সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থাটিকে ভেঙে ফেলতে হবে। আর সেটি করতে হলে জাতিবর্ণের ভিত্তিতে পেশা নির্ধারিত হওয়ার নিয়মটি তথা জাতিবর্ণ ব্যবস্থার কাঠামোটিকেও ভেঙে চুরমার করে দিতে হবে, না হলে এ দেশে উৎপাদনের বিকাশ ঘটবে না, গণতন্ত্রেরও বিকাশ ঘটবে না। তাই সমস্যাটা নিম্ন জাতিবর্ণের মানুষের দুর্বলতা নয়, সমস্যা এইখানে যে এই সমাজের এমন কোন নিজস্ব গতি নেই যার ভিত্তিতে জাতিবর্ণ ব্যবস্থা ভেঙে গিয়ে গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারে, সমস্ত মানুষ স্বাধীনভাবে দক্ষতা অর্জন ও সেই দক্ষতার ভিত্তিতে উৎপাদনে অংশগ্রহণ করে সামাজিক উৎপাদনের বিকাশ ঘটাতে পারে। দেশের একটি বড় অংশের শিশুকে যদি পেটের দায়ে চায়ের দোকান, বাজীর কারখানায় কাজ করতে হয়, লক্ষ লক্ষ পুরুষ ও মহিলাকে কৃষিকাজ সহ অন্যান্য সামাজিক উৎপাদন ছেড়ে মধ্যবিত্ত পরিবারে ঝি, চাকর ও দরোয়ানের কাজ করতে হয়, লক্ষ লক্ষ মানুষকে যদি ট্রেনে-বাসে-ফুটপাথে সামান্য মূল্যের পণ্য নিয়ে হকারী করতে হয়ত তাতে কী দেশের উন্নয়ন হতে পারে? ইউরোপের কোন উন্নত দেশে কী এমনটা দেখা যায়?
তাই বৈজ্ঞানিক বিচারধারা প্রয়োগ করে বলা যায় যে আসল কাজ হল দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবার লক্ষ্যে জাতিবর্ণ প্রথাকে ধ্বংস করা একান্ত জরুরী এবং সংরক্ষণ ব্যবস্থা হল এই লক্ষ্য অর্জনে যেসব গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপগুলি নিতে হবে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ না হলেও অন্যতম। শেষ বিচারে নিম্ন জাতিবর্ণের মানুষের মর্যাদা ও অধিকারের জন্য সংরক্ষণের দাবী সহ সমস্ত সংগ্রামই ভারতীয় সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবার গণতান্ত্রিক সংগ্রামেরই অংশ।
সংরক্ষণ ব্যবস্থার সুযোগ কী নিম্ন জাতিবর্ণভূক্ত অপেক্ষাকৃত সচ্ছল অংশটিই নিয়ে নিচ্ছে না?
ভারতীয় সমাজে সংরক্ষণের বিষয়টি হটাৎ শাসকদের মাথা থেকে উদয় হয় নি। সমাজে তার বস্তুগত ভিত্তি তৈরী হবার পর থেকেই একমাত্র এই সংক্রান্ত দাবী দাওয়া উঠে এসেছে। আমরা আগেই আলোচনা করেছি যে ব্রিটিশ ভারতে যে অর্থনীতি গড়ে তোলা হয় তার প্রভাবেই নিম্ন জাতিবর্ণের একটি ক্ষুদ্র অংশ সহরে নানা ধরনের নিম্ন বেতনের পেশার সাথে যুক্ত হয় এবং কালক্রমে শিক্ষার সুযোগ কিছুটা কাজে লাগানোর ফলে তাদের মধ্যেও অপেক্ষাকৃত ছোট একটি মধ্যবিত্তশ্রেণি গড়ে ওঠে। আর স্বাভাবিক নিয়মেই এই মধ্যবিত্তশ্রেণির মানুষের মধ্যেও শিক্ষা ও সরকারী চাকুরীতে অংশ নেবার আকাঙ্খা গড়ে ওঠে। কিন্তু এইসব ক্ষেত্রগুলিতে উচ্চবর্ণের আধিপত্য এতটাই প্রবল ছিল যে তারা কিছুতেই এর ভাগ ছাড়তে প্রস্তুত ছিল না। এইরকম একটি অবস্থায় শিক্ষা ও সরকারী চাকুরীতে সংরক্ষণের দাবী নিম্নবর্ণ থেকে তৈরী হওয়া এই মধ্যবিত্তশ্রেণির আশা আকাঙ্খার প্রতিফলন।
এই বাস্তবতা চেপে গিয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা ও তার সহযোগী শাসকেরা বোঝাতে চায় যে সংরক্ষণের উদ্দেশ্য দরিদ্র মানুষদের সাহায্য করা কিন্তু বাস্তবে নিম্নবর্ণের অপেক্ষাকৃত সচ্ছল অংশের লোকেরাই এই সুযোগ নিয়ে নিচ্ছে। এর মধ্যে দিয়ে ভুলিয়ে দেবার চেষ্টা করা হয় যে সরকারী চাকুরী পেতে গেলে বা উচ্চশিক্ষায় যুক্ত হতে গেলে ন্যূনতম কিছু যোগ্যতা অর্জন করতে হয় এবং নিম্ন জাতিবর্ণের ক্ষেতমজুর, ভূমিহীন কৃষকের মত দরিদ্র মানুষেরা সেই যোগ্যতা অর্জনের সুযোগ পায় না। তাই সংরক্ষণের সুযোগ গ্রহণ করার মত অবস্থায় থাকে নিম্ন জাতিবর্ণভূক্ত মধ্যবিত্ত মানুষ। আর ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তি চালাকী করে দরিদ্র মানুষের কথা সামনে রেখে আসলে সংরক্ষণ প্রথাকেই অকার্যকরী করবার অপচেষ্টা চালায়।
মনে রাখা দরকার যে সংরক্ষণের উদ্দেশ্য হচ্ছে শিক্ষা চাকুরী সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিম্ন জাতিবর্ণের মানুষের জনসংখ্যার অনুপাতে প্রতিনিধিত্ব ঘটানো, এর উদ্দেশ্য দারিদ্র্য মোচন নয় এবং এভাবে দারিদ্র্য মোচনের কথা ভাবাও হাস্যকর। দারিদ্র্য মোচনের জন্য রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে শ্রমিকশ্রেণির রাজ গড়ে তুলতে হয়, উৎপাদনের উপায়ের উপর ব্যক্তিমালিকানার উচ্ছেদ ঘটিয়ে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হয়। খালি তাই নয়, কেবল সংরক্ষণের মধ্যে দিয়ে জাতিবর্ণ প্রথা বিলুপ্তও হয় না, কিন্তু জন্ম দিয়ে পেশা নির্ধারণ হবার প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শটি অপেক্ষাকৃত দুর্বল হয় এবং নিম্ন জাতিবর্ণের মানুষের আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার আকাঙ্খা গড়ে ওঠে।
সংরক্ষণের কথা উঠলেই মেধার বিষয়টি সামনে চলে আসে। এটা আমাদের কীভাবে দেখা উচিত?
বর্তমানে ভারতীয় সমাজে নিশ্চয়ই আইন করে নিম্নবর্ণের মানুষদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা হয় না। নিম্ন জাতিবর্ণের মানুষ, আদিবাসী, মুসলিম ও খ্রীশ্চান দলিতদের একসাথে ধরলে তারা দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশেরও বেশি। তা সত্ত্বেও উচ্চশিক্ষা, উচ্চপদের চাকুরী, উচ্চপদস্থ আমলা, ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার ইত্যাদি পেশাগুলিতে এই অংশের মানুষদের প্রায় খুঁজে পাওয়া যায় না কেন? তাহলে সংরক্ষণ বিরোধী তথাকথিত মেধাবীদের যুক্তিতে বলতে হয় যে এই বিশাল অংশের মানুষের মেধা নেই। কিন্তু কেন এমনটা হল? এই অবস্থা দুটি কারণে হতে পারে;
ক) নিম্ন জাতিবর্ণের মানুষের সাথে উচ্চবর্ণের মানুষের বায়োলজিক্যাল (মস্তিষ্কের গঠনগত বা জিনগত) পার্থক্য আছে যার ফলে নিম্নবর্ণের মানুষের মেধা প্রকৃতিগতভাবেই কম থাকে। হয় নিম্নবর্ণের মানুষের মস্তিষ্ক সেভাবে বিকশিত হয় নি অথবা তাদের জিনগত সমস্যা আছে।
খ) প্রশ্নটি মেধার নয়, আসলে মেধা বলতে যা বলা হয় সেটি অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত সুযোগ সুবিধা থেকে নিম্নবর্ণের মানুষকে দীর্ঘকাল বঞ্চিত রাখা হয়েছে। আর এই বঞ্চনাকে যুক্তিসম্মত করতে ধর্ম, কর্মফল সহ আরোও নানা ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতিকে শক্তিশালী করা হয়েছে যাতে নিম্নবর্ণের মানুষের কাছে জাতিবর্ণভেদের বিষয়টি একটি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়ম বলে মনে হয়।
বিজ্ঞানের কোন রকম অনুমোদন না থাকা সত্ত্বেও যারা প্রথমটিকে সত্য বলে মনে করেন তাদের কাছে অবশ্যই সংরক্ষণের কোন যৌক্তিকতা থাকতে পারে না কারণ যেহেতু জাতিবর্ণগত পার্থক্য প্রকৃতিগত বিষয়, সংরক্ষণ চালু করে এই পার্থক্য দূর করা যাবে না। আর দ্বিতীয়টি যদি সত্য হয় (সেটাই আসলে জাতি-বর্ণ প্রথার ইতিহাস) তাহলে নিশ্চয়ই এই প্রথাকে ঘোচাতে নিম্নবর্ণের মানুষের অধিকার অর্জনের লড়াই জারী থাকবে আর প্রতিটি গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষকে এই লড়াইয়ের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাই এটা ঠিক যে সংরক্ষণের পক্ষে লড়াই নিম্নবর্ণভূক্ত অপেক্ষাকৃত সচ্ছল মধ্যবিত্তশ্রেণির স্বার্থের পক্ষে লড়াই, কিন্তু জাতিভেদ প্রথার অস্তিত্বের কারণে এই লড়াই নিম্নবর্ণের মানুষের সামগ্রিক গণতান্ত্রিক লড়াইয়েরও অংশ কারণ এই লড়াই নিম্নবর্ণের মানুষের মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরী করতে ও সামাজিক মর্যাদার জন্য তাদের সংগ্রামকে বিকশিত করতে সাহায্য করে।
অর্থনৈতিক মানদন্ডের নিরিখে সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু করার দাবী কি সঠিক?
অনেকের মুখেই শোনা যায় যে সংরক্ষণ ব্যবস্থা যদি রাখতেই হয় তবে তা অর্থনৈতিক মানদন্ডের ভিত্তিতে হওয়া উচিত। এই রাজ্যের শাসকের অংশ হয়ে ওঠা মার্কসবাদীদের মুখেও এরকম কথা শোনা যেত। আমরা যা আগেই বলেছি যে এই বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে আসলে সংরক্ষণকে কৌশলে দারিদ্র্য দূরীকরণ কর্মসূচী হিসাবে হাজির করা হচ্ছে যা আদৌ ঠিক নয়। যে কোন শ্রেণি সমাজেই দারিদ্র্য থাকে কারণ শ্রেণি সমাজের উৎপাদন সম্পর্ক এমনই যে সমাজে শোষিতশ্রেণি কর্তৃক সৃষ্ট সম্পদ স্থায়ীভাবে শোষকশ্রেণির কুক্ষিগত হয়ে থাকে এবং তার ফলে তা অসাম্যকে ক্রমাগত পুনরুৎপাদিত করে চলে। এই সামাজিক সম্পর্ককে না ভেঙে শোষিত মানুষদের একটি অংশকে কিছু সাহায্য করলে তা কিছুতেই অসাম্যের উৎসকে নিশ্চিহ্ন করতে পারে না। তাই সমাজে দারিদ্র্যের অবসান ঘটাতে গেলে পুঁজিতন্ত্র সহ সমস্ত শোষণমূলক সম্পর্ক উচ্ছেদ করে তার স্থলে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করতে হয় যা উৎপাদনের উপায়গুলির উপর ব্যক্তিমালিকানার অবসান ঘটিয়ে দারিদ্র্য অবসানের দিকে এগিয়ে যাবার সূচনা ঘটায়।
সংরক্ষণ প্রথা হচ্ছে এমন একটি প্রথা যার লক্ষ্য সীমিত। আমরা আগেই আলোচনা করেছি যে ভারতীয় অঞ্চলে যে জাতিবর্ণ ব্যবস্থার উদ্ভব হয় তা শ্রেণি ব্যবস্থার পাশাপাশি অন্য কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট বহন করে এবং সেগুলি তার দীর্ঘ অস্তিত্বের মধ্যে দিয়ে অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানুষের মননক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। আর তাই আজও পারিবারিক উপার্জনের ভিত্তিতে অর্থনৈতিকভাবে একই অবস্থানে থাকা একটি উচ্চবর্ণীয় পরিবার ও একটি নিম্নবর্ণীয় পরিবার সামাজিকভাবে আসলে একই রকম সুযোগ সুবিধা ভোগ করে না এবং এই পার্থক্য বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে দিয়ে প্রতি মুহুর্তে প্রতিফলিত হয়। এই কারণেই নিম্ন জাতিবর্ণের এমনকি মধ্যবিত্ত বা অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল অংশের মানুষও সমাজের বিভিন্ন সম্মানজনক পেশাগুলিতে সহজে অংশগ্রহণের সুযোগ পায় না, কারণ এইসব ক্ষেত্রগুলিতে উচ্চবর্ণের প্রবল আধিপত্য বজায় থাকে এবং জাতিবর্ণ প্রথার মতাদর্শের শক্তিশালী অস্তিত্বের কারণে নিম্নজাতির মানুষের সেখানে সুযোগ পাওয়া অসম্ভব হয়ে ওঠে। তাই অর্থনৈতিক মানদন্ডের কথা বলার অর্থ হল নিম্ন জাতিবর্ণভূক্ত মানুষের যে অংশটি খানিকটা অর্থনৈতিক সচ্ছলতার কারণে শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করে সংরক্ষণের সুবিধা গ্রহণ করতে সক্ষম হয়ে উঠেছে তাদেরকে বঞ্চিত করা। এটা কে না জানে যে নিম্নবর্ণের ক্ষেতমজুর বা গরীব কৃষকের ঘরের ছেলেমেয়েরা সাধারণভাবে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সহ উচ্চ পেশার চাকরীতে আবেদন করবার যোগ্যতাই অর্জন করবার সুযোগ পায় না। এমনিতেই ব্রাহ্মণ্যবাদী কলাকৌশলের ফলে উচ্চ পেশায় সংরক্ষিত পদগুলির একটি বড় অংশ খালি পড়ে থাকে, সেখানে অর্থনৈতিক মানদন্ডের কথা বলার অর্থ হল যেটুকু সংরক্ষিত পদ পূরণ হয় সেটাও বন্ধ করা বা সেগুলিকে উচ্চবর্ণের হাতে তুলে দেওয়া।
জাতিবর্ণ প্রথার বিরুদ্ধে লড়াই কী উচ্চবর্ণের বিরুদ্ধে নিম্নবর্ণের মানুষের লড়াই?
প্রথমতঃ জাতিবর্ণ প্রথা যেমন ভারতীয় অঞ্চলের একটি বিশেষ সামাজিক কাঠামো তেমনি তা একটি প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শ যা সমাজকে দুর্বল করে, পিছিয়ে রাখে। তাই এখানকার যে কোন প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক সংগ্রামের লক্ষ্যবস্তু হল জাতিবর্ণ ব্যবস্থা। প্রাচীনকালে যখন জাতিবর্ণ ব্যবস্থা ও শ্রেণি ব্যবস্থা প্রায় সমার্থক ছিল তখন উচ্চবর্ণের বিরুদ্ধে নিম্ন জাতিবর্ণের মানুষের সংগ্রাম শ্রেণিসংগ্রামের রূপ পরিগ্রহণ করতো। কিন্তু জাতিবর্ণ ব্যবস্থা বিভিন্ন সময়ে নানা পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে, কখনো শূদ্রজাতির কোন কোন অংশ কোন কোন অঞ্চলে সামাজিক প্রাধান্যে চলে এসেছে, কোথাও কোথাও তাদের নেতৃত্বে রাজত্ব গড়ে উঠেছে এবং পরবর্তীকালে বিশেষতঃ ব্রিটিশ আমলে অর্থনীতির ক্ষেত্রটি এমন কিছু পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে যার ফলে বিশেষতঃ কৃষিক্ষেত্রে কয়েকটি শূদ্রজাতিও বিভিন্ন অঞ্চলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রাধান্যে চলে আসে। বর্তমানে বেশ কিছু জায়গায় শূদ্রজাতির এই উপরের অংশগুলি অতিশূদ্র তথা দলিত ও আদিবাসী মানুষের উপর নিপীড়ণকারী হয়ে উঠেছে। অপরদিকে এই ব্যবস্থাতে উচ্চবর্ণের একটি অংশ শোষণ ও শাসনে যুক্ত থাকলেও সমস্ত উচ্চবর্ণের মানুষ নিপীড়ক নয়, বরং আজকের অর্থনীতিতে তাদের মধ্যেকার একটি বড় অংশও দারিদ্র্য, বেকারত্ব, ছাঁটাই ও অর্থনৈতিক মন্দার শিকার। তাই আজকের জাতিবর্ণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম মর্মবস্তুর দিকে থেকে ক্ষমতাসীন শাসক শোষক যারা কিনা জনগণকে বিভক্ত করতে ব্রাহ্মণ্যবাদী মতাদর্শকে কাজে লাগায় তাদের বিরুদ্ধে সমস্ত বর্ণের শ্রমজীবি মানুষের সংগ্রাম এবং তা ভারতে চলমান গণতান্ত্রিক সংগ্রামেরই অংশ।
ভারত যেহেতু একটি পশ্চাদপদ এবং অসম বিকাশের দেশ, অর্থনীতির কোন গতিশীলতা নেই, শিল্প পুঁজি, ব্যাঙ্ক পুঁজি এবং বাজার কয়েকটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী যথা পার্সী, মাড়োয়ারী ইত্যাদিদের হাতে কুক্ষিগত রয়েছে, বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলির উচ্চপদগুলিতে বিনিয়োগ হয় বিভিন্ন আত্মীয়তা ও গোষ্ঠীগত সম্পর্কের ভিত্তিতে তাই এখানে সরকারী চাকুরীই মধ্যবিত্ত মানুষের স্বচ্ছন্দ জীবন যাপনের জন্য কিছুটা সুযোগ করে দেয়। খুব স্বাভাবিকভাবেই দলিত ও অন্যান্য নিম্নবর্ণের শিক্ষিত মানুষেরা মধ্যবিত্ত জীবন যাপনের লক্ষ্যে সরকারী চাকুরীর প্রতি বিশেষ আকর্ষণ অনুভব করে। অপরদিকে বিশেষতঃ নয়া অর্থনীতির জমানায় সরকারী ক্ষেত্রগুলি ক্রমাগত সঙ্কুচিত হয়ে চলেছে যার ফলে উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণ তথা সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যেই শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা অভূতপূর্বভাবে বেড়ে চলেছে। আর এইরকম একটি অবস্থায় সরকারী চাকুরী ও শিক্ষাক্ষেত্রে সংরক্ষণ প্রথা বিশেষ দ্বন্দ্বের জন্ম দিয়েছে। যদিও বিষয়টি জনগণের মধ্যেকার একটি অবৈরীমূলক দ্বন্দ্ব কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তা বৈরীমূলক রূপ ধারণ করেছে। সংরক্ষণকে ঘিরে নানা ধরনের জাতিবিদ্বেষ, হানাহানি ও নিম্নবর্ণের মানুষের উপর আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকদের একটি অংশ এগুলিকে বরাবরই মদত করে থাকে। অন্যদিকে নিম্নবর্ণের একটি সুবিধাভোগী অংশও নিজেদের রাজনৈতিক ক্ষমতার আকাঙ্খা পূরণ করতে উচ্চবর্ণের সমস্ত মানুষকে শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করতে চেষ্টা করে। এ দুটিই প্রতিক্রিয়াশীল ও তা আসলে জনগণকে বিভক্ত রাখার বর্ণবাদী নীতিকে সেবা করে। এটা ঠিক যে নিম্ন জাতিবর্ণের মানুষেরা যেহেতু সর্বাধিক শোষিত ও নিপীড়িত তাই তারাই জাতিবর্ণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রামে প্রধান শক্তি কিন্তু এই ব্যবস্থাকে নিশ্চিহ্ন করতে হলে এই প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শের বিরুদ্ধে সমস্ত বর্ণের ও স্তরের শ্রমজীবি মানুষের সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে।
ভারতবর্ষে সংরক্ষণ ব্যবস্থা কবে প্রচলিত হয় ও তার সাংবিধানিক রূপ কেমন?
১৮৪৮ সাল থেকে মহারাষ্ট্রে মহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলে ভাগীদার বা সাম্যবাদী সংরক্ষনের পক্ষে সংগ্রাম চালান আর সেই অর্থে তাকেই সংরক্ষণ প্রথার জনক বলা যায়। আই ধরনের আন্দোলন ক্রমে ক্রমে দক্ষিণ ভারতে ছড়িয়ে পড়ে যা পরবর্তীতে অব্রাহ্মণ, অনার্য ও দ্রাবিড়দের ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের রূপ নেয়। দক্ষিণ ভারতে এই আন্দোলন পেরিয়ার আন্দোলন নামে পরিচিত। পরবর্তীতে তামিলনাড়ুতে যে ৬৯ শতাংশ সংরক্ষণ চালু হয় এটা এই আন্দোলনেরই ফসল। এছাড়া বিংশ শতকের গোড়াতেই তথা ১৯০২ সালে কোলাপুর রাজ্যের ছত্রপতি শাহু মহারাজ অনগ্রসর বর্ণের মানুষের জন্য সরকারী চাকুরীতে ৫০ শতাংশ আসন সংরক্ষণ বাধ্যতামূলকভাবে চালু করে।
শিক্ষা, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পেশাগত অবস্থানের ভিত্তিতে যে কয়েকটি জাতিবর্ণের সম্প্রদায়কে সংবিধানের ৩৪১ নং ধারায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে তাদের অনুসূচিত বা তপশিলী জাতি (Scheduled Castes) হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর যাদের ৩৪২ নং ধারায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে তাদের তপশিলী উপজাতি (Scheduled Tribes) হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সংবিধানগতভাবে চাকুরী, শিক্ষা ও শাসনবিভাগে সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু হয় ১৯৪৭ সাল থেকে যদিও তপশিলী জাতির জন্য সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত সরকারীভাবে গ্রহণ করা হয় ১৯৪৩ সালে। এই কৃতিত্বের দাবীদার ডঃ বাবাসাহেব আম্বেদকর।
ভারতীয় সংবিধানের ১৬(৪) ধারায় সরকারী চাকুরীতে রাজ্যের তপশিলী জাতি ও উপজাতির জনসংখ্যার অনুপাতে সরকারী চাকুরীতে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। ১৬(৪ক) ধারায় সরকারী চাকুরীতে পদোন্নতির কথা বলা হয়েছে ও তার সাথে সাথে শিক্ষা, অর্থনৈতিক উন্নতি ও সামাজিক নিরাপত্তার প্রতি যত্ন নেবার কথা বলা হয়েছে।
সংরক্ষণের বর্তমান রূপঃ
সর্বভারতীয় ক্ষেত্র
তপশিলী জাতি্র জন্য ————১৫%
তপশিলী উপজাতির জন্য ———–৭.৫%
অন্যান্য পশ্চাদপদ জাতির জন্য——–২৭%
পশ্চিমবঙ্গ
তপশিলী জাতির জন্য ————২২%
তপশিলী উপজাতির জন্য ———-৬%
অন্যান্য পশ্চাদপদ জাতির জন্য——–৭%
মন্ডল কমিশন কী?
আমরা সংরক্ষণের যে চিত্র আগের প্রশ্নের উত্তরে তুলে ধরেছি তাতে অন্যান্য পশ্চাদপদ জাতির জন্য যে সংরক্ষণ রয়েছে তা আগে ছিল না। ভারতীয় সংবিধানের ৩৪০ নং ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রয়োজনে ভারতের সামাজিক ও শিক্ষাগত দিক থেকে পশ্চাদপদ শ্রেণিগুলির অবস্থা ও সমস্যা নিয়ে অনুসন্ধান করা ও সেগুলি দূর করতে সুপারিশ করার উদ্দেশ্যে যোগ্য লোকেদের নিয়ে কমিশন গঠন করতে পারে। ১৯৫৩ সালে এই লক্ষ্যে প্রথম কমিশন গঠিত হয় যার নেতৃত্বে ছিলেন কাকাসাহেব কালেল্‌কর। ১৯৫৬ সালে এই কমিশনের রিপোর্ট লোকসভায় পেশ হলে সেইসময় কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চাদপদ শ্রেণিগুলির চিহ্নিতকরণ ও তাদের জন্য সংরক্ষণ সম্পর্কিত বিষয়ে এই কমিশন যেসব সুপারিশ করে তা গ্রহণ করে নি। সরকারের বক্তব্য ছিল, “এটা অস্বীকার করা যায় না যে জাতিভেদ ভারতের সমাজ জীবনে সমতা স্থাপনের পথে প্রধান বাঁধা। কাকা কালেল্‌কর কমিশনের রিপোর্টে উল্লিখিত জাতিগুলিকে ‘পশ্চাদপদ’ স্বীকৃতি দিলে তা জাতি-বৈষম্য বজায় রাখবে ও স্থায়ী করবে।” এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬১ সালে কেন্দ্রীয় সরকার জানায় যে রাজ্য সরকারগুলি তাদের নিজেদের রাজ্যের জন্য তারা ‘অন্যান্য পশ্চাদপদ শ্রেণি’-র তালিকা প্রস্তুত করতে পারে ও সেই অনুযায়ী তাদের রাজ্যে সংরক্ষণ চালু করতে পারে।
এরপর আবার মোরারজী সরকার ১৯৭৮ সালে আর একটি কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৭৯ সালে বি.পি.মন্ডলের নেতৃত্বে এই কমিশন গঠিত হয় এবং এই মন্ডল কমিশন ১৯৮০ সালে তার রিপোর্ট পেশ করে। এই কমিশনের রিপোর্টের মর্মার্থ হচ্ছে তপশিলী জাতি ও উপজাতিদের বাদ দেবার পরেও এ দেশের ৫২% মানুষ অন্যান্য পিছিয়ে পড়া শ্রেণিগুলির মধ্যে পড়ে। এই পিছিয়ে পড়া জাতিগুলিকে চিহ্নিত করা হয়েছে সামাজিক, শিক্ষাগত ও অর্থনৈতিক মানদন্ডের উপর নির্ভর করে। মন্ডল কমিশনের রিপোর্টেই প্রথম সামাজিক অনগ্রসরতা নির্ণয়ে অর্থনৈতিক বা শ্রেণিগত কারণ অপেক্ষা জাতিবর্ণগত বৈশিষ্টের উপর বেশি জোর দেওয়া হয়। অনগ্রসরতা নিরুপণের জন্য এই কমিশন ৪টি সামাজিক, ৩টি শিক্ষাগত ও ৪টি অর্থনৈতিক কারণকে পশ্চাদপদতা নির্ণয়ের নির্ধারক হিসাবে গ্রহণ করে। সামাজিক সূচকগুলি এইরকমঃ
যে সমস্ত জাতিগুলি (Castes)
১) অন্যদের দ্বারা সামাজিক অনগ্রসর বলে গণ্য হয়।
২) জীবন ধারণের জন্য মূলতঃ কায়িক শ্রমের উপর নির্ভরশীল।
৩)যাদের মধ্যে গ্রামাঞ্চলে ১৭ বছরের কম বয়সে বিয়ে হওয়া মেয়েদের সংখ্যা রাজ্যের গড় হারের চেয়ে অন্ততঃ ২৫% বেশি ইত্যাদি।
একইরকমভাবে শিক্ষাগত সূচকের একটি উদাহরণ হল যে সমস্ত জাতির মধ্যে ৫ থেকে ১৫ বছর বয়সের মধ্যে ছেলেমেয়েরা কখনই স্কুলে যায়নি এরকম ছেলে মেয়েদের সংখ্যা রাজ্যগত গড়ের থেকে অন্ততঃ ২৫% বেশি। অর্থনৈতিক সূচকের একটি উদাহরণ হল যে সমস্ত জাতির গড় পারিবারিক সম্পত্তি রাজ্যের গড়ের অন্ততঃ ২৫% নীচে।
সামাজিক প্রতিটি সূচকগুলির জন্য ৩, শিক্ষাগত সূচকের জন্য ২ এবং অর্থনৈতিক সূচকের জন্য ১ পয়েন্ট ধার্য করে সেগুলি সমস্ত জাতিবর্ণের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়। যে সমস্ত জাতিগুলি ২২ পয়েন্টের মধ্যে ১১ পয়েন্টের বেশি পায় তারাই মন্ডল কমিশন কর্তৃক অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির (Other Backward Castes) তালিকাভূক্ত হয়।
জাতিবর্ণ ব্যবস্থার মর্মবস্তু বুঝতে মন্ডল কমিশনের নিম্নোক্ত বক্তব্যটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ; “জাতিবর্ণগত ব্যবস্থার সর্বব্যাপী প্রাধান্যই নিম্নবর্ণের মানুষকে সামাজিকভাবে পশ্চাদপদ ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করেছে। তাদের দারিদ্র্যের কারণ হল সামাজিক বৈষম্য, দারিদ্র্যের কারণে তারা পশ্চাদপদ হয়নি। ঐতিহাসিক ও সামাজিক ব্যাখ্যার এই পরিপ্রেক্ষিতে এই মতকে সমর্থন করা যায় না যে দারিদ্র্যের কারণেই মূলতঃ সামাজিক পশ্চাদপদতা এসেছে। বাস্তবত এর উল্টোটাই সত্য।” প্রসঙ্গত গত শতকের ষাটের দশকে মহীশূর রাজ্যে সংরক্ষণের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টে যে মামলা (বালাজী মামলা) হয় তার পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রীম কোর্টের বক্তব্য ছিল এর ঠিক বিপরীত; “শেষ বিচারে সামাজিক পশ্চাদপদতা অনেকাংশেই দারিদ্র্যের ফল। যে শ্রেণির নাগরিকরা অত্যন্ত গরীব তারা স্বাভাবিকভাবেই সামাজিক ক্ষেত্রে পশ্চাদপদ হয়ে পড়ে।”
মন্ডল কমিশনের রিপোর্টে সামাজিক, শিক্ষাগত ও অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর ভারতীয় জনগণকে তপশিলী জাতি (১৫.%), তপশিলী উপজাতি (৭.৫%) এবং অন্যান্য হিন্দু (৪৩.৭০%) ও অহিন্দু (৮.৪০%) অনগ্রসর শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে যেখানে এই অন্যান্য অনগ্রসর জাতি মোট জনসংখ্যার ৫২%। এই হিসাব অনুযায়ী তপশিলী জাতি, উপজাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর জাতির মানুষেরাই দেশের মোট জনগণের ৭০ শতাংশের চেয়েও বেশি। এরাই প্রাচীন শাস্ত্রে বর্ণিত শূদ্র ও অতিশূদ্র জাতির মানুষ। মন্ডল কমিশন রিপোর্টে আরও দেখা যায় যে সরকারী প্রথম শ্রেণির কর্মচারীর মাত্র ৫.৬৮% তপশিলী জাতি ও উপজাতি এবং ৪.৬৯% অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি। দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মচারীর ক্ষেত্রে এই হিসাবটি যথাক্রমে ১৮.১৮% এবং ১০.৬৩%।
মন্ডল কমিশনের সুপারিশগুলি কী?
১) সমস্ত কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারী চাকুরীতে এবং ডাক্তারী, ইঞ্জিনীয়ারিং ইত্যাদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে তপশিলী জাতির জন্য ১৫%, তপশিলী আদিবাসীদের জন্য ৭৫% এবং অন্যান্য পশ্চাদপদ জাতির জন্য ২৭% আসন সংরক্ষণ করতে হবে। ৫২% মানুষের জন্য কেন ২৭% সংরক্ষণ? এক্ষেত্রে মন্ডল কমিশন সুপ্রীম কোর্টের একটি রায়কে মেনে সংরক্ষণকে সঙ্কুচিত করে। প্রসঙ্গত সংরক্ষণের সর্বোচ্চ সীমা সম্পর্কে সংবিধানে কিছু বলা না থাকলেও সুপ্রীম কোর্টের এই রায়ে বলা হয়েছিল যে মোট সংরক্ষণ ৫০% অতিক্রম করবে না।
২) যেসব এলাকায় অন্যান্য পশ্চাদপদ জাতির মানুষেরা কেন্দ্রীভূত রয়েছে সেইসব এলাকায় এই অংশের ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মসূচী এবং পেশাগত শিক্ষার উপর বিশেষ জোর দিতে হবে।
৩) গ্রামীণ হস্তশিল্পীদের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং ভর্তুকী সহ ব্যাঙ্ক ঋণের ব্যবস্থা করা।
৪) সমস্ত রাজ্যে আমূল ভূমি সংস্কারের উপর জোর দেওয়া।
সংরক্ষণ ভারতে কতটা কার্যকরী হয়েছে?
ভারতবর্ষে গত শতকের ৪০’র দশক থেকে সংরক্ষণ চালু থাকলেও তা সামান্যই কার্যকরী হয়েছে কিন্তু উল্টোদিকে সংরক্ষণের আওতাভূক্ত জাতিবর্ণের মানুষের প্রতি ঘৃণা তৈরী করা হয়েছে ব্যাপকভাবে। ব্রিটিশ আমলের জমিদার, জোতদার, আমলাতন্ত্র, কেরানিকূল ও শিক্ষাব্যবস্থার সাথে যুক্ত মানুষের প্রায় গোটা অংশটাই উচ্চবর্ণের হওয়ার ফলে গোটা শাসন কাঠামো জুড়ে একটি অত্যন্ত শক্তিশালী ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতি চালু রয়েছে যার ফলস্বরূপ সংরক্ষণ প্রথাকে পিছিয়ে পড়া জাতি ও আদিবাসী মানুষের অধিকারের বদলে অনেকটা ভিক্ষার দান হিসাবে দেখানো হয়। সরকার ও প্রশাসনে যুক্ত সংখ্যাগুরু উচ্চবর্ণীয় সম্প্রদায়ের ব্রাহ্মণ্যবাদী মতাদর্শে আচ্ছন্ন ব্যক্তিবর্গ যেহেতু জাতিবর্ণ ব্যবস্থা বজায় রাখার পক্ষে তাই সংবিধানে স্বীকৃত হলেও তারা নানা উপায়ে সংরক্ষণ প্রথাকে অকার্যকরী করতে চেষ্টা করে এবং কখনই সরকারের পক্ষ থেকে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা বৈজ্ঞানিকভাবে তুলে ধরা হয় না। এরকম একটি পরিস্থিতিতে নিম্ন জাতিবর্ণভূক্ত গোষ্ঠীর বেশিরভাগ সদস্যরা নিজেদের পরিচয়পত্র নিতে এবং সংরক্ষণের সুযোগ নিতে সঙ্কুচিত বোধ করে। আবার অনেকে সংরক্ষণের সুযোগ নিলেও সেটিকে প্রকাশ্যে সমর্থন করতে দ্বিধাবোধ করে। আর এইরকম একটি সংরক্ষণ বিরোধী সংস্কৃতি বজায় থাকবার কারণে সরকারী বিভিন্ন দপ্তরের নিয়োগকারী কর্তাব্যক্তির তপশিলী জাতি ও উপজাতিদের নিয়োগের ক্ষেত্রে ন্যূনতম যোগ্যতার বদলে নিজেদের মনোমত যোগ্যতার মাপকাঠি তৈরী করে আর তার ফলে অনেক ক্ষেত্রেই সংরক্ষিত পদগুলি পূরণ হয় না বা সামান্য কিছু পূরণ করে বাকী পদগুলিকে অসংরক্ষিত করবার চেষ্টা করা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে যে সংরক্ষণ কিছুটা কার্যকরী হয়েছে তার কারণ হল সেইসব ক্ষেত্রে তপশিলী জাতি, উপজাতির মানুষেরা নিজেদের অধিকার আদায়ের পক্ষে আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। আজও ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতি এতটাই শক্তিশালী যে অফিস, আদালত, স্কুল, কলেজে সংরক্ষণপ্রাপ্ত মানুষদের প্রতি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ঘৃণা প্রদর্শন একটি স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। নানা ধরনের অপকৌশল করে নিম্নবর্ণের মানুষদের সংরক্ষণ থেকে বঞ্চিতই করা হয় না, সরকারী প্রকল্পের রূপায়নের ধরন, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌগলিক অবস্থান, ইংরাজী ভাষা নির্ভর সংস্কৃতি ইত্যাদি সবকিছুই থাকে নিম্নবর্ণের মানুষের স্বার্থের প্রতিকূলে।
সংরক্ষণ কতটা কার্যকরী হয়েছে তার নির্দিষ্ট সরকারী হিসাব পাওয়া খুব সহজ নয়। তাই আমরা বিভিন্ন সূত্রে বিভিন্ন সময়ে পাওয়া তথ্যগুলির ভিত্তিতে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করব। এ ব্যাপারে ১৯৯০ সালে খুশবন্ত সিং ‘ব্রাহ্মণ শক্তি’-র উদাহরণ তুলে ধরতে গিয়ে দেখিয়েছেন;
“আমাদের দেশে ব্রাহ্মণরা জনসংখ্যার ৫.৫ শতাংশের বেশি নয়। অথচ বর্তমানে তারা সরকারী চাকরীর ৭০% দখল করে আছে। সরকারী সহ সচিবের মত ৫০০ উঁচুপদে ব্রাহ্মণবর্ণের মানুষ আছেন ৩১০ জন অর্থাৎ ৬৩%। ২৬ জন প্রধান সচিবের মধ্যে ১৯ জন ব্রাহ্মণ, ১৬ জন সুপ্রীমকোর্টের বিচারকের মধ্যে ৯ জন ব্রাহ্মণ, ৩৩০ জন হাইকোর্টের বিচারকদের মধ্যে ১৬৬ জন ব্রাহ্মণ, ১৪০ জন বৈদেশিক দূতের মধ্যে ৫৮ জন ব্রাহ্মণ, ৩,৩০০ জন আই. এ. এস. অফিসারদের মধ্যে ২,৩৭৬ জন ব্রাহ্মণ। ……… এটা কীভাবে হল আমার জানা নেই। কিন্তু এটা আমার পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন যে এটা ব্রাহ্মণদের উচ্চ মেধার জন্য সম্ভব হয়েছে।”
২৫ বছর পরে এই তথ্য আজকের জন্যও সত্যি হয়তো হবে না, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যে এটাই হচ্ছে জাতিবর্ণ ব্যবস্থার কাঠামো। এবার আমরা আরোও সাম্প্রতিককালের তথ্যে চলে আসি। ২০১১ সালে ১৫৪ জন সচিব স্তরের পদে একজনও তপশিলী জাতির লোক নেই, তপশিলী উপজাতির মাত্র চারজন আছে। আই. এ. এস., আই. পি. এস., আই. এফ. এস. পদে ১৩.৯% তপশিলী জাতি, ৭.৩% তপশিলী উপজাতি এবং ১২.৯% অন্যান্য অনগ্রসর জাতির প্রতিনিধিত্ব আছে। ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রীর অফিসের প্রতিনিধি হিসাবে ভি নারারনস্বামী লোকসভায় এই তথ্য দিয়েছিলেন। এছাড়াও তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী জানা যায় যে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রায় ৭৩টি দপ্তরে তপশিলী জাতির জন্য সংরক্ষিত ২৫০৩৭টি পদ নিয়োগ না হবার ফলে খালি পড়ে আছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই শূন্য পদগুলি পূরণ না করে সরকারী খরচ কমানোর নামে বর্তমানে এরকম অনেক পদ বিলুপ্ত করে দেওয়া হচ্ছে।
২০১১ সালে পয়লা জানুয়ারী কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী বিভিন্ন পদে তপশিলী জাতি, তপশিলী উপজাতি ও অন্যান্য পশ্চাদপদ জাতিগুলির প্রতিনিধিত্ব ১ নং সারণী থেকে পাওয়া যায়।
সারণী-১
১ নং সারণী থেকে পরিস্কার যে সংরক্ষণের ফলে সরকারী চাকুরীর ক্ষেত্রে তপশিলী জাতির কিছুটা হলেও প্রতিনিধিত্ব পাওয়া যায় কিন্তু অন্যান্য পশ্চাদপদ জাতিগুলি মোট জনসংখ্যার ৫২% হওয়া সত্ত্বেও তাদের প্রতিনিধিত্ব ভয়ানকভাবে কম।
শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা বিস্তৃত তথ্যের দিকে যাব না। ভারতের ১৫০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে যে সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপকদের মধ্যে মাত্র ১২% তপশিলী জাতি ও উপজাতি, ৬.৮% অন্যান্য পশ্চাদপদ জাতি এবং বাকীটা উচ্চবর্ণের মানুষ। তবে দিল্লীর যে জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রগতিশীল সমাজবিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদদের চারণক্ষেত্র বলা হয়ে থাকে সেখানে ২৭ বছর ধরে সংরক্ষণ চালু থাকার পরেও মোট অধ্যাপক পদের ৩.২৯% দলিত ও ১.৪৪% আদিবাসী। ২০১০ সালে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে কিছু অধ্যাপকের মত ছিল যে সংবিধান অনুযায়ী অধ্যাপকপদে নিয়োগ করলে এই বিশ্ববিদ্যালয় তার সুনাম হারাবে এবং উচ্চঘরের যোগ্য ছাত্ররা বিদেশের বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চলে যাবে এবং নিম্নবর্ণের ছাত্ররাও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্বমানের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে। জীব বিজ্ঞানের এক অধ্যাপক বি এন মল্লিক কোন লজ্জাবোধ না করে বলেছিলেন, “কিছু জাতি-বর্ণগত সম্প্রদায় জিনগতভাবে এতটাই দুর্বল যে তাদের সুযোগ দিয়ে প্রায় কোন লাভ হবে না। তা সত্ত্বেও তাদের যদি সুযোগ দেওয়া হয় তাহলে মেধা ও উৎকর্ষতার অবনমন ঘটবে।”
বেসরকারী ক্ষেত্রে সংরক্ষণ প্রথা নিয়ে যে বিতর্ক হচ্ছে সেটিকে আমাদের কীভাবে দেখা উচিত?
সম্প্রতি বেসরকারী বিভিন্ন সংস্থায় সংরক্ষণ চালু কর বিষয়টি সামনে এসেছে এবং এক্ষেত্রে বৃহৎ গণমাধ্যম, বৃহৎ শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী এবং ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকেরা এই সংরক্ষণের বিরোধিতায় ঝাপিয়ে পড়েছে। বিষয়টি সামনে আসার একটি বিশেষ কারণ হল সরকারী ক্ষেত্রটির ক্রমাগত সঙ্কুচিত হয়ে পড়া যার ফলে সংরক্ষণের ক্ষেত্রটিও ক্রমাগত সঙ্কুচিত হয়ে চলেছে এবং এইভাবে আন্তর্জাতিক পুঁজির বিশ্বায়নের কর্মসূচী প্রকারান্তরে ভারতের ব্রাহ্মণ্যবাদী কাঠামোটিকেই সহায়তা করছে। তবে এক্ষেত্রে বৃহৎ পুঁজির মালিকদের ভূমিকা বিশেষ উল্লেখ্য কারণ অতীতে অনেক দেশের পুঁজিপতিশ্রেণিই প্রাক্‌ পুঁজিবাদী বিভিন্ন অসাম্যের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়েছিল। আর আমাদের দেশে সেই পুঁজির মালিকরাই ব্রাহ্মণ্যবাদী মতাদর্শে নিমজ্জিত এমন একটি গোষ্ঠী যারা জাতিবর্ণ সহ সমস্ত ধরনের প্রাক্‌ পুঁজিবাদী অসাম্যকে টিকিয়ে রাখতে মরীয়া।
আর তাদের এই আচরনের উৎস লুকিয়ে রয়েছে তাদের জন্ম ও তাদের বিকাশের ইতিহাসের মধ্যে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি ও জাতিবর্ণ ভিত্তিক সামন্তবাদের বিরুদ্ধে কোন জাতীয় চেতনার উন্মেষের মধ্যে দিয়ে নয়, বরং এইসব প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সহায়তায় ভারতীয় বৃহৎ বুর্জোয়াশ্রেণির জন্ম হয়। এই শ্রেণি একদিকে যেমন ঔপনিবেশিক পুঁজি কর্তৃক লুন্ঠণকে সহায়তা করে তেমনি ঔপনিবেশিক শক্তিও এদের নানারকম রাষ্ট্রীয় সংরক্ষণ দেয় যার ফলে এরা দেশীয় বাজার কুক্ষিগত করে বেড়ে উঠবার সুযোগ পায়। এতে পুঁজি ও প্রযুক্তি সরবরাহ করে ব্রিটেনের শিল্পপতিরা বিপুল মুনাফা করে। বলা যায় যে জন্মকাল থেকেই এই বৃহৎ পুঁজির মালিকেরা ঔপনিবেশিক পুঁজির লুন্ঠণের বাহক হিসাবে কাজ করে চলেছে। বর্তমানেও এদের সেই চরিত্রের কোন গুণগত রূপান্তর হয় নি, পরিবর্তন যেটুকু তা হল আজ তারা আর কেবল ব্রিটিশ নয়, নানা সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির লুন্ঠণের বাহক হিসাবে কাজ করে। এর পাশাপাশি এরা শিল্পক্ষেত্রে একচেটিয়াভাবে রাষ্ট্রের কাছে সস্তায় বা বিনামূল্যে জমি, বিদ্যুৎ, জল, কর মকুব, ব্যাঙ্কলোন ইত্যাদি সমস্ত ক্ষেত্রে সুবিধা আদায় করে নেয়। আর এর ফলেই মূলতঃ পরিবার ভিত্তিক কুঠির বা ক্ষুদ্রশিল্প যা কিনা বহুল পরিমাণে কর্মসংস্থান ঘটায় এবং যেগুলিই সুযোগ পেলে সত্যিকারের জাতীয় পুঁজির বিকাশ ঘটাতে পারত তা সবসময় উপরোক্ত সমস্ত ক্ষেত্রে অবহেলার শিকার হয় এবং এই অবহেলা বিশ্বায়নের আবহে ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। যাইহোক বৃহৎ পুঁজির এই চরিত্র মাথায় রেখে এবার আমরা দেখি জাতিবর্ণগত বা সংরক্ষণ প্রশ্নে এদের মতামত কি রকম।
বেসরকারী সংস্থায় সংরক্ষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার আওয়াজ তুলেছে দি ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান চেম্বার অফ কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি (FICCI) এবং বাজাজ অটো-র চেয়ারম্যান রাহুল বাজাজ সেই প্রচারে নেতৃত্ব দিয়ে ২০০৪ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর টাইমস অফ ইন্ডিয়া-তে “Devoid of Merit: Reservations Will Kill Indian Private sector” শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লেখেন যাতে তিনি বলবার চেষ্টা করেন যে (ক) স্বাধীনতার সময় থেকে অনুসূচিত জাতি ও উপজাতির জন্য সংরক্ষণ চালু থাকায় সরকারী ও জাতীয় মালিকানাধীন সংস্থাগুলির বেহাল দশা হয়েছে। (খ) জাত পরিচয়ের ভিত্তিতে অনুসূচিত জাতি ও উপজাতিদের সংরক্ষণ দিলে তা হবে ব্যক্তিমালিকানাধীন সংস্থাগুলির আত্মহত্যার সামিল। মানসিক গড়নে বিদেশী একচেটিয়া পুঁজির একনিষ্ঠ সেবাদাস EXL Services-এর চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার বিক্রম তলোয়ার বলেছেন, “এটা পাগলামি। সমস্ত শিল্পই নর্দমায় নিক্ষিপ্ত হবে। আউটসোর্সিং ইন্ডাস্ট্রি চালানোর মাধ্যমে মাল্টি বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্যের স্বপ্ন, এসব এবার ভুলে যেতে হবে।”
রাহুল বাজাজ যা বলেছেন অর্থাৎ স্বাধীনতার সময় থেকে তপসিলি জাতি ও উপজাতির জন্য সংরক্ষণ চালু থাকায় সরকারী ও জাতীয় মালিকানাধীন সংস্থাগুলির বেহাল দশা হয়েছে-এটা শুনে বদ্ধ পাগলেরও হাসি পেয়ে যাবে। সরকারী ও জাতীয় মালিকানাধীন সংস্থাগুলির উচ্চ ও নীতি নির্ধারক পদগুলিতে কোন জাতিবর্ণের মানুষ আসীন থাকে সেটা এই অস্থি মজ্জায় ব্রাম্মণ্যবাদী বৃহৎ পুঁজিপতিকূল ভেবে দেখবার প্রয়োজনও বোধ করে না। তার জানা নেই যে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে সুপারভাইজরি পদে তপসিলি জাতির উপস্থিতি ২.৬ শতাংশ, আর তপসিলি উপজাতির মাত্র ১.১ শতাংশ।
তাই ব্রিটিশ শাসকদের নিয়ন্ত্রণে বেড়ে ওঠা ও সামন্তবাদের সাথে হাজারো বন্ধনে আবদ্ধ অসুস্থ ভারতীয় বৃহৎ পুঁজি আসলে দেশীয় স্বাধীন পুঁজিবাদের বিকাশের ক্ষেত্রেও সবচেয়ে বড় শত্রু। আর তা বারেবারে প্রমাণিত হয়েছে যেমন সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে, ভূমি সংস্কারের ক্ষেত্রে, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামের ক্ষেত্রে তেমনি জাতিবর্ণ প্রথা ভাঙার ক্ষেত্রে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই এদের ভূমিকা চরম প্রতিক্রিয়াশীল। ব্রাম্মণ্যবাদী মতাদর্শে নিমজ্জিত এইসব পুঁজিপতিদের এটুকুও বোঝার ক্ষমতা নেই যে তাদের প্রভু দেশ মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্রে কালো মানুষদের জন্য সংরক্ষণ কেবল সরকারী ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, তা সর্বত্র প্রসারিত। আসলে এদের বোঝার ক্ষমতা নেই বা বোঝার দরকার নেই যে সংরক্ষণের অর্থ মেধার অবনমন নয়, ঐতিহাসিক কারণে পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীর মধ্যে থাকা মেধাকে সামনে আনা যার মধ্যে দিয়ে শেষ বিচারে দেশের উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধি ঘটে, ক্রয়ক্ষমতার বৃদ্ধির মধ্যে দিয়ে বাজার আরো শক্তিশালী হয়, সমসত্ত্ব শ্রমের বাজার তৈরী হয় যা আবার বাজারের প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে পুঁজির সঞ্চয়নের বৃদ্ধি ঘটায়। দেশের পশ্চাদপদতা বজায় রেখে বিদেশী একচেটিয়া পুঁজির অতি মুনাফাকে নিশ্চিত করতে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ও শস্তা শ্রমের যে লুন্ঠণ চলে সেই লুন্ঠণকে জারী রাখা ও তার একটি ভাগ পেতেই যারা অভ্যস্ত সেই বৃহৎ পুঁজিপতিদের এমন জাতীয়তাবাদী ও দেশপ্রেমিক ভাবনা আসবে কোথা থেকে?
সংরক্ষণ যদি জাতিবর্ণ প্রথাকে দুর্বল করার একটি উপায় হিসাবে বিবেচিত হয় তাহলে এমন কোন কারণ থাকতে পারে না যার জন্য এই প্রথা সরকারী ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকতে হবে। বরং আইন করে সেটি সরকারী বেসরকারী সমস্ত ক্ষেত্রে প্রসারিত করা দরকার। কিন্তু এখানে বিষয়টি আলোচনা করা হল এটা বোঝার জন্য যে আমাদের দেশকে যারা নেতৃত্ব দেয় সেই বৃহৎ পুঁজিপতিশ্রেণি কীভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদী মতাদর্শে আকন্ঠ নিমজ্জিত এবং নিম্নবর্ণের শত্রু। তাই এদের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা থাকলে কখনই জাতিবর্ণ প্রথা দূর করবার কার্যকরী কর্মসূচী গৃহিত হবার সুযোগ নেই, এদের হাত থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতা কেড়ে নিয়েই একমাত্র সে ধরনের কর্মসূচীর রূপায়ন সম্ভব।
বলা হয় যে পশ্চিমবঙ্গে জাতিবর্ণ ব্যবস্থার সেভাবে অস্তিত্ব নেই। একথা কী ঠিক?
আসলে আমরা আগেই আলোচনা করেছি যে জাতিবর্ণ ব্যবস্থার অন্তর্বস্তু হচ্ছে জাতি পরিচয়ের ভিত্তিতে সামাজিক পেশা নির্ধারণ, আর অস্পৃশ্যতা, সবর্ণ বিবাহ, ধর্ম এগুলি হল এই ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করবার সাংস্কৃতিক হাতিয়ার। বামপন্থী সহ অনেক প্রগতিশীল মানুষ জাতিবর্ণ ব্যবস্থা বলতে অস্পৃশ্যতাকেই বোঝেন। বিভিন্ন ঐতিহাসিক কারণে ও পরবর্তীতে কৃষক আন্দোলন ও বামপন্থী আন্দোলনের প্রভাবে হিন্দী বলয়ের তুলনায় অস্পৃশ্যতার প্রভাব এই রাজ্যে দুর্বল যদিও অসবর্ণ বিবাহ খুব কম ক্ষেত্রেই ঘটে থাকে। অপরদিকে আমারা যদি পেশার ভিত্তিতে উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণের মানুষের অবস্থান বিবেচনা করি তাহলে দেখব যে সরকারী উচ্চ ও মাঝারী চাকুরী, ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার, বিচারক, অধ্যাপক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মী ইত্যাদি পেশাগুলির সুবিপুল সংখ্যাগরিষ্ট অংশ মূলতঃ ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও কায়স্থ এই তিনটি উচ্চবর্ণ থেকে আগত। অপরদিকে এরাজ্যে দক্ষিণ ভারতের মত নিম্নবর্ণের মানুষের বিশেষ কোন আন্দোলন না থাকায় ও সংসদীয় বামপন্থী পার্টিগুলির নেতৃত্বতে উচ্চবর্ণবাদী মানুষের শক্তিশালী প্রাধান্যের ফলে বাম ও দক্ষিণপন্থী যারাই ক্ষমতায় থাকুক না কেন রাজনীতিতে উচ্চবর্ণীয় শক্তিগুলিই নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ভোগ করে।
পশ্চিমবঙ্গের ডাক্তারী ইঞ্জিনীয়ারিং সহ সমস্ত উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রগুলিতে কর্তৃত্বে থাকা ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকেরা সংরক্ষণ নিয়ে সরকারী নীতিকে অগ্রাহ্য করেছে, নিজেদের মনোমত ন্যূনতম যোগ্যতা স্থির করে নির্বিচারে তপশিলী জাতি ও উপজাতির প্রার্থীদের বঞ্চিত করেছে। ফলে বর্তমানে এই রাজ্যে মানসিক শ্রম ও দৈহিক শ্রমের মধ্যে জাতিবর্ণগত পার্থক্য অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় সম্ভবত বেশি।
বিগত বাম আমলে এই শতকের প্রথম কয়েক বছরে সরকার চাকুরী ও শিক্ষাক্ষেত্রে সংরক্ষণের ব্যাপারে কয়েকটি উদ্বেগজনক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ১০৭৫টি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্কুল শিক্ষকের পদ অসংরক্ষিত করে দিয়ে সেখানে সাধারণ প্রার্থী নিয়োগ করা হয়েছে। ২০০১ সালে দেখা যায় যে তপশিলী আদিবাসীদের জন্য মেডিকেল শিক্ষায় সংরক্ষিত ৪৫টি আসনের মধ্যে মাত্র ৫টি পূরণ হয়েছে। ঐ সময়েই হাইকোর্টের বিচারপতি ডি পি কুন্ডু এই নির্দেশ জারী করেছিলেন যে বিভিন্ন কলেজগুলিতে শিক্ষকপদের জন্য সংরক্ষিত ৭০০টি আসনে যোগ্য প্রার্থী না মেলাতে সেগুলিতে সাধারণ প্রার্থীদের নিয়োগ করা যেতে পারে।
সেই সময় রাজ্যের উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী সুদর্শন রায়চৌধুরী জানিয়েছিলেন যে সংরক্ষণ নীতির ফলে অধ্যক্ষ ও অধ্যাপক পদে নিয়োগ আটকে যাচ্ছে। তার হিসাবে তৎকালীন সময়ে সরকারী কলেজে অধ্যক্ষ ও অধ্যাপক পদে যথাক্রমে ১১ ও ৩২৮টি সংরক্ষিত খালি পদ পড়ে আছে। বেসরকারী কলেজের জন্য এই হিসাবটি যথাক্রমে ৮৮ এবং ২১৬৬। ফলে ভবিষ্যতে এই পদগুলি আবার অসংরক্ষিত হতে চলেছে। মন্ত্রীমশাই জানিয়েছিলেন সংরক্ষিত পদে উপযুক্ত প্রার্থী পাওয়া যায় নি কিন্তু আমরা জানিনা যে এই সমস্ত পদে যে ন্যূনতম যোগ্যতা লাগে সেই যোগ্যতার তপশিলী জাতি ও উপজাতির প্রার্থী ছিল কিনা। এরকম অনেক উদাহরণ আছে যে তপশিলী জাতি ও উপজাতির প্রার্থীরা ডক্টরেট ডিগ্রি ও নেট পরীক্ষায় পাশ করা সত্ত্বেও বাঙালী ভদ্রবাবুদের ইন্টারভিউ বোর্ডে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারেনি। এ রাজ্যের অনেক তপশিলী শ্রেণিভূক্ত প্রার্থীদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে যে তাদের অনেকে যোগ্যতার মাপকাঠিতে উচ্চবর্ণীয়দের সমকক্ষ হলেও অনেক ক্ষেত্রে কেবল জাত পরিচয়ের ভিত্তিতেই তাদের বাদ দিয়ে দেওয়া হয়।
আসলে উচ্চবর্ণীয় বাঙালী ভদ্রবাবুরা সহজে সংরক্ষণ মেনে নেবেন তাতো হয় না। যেমন ভি পি সিং-এর সরকার ১৯৯০ সালে অন্যান্য পশ্চাদপদ জাতির জন্য সরকারী চাকুরীতে ২৭% সংরক্ষণ ঘোষণা করবার পর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বলে বসলেন যে এ রাজ্যে নাকি অন্যান্য পশ্চাদপদ জাতির অস্তিত্ব নেই। মন্ডল কমিশনের তালিকাতে যে পশ্চিমবঙ্গের গোয়ালা, বারুজীবী, আনসারী, অগ্রদানী, তেলি, নাপিত, তাঁতী, মাহিষ্য সহ ১৭৭টি জাতির উল্লেখ রয়েছে এবং সেই তালিকা যে একটি নির্দিষ্ট মানদন্ডের ভিত্তিতে করা হয়েছে তা জানা ও বোঝার কোন দায়িত্ব ওনার ছিল না। বুদ্ধবাবু কথায় কথায় বলতেন যে সংরক্ষণ চালু করে নিম্ন জাতিবর্ণের মানুষের উন্নতি করা যাবে না। যে সরকারের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তিরা এভাবে কথা বলে তারা যে হাজার হাজার শূন্যপদ পড়ে থাকলেও সংরক্ষণ কিছুতেই লাগু হতে দেবে না তাতে আর সন্দেহ কি! এদের ভাবটা এমন যে কিছু বর্গা রেকর্ড করে এরা ভূমি সংস্কারের কাজ শেষ করে দিয়েছেন, তাই এরাজ্যে আর চাকুরী ও শিক্ষাতে সংরক্ষণের দরকার নেই। তবে ক্যাপিটেশন ফী চালু করে ধনীবাবুদের ঘরের সন্তানদের জন্য সংরক্ষণ চালু করতে এরা বেশ উদ্যোগ নিয়েছিল।
অপরদিকে মন্ডল কমিশনের সুপারিশ লাগু হবার কথা ঘোষিত হবার পর দেশ জুড়ে যে সংরক্ষণ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয় এই রাজ্যও তার থেকে বাদ যায় নি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্ন মেডিকেল ও ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজের উচ্চবর্ণীয় ছাত্ররা জুতো পালিশ, লজেন্স বিক্রি ইত্যাদির অভিনয় করে সংরক্ষণের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ উগরে দেয়। কোথাও কোথাও তপশিলী জাতি ও উপজাতির ছাত্র-ছাত্রীদের উপর দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়। উচ্চবর্ণীয় মতাদর্শে নিমজ্জিত ছাত্র ও তাদের অবিভাবকরা বুঝতেই পারে নি তাদের আন্দোলনের রূপটির মধ্যে দিয়ে আসলে বলতে চাওয়া হচ্ছে যে তাদের (উচ্চবর্ণীয়) সম্প্রদায়ের লোকদের কেন শূদ্রদের জন্য নির্দিষ্ট (সামাজিকভাবে ঘৃণ্য) পেশার কাজ করতে হবে। খালি তাই নয়, সেদিন বাঙালী উচ্চবর্ণীয় ভদ্রবাবুরা কিন্তু এই হীন কার্যকলাপের নিন্দা করতে এগিয়ে আসেন নি বরং মনে মনে সংরক্ষণ বিরোধী এই আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন।
যাইহোক এবার আমরা দেখি যে পশ্চিমবঙ্গের স্কুল, কলেজে তপশিলী জাতি ও উপজাতির যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ার কথা যদি সত্যি বলেও ধরে নেওয়া যায় তাহলে তার পেছনে কী কী কারণ থাকতে পারে?
ক) তপশিলীভূক্ত জাতির লোকেরা প্রকৃতিগতভাবে নির্বোধ, তাই তাদের হাজার সুযোগ দিলেও তারা তা গ্রহণ করতে অপারগ।
খ) এ রাজ্যে নিম্নবর্ণের মানুষের লেখাপড়ার সুযোগ অত্যন্ত কম, বা নেই বললেই চলে। ফলে তাদের মধ্যে চাকুরী পাওয়ার মত যোগ্য মানুষ তৈরী হয় না।
নিশ্চয় এর বাইরে কোন কারণ থাকতে পারে না। প্রথমটি সত্য হলে তো বলতে হয় জাতি-বর্ণ প্রথা প্রকৃতিগত বিষয়, তাকে পরিবর্তনের প্রশ্নই উঠতে পারে না। এতাই তো আসলে খাঁটি মনুবাদ। আর দ্বিতীয়টি সত্যি হলে বলতে হয় যে তৎকালীন সময়ের পশ্চিমবঙ্গের বাম সরকার সহ পূর্বতন সরকারগুলি জাতিবর্ণ প্রথাকে নির্মূল করতে পদক্ষেপ নেওয়া তো দূরের কথা, নিম্ন জাতিবর্ণের মানুষের শিক্ষাকে নিরবচ্ছিন্নভাবে অবহেলা করেছে এবং তাদের বঞ্চনা করতে নানা ধরনের কলাকৌশলকে মদত করেছে।
সংরক্ষণ প্রথাকে কী ভোট ব্যাঙ্কের কাজে ব্যবহার করা হয় না?
এই প্রশ্নটি বিচার করবার আগে দুটি বিষয় পরিস্কার করে নেওয়া দরকার, না হলে বিভ্রান্তি তৈরী হতে পারে।
ক) ভারতবর্ষে জাতিবর্ণ প্রথার অস্তিত্বের পরিপ্রেক্ষিতে সংরক্ষণ ব্যবস্থার দাবী নিম্ন জাতিবর্ণের মানুষের একটি গণতান্ত্রিক দাবী।
খ) নিম্ন জাতিবর্ণের মধ্যেকার সহুরে মধ্যবিত্তশ্রেণির সংগ্রামের ফলেই সংরক্ষণ প্রথা চালু হয়েছে এবং সামান্য হলেও কার্যকরী হয়েছে।
কিন্তু ভারতবর্ষের শাসকেরা সংরক্ষণকে জাতিবর্ণের ভিত্তিতে তৈরী হওয়া মানসিক ও কায়িক শ্রমের বিভাজনকে বিলুপ্ত করবার একটি নীতি হিসাবে গ্রহণ করেনি। উল্লেখ্য যে ১৯৫৫ সালে কাকা কালেল্‌কর কমিশনের রিপোর্ট জমা পড়লে নেহেরু সরকার জানিয়েছিল যে রিপোর্টে উল্লিখিত জাতিগুলিকে পশ্চাদপদ হিসাবে চিহ্নিত করে সংরক্ষণের সুযোগ দিলে তা জাতিবর্ণগত বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে দেবে এবং স্থায়ী করবে।
যাইহোক গত শতকের ৬০’র দশক থেকে শুরু আন্তর্জাতিক ও জাতীয় ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিভিন্ন রাজ্যের জাতিসত্ত্বাগুলির মধ্যে থেকে আঞ্চলিক বুর্জোয়াদের উত্থান, নিম্নবর্ণের মধ্যবিত্তশ্রেণির গণতান্ত্রিক আকাঙ্খার বৃদ্ধি ও সর্বোপরি শ্রমিকশ্রেণির সংগ্রাম ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিপ্লবী কৃষক সংগ্রাম এবং তার প্রভাবে দলিত ও আদিবাসী মানুষের জাগরণ ভারতীয় শাসকশ্রেণিকে আতঙ্কিত করে তোলে। ১৯৭৫ সালে কংগ্রেস সরকার জরুরী অবস্থা চালু করে দমন পীড়ণ শুরু করে। এই সময় বিভিন্ন রাজ্যের নিম্নবর্ণের অন্তর্ভূক্ত মধ্যশ্রেণি ও বিশেষতঃ উত্তর ভারতে কৃষির সাথে যুক্ত নিম্নবর্ণভূক্ত অপেক্ষাকৃত প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলি রাজনৈতিক ক্ষমতায় ভাগ সহ তাদের নানা দাবী দাওয়া সামনে আনতে শুরু করে। আর এরই ফল হিসাবে কংগ্রেস সরকারের পতন হয়। পরবর্তী জনতা সরকারের আমলে মন্ডল কমিশন গঠিত হয়। তবে ১৯৮০ সালে মন্ডল কমিশনের রিপোর্ট জমা পড়ার পরেও পিতার ঐতিহ্যকে অনুসরণ করে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস সরকার সেটিকে চেপে রেখে দেয়। পরে ভি. পি. সিং-এর দুর্বল জোট সরকার ভোটব্যাঙ্কের কথা মাথায় রেখেই মন্ডল কমিশনের সুপারিশের একটি অংশ লাগু করবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ১৯৮৯ সালে অর্থাৎ কংগ্রেস সরকারে থেকেও ৯ বছর এ বিষয়ে চুপচাপ থাকার পর। তৎকালীন কংগ্রেস পার্টি ও বিজেপি এই সিদ্ধান্তকে ভারতীয় জনগণকে জাতিবর্ণের ভিত্তিতে বিভক্ত করবার চক্রান্ত হিসাবে ঘোষণা করেছিল ঠিক যেমনটা মনে করেছিল নেহেরু সরকার ১৯৫৫ সালে।
এই প্রেক্ষিতে সঙ্গতভাবেই একটি প্রশ্ন রাখা যেতে পারে যে মন্ডল কমিশনের সুপারিশ কার্যকরী করা যদি সমাজকে বিভক্ত করাই হয় তাহলে পরবর্তী কংগ্রেস সরকার এবং বিজেপি সরকার এই সংরক্ষণকে তুলে দেয় নি কেন। এমনকি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও বলছেন যে তিনি জীবন দিয়ে সংরক্ষণ প্রথাকে রক্ষা করবেন। তাই সংসদীয় রাজনীতিকদের একটি বড় অংশই নীতিগতভাবে অসৎ কারণ সংরক্ষণ নিয়ে তারা যা মনে করেন তা কাজে করতে ভয় পান। তাই মন্ডল কমিশনের সুপারিশ লাগু করার পেছনে ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি আছে এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু একইসাথে মনে রাখা দরকার যে জাতিবর্ণ প্রথার ভিত্তিতে যে সামাজিক বৈষম্য তৈরী হয়েছে তা দূর করার জন্য সংরক্ষণ একটি বিশেষ পদক্ষেপ এবং বিষয়টি নিছক ভোটব্যাঙ্কের দিকে তাকিয়ে লাগু হওয়ার জন্য তার যথোপযুক্ত প্রয়োগ ঘটছে না। এটিকে সৎভাবে একটি নীতির স্তরে উন্নীত করেই সঠিকভাবে লাগু করা সম্ভব আর তা হতে পারে একটি সত্যিকারের দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক সরকারের উদ্যোগে।
ভারতে কী জাতিবর্ণের ভিত্তিতে দাঙ্গা হয়ে থাকে?
জাতিবর্ণ প্রথা হচ্ছে ভারতীয় সমাজের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তাই যেভাবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই প্রথা টিকে আছে এবং তার ভিত্তিতে সমাজে যে শোষণ চলছে তা যদি বিশেষ কোন চ্যালেঞ্জের মুখে না পড়ে তাহলে সেইভাবে আক্রমণের ঘটনাও ঘটে না। আমরা আগেই আলোচনা করেছি যে গত শতকের ৬০’র দশক থেকে সমাজের স্থবিরতা ভেঙে পড়তে শুরু করে এবং এই অস্থিরতার বহু উপাদানের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য উপাদান হল গ্রামাঞ্চলে আধা সামন্ততান্ত্রিক শোষণের বিরুদ্ধে দলিত, আদিবাসী ও নিম্নবর্ণের মানুষের জাগরণ ও সহরে নিম্নবর্ণের অপেক্ষাকৃত সচ্ছল মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের সরকারী চাকুরী ও ক্ষমতায় ভাগ পাওয়ার আকাঙ্খা। ৬০’র দশকের শেষভাগ থেকে পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাড়ী, বিহার, অন্ধ্রপ্রদেশ সহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিপ্লবীদের নেতৃত্বে নিম্নবর্ণের ভূমিহীন চাষী, ক্ষেতমজুরদের সামন্ততন্ত্র বিরোধী ও জমি দখলের লক্ষ্যে বৈপ্লবিক সশস্ত্র আন্দোলন শুরু হয় যা পরবর্তীতে বিপ্লবী পার্টির নেতৃত্বে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের আন্দোলনে পরিণত হয়। রাষ্ট্রীয় আক্রমণের সামনে এই সংগ্রাম সে সময়ে পিছু হটলেও গ্রামীন ক্ষেত্রে জমিদারী ব্যবস্থার মাধ্যমে চলে আসা উচ্চবর্ণের কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। আর এই কারণেই তারপর থেকে যেমন ভারতের কোণে কোণে নিম্ন জাতিবর্ণের মানুষের জাগরণ ঘটেছে তেমনি তার উপর নেমে এসেছে রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদতে উচ্চবর্ণবাদী আক্রমণ।
বড় আকারে দলিত হত্যা শুরু হয় ১৯৬৮ সালে তাঞ্জাভুর জেলায়। দলিত ক্ষেত্মমজুররা উচ্চ মজুরীর দাবীতে ধর্মঘটের ডাক দিলে ঐ গণহত্যা চালানো হয়। ১৯৭০ সাল থেকে বিহার, মহারাষ্ট্র, অন্ধ্র ও কর্নাটকে দলিতদের উপর আক্রমণ বাড়তে থাকে। গুজরাটের সংরক্ষণ বিরোধীরা কয়েক হাজার দলিত মানুষের ঘরবাড়ী পুড়িয়ে দেয়। কোন কোন অঞ্চলে দলিত ও নিম্নবর্ণের মধ্যবিত্ত মানুষরাও রেহাই পায়নি।
১৯৭৩ সাল থেকে মহারাষ্ট্রের ব্ল্যাক পান্থার আন্দোলন দলিত সংগ্রামের ব্যাপারে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। মনুস্মৃতি পুড়িয়ে এই আন্দোলন জাতিবর্ণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। একটি পর্যায়ে এই আন্দোলন ভোট বয়কটের মত রূপও গ্রহণ করে। উচ্চবর্ণবাদী মতাদর্শে সংগঠিত শিবসেনা ও রাষ্ট্রীয় বাহিনী আন্দোলনের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। এই আক্রমণে ভাস্কর যাদব বলে এক তরুন কবির মৃত্যু হয়। একটি পর্যায়ে এই আন্দোলন দুর্বল হয়ে যায় বটে কিন্তু এরপর মহারাষ্ট্রে দলিতদের সংরক্ষণ কিছুটা কার্যকরী হয় যেখানে আগে ঝাড়ুদাড় পদে ছাড়া দলিতরা সরকারী চাকুরী পেত না। ১৯৯৭ সালের ১০ই জুলাই মুম্বাইয়ের রামবাই আম্বেদকর কলোনিতে আম্বেদকরের মূর্তিতে শিবসেনার কিছু দুস্কৃতি জুতোর মালা পরিয়ে দেয়। ১১ই জুলাই থেকে দলিত মানুষের বিক্ষোভ শুরু হয়। সংগ্রামী জনতার উপর পুলিশ গুলি চালালে ১১ জন দলিত মানুষের মৃত্যু হয় এবং বহু মানুষ আহত হয়। এরপর মহারাষ্ট্র জ্বলে উঠলে নাগপুরে কার্ফূ জারী করা হয় এবং পুলিশ ও শিবসেনার আক্রমণে আরও ৫ জনের মৃত্যু ঘটে।
২০০২ সালের ১৫ অক্টোবর হরিয়ানার একটি থানার সামনে একটি মরা গরুকে বিক্রি করতে নিয়ে যাওয়ার অপরাধে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবকের গুন্ডাবাহিনী ৫ জন দলিত মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করে। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতা গিরিরাজ কিশোর প্রকাশ্যে এই হত্যাকে সমর্থন করে। মহারাষ্ট্রে ২০০৩ সালে দলিতদের বিনামূল্যে দেবার জন্য সমস্ত পুস্তিকা আর. এস. এস. পুড়িয়ে দেয়। এছাড়াও বিভিন্ন অঞ্চলে আর. এস. এস., শিবসেনা বা আরও নানান রঙ বেরঙের হিন্দুত্ববাদী সংগঠন দলিতদের উপর তীব্র দমন পীড়ণ নামিয়ে আনে।
সমস্ত আক্রমণের ঘটনাগুলিকে বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে যে অঞ্চলগুলিতে দলিত ও নিম্নবর্ণের মানুষেরা চিরাচরিতভাবে বশ্যতার অবস্থানে রয়ে গেছে সেখানে বিশেষ কিছু ঘটে নি, কিন্তু যেখানেই কিছুটা আর্থিক সচ্ছলতা ও শিক্ষার কারণে দলিতদের মধ্যে আত্মসম্মান বোধ জেগে উঠেছে সেখানেই উচ্চবর্ণীয় জমিদার, অভিজাতবর্গ বা কোথাও কোথাও অপেক্ষাকৃত নিম্নবর্ণীয় অভিজাতবর্গ তা সহ্য করতে না পেরে আক্রমণ সংগঠিত করেছে। ২০০৬ সালে এরকমই একটি ঘটনা ঘটে মহারাষ্ট্রের খেরলাঞ্জি গ্রামে। আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচার অপরাধে মাহার পরিবারের ৪ সদস্য তথা মা সুরেখা ও তার ৩ সন্তানকে পৈশাচিকভাবে হত্যা করা হয়। ঐ অঞ্চলের বিজেপি এম.এল.এ., পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল পঙ্কজ গুপ্ত ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আর.আর.পাতিল হত্যাকারীদের রক্ষা করতে সমস্তরকম প্রচেষ্টা চালায়। রাজস্থানে ২০০৩ সালের মে মাসে দলিত মানুষের একটি বিবাহ অনুষ্ঠানে ঘোড়া ব্যবহার করার জন্য (যা রাজপুতদের সংস্কৃতি) দলিতদের উপর বিরাট আক্রমণ সংগঠিত হয়।
এছাড়াও ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী ভারতে গড়ে প্রতিদিন ৪ জন দলিত মহিলা ধর্ষিত হয়, প্রতি সপ্তাহে ১৩ দলিত জন দলিত মানুষ খুন হন। যে বছর দিল্লীর ধর্ষণকান্ডে দেশ উত্তাল হয় সেই ২০১২ সালেই দেশে ১৫৭৪ জন দলিত মহিলা ধর্ষিত হয়েছিলেন এবং ৬৫১ জন দলিত মানুষ খুন হন। তবেতবে একথাও মনে রাখা দরকার যে দলিত মানুষের উপর নির্যাতনের খুব কম খবরই গণ্য মাধ্যমে আসতে পারে তাই প্রকৃত চিত্রটা আরোও ভয়ঙ্কর হতে পারে। একথাও
আম্বেদকরের ভূমিকাকে আমরা কী চোখে দেখব?
বর্তমানে ভারত সরকার দলিত মানুষদের বিভ্রান্ত করতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে বাবাসাহেব আম্বেদকরকে সংবিধান প্রণেতা বানিয়ে দিয়েছে। যে সংবিধানকে সামনে রেখে ভারত সরকার প্রতি মুহুর্তে ভারতের দলিত, আদিবাসী মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিচ্ছে, জাতিসত্ত্বার আন্দোলনগুলির উপর সামরিক আগ্রাসন চালাচ্ছে, ধর্ষণ ও হত্যালীলা চালাচ্ছে, মধ্যভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে জল-জমি-জঙ্গল রক্ষা আন্দোলনের উপর অপারেশন গ্রীন হান্টের নামে সামরিক আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে, বিভিন্ন অঞ্চলে জমিদাররা কৃষক বা দলিত-আদিবাসী আন্দোলনকারীদের দমনের লক্ষ্যে ইচ্ছামত নিজস্ব বাহিনী গড়ে তুলে খুন ও ধর্ষণ চালাচ্ছে, কৃষিজমি থেকে নির্বিচারে কৃষকদের উচ্ছেদ করে চলেছে সেই ভারতীয় সংবিধানের সমস্ত দায়িত্ব আম্বেদকরের উপর চাপিয়ে দেওয়া এক জঘণ্য চক্রান্তই বটে।
বাস্তবত মাহার সম্প্রদায়ের সন্তান আম্বেদকর বিরাট প্রতিভার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও নিজের জীবন দিয়ে জাতিবর্ণ প্রথার ঘৃণ্য দিকটিকে উপলব্ধি করেন। আর সেই কারণে বিরাট বুদ্ধিজীবি হওয়া সত্ত্বেও শেষপর্যন্ত নিজেকে শিক্ষাজগতের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে পারেন নি, দলিত মানুষের অধিকার অর্জনের চেষ্টায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। তিনি নানা ধরনের গণ আন্দোলন গড়ে তোলেন যার মধ্যে নাসিকে দলিতদের মন্দিরে প্রবেশের অধিকার, পুকুরের জল ব্যবহারের অধিকার বিশেষ উল্লেখযোগ্য। বিশেষতঃ ১৯৪১ সাল পর্যন্ত আম্বেদকরের নেতৃত্বে দলিত মানুষের যে আন্দোলন ফেটে পড়েছিল সেখানে গণসমাবেশ, জনগণের শক্তির উপর নির্ভরতা বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল এবং এই আন্দোলন ভারতবর্ষের দলিত আন্দোলনে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে আম্বেদকর দলিত আন্দোলনকে সামাজিক সংস্কা্রের গন্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে দলিতদের রাজনৈতিক অধিকার ও ক্ষমতা অর্জনের বিষয়টি সামনে আনেন। কিন্তু তিনি ছিলেন একজন প্রগতিশীল উদারনৈতিক বুর্জোয়া দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন মানুষ আর তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই ভেবেছিলেন যে সংসদীয় গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যেই এই অধিকার অর্জন করা সম্ভব। আর এটি করতে গিয়ে তিনি আবার ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের গুরুত্বকে সেভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হননি যদিও অনেক ক্ষেত্রেই তিনি কংগ্রেস নেতৃত্ব ও গান্ধীজীর ব্রিটিশ শক্তির প্রতি আপোষকামী চরিত্র তুলে ধরতে সক্ষম হন। অপরদিকে তিনি দলিতদের মুক্তির প্রশ্নের সাথে বৈপ্লবিক ভূমি সংস্কার ও কৃষিতে নানা ধরনের আধা সামন্ততান্ত্রিক সম্পর্কের উচ্ছেদের গভীর আন্তঃসম্পর্ক উপলব্ধি করতে পারেন নি। জাতিবর্ণ ভিত্তিক আধা-সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা বহাল রাখবার পেছনে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকদের স্বার্থ কীভাবে লুকিয়ে আছে সেটাও তিনি সেভাবে অনুধাবন করতে পারেন নি। কিন্তু এইসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও দলিত মানুষের মুক্তির প্রশ্নে ও জাতিবর্ণ ব্যবস্থা উচ্ছেদের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ার লক্ষ্যে তিনি যেসব বিতর্ক, সংগ্রাম ও নানা ধরনের বৌদ্ধিক কার্যকলাপ চালিয়েছেন তা গণতান্ত্রিক সংগ্রামেরই অংশ এবং এই কারণেই তা দলিত আন্দোলনের কাছে বিশেষ প্রেরণা হয়ে থাকবে।
বর্তমান রাজনীতিতে দলিত ও নিম্নবর্ণের নেতাদের ভূমিকা কেমন?
আমরা আগেই আলোচনা করেছি যে গত শতকের ৭০’র দশক থেকে অন্যান্য বিপ্লবী জাগরণের সাথে সাথে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের নিম্ন জাতি-বর্ণের মানুষের মধ্যেও গণতান্ত্রিক আকাঙ্খার জাগরণ ঘটে যার একটি উপাদান হল বিভিন্ন রাজ্যের নিম্নবর্ণের অপেক্ষাকৃত সচ্ছল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, বড় কৃষক ও আঞ্চলিক বুর্জোয়াদের বর্তমান প্রচলিত ব্যবস্থার মধ্যেই রাজনৈতিক ক্ষমতার ভাগ পাওয়া। কংগ্রেসের অতি কেন্দ্রীভূত এককেন্দ্রিক শাসন ক্ষমতার ভাগ ছাড়তে রাজী ছিল না। কিন্তু সংসদীয় সংগ্রামের একটি পর্যায়ে এরা আস্তে আস্তে কিছু রাজনৈতিক ক্ষমতা করায়ত্ত করে ও অচিরেই বর্তমান রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অঙ্গীভূত হয়ে যায়। ফলে বর্তমানে একগুচ্ছ দলিত ও নিম্নবর্ণ থেকে আগত নেতারা এই জমিদার ও আমলাতান্ত্রিক মুৎসুদ্দী বুর্জোয়া স্বার্থে চালিত ব্যবস্থার অঙ্গীভূত হয়ে গেছেন এবং ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতিতে নিমজ্জিত হয়েছেন। ক্ষমতা পাওয়ার লক্ষ্যে সমস্ত দলিত ভোট পেতে এরা যেমন কখনো কখনো গোটা উচ্চবর্ণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে তেমনি মসনদে বসার জন্য সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তিগুলির সাথে জোট করতেও এদের বাধে না। দলিত ও নিম্নবর্ণের ক্ষেতমজুর, ভূমিহীন কৃষকদের স্বার্থে বৈপ্লবিক ভূমি সংস্কার কর্মসূচী বিষয়ে নিশ্চুপ থেকে এরা সমগ্র দলিত আন্দোলনকে কেবল সংরক্ষণ ও সংসদীয় ক্ষমতার সীমার মধ্যে বেঁধে রাখার প্রয়াস চালায় ও এইভাবে বর্তমান ব্রাহ্মণ্যবাদী ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার পক্ষে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তাই এদের বর্তমান শ্রেণিচরিত্রের কারণে এরা জাতিবর্ণ ব্যবস্থা উচ্ছেদের পক্ষে কোন প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করতে পারবে না, বরং দলিত জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরী করবে এবং বিপ্লবী আন্দোলনকে দমন করতে রাষ্ট্রশক্তির সাথে জোট গড়ে তুলবে।
হিন্দুত্ববাদী শক্তি কী জাতিবর্ণ ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে চায়?
রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক, হিন্দু মহাসভা ইত্যাদি হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলি কোন রাখঢাক না রেখেই জাতিবর্ণ প্রথার পক্ষে সরাসরি ওকালতি করে। এই হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি তাদের জন্মকাল থেকেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির পূজারী ও মুসলমান বিদ্বেষী। তাই ব্রিটিশ শাসনকালে জনগণের স্বাধীনতার আকাঙ্খার সামনে ভীত হয়ে গান্ধী-নেহেরুর নেতৃত্ব যে আংশিক স্বাধীনতার লড়াই করতে বাধ্য হয় তাতেও এরা অংশগ্রহণ করেনি। ইতিহাস বিকৃতি ও হিন্দুশাস্ত্র সম্পর্কিত অপবিজ্ঞানের প্রচারে এদের জুড়ি নেই। তারা মনেই করে যে জাতিবর্ণ প্রথার ভিত্তিতেই দেশকে চালাতে হবে, ব্রাহ্মণত্বের শ্রেষ্টত্ব বজায় রাখতে হবে ও দলিত ও নিম্নবর্ণের মানুষের শাস্ত্রসিদ্ধ পেশার কাজগুলিই করে যেতে হবে। মনু সংহিতা ও গীতার বক্তব্যই তাদের কাছে শেষ কথা যেখানে মনু সংহিতাতে কিনা শূদ্র ও নারীজাতিকে কুকুরের সাথে তুলনা করা হয়েছে। কিন্তু সংগঠন বাড়ানোর লক্ষ্যে তারা নিজেদের দলিত ও আদিবাসী মানুষদের ত্রাতা হিসাবে তুলে ধরে এবং হিন্দুত্বের গৌরবের কথা ও নানা মিথ্যা প্রচার চালিয়ে তাদের বিভ্রান্ত করে এবং প্রয়োজনে মুসলিম সহ বিভিন্ন ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষ নিধনের কাজে লাগায়। মন্ডল কমিশনের সুপারিশ লাগু করার সিদ্ধান্ত গৃহিত হওয়ার পর এরা গুজরাট সহ দেশের নানা স্থানে সংরক্ষণ বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলে, দাঁঙ্গা বাধায় ও দলিত মানুষদের হত্যা করে।
এই হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলি যে কতখানি জাতিবর্ণ ব্যবস্থার কট্টোর সমর্থক তা বোঝা যায় যখন সঙ্ঘনেতা দীনদয়াল উপাধ্যায় লেখেন, “আমাদের ধারণায় চারটি জাত (বর্ণ) হল বিরাট পুরুষের চারটি অঙ্গ। .. এই অঙ্গগুলি শুধু একে অপরের পরিপূরক নয়, সেগুলির মধ্যে স্বাতন্ত্র্য ও ঐক্যও রয়েছে। রয়েছে স্বার্থ, নিজস্বতা, অস্তিত্বের অভিন্নতা। …এই ধারণাকে যদি বাঁচিয়ে না রাখা যায় তবে জাতগুলি পরস্পরের পরিপূরক হয়ে ওঠার পরিবর্তে সংঘাতের জন্ম দিতে পারে। সেটা তাহলে বিচ্যুতিই হবে।” এরা যে বরাবরই শূদ্র ও নিম্নবর্ণের মানুষের চরম শত্রু তা বোঝা যায় যখন বর্তমান সময় দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক প্রধান মোহন ভাগবৎ সংরক্ষণ প্রথার পুনর্বিবেচনার কথা বলেন। আবার বিপাকে পড়ে যে নরেন্দ্র মোদী সংরক্ষণকে জীবন দিয়ে রক্ষার কথা বলেছেন তিনিই ২০০৬ সালে তার ‘কর্মযোগ’ নামে একটি বইতে লিখেছেন, “আমি মনে করি না, বাল্মীকিরা অন্যের মল সাফ করার এই কাজটি কেবল রুজি-রুটির জন্য করে। তা যদি হতো, তাহলে বংশ তাহলে বংশপরম্পরায় এ কাজ তারা করত না। কোনও এক কালে নিশ্চয়ই তাদের কারও চেতনায় দৈব প্রত্যাদেশে এই আধ্যাত্মিক উন্মোচন ঘটেছিল যে, এ কাজ তারা করছে ভগবানকে খুশি করতে। সেই অভ্যন্তরীণ আধ্যাত্মিকতার প্রেরণাতেই শতাব্দীর পর শতাব্দী তারা প্রজন্ম পরম্পরায় এ-কাজ করে যাচ্ছে। এটা বিশ্বাস করা কঠিন যে, তাদের পূর্বপুরুষরা ইচ্ছে করলে বিকল্প কোনও রুজি রোজগারের সন্ধান পেত না।” ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতাকে সামনে রেখে বাল্মীকিদের জন্মগত পেশাকে যুক্তিসম্মত করবার উদ্যোগের চেয়ে নোংরা ব্রাহ্মণ্যবাদ আর কী হতে পারে!
বলা বাহুল্য যে এই সংঘ পরিবার কেবল ব্রাহ্মণ্যবাদেরই পৃষ্ঠপোষক নয়, তারা দলিত, আদিবাসী ও নিম্নবর্ণের জনগণের উপর অত্যাচারী সমস্ত শক্তির মদতদাতা। গোটা মুসলিম সম্প্রদায়কে এরা বিদেশী হিসাবে চিহ্নিত করে তাদের উপর রাষ্ট্রীয় মদতে গণহত্যা চালায় যেখানে কিনা দলিত মানুষের একটি বড় অংশ ব্রাহ্মণ্যবাদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করে। বিহারের সানলাইট সেনা, রনবীর সেনা গঠন ও তাদের দিয়ে দলিত হত্যায় এই হিন্দুত্ববাদীরাই মদত দিয়ে থাকে। তবে একথা মনে রাখা দরকার যে ভারত রাষ্ট্র নিজেই হিন্দুত্ববাদ ও জাতিবর্ণের মতাদর্শে নিমজ্জিত। কংগ্রেস সহ অন্যান্য সংসদীয় দলগুলি জাতিবর্ণের মতাদর্শটিকে একটু নরম আকারে সামনে রাখে আর হিন্দুত্ববাদীরা সেটাকে খোলাখুলি তুলে ধরে। এই দুটি ধারাই আসলে একই ভারতীয় শাসকের দুটি আপাত ভিন্ন মুখ। আধা ঔপনিবেশিক ও আধা সামন্ততান্ত্রিক এই ব্যবস্থা বজায় রাখার জন্য যখন যেটার প্রয়োজন সেটিকে ব্যবহার করে থাকে। বিশেষতঃ বিশ্বায়নের পর্যায়ে জনগণের সংগ্রাম দুর্বল করা ও তাদের বিভক্ত করার লক্ষ্যে শাসকশ্রেণির কাছে চরম হিন্দুত্ববাদী শক্তির গুরুত্ব আগের তুলনায় বেড়ে গিয়েছে।
এই জাতিবর্ণ ব্যবস্থা থেকে মুক্তির পথ কী?
পৃথিবীর যে সব জায়গাতে শ্রেণি ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটেছিল সেখানেই তার আগেই সমাজে শ্রম বিভাজন ঘটেছিল। আবার শ্রম বিভাজন ঘটার জন্য একটি মাত্রায় উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের প্রয়োজন হয়। অবশ্যই তার মানে এই নয় যে শ্রমবিভাজন মানেই শ্রেণি ব্যবস্থা। শ্রেণি ব্যবস্থা হচ্ছে শ্রম বিভাজনের ভিত্তিতে উৎপাদকদের কাছ থেকে উদ্বৃত্ত আদায়ের একটি অপেক্ষাকৃত স্থায়ী ব্যবস্থা। ভারতীয় অঞ্চলে একটি পর্যায়ে কায়িক ও মানসিক শ্রমের বিভাজন হয়েছিল বর্ণ ব্যবস্থার ভিত্তিতে ও পরবর্তীতে কায়িক শ্রমের সাথে যুক্ত শূদ্রদের মধ্যে পেশার ভিত্তিতে বহু জাতির আবির্ভাব বিষয়টিকে শক্তপোক্ত ভিত্তি যুগিয়েছিল। প্রাচীনকালে মানসিক শ্রমকারী জাতিবর্ণগুলি গোটাগুটিভাবে নিম্নবর্ণের মানুষের তৈরী উদ্বৃত্ত আদায় করত এবং তার ফলে তাদের শোষকশ্রেণি হিসাবে চিহ্নিত করা যেত।
কিন্তু বহু ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে নানা পরিবর্তন ও বিশেষতঃ ব্রিটিশ শাসনের মধ্যে দিয়ে জাতিবর্ণ ব্যবস্থাও অনেক রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে যায়। যেমন ভারতে যে শ্রমিকশ্রেণির সৃষ্টি হয়েছে তার মানসিক শ্রমকারী অংশটি মূলতঃ উচ্চবর্ণের ও কায়িক শ্রমকারী অংশটি মূলতঃ নিম্নবর্ণের। এতে জাতিবর্ণ প্রথার শক্তিশালী অস্তিত্ব থাকার কথা প্রমাণ হয় বটে কিন্তু তাতে এটা বোঝায় না যে শ্রমিকশ্রেণির মানসিক শ্রমের সাথে যুক্ত অংশটি গোটাগুটিভাবে শোষক যদিও তাদের একটি বড় অংশ ব্রাহ্মণ্যবাদী মতাদর্শে নিমজ্জিত থাকতে পারে।
আবার গ্রামাঞ্চলে সামন্ত জমিদারদের ৯০% উচ্চবর্ণের, কিন্তু তার মানে এই নয় যে উচ্চবর্ণ মানেই শোষক। উচ্চবর্ণের মধ্যেও মধ্য কৃষক, গরীব কৃষক রয়েছে যদিও জাতিবর্ণ ব্যবস্থার সংস্কৃতি শক্তিশালী হওয়াই ব্রাহ্মণদের মধ্যে লাঙল ধরার চল প্রায় নেই। একইভাবে ক্ষেতমজুর ও ভূমিহীন চাষীদের ৯০% নিম্নবর্ণের অন্তর্ভূক্ত, কিন্তু একইসাথে এটাও সত্য যে নিম্ন জাতিবর্ণের বেশ কিছু মানুষ আজ গ্রামাঞ্চলে শাসক ও শোষক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত এবং কোথাও কোথাও তারাই দলিত কৃষকদের উপর প্রধান আক্রমণকারী। ফলে আমাদের বুঝতে হবে যে বর্তমানে জাতিবর্ণের ভিত্তিতে বিভাজন মানেই শ্রেণি বিভাজন নয়, কিন্তু একই সাথে শ্রেণি ব্যবস্থার সাথে জাতিবর্ণ ব্যবস্থার একটি গভীর আন্তঃসম্পর্ক রয়েছে। আর তাই এখানে শ্রেণিসংগ্রাম ও জাতিবর্ণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রামও আন্তঃসম্পর্কিত হয়ে থাকবে। তৎকালীন কমুনিষ্ট পার্টি এই আন্তঃসম্পর্ক না বুঝে জাতিবর্ণগত সমস্যা এড়িয়ে গিয়ে যান্ত্রিকভাবে শ্রেণিসংগ্রামের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিল। শ্রমিকদের মধ্যে সংগঠিত ক্ষেত্রটিতে একতরফা জোর দেওয়ার ফলে অনেক জায়গাতেই বিপ্লবের একটি প্রধান শক্তি দলিত শ্রমিকদের থেকে পার্টি নেতৃত্ব বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছিল কারণ সংগঠিত ক্ষেত্রে উচ্চবর্ণ থেকে আগত শ্রমিকদের সংখ্যাই বেশি। খালি তাই নয়, পার্টি নেতৃত্ব শ্রেণিসংগ্রামকেও কেবল মাত্র অর্থনৈতিক দাবী আদায়ের মধ্যে সীমিত করে। জাতিবর্ণের বিষয়টিকে ভারতের আধা ঔপনিবেশিক আধা সামন্ততান্ত্রিক আর্থ সামাজিক কাঠামোর সাথে সম্পর্কিত বিষয় হিসাবে না দেখে কেবল উপরিকাঠামোর বিষয় হিসাবে দেখার ফলে পার্টির নেতৃত্বের মধ্যে নিজেদের অজান্তে ব্রাহ্মণ্যবাদী মতাদর্শ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। জাতিবর্ণ ব্যবস্থা থেকে দলিত ও নিম্নবর্ণের মানুষের মুক্তির প্রশ্নটি মূর্তভাবে না ওঠায় পার্টি নেতৃত্ব ভারতীয় সমাজের আধা সামন্ততান্ত্রিক চরিত্র ও বৈপ্লবিক ভূমি সংস্কারের গুরুত্ব বুঝতে ব্যর্থ হয় ও পরবর্তীতে সংসদীয় সংগ্রামের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। আরোও পরবর্তীতে সিপিএম ও সিপিআই এই মতাদর্শকে বহন করে সংসদীয় পাঁকে নিমজ্জিত হয় এবং একটি পর্বে শাসকশ্রেণির অংশ হয়ে ওঠে।
যাইহোক ভারতবর্ষকে একটি সত্যিকারের উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে রূপান্তরিত করতে হলে তার উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের পথে প্রধান যে বাঁধা অর্থাৎ গ্রামাঞ্চলে জাতিবর্ণ ভিত্তিক আধা সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ভেঙে চুরমার করে দিতে হবে। বৈপ্লবিক ভূমি সংস্কার করে জমির উপর প্রকৃত কৃষকদের মালিকানা ও গ্রামাঞ্চলে তাদের রাজনৈতিক আধিপত্য কায়েম করতে হবে। বৈপ্লবিক ভূমি সংস্কার কার্যকরী হলে ভারতীয় সামন্ত ব্যবস্থার একটি বিশেষ অঙ্গ তথা জাতিবর্ণ প্রথাও দুর্বল হয়ে পড়বে কারণ গ্রামাঞ্চলে দলিত ও নিম্নবর্ণের ভূমিহীন কৃষকরা জমির মালিকানা পাবে ও রাজনৈতিক কর্তৃত্বে অংশগ্রহণ করতে পারবে, জাতি-বর্ণ ব্যবস্থায় যা একেবারেই অসহনীয়। কিন্তু এই ধরনের গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্মসূচী সফল করতে গেলে দলিত ও নিম্নবর্ণের মানুষের মর্যাদার জন্য লড়াইকে সামনে রাখতে হবে, উচ্চবর্ণীয় জমিদারদের সমস্ত আক্রমণকে প্রতিহত করতে তাদের নেতৃত্ব দিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের বিকাশ ঘটাতে হবে, সংগ্রামকে কেবলমাত্র মজুরী বৃদ্ধির দাবীর মতো অর্থনৈতিক আন্দোলন এবং কিছু খাস জমির বন্টণের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে তা কখনই জাতিবর্ণ ভিত্তিক সামন্তবাদকে উচ্ছেদের সংগ্রামে পরিণত হবে না।
ভারতবর্ষের উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের পক্ষে প্রধান বাঁধা হল তিনটি পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত তিনটি শক্তি যথা সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি, তার সাথে ঘনিষ্ট মুৎসুদ্দী বৃহৎ পুঁজি ও জাতিবর্ণ প্রথা ভিত্তিক আধা সামন্তবাদ। সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি দেশীয় মুৎসুদ্দী পুঁজি ও সরকারী নীতির সহায়তায় ভারতের মোট জাতীয় আয়ের ২০% লুঠে নিয়ে চলে যায় যার ফলে এখানকার পুঁজির সঞ্চয় থাকে দুর্বল। আর বর্তমানে বিশ্বায়ন নীতির মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি যে নতুন নতুন আক্রমণ করে চলেছে তাতে দলিত ও নিম্নবর্ণের মানুষ আরও কোনঠাসা হয়ে পড়ছে। ক্ষুদ্রশিল্পের জন্য সংরক্ষিত ক্ষেত্র ও খুচরো ব্যবসার ক্ষেত্রটি ক্রমাগত বিদেশী ও দেশী কর্পোরেট পুঁজির কাছে উন্মুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে যার ফলে এই ক্ষেত্রগুলিতে নিম্ন জাতিবর্ণের বপুল সংখ্যক মানুষ ক্রমাগত তাদের রুজি রোজগার হারিয়ে চলেছেন। সেজ ও উপনগরী গড়ে তোলার জন্য আদিবাসী ও দলিত কৃষকদের জমি ও বাসস্থান থেকে নিয়মিতভাবে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। একের পর এক সরকারী সংস্থার বিলোপ সাধন, বেসরকারীকরণ ও সরকারী অফিসে কনট্র্যাক্ট প্রথা সরকারী চাকুরীতে সংরক্ষণকে অর্থহীন করে তুলেছে। একদিকে বেসরকারী সংস্থাগুলি সরকারের কাছ থেকে নানা ধরনের সুযোগ গ্রহণ করে চলেছে এবং অপরদিকে তারা দাঁত চেপে বেসরকারী ক্ষেত্রে সংরক্ষণের বিরোধিতা করে চলেছে। শিক্ষার বেসরকারীকরণ, ডাক্তারী-ইঞ্জিনীয়ারিং-এর মত পেশাগত ক্ষেত্রে ক্যাপিটেশন ফী, শিক্ষায় ইংরাজী ভাষার প্রবল আধিপত্য দলিত ও নিম্নবর্ণের মানুষের পূর্বে অর্জিত কিছু সুযোগ সুবিধাকেও সঙ্কুচিত করে ফেলেছে। এমনকি দলিত মানুষেরা যেখানে কিছুটা সুযোগ পান সেই সরকারী চতুর্থ শ্রেণির পদগুলি তুলে দিয়ে সেই কাজগুলিকে কনট্র্যাক্ট প্রথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির এই তীব্র আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়তে না পারলে ভবিষ্যতে সংরক্ষণ ব্যবস্থা লিখিত নিয়ম হিসাবেই থাকবে, তার কোন কার্যকরী ভূমিকা থাকবে না।
তাই শেষ বিচারে দলিত, নিম্নবর্ণ ও নিপীড়িত সংখ্যালঘু মানুষের মুক্তির একমাত্র পথ হচ্ছে দেশ থেকে সাম্রাজ্যবাদ ও তার সহযোগী দেশীয় বৃহৎ পুঁজি এবং সামন্তবাদের উচ্ছেদ সাধন। আর এ কাজে সফল হতে গেলে গ্রামাঞ্চলে সামন্তবাদী শক্তিগুলিকে উচ্ছেদ করে কৃষকদের বিপ্লবী সরকার গড়ে তুলতে হবে। আর অনেক অঞ্চলে এই ধরনের বিপ্লবী সরকার তৈরী করেই সহরগুলিতে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি ও মুৎসুদ্দী বৃহৎ পুঁজির জোয়াল ভাঙতে হবে, গড়ে তুলতে হবে শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্ত ও দেশপ্রেমিক উদ্যোগপতিদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব। এরকমভাবে গড়ে ওঠা নয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই বৈপ্লবিক ভূমিসংস্কারের উপর ভিত্তি করে সংরক্ষণ সহ আরও নানাবিধ কর্মসূচী গ্রহণ করার মাধ্যমে জাতিবর্ণ ব্যবস্থাকে নির্মূল করে তাকে যাদুঘরে পাঠিয়ে দিতে পারবে।
তথ্যসূত্রঃ
* ‘The Doctor and the Saint’ an introduction by Arundhati Roy, in the Book ‘Annihilation of Caste’ by B.R.Ambedkar, Navayana.
* ‘Scripting the Change’ Selected writing of Anuradha Gandhi, Daanish Books.
* ‘Class Caste Relations; Marxist Approach’, DAFODWAM.
* ‘জাতি-বর্ণ ব্যবস্থা, সংরক্ষণ ও মন্ডল কমিশন’, সন্তোষ রাণা, সি.পি.আই.(এম-এল) প্রকাশনী।
* ‘বিবেকানন্দ মানস ঐতিহ্য ও আধুনিকতা’ কনিষ্ক চৌধুরী, সেতু
* ‘Reservation in private Sector: An Overview of the Proposition, People’s March, Vol.6, 2005.
* ‘সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও সংঘ পরিবার’ সব্যসাচী গোস্বামী, আবাদ ভূমি।
* ‘Caste Injustice in Jawaharlal Nehru University’, S.Santosh, Joshil K Abraham, Economic and Political Weekly, 26 June, 2010.
* ‘জাতি-বর্ণ ব্যবস্থা, আধা সামন্ততন্ত্র ও ভারতীয় বৃহৎ পুঁজির ভূমিকা’, গুরুপ্রসাদ কর, চেতনা লহর, ২০১৪।
- - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - শ্রী গুরুপ্রসাদ কর, অধ্যাপক আই এস আই, কোলকাতা
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে আগস্ট, ২০১৬ রাত ১১:৫৮
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×