somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মরুযাত্রা ২ঃ ড্রিম ইন দ্যা ডেজার্ট

২৭ শে মার্চ, ২০১৬ বিকাল ৩:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
পাম আইল্যান্ড, পাখির চোখে দেখা



আগের পর্ব
মরুযাত্রা-১ঃ টু দ্যা ল্যান্ড অব পার্ল

ঢাকা ফেরার পথে বাহরাইন-দুবাই ফ্লাইটে এক ইরানী ভদ্রমহিলার সাথে পরিচয়। ভীষণ সুন্দরী। ফুটফুটে দুইটা জ্যান্ত পুতুল সাথে ছিল তার। যাচ্ছিলেন ডিপ্লোম্যাট হাজব্যান্ড এর কাছে। ভদ্রলোক বাহরাইন থাকেন। এক ফাকে ভদ্রমহিলার স্মার্ট ও চমৎকার ড্রেস সেন্সের প্রশংসা করায় তিনি উত্তর দিলেন “ আসলে পোষাকের চেয়ে তার ভেতরের মানুষটাকে সুন্দর বানানো জরুরী। আরবিতে প্রবাদ আছে আল আলিব গালিব। অর্থাৎ তুমি তোমার পোষাকের চেয়ে বেশি সুন্দর।” তার দার্শনিক মার্কা উত্তর মোটেও আশা করিনি আমি। জানতে চাইলাম, “এমন কোন দর্জি কি আছে যিনি সুন্দর পোষাকের মত করে সুন্দর করে মনও বানাতে পারেন।” ইয়েস, এ গুড বুকস ক্যান ডু” তিনি বললেন। এর পর চমৎকার কিছু বইয়ের নাম বললেন। আমার ইংরেজি বই পড়ার দৌড় চেতন ভগত আর ড্যান ব্রাউন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। তাই এ বিষয়ে আর কথা বাড়ালাম না। দুবাই বিমানবন্দরে নামার সময় একটা মজার ঘটনা ঘটল। বিমান থেকে কিছুতেই নামছিল না তার ছোট্ট পুতুলটা। বিমানের পেছনে গিয়ে দৌড়াচ্ছিল সীটে,করিডোরে, নির্বিঘ্নে-মনের আনন্দে। বড় বোনের তাকে রেখে বাড়ি চলে যাবার হুমকি , কেবিন ক্রুদের শত চেষ্টা ইত্যাদি ভয় থোরাই কেয়ার করছিল পিচ্চিটা। অন্যদিকে তার মা ছিল একেবারে নিশ্চিন্ত। লাগেজ গোছানো সেরে বললেন, মারিয়াম, (পিচ্চি পুতুলটার নাম) আই হ্যাভ সাম ক্যান্ডি ফর ইউ। ইফ ইউ ডোন্ট কাম, আই অ্যাম গনা গিভ অল দিস টু ইয়োর সিস্টার। সাথে সাথে পিচ্চিটা দৌড়ে হাজির হলো মায়ের কাছে। এখানে একটা বিষয় শিক্ষণীয় যে, কাউকে ম্যানেজ করতে তার আগ্রহ আর ড্রাইভিং ফোর্সের জায়গাটা খুজে বের করা জরুরী।

আমাদের দেশের মানুষ আরব আমিরাতকেই দুবাই নামেই চেনে। কৈশরে এক নষ্টালজিক বিটিভি নাটক দিয়ে দুবাই চিনেছিলাম। সেখানে এক ভগ্নিপতির কাছে শ্যালকের আবদার ছিল ”ট্যাকা দ্যাও দুবাই যামু”। সেই দুবাইতে পৌঁছে হোটেলের এক গাইড আর বিভিন্ন দেশের চার-পাঁচ জন ট্যুরিস্ট নিয়ে শুরু হলো আমাদের স্বপ্নযাত্রা। প্রথমেই গেলাম দুবাই মল- বিশ্বের বৃহত্তম শপিং সেন্টার।

দুবাই মল



এখানে অনেক আরব নারীদের দেখা মিলল। ছোটবেলায় আরবদেশ ঘুরে এসে এক বন্ধু বলে ছিল আরব মেয়েরা নাকি পরীর মত। কোথায় কিসের পরী। তাকে পেলে ধরে জিজ্ঞেস করতাম, ”ঐ ব্যাটা পরীদের কি কখনো এমন মুটকি হইতে দেকছস?”। আমাদের থাই গাইড আপা বললেন, আরব মেয়েদের মধ্যে নাকি শতকরা ৪০ ভাগের মত মেয়ে স্থুলকায়। আরেকটা অবাক ব্যাপার যে, আরব মেয়েদের অর্ধেকেরই নিজের কোন মোবাইল ফোন নাই। এই পরিসংখ্যান একদিকে যেমন নারীর নিজস্বতা/স্বাধীনতা হীনতা বোঝায় অন্যদিকে তাদের বিলাসি জীবনযাপনেরও ইঙ্গিত দেয়। আরব পুরুষদের বিলাসি জীবন ঘর ছাড়িয়ে আসতে পারলেও মেয়েদেরটা ঘরের মাঝে চার দেয়ালেই বন্দি। বলা যায় আরব মোল্লার দৌড় মসজিদ ছাড়িয়ে এখন বহুদুর হলেও তাদের স্ত্রী-কন্যাদের দৌড় শপিং মল পর্যন্তই- এই বিংশ শতকেও। হুমায়ুন আহমেদের মতে মেয়েদের প্রিয় বিশ্রাম হলো শপিং। সেই হিসেবে দুবাই মলকে মেয়েদের জন্য বিশ্বের সেরা বিশ্রামের যায়গা বলাই যায়। আমরা বিশ্বের নানা প্রান্তের কয়েকজন পুরুষ সেই মল মাত্র আধা ঘন্টায় ঘুরে গিনেস বুকে নাম উঠানোর ব্যবস্থা করে ফেললাম। এরপর উপভোগ করলাম মলের পাশেই সাগরের বুকে মনোমুগ্ধকর এক আয়োজন, জলের নাচ- ড্যান্সিং ফাউন্টেন। [আগ্রহীরা চাইলে ইউটিউবে ঢুঁ মেরে দেখে নিতে পারেন।]
মলের এক পাশেই বুর্জ আল খলিফা- আধা মাইলের বেশি উঁচু বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন। সামনে প্রতিবন্ধক না থাকলে এটা নাকি ভূ-পৃষ্টের ৯৫ কিলোমিটার দুর থেকেও দেখা যেত। এর ১৫০ তলা বা তার উপরের বাসিন্দাদের নীচের লোকদের চেয়ে ৫ মিনিট বেশি সময় ধরে রোজা রাখতে হয় কারণ তারা অন্যদের চেয়ে বেশি সময় সূর্য উদিত অবস্থায় দেখতে পান।

মেঘের উপর বাড়ি



বুর্জ আল খলিফা বনাম প্রতিযোগিরা



দুবাই ট্যুরিস্ট আর ইমিগ্রান্টদের কাছে অনেকটা স্বর্গের মত । এখানকার শতকরা প্রায় ৮৩ ভাগ মানুষই বিদেশি। ক্রাইম রেট প্রায় শুন্যের কাছাকাছি এখানে। এখানে লোকদের কোন ইনকাম ট্যাক্স দিতে হয় না। ট্রাফিক আইন লঙ্ঘণকারী বা দ্রুতগামী অপরাধী ধরতে ট্রাফিক পুলিশ Lamborghini, Ferrari ’র মত স্পোর্টস কার ব্যবহার করে। অন্যদিকে আমাদের পুলিশ, সরকারি বড়কর্তা বা তাদের বউ-বাচ্চারা পাজেরো ব্যবহার করেন শপিং মলে মূল্যছাড়ের শেষ সুযোগ ধরতে। এছাড়া বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল হোটেল, সবচেয়ে বড় শপিং মল, সর্বোচ্চ আবাসিক ভবনসহ সব ’বড়’ এর সমাহার এখানে। এসব কাজ করতে সারা বিশ্বের চারভাগের একভাগ ক্রেন এখানে নিয়োজিত। এতসব বৃহৎ এর মাঝে নিজেকে বড় ক্ষুদ্র মনে হতে লাগল। মানুষের এত টাকা থাকতে পারে! বিল গেটস এর টাকা বিষয়ে একটা অমর বাণী আছে “গরীব হয়ে জন্মানোর দোষ তোমার না-বরং গরীব থেকে মারা গেলে তার জন্য তুমিই দায়ী।” এটার একটা দেশি ফেসবুক ভার্সন আছে “তোমার বাবা গরীব, সেটা তোমার দোষ নয়, তোমার শ্বশুর যদি গরীব হয় তার জন্য তুমিই দায়ী।”
এরপর গেলাম দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সোনার বাজার-দুবাই গোল্ড সুক। সুক অর্থ বাজার। দুবাই গোল্ড সুকে যেতে পকেট ভর্তি টাকা টাকা হলেই চলবে তা না, বুকের পাটাও থাকতে হবে। গাইড আপা আমাদের সাথে একটু রসিকতা করতে চাইলেন,“ নো ওয়ান ব্লিং(ব্রিং) ওয়াইফ, সো ইউ হ্যাভ নো লিস্ক (রিস্ক ) অফ লুজিং মানি।” তাই রিস্ক প্রটেকশন (পর্যাপ্ত মূলধন) না নিয়ে বা সোনার প্রতি দুর্বল মেয়েদের এখানে নিয়ে আসার আগে আপনাকে দ্বিতীয়বার ভাবতে হবে। ১৯৯৯ সালে দুবাই শপিং ফেস্টিভালে এখানে মোট বাইশ কেজি ওজনের প্রায় চার কিলোমিটার দীর্ঘ একটা সোনার চেইন আনা হয়েছিল। সেটা এখন না থাকলেও বর্তমানে এখানে সাড়ে পাঁচ কেজি ওজনের একটা আংটিসহ আরও বেশ কিছু বিশালকায় অলংকার আছে।

সোনার আখড়া



২০১৩ সালে এই বাজারে প্রায় আড়াই হাজার টন (সাড়ে তিনশ আফ্রিকান হাতির সমান ওজন) সোনা কেনাবেচা হয়েছে। আরেকটা মজার ব্যাপার হলো দুবাইয়ে বেশ কিছু ATM আছে যেখানে আপনি নানা দেশের নানা রকম মুদ্রার পাশাপাশি গোল্ড বারও পেতে পারেন। ”টাইম ইজ গোল্ড, সামটাইমস ইট ইজ মোর প্রেশাস দ্যান গোল্ড।” তাই সোনার বাজার অনেকটা অদেখা রেখেই চলে আসতে হলো। শেষ বিকেলের দিকে সাগরতলে তৈরী সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে আমরা পৌছলাম বিশ্বের বিস্ময় পাম আইল্যান্ডে। পাম আইল্যান্ডের আকৃতি ভালভাবে বুঝতে চাইলে একে আকাশ থেকে দেখতে হয়। এই দ্বীপেই বিশ্বের অন্যতম সেরা পাঁচতারা হোটেল আটলান্টিস এর অবস্থান। সমুদ্রের নীচে এদের কয়েকটি বিলাসবহুল স্যুট আছে । এখানে ডলফিন আর মাছেদের সাথে ভেসে ভেসে কাঁচঘেরা জানালার কাছে এসে আপনি আপনার প্রেয়সীকে জানাতে পারেন মনের ভাষা "উইল ইউ ম্যারি মি" অথবা "আই লাভ ইউ"। আর এজন্য আপনাকে অবশ্যই মুসা বিন শমসের বা সাকিব আল হাসান হতে হবে। এখানে এক রাত থাকার জন্য খরচ ২৫ হাজার ডলার অর্থাৎ প্রায় ২০ লাখ টাকা মাত্র।

সমুদ্রবিলাস-১



সবশেষে যখন আল জামেইরা বীচে পৌছলাম তখন রাতের আকাশে একঝাঁক তারা। বীচের পাশেই বিশ্বের একমাত্র ৭ তারকা হোটেল, বুর্জ আল আরব। হাজার হাজার তারা আর প্রবল প্রতিপক্ষ চাঁদকে ম্লান করে নিজের অপূর্ব নীল-কমলা আলোয় জ্বলছিল বিশ্বের সবচেয়ে বিলাসবহুল এ স্থাপনাটি।

সমুদ্রবিলাস-২



সময়ের অভাবে দুবাই মিরাকল গার্ডেন দেখা হলো না। যেটা নাকি বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফুলবাগান। হার্ট, পিরামিড, ইগলু, গাড়ি ইত্যাদি আকারের নানান রকম রঙিন ফুলের গাছও দেখা হলো না। তাই এই আনন্দময় মরুযাত্রা শেষে এই ছোট্ট ভ্রমণটাকে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের মত মনে হচ্ছিল আমার, শেষ হইয়াও হইল না শেষ।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মার্চ, ২০১৬ বিকাল ৪:৩৫
১৯টি মন্তব্য ১৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×