somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সুনীল স্মরণে

২৪ শে অক্টোবর, ২০১২ বিকাল ৪:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আমার এক খালাতো বোন বয়সে আমার দুই বছরের বড়। থাকে রংপুরে। ছোটবেলায় ঢাকা থেকে ওদের বাসায় বেড়াতে গিয়ে সপ্তাহখানেক থাকা হত। আমার ঐ বোনটি খুব সরলপ্রকৃতির। ওকে নিয়ে খুব হাসাহাসি হত। শুধু একটা উদাহরণ দেই- সে বাংলা বা হিন্দী সিনেমার যে পর্যায়ে ‘বিরহ’ অর্থাৎ ‘দুঃখের অংশ’ শুরু হত, তখন কেঁদে ফেলত! আমরা ছেলেরা সেটা দেখে খুব মজা পেতাম। ভাবতাম, সিনেমা দেখে আবার কেউ কাঁদে নাকি!

পরবর্তীতে যখন বয়ঃসন্ধিকালে যখন বইয়ের নেশায় ডুবে গেলাম, তখন এই আমি বইয়ের কোন চরিত্রের দুঃখে কেঁদেছি, দিনের পর দিন ভেবেছি- এমন কেন হল? এটা না হলে কি হত! খুব রাগ লাগত লেখকের উপর!

আগেও বিভিন্ন জায়গায় লিখেছি, আমার বইয়ের নেশা শুরু সেবা প্রকাশনীর বই দিয়ে। কিশোর, মুসা, রবিন, রাজুদের সাথে প্রতি সপ্তাহে অ্যাডভেঞ্চারে বেরিয়ে পড়তাম। পড়ার বইয়ের ভিতর গল্পের বই লুকিয়ে পড়া- সেই সাথে ধরা পড়ার ভয়ে বুকে ধুকপুকানি! এমনকি স্কুলেও পিছনের বেঞ্চে বসে বইয়ের ভিতর সেবা-র বই পড়তাম। তবে খারাপ লাগত- সেবা প্রকাশনীর বই নিয়ে আমাদের অভিভাবক, শিক্ষকদের মধ্যে একটা অযথা ভীতি নিয়ে। ওঁরা ভাবতেন, সেবা-র বই পড়ে অল্প বয়সে ছেলেমেয়েরা ‘পাকনা’ হয়ে যাবে। পাকনা হয়ত কিছুটা হয় সবাই, কিন্তু সেবা-র বিশ্বসেরা ক্লাসিক, অনুবাদ বইগুলো পড়ে প্রতিটি শিশু-কিশোর-তরুণের যে নতুন জন্ম হয়, পৃথিবীর বিশালত্ব বুঝতে শেখে- সেটা আসলে যে শৈশবে সেবা-র বই পড়েনি তাকে বোঝানো অসম্ভব!

সেটা অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ। সেবা-র বই তো সবসময় কিনতে পারতাম না। স্কুল বয়সে ২০ টাকা একবারে পাওয়া কঠিন ছিল। মাসে হয়ত ১/২ টা বই কিনতে পারতাম টিফিনের টাকা জমিয়ে, পুরনো পত্রিকা বেচে। কিন্তু একটা বই শেষ করতে লাগত দুই থেকে তিনদিন। তারপর?

তারপর যেতাম আশেপাশের লাইব্রেরীগুলোতে যেখানে বই ভাড়া দেয়া হয়। একসময় লাইব্রেরীর সংগ্রহে থাকা সেবা-র সব বই পড়া শেষ হয়ে যায়। তখন হাতে আসে সুনীল, সমরেশ, শীর্ষেন্দু, সত্যজিৎ রায়ের শিশুতোষ বইগুলো। এ এক অন্য জগত! সেবা-র বইয়ে যেখানে বাইরের দুনিয়াকে কল্পনার চোখে দেখতাম- সেখানে প্রফেসর শঙ্কু, ফেলুদা, কাকাবাবু, সন্তু, অর্জুনদের মনে হত পাশের বাড়ির মানুষ। এমনকি কিকিরা (কিশোর কিঙ্কর রায়)কেও খুব ভাল লাগত!

বয়স বাড়ে, রুচির পরিবর্তন হয়। ছোটদের বই ছেড়ে হাত বাড়াই ‘বড়’দের বইয়ের দিকে। মাসুদ রানা, কুয়াশা যেমন পড়ি- তেমন পড়ি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, হুমায়ূন আহমেদ, সমরেশ মজুমদার, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব গুহ, বিমল করদের উপন্যাস। বন্ধুদের সাথে বই আদান প্রদান করি। একেক জনের একেক সাজেশন, সবাই সবার সাজেশনে বই পড়তাম, কিনতাম। কয়েকজন পয়সাওয়ালা বন্ধু ছিল যাদের জন্য আমি সেগুনবাগিচার সেবা প্রকাশনী অফিস থেকে, বাংলাবাজার, নিউ মার্কেট থেকে বই কিনে এনে দেতাম- বিনিময়ে পেতাম পড়ার সুযোগ। বৃহৎ উপন্যাসের মধ্যে আমার প্রথম পড়া বই সমরেশ মজুমদারের ‘কালবেলা’। আগে ভাবতাম, বিভিন্ন বাসায় দেখি এত মোটা মোটা বই- এগুলো কেউ পড়ে? নাকি এনসাইক্লোপিডিয়ার মত সাজিয়ে রাখে! ‘কালবেলা’ পড়ে আমার ভুল ভাঙ্গল। মাধবীলতার প্রেম পড়লাম। তারপর যেটা হল- ‘সবিনয় নিবেদন’ এর মত ‘চটি’ সাইজের বই শেষ করতে লাগে দুই ঘন্টা, ‘পূর্ব-পশ্চিম’-এর একখন্ড শেষ করতে লাগে বড়জোড় এক সপ্তাহ! মাধুকরীর মত ‘শক্ত’ বই শেষ করতে দুই সপ্তাহ লেগে যেত!

এসএসসির পর অবসরে একটা লাইব্রেরীতে বিনা পয়সায় ‘কামলা’ দিতাম! আর প্রায়ই একটা করে বই হাতে নিয়ে বাসায় ফিরতাম। পুরো নটরডেম কলেজ জীবন আমি দুইটা কাজ মনোযোগ দিয়ে করেছি- এক. গল্প-উপন্যাস পড়া, দুই. নটরডেমের কম্পিউটার ক্লাবে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটানো (এটা নিয়ে একটা মজার অভিজ্ঞতা পরে শেয়ার করব)।

তারপর তো আরও স্বাধীনতা! বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে শুধু নিয়মিত প্র্যাকটিকাল ক্লাস করা আর পরীক্ষার আগের দিন ‘চোথা’ ফটোকপি করে মুখস্থ করা ছাড়া আর কোন কাজ আছে! রুখবে আমায় কে?

আমার সেই স্বাধীনতায় ছেদ পড়ে কর্মক্ষেত্রে যোগ দিয়ে। এখন আমার পকেট ভর্তি টাকা- কিন্তু বই পড়ার একঘন্টা অবসর নেই। চাকরির কারণে স্ত্রী-সন্তানদের সময় দিতে পারি না- বইয়ের কথা বলাই বাহুল্য!

আমার এই অনাবশ্যক খন্ডিত আত্মজীবনী ব্লগে লেখার একটাই কারণ- আমি ২০১২ সালটিকে ভাবছি জীবন থেকে মুছে দিব! কারণ হল- একটা বছরে এতগুলো প্রিয় মানুষ কিভাবে চলে যায়! আমার তো তেমন বয়স হয়নি- হিসেবে তেত্রিশ বছরই! সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এই বয়সেই তো অভিযোগ করেছেন- কেউ কথা রাখে না! আমি তো দেখছি সেটাই সত্যি! সুনীল নিজেই আমার জীবনের তেত্রিশ বছরটিকে আফসোসের বছর করে রেখে গেলেন!

তেত্রিশ বছরের জীবনে হয়ত বাংলা সাহিত্যের ক্ষুদ্র একটা অংশে আমি প্রবেশ করেছি- কিন্তু এই ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা বলতে পারি- আমার চোখে সবচেয়ে ‘নিখুঁত’ সাহিত্যিক হলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তার যত উপন্যাস, কবিতা, শিশুতোষ বই পড়েছি- কোথাও তার লেখার গাঁথুনি দুর্বল মনে হয়নি, কোন ঘটনাপ্রবাহকে অহেতুক টেনে লম্বা করতে দেখিনি, কোথাও ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ চাপিয়ে দেননি, ধর্ম নিয়ে বিতর্ক তৈরি করেননি- গল্পের প্রয়োজনে সামনে যা এসেছে- তিনি সেটা নিরপেক্ষদৃষ্টিতে বর্ণনা করেছেন। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে খুব কমই জানি- কিন্তু লেখার মাধ্যমে তাকে আমার একজন পরিপূর্ণ ভদ্রমানুষ মনে হয়েছে। তাঁর ব্যক্তিত্ব, কথা বলার ভঙ্গিমা- সবই ছিল ঈর্ষণীয়! তিনি পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী হলেও বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁর কোন উন্নাসিকতা ছিল না। তিনি এমনই একজন মানুষ যাকে শ্রদ্ধা না করে পারা যায় না।

আমার মনে আছে, ‘সেই সময়’ শেষ করার পর আমি প্রায় এক সপ্তাহ একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। নবীনকুমার নামের মানুষটির জন্য মনটা কেমন যেন করছিল! কোন উপন্যাস, কোন চলচ্চিত্র যদি মানুষের বাস্তব জীবনের ছন্দপতন ঘটাতে পারে- তাহলে সেই সৃষ্টির প্রশংসা করতেই হবে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লেখা পড়ে আলোড়িত হননি- এমন পাঠক খুব কমই পাওয়া যাবে।

সম্ভবত, ‘বুকের মধ্য আগুন’ আমার পড়া সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাস। ‘একা এবং কয়েকজন’ নামের উপন্যাসে সূর্যকুমার ভাদুড়ীর তেজ আমাকে দীপ্ত করেছিল। ‘এলোকেশী আশ্রম’, ‘সোনালী দুঃখ’, ‘পায়ের তলায় সরষে’, 'যুবক যুবতীরা'- এরকম অসংখ্য শব্দমালা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রতিশব্দে পরিণত হয়েছিল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এমনই এক অধ্যায়- যার সীমা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর!

বাংলাদেশী কোন ম্যাগাজিনের ঈদসংখ্যা কিনলে হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস আছে কি না আগে দেখতাম এবং কেনার পর আগে হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসই গোগ্রাসে গিলতাম। ঠিক তেমনিভাবে দেশ বা আনন্দমেলার পূজা সংখ্যা হাতে পেলে আগে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখাটাই পড়া হত।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর নেই! উপমহাদেশের হিসেবে ৭৮ বছর অবশ্যই দীর্ঘ সময়- কিন্তু প্রিয় মানুষের জন্য বড্ড কম সময় মনে হয়। বাংলা সাহিত্যের শীর্ষত্বের মুকুট মাথায় নিয়েই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রয়াত হয়েছেন- তাঁর হয়ত দেবার আরও কিছু ছিল- কিন্তু তিনি বাংলা সাহিত্যকে যা দিয়েছেন, আমাদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম চেষ্টা করলেও সেই ঋণ শোধ হবে না।

এই গুণী সাহিত্যিকের মৃত্যুতে গভীর শোক ও বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই!
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ২:১২
৩টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×