বাহরাইনগামী এমিরেটস এর ফ্লাইটে আমার সহযাত্রীর কাছে মজার এক গল্প শুনে আমি প্রায় হাসতে হাসতে পড়েই যাচ্ছিলাম। অথচ একটু আগেও লোকটার মন ভীষণ খারাপ ছিল। একটা ছোট্ট মেয়ের ছবি সামনে নিয়ে বারবার দেখছিল। জামাল শেখ। স্ত্রী-কন্যা রেখে,সহায় সম্বল বেঁচে দিয়ে মরুদেশে পাড়ি দিচ্ছেন। বাজি ধরেছেন জীবন জুয়ায়- ভীষণ অনিশ্চয়তায় ।
আপনার মেয়ে? ছবিটা দেখে আমি জানতে চাইলাম। এই একটি কথাই তার জগৎ পাল্টে দিল। মুহূর্তে অন্য মানুষ হয়ে গেলেন তিনি। কথা আর গল্পের ঝুড়ি খুলে বসলেন- “হারিস মিয়া নামের এক বাংলাদেশি যুবক চাকুরি নিয়ে যাচ্ছিল আরব দেশে। সে যুগে ফেসবুক, মোবাইল বা ইমেইল ছিল না। রিক্রুটিং এজেন্সি তার কোম্পানিতে টেলেক্স করে জানিয়ে দিল “ Haris Mia Coming” । আরবীতে হারিস শব্দের অর্থ প্রহরী আর মিয়া অর্থ এক’শ। নির্দিষ্ট দিনক্ষনে সেই কোম্পানি এক হারিস মিয়াকে একশ জন ভেবে এয়ারপোর্টে ৫০ সিটের ২ টা বাস পাঠিয়ে দিল ।”
তার মত আরো অনেক জামাল অথবা হারিস মিয়াদের সাথে মেঘে ভেসে ভেসে পৌছে গেলাম মরুর দেশ, বাহরাইন। গাল্ফ এর বুকে মুক্তোদানা সদৃশ ছোট্ট দ্বীপদেশ-মুক্তার দেশ, ল্যান্ড অব পার্ল।
আমরা করি সমুদ্রবিজয় আর তারা করে সমুদ্রশাসন
প্রাচীনকাল থেকেই পৃথিবীর অন্যতম ব্যবসাকেন্দ্র। আমি অবশ্য ব্যবসা করতে এখানে আসিনি। বরং বলা যায় এসেছি ব্যবসা শিখতে। সুদমুক্ত ব্যাংকিং ব্যবসা। এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে নেমে ফ্রেশ হলাম। নরম বিছানা চুম্বকের মত টানছিল আমার শরীরকে। মনকে শরীরের বিরোধী দল বানিয়ে দিলাম। আমি এখানে ঘুমাতে আসিনি। দেশের একটি ধানের শীষের উপর একটি শিশির বিন্দু দেখা শেষ। “ঘর হইতে তাই দুই পা ফেলিয়া” এসেছি দুর দেশে। মুক্তা সদৃশ শিশির বিন্দু নয়,আসল মুক্তা দেখার সময় এখন। “বাঁচতে হলে দেখতে হবে, জানতে হবে”- বাণীতে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমি হোটেল থেকে বের হয়ে এলাম। বাইরে আলোকিত নগরী। চোখ ধাধিঁয়ে গেল। ঝলমলে সব দোকানপাট, হোটেল-রেস্টুরেন্ট। রাস্তায় প্রচুর বাংলাদেশি। বাংলায় লেখা হোটেল-রেস্তোরা চোখে পড়ে। কি অদ্ভূত! দেশের বাইরে দেশ! একটা নিরিবিলি বাংলা হোটেলে ঢুকে পড়লাম। আমাদের দেশের সাধারন রেস্তোরাগুলোর মতই। ছোটমাছ, ভর্তা-ভাজি সবই আছে।
পরের দিন সকাল সকাল পৌছে গেলাম হোটেল শেরাটন ব্লুতে। যেখানে আমাদের সেমিনার। সামনের রাস্তার উল্টাদিকেই কুরআন যাদুঘর, বাইত-আল কুরআন । যেখানে প্রবেশ করা যায় সকাল দশটা থেকে বিকাল চারটার মধ্যে। এর মধ্যে দুপুরে আবার নামাজের বিরতি। সুতরাং ক্লাস ফাঁকি না দিয়ে সেখানে যাবার সুযোগ নেই। মাত্র আধ ঘন্টার ক্লাস ফাঁকিতে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না বরং আমি কিছু একটা হারাবো। আর ক্লাস ফাঁকি না দিয়ে কে কবে নজরুল,রবীন্দ্রনাথ হতে পেরেছিল। বেলা এগারটার চা বিরতিতে চলে গেলাম সেখানে। অনন্য ইসলামিক ইতিহাসের সাক্ষী হলাম।
বাইত আল কুরআন এর ভেতরে, গম্বুজে ক্যালিগ্রাফি
দেয়ালে মাছ আকৃতির ক্যালিগ্রাফি
সপ্তম-অস্টম শতকের কুরআন
চমৎকার সব ক্যালিগ্রাফি আর কাঠ এবং ধাতুতে খোদাই করা ক্ষুদ্রাকার,বৃহদাকার নানা রকমের কুরআন সমারোহ ! আল্লাহর বাণীর এক অনুপম প্রদর্শনী। সন্ধ্যায় ক্লাস থেকে বেরিয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম পায়ে হেটেই হোটেলে ফিরব। একটু এগোতেই পার্ক। পাশে আরব সাগর।
মরুসৈকত
পার্কের একটা বেঞ্চে বসলাম। সাগরের একপাশ জুড়ে ঝলমলে রেস্টুরেন্ট-বাড়িঘর। ছোট্ট এক জাহাজ ভেসে যাচ্ছে সাগরের অন্যপ্রান্ত দিয়ে। থাইল্যান্ডের পাতায়ার মত সংক্ষিপ্ত একটা বীচ। একজন ইউরোপিয়ান তরুন প্রেয়সীর কোমর জড়িয়ে হেটে যাচ্ছে। হাওয়ায় ভাসছে প্চল। সাগরের মৃদু গর্জন। ভীষণ রোমান্টিক রাতের সমুদ্র। এমন সময় প্রিয়তম/প্রিয়তমা পাশে না থাকা ভীষণ অন্যায়। এরকম পরিবেশেই বোধহয় বিখ্যাত ব্যান্ড Eagles এর কালজয়ী গান Hotel California’র সৃষ্টি হয়েছিল-“On a dark desert highway, cool wind in my hair
Warm smell of colitas, rising up through the air
I saw Shaw a shimmering light and my sight grew dim”
”ঘোর আধার মরুপথ,প্রশান্ত হাওয়ায় উড়ছে চুল
সবুজ নেশার উষ্ম ঘ্রাণ, চোখে আলোকিত বিভ্রম।”
আর গানের শেষ লাইনটা এমন ছিল, “ You can check-out any time you like,But you can never leave! "
আমাদের এই দুনিয়া নামের রঙ্গশালাই কি গানের সেই হোটেল ক্যালিফোর্নিয়া ? যেখানে হারানোর পথ অনেক কিন্তু পালাবার পথ নেই। বড় ভাবের কথা। এর মানেই বা কি? আমাদের লালন শাহ বেঁচে থাকলে হয়তো গানের সুরে বুঝিয়ে বলতে পারতেন।
বাহরাইনে শেষ দিনের সেমিনার। লাঞ্চের সময় প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর আমাদের কাছে জানতে চাইলেন “হোয়াট ইজ দ্যা বেস্ট থিং হিয়ার ইন বাহরাইন টু ইউ?” উত্তরে এক কোরিয়ান Participant এর জবাব খানা ছিল ক্লাসিক-“দ্যা বেস্ট থিং ইজ ওয়াইফ ইজ নট হিয়ার অ্যান্ড আইম নাউ ফ্রি ফ্রম হার।” দুনিয়ার বেশিরভাগ পুরুষেরই কি একই ভাষা? বিয়ের পর এমনিতেই ছেলেরা নাকি ব্যাচেলর ডিগ্রি হারায় আর মেয়েরা পায় তার মাস্টার্স। দুপুরের ভারী খাবার শেষে ক্লাসের সবাই তখন ফুড কোমাতে। ডাক্তারি পরিভাষায় যাকে বলে " Post prandial Somnolence”। কেউ কেউ ততক্ষনে মৃত্যুর ভাইকে ডাকতে শুরু করেছে। গ্রীক মহাকবি হোমারের ভাষায় ঘুম হলো মৃত্যুর সহোদর। এমন সময় কারই বা ইচ্ছা করে ক্লাসে মনোযোগ দিতে। আমি নোটবুকে হাবিজাবি লিখতে শুরু করলাম। এমন সময় পাশের এক মালয়েশিয়ান আমাকে জিজ্ঞেস করল, ইউ আর রাইটিং বাংলা, রাইট?
আমি একটু অবাক হলাম। বললাম “ইয়েস, গ্রেট টু হিয়ার দ্যাট ইউ প্রনাউন্সড বাংলা নট বেংগলী অর বংগালী। আমি নিশ্চিত, এই পাবলিকের তার দেশের বিসিএস পরীক্ষা দেবার অভিজ্ঞতা আছে। তা না হলে এসব দেশ, জাতি, ভাষা রাজধানী মুখস্ত রাখা কি চাট্টিখানি কথা ? [ মরুযাত্রা ২ঃ ড্রিম ইন দ্যা ডেজার্ট]
N.B. Most of the pictures were taken from the Internet