বঙ্কিম যেই বাঙালির শ্রেষ্ঠত্বের কাহিনী লিখতে চেয়েছিলেন সেই বাঙালি মুসলমান আগমনপূর্ব বাঙালি। মুসলমানদের তিনি বাঙালি মনে করতেন না। ফকির সন্যাসী বিদ্রোহকেও তিনি বানিয়ে ফেলেছেন শ্রেফ সন্যাস বিদ্রোহ। মজনু শাহ সেইখানে অপসৃত, মুসলমানরা সেইখানে ব্রিটিশদেরচেও বড় ভিলেন। পরের কালে পালটা জবাব দিতে মুসলমানরাও শিখেছে।
রমেশচন্দ্র মজুমদার কর্নাটক থেকে আসা বহিরাগত সেন রাজা’দের প্রশংসা করে লিখেছেন, ““বিজয় সেনের রাজত্ব বাংলার ইতিহাসে একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা। বহুদিন পর একটি দৃঢ় রাজশক্তি প্রতিষ্ঠিত হইয়া দেশে সুখ ও শান্তি আনয়ন করিয়াছিল।” রমেশচন্দ্র, ১৯৯৮; ১০৭)
মুসলমানরাও একিরকম ঔপনিবেশিক ইতিহাসচর্চার কায়দায় প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। যেমন, মোহাম্মদ আবদুল মান্নান লিখেছেন: জনগণ বহিরাগত সেন শাসন উচ্ছেদকারী বখতিয়ার খিলজীকে আরেক বহিরাগত উৎপীড়ক হিসাবে দেখেননি; বরং এই মুসলিম বিজেতার মাঝে তারা দেখেছেন তাদের মুক্তিদাতার প্রতিচ্ছবি।” মান্নান, ২০০৬;১০৪)।
এই যে পাল্টাপাল্টি ইতিহাস চর্চা, এর শুরু সেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কালে। নিজের নিজের পূর্ব পুরুষের বিরত্বগাথা, আর জমির উপর নিজের পূর্বপুরুষদের বৈধ মালিকানা দাবি করে পালটা পালটি ইতিহাস চর্চা এককালে শুরু হয়েছিল হিন্দু-মুসলিম মেরুকরণ দিয়া। আজকাল যখন বেগম খালেদা জিয়া ঘোষনা করেন –‘আওয়ামীলীগ মুক্তিযুদ্ধ করে নাই’ আর শেখ হাসিনা যখন আওয়াজ তুলেন – ‘জিয়াউর রহমান রাজাকার ছিলেন’ তখন সেই ঔপনিবেশিক ইতিহাস চর্চার ধারাবাহিকতা, ঔপনিবেশিক হীন্যমনতা আর তার হাত ধরে উপনিবেশের জয়ই অব্যাহত থাকে। আর উপনিবেশকে মাথায় তুলে রেখে, উপনিবেশকে শ্রেষ্ঠ মেনে কখনো উপনিবেশের বিরোধীতা করা যায়না। ফলাফল সৈন্য সামন্ত ছারাই প্রাক উপনিবেশী রাষ্ট্রগুলোর উপর ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব টিকিয়ে রাখা যায়। নয়া-উপনিবেশের কড়ি-বর্গার অন্তর্গত রাজনৈতিক শ্রেণীর উপনিবেশ বিরোধীতার নৈতিক শক্তি নাই, তার জ্ঞান, বোধ আর রূচি ঔপনিবেশিক হেজিমনিতে পচন ধরা। প্রাক্তন উপনিবেশক প্রভুর মতোই লুটপাট করে প্রভুর ভোগবাদী জীবন যাপনের অনুকরণ করাই তার একমাত্র কাজ। ঔপনিবেশিক আধিপত্ব্বের বিরুদ্ধে লড়াই করার নৈতিক শক্তি যেমন তার নাই তেমনি পশ্চিমা প্রভুর ভোগবাদী জীবনাচারের অনুকরণে তাকে সহায়তা করার জন্যে পুরনো রূপেই কর্তৃত্ব এবং বন্ধুত্ব নিয়ে আবারো ফিরে এসেছে উপনিবেশ।
উপনিবেশ বরাবরই কৃত্তিম ঐক্য দাবি করে। একি ভুখন্ডে আলাদা আলাদা ভাষা, ধর্মের মানুষের সহাবস্থানের যেই ঐক্য এই ঐক্য তা না। উপনিবেশ দাবি করে সরল পরিচয়ের ঐক্য। এতে ঔপনিবেশিক শাসনে সুবিধা হয়। বহু জাতি গোষ্ঠির ভুখন্ড তাই ব্রিটিশ শাসনের অধিনে পরিণত হয় ‘ইন্ডিয়া’ নামক একক উপনিবেশে। এই ঐক্য দাবি করে এক ভাষা, এক জাতির। এমনকি ঔপনিবেশিক প্রভুর যখন বিদায় নেয়ার সময় হয় তখন তাদের বিরুদ্ধে জনগণের জনপ্রিয় আন্দোলনের প্রতিনিধিত্বকারী শিক্ষিত মধ্যবিত্ত্ব এবং উচ্চবিত্ত্বের রাজনৈতিক দলও এই ঔপনিবেশিক ঐক্যের ডিসকোর্স ভাঙতে পারেনা, আমাদের ক্ষেত্রে তা হয়ও নাই। কংগ্রেস এবং মহাত্মা গান্ধী ঠিক ঔপনিবেশিক ইন্ডিয়ার মানচিত্র অনুযায়ী জন্ম দিতে চেয়ছেন স্বাধীন ভারত। ব্রিটিশরা যেমন গোটা ভারতবর্ষে এক কর্তৃত্বকারী ভাষা ইংরেজির প্রচলন ঘটিয়েছে, মহাত্মা ঘান্ধিও তেমনি সারা ভারতে হিন্দি ভাষা’র প্রচার প্রসারের জন্যে খাটাখাটনি করেছেন, ‘দক্ষিন ভারত হিন্দী প্রচার সভা’ গঠন করে দক্ষিন ভারত দাবিয়ে বেরিয়েছেন। এক জাতি তত্ত্ব ভাত পায়নাই। তাই দ্বিজাতী তত্ত্বের আবির্ভাব, সেই ঔপনিবেশিক হিন্দু-মুসলমান মেরুকরণ কেন্দ্র করে। সেই দুই রাষ্ট্রেও একি রকম ঔপনিবেশিক কাঠামো। পাকিস্তানে ‘বাঙলা’ ভাষার জন্যে যেমন বাঙালিকে লড়তে হয়েছে আধিপত্ত্ববাদী ঊর্দু ভাষার বিরুদ্ধে, ভারতে তামিলদের লরতে হয়েছে হিন্দী ভাষার বিরুদ্ধে। আর এখন স্বাধীন বাংলাদেশে বৃহৎ দুই রাজনৈতিক দলের একপক্ষ বাংলাদেশকে ৯০ভাগ মুসলমানের ঐক্যের দেশ দাবি করে আরে আরেক পক্ষ ৯৫ ভাগ বাঙালির ঐক্যের দেশ দাবি করে ঔপনিবেশিক ঐক্যের ধ্যান ধারণা টিকিয়ে রেখেছে।
আমাদের এককালে ব্রিটিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে। ব্রিটিশ উপনিবেশ বিদায় নিয়েছে, তার জায়গা দখল করেছে মার্কিনপন্থী পাকিস্তানি উপনিবেশ আর তার দেশীয় দালাল শ্রেণী। ভাষা আন্দোলন আর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়া আমরা বি-উপনেবিশায়নের জরুরি দুইটা স্তর পার করে এসেছি। তারপরও স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের এখন মার্কিন, ইউরোপিয়, ভারতিয় উপনিবেশ আর তার দালাল শ্রেণীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হচ্ছে। শুধুমাত্র বিদেশী কর্তৃত্ব আর তার দেশীয় দালাল শ্রেণীকে উচ্ছেদ করতে পারলেই যে উপনিবেশকে উচ্ছেদ করা যায়না ইতিহাস তা সাক্ষ্য দেয়। বাংলাদেশের জ্বালানী সম্পদের উপর থেকে বহুজাতিকের কর্তৃত্ব উচ্ছেদ করতে এবং তাতে বাংলাদেশের জনগণের শতভাগ মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে তাই সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করতে হবে নয়া উপনিবেশের কড়ি-বর্গা নামক ঔপনিবেশিক ক্ষমতা কাঠামো।
দ্যা গ্রেট গেম , ইতিহাস ফিরে দেখা
নয়া উপনিবেশের সাম্প্রতিক রাজনীতি অনেক জটিল। তবে পুরনো ইতিহাস খুলে দেখলে এই জটিলতায়ও অতীতের পুনরাবৃত্তি খুঁজে পাওয়া যায়। পুরনো ঔপনিবেশিক শক্তিগুলার মাঝের দ্বন্দ, ঐক্য আর উপনিবেশিত জনগনএর উপর তাদের সম্মিলিত কর্তৃত্বের বাসনা নির্নয় করা যায়। The great game শব্দটা প্রথম ব্যবহার করেন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সিক্সথ ব্যঙ্গল লাইট ক্যাভেলরি’র একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা আর্থার কনোলি, উনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে। শুরুতে এসপিওনাজ বিষয়বস্তু হলেও পরবর্তিতে The great game শব্দের ব্যবহার বিভিন্ন পশ্চিমা গণমাধ্যমেও উঠে আসে। এই মহা খেলা ছিল মূলত মধ্য এশিয়ায় বিশেষ করে আফগানিস্তান কেন্দ্র করে ব্রিটিশ উপনিবেশ আর রাশিয়ান সাম্রাজ্যের মধ্যে কৌশলগত স্নায়ু যুদ্ধ, ইন্টিলিজেন্স ওয়ারফেয়ার আর তিন তিনটা এংলো-আফগান যুদ্ধ। রাশিয়ায় একে বলা হয় Tournament of shadows.
ইউরোপিয় শক্তিগুলার মধ্যে শুরুতে ডাচরা ঔপনিবেশিক সুপার পাওয়ার হিসাবে আবির্ভুত হয়, এই অবস্থানের জন্যে ইংল্যান্ড আর ফ্রান্সএর মধ্যে লড়াই চলেছে দীর্ঘদিন। আর এই লড়াইয়ের অন্যতম লক্ষ্য ছিল ব্রিটিনের রানীর ‘জুয়েল অভ দা ক্রাউন’ ভারতিয় উপমহাদেশের উপর নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা। ভারতিয় উপমহাদেশের উপর নিয়ন্ত্রন ছিল বলেই ব্রিটিশরা ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উপরে জায়গা করে নিতে পেরেছিল। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট মিশর দখল করে সুয়েজ খাল খননের কাজ শুরু করেন লোহিত সাগর দিয়ে যেনো বিপূল সংখ্যক ফরাসি সৈন্য পাঠাতে পারেন তৎকালিন সময়ে বাঙলায় শক্ত খুটি গেড়ে বসা ব্রিটিশদের উৎখাত করার জন্যে। নেপোলিয়নের সেই স্বপ্ন পুরণ হয়নাই। খোদ ইউরোপেই রাজনৈতিক নানা টানাপোরেনে তাকে এই অভিযান বাদ দিয়া নিজের মুকুট সামলাতে ব্যস্ত হতে হয়। নেপোলিয়নের পতনএর পর ফরাসীরা ভারতবর্ষের উপর ব্রিটিশদের কর্তৃত্বকে আর চ্যালেঞ্জ জানাতে যায়নাই।
১৮০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই মধ্য এশিয়ায় সাম্রাজ্য বিস্তারে মনযোগ দেন রাশিয়ার জার আলেক্সান্দার ১। ইরানের শাহ ফাতহ আলী তখন ব্রিটিশদের সাথে চুক্তিবদ্ধ ছিলেন এই মর্মে যে ভারতিয় উপমহাদেশে অন্যকোন ইউরোপিয় শক্তিকে তিনি ঢুকতে দেবেন না। কিন্তু রাশিয়া মধ্য এশিয়ার বেশকিছু ইরানী শাসনাধিন অঞ্চল জয় করে নিলে ইরান ব্রিটিশদের সাথে চুক্তি ভেঙে রাশিয়ার সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পরে। যুদ্ধে জয় হয় রাশিয়ার। ১৮১৩ সালে ‘গুলিস্তানের সন্ধিচুক্তি’র মাধ্যমে আজারবাইজান, জর্জিয়া প্রভৃতি মধ্য এশিয় রাষ্ট্রে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে রাশিয়ান সাম্রাজ্য, আর সেই থেকেই শুরু হয় ‘মহাখেলা’। অল্প সময়ের মাঝে পুরো মধ্য এশিয়ায় নিজেদের নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয় রাশিয়া, আবির্ভুত হয় ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দী হিসাবে। রাশিয়ানদের সাম্রাজ্য এসময় বিস্তৃত হয় একেবারে আফগানিস্তানের সীমানা পর্যন্ত। আফগানিস্তান হয়ে ভারতবর্ষে প্রবেশ করতে পারে রাশিয়া, এটাই ছিল ব্রিটিশদের মূল দুঃশ্চিন্তা। ব্রিটিশদের বিরোধীতা সত্ত্বেও আফগানিস্তানে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সংকল্প করে রাশিয়া, ভারতে প্রবেশের ইচ্ছাতেই। আফগানিস্তান পরিণত হয় দুই ইউরোপিয় শক্তির রাজনৈতিক আধিপত্ব বিস্তারের ফ্রন্টিয়ারে। ফলস্বরূপ ১৮৩৮ এবং ১৮৭৮ সালে সংগঠিত হয় প্রথম ও দ্বিতীয় এংলো-আফগান যুদ্ধ। ১৮১৩ সালে শুরু হওয়া এই‘মহাখেলা’ চলে ১৯০৭ সাল পর্যন্ত। এই পুরো সময়ে আফগানিস্তান এবং আশেপাশের অঞ্চলে কখনো রাশিয়ানরা আবার কখনো ব্রিটিশরা নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়। চলে নানান রকম এসপিওনাজ মিশন, গোপন চুক্তি, এই মহাখেলায় এমনকি নানাভাবে যুক্ত হয় ফ্রান্স এবং আরো কিছু ইউরোপিয় শক্তি। উনবিংশ শতকের শেষের ভাগে এবং বিংশ শতকের শুরুর ভাগে মঙ্গোলিয়া এবং তিব্বতে নিজেদের নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করে রাশিয়া। বিশেষ করে ১৯০৪ সালে লাসা দখল করে নেয়ার পর ভারতে রাশিয়ানদের প্রবেশ ছিল সময়ে ব্যাপার মাত্র। কিন্তু জাপানের কাছে লজ্জাজনক পরাজয় আর অন্তর্কলহের জের ধরে ভারতে প্রবেশ করে ব্রিটিশদের সাথে আরো বড় যুদ্ধে জড়িয়ে পরার ঝুকি তখন আর নেয়নাই রাশিয়ানরা। তবে বিংশ শতকের গোড়া থেকেই জার্মান’রা মধ্য এশিয়ায় নিজেদের উপনিবেশ বিস্তারের তৎপরতা শুরু করলে ১৯০৭ সালে এংলো-রাশিয়ান কনভেনশনের মধ্য দিয়া সাময়িকভাবে ‘মহাখেলা’র সমাপ্তি ঘটায় এই দুই পরাশক্তি, মধ্য এশিয়ার নিয়ন্ত্রন নিজেদের মাঝে ভাগ বাটোয়ারা করে নেয়ার স্বিদ্ধান্ত হয়। ১৯১৭তে বলশেভিক বিপ্লবের পর সংগঠিত হয় মহাখেলার শেষ ধাপ। রাশিয়ার মদদপুস্ট আফগানিস্তান ১৯১৯ সালে তৃতীয় এংলো-আফগান যুদ্ধে ব্রিটিশ কর্তৃত্ব উৎখাত করতে সক্ষম হয়। ১৯২১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আর আফগানিস্তানের মাঝে হয় মৈত্রিচুক্তি। এসময় রাশিয়া আফগানিস্তানকে প্রচুর পরিমান টাকা, অস্ত্র, প্রযুক্তি দেয়, সেইসাথে একধরণের হেজিমনিগত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। প্রথম ‘মহাখেলার’ সমাপ্তি টানা হয় এইখানেই।
নয়া উপনিবেশের সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক রাজনীতি, দ্বিতীয় মহাখেলাঃ
“যুক্তরাজ্য, পশ্চিম ইউরোপ এবং তোমরা মার্কিনিরা, আমরা আবার ‘গ্রেট গেম’ খেলতে ফেরত এসেছি। এবং এইবার আমরা জয়ের লক্ষ্যেই আছি”। -ব্রিটিশ প্রিন্স এন্ড্রু (উইকিলিক্সে ফাস হওয়া তারবার্তা থেকে)
প্রিন্স এন্ড্রু রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের পুত্র। মধ্য এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে তিনি পালন করেন যুক্তরাজ্যের বানিজ্যিক দ্যুতের গুরু দায়িত্ব। মার্কিন রাষ্ট্রদ্যুতের সাথে তার কথপোকথনের ফাস হওয়া তারবার্তা সেই সন্দেহেরই স্বিকৃতি দেয় যে গ্রেট গেম ফেরত এসেছে। গ্রেট গেমএর ইতিহাস যারা জানেন আর গত কয়েক দশকের আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রতি তিক্ষ্ণ দৃষ্টি যারা রাখছেন গ্রেট গেম’এর ফিরে আসাটা তাদের সন্দেহের মধ্যে ছিল আগে থেকেই। পুরনো জমিতেই গ্রেট গেমএর নতুন মঞ্চায়নে এবার মূল আরাধ্য অবশ্য এখন আর ভারতবর্ষ না, বরং মধ্যপ্রাচ্য এবং এর আশেপাশের জ্বালানি সম্পনে সম্পদে ধনী দেশগুলা। প্রিন্স এন্ড্রুর জবানিতে মার্কিনীদের কথা পরে উল্লেখ থাকলেও সারা দুনিয়ায় নয়া ঔপনিবেশিক প্রভুত্ব এখন আর ব্রিটিশদের নাই, এই প্রভুত্ব এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অধিকার করে আছে। গ্রেট গেমএর আসল ফ্রন্টিয়ার আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নকে টাকা এবং অস্ত্র এই দুই ঢেলে বিতারিত করতে সক্ষম হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এরপর নিজেদের তৈরি মুজাহিদদের সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে আবার নিজেরাই দখল করে নিয়েছে আফগানিস্তান। উইপন্স অফ ম্যাস ডিসট্রাকশনের জুজু দেখিয়ে দখল করে নিয়েছে ইরাক, সম্প্রতি আধিপত্ব বিস্তার করেছে লিবিয়ায়। বারবার ইরানকে হুশিয়ার করে দিলেও সরাসরি ইরানের বিরুদ্ধে যে মাঠে নামতে পারছেনা যুক্তরাষ্ট্র তার পেছনের কারণও দ্বিতীয় গ্রেটগেম। এইবার এই খেলায় পুরনো খেলোয়াড় রাশিয়া আর নতুন খেলোয়াড় চীন আবির্ভুত হয়েছে মার্কিন, ব্রিটিশদের প্রতিদ্বন্দী হয়ে। গ্রেট গেমএর এবারের লড়াই জ্বালানি সম্পদের পাইপ লাইন, কনসোর্টিয়াম, আর কন্ট্রাক্টস এর নিয়ন্ত্রনের লড়াই। আর গ্রেট গেমএর মাঠের বাইরেও এই প্রতিদ্বন্দীতায় এগিয়ে থাকার লক্ষ্যে মার্কিন শেভরন কনকো ফিলিপ্স ইত্যাদির মতো এবার বাংলাদেশেও এসে হাজির হয়েছে চীন আর রাশিয়ার জ্বালানি কর্পোরেশন। ব্রিটিশদের বিদায়ের পর দক্ষিন এশিয়ায় ঠিক ব্রিটিশদের দেখানো পথে আঞ্চলিক কর্তৃত্ববাদী এবং ঔপনিবেশিক ইন্ডিয়াও ঠিক একিসময়ে বাংলাদেশের উপর দিয়ে ট্রানজিট নেয়ার যেই তৎপরতা শুরু করেছে এবং সেইসাথে নানান আগ্রাসি কর্মসূচির মাধ্যমে বাংলাদেশকে দাবিয়ে রাখার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে কি শুধুমাত্র নিজ স্বার্থে না আরো বড় কোন আন্তর্জাতিক ঔপনিবেশিক খেলার অংশ হিসাবে তা অবশ্য এখনো আমাদের সামনে পরিস্কার হয়নাই।
টোকাই ভাবনা, উপনিবেশ বিরোধীতার মন্ত্রঃ
বাংলাদেশের জন্যে বর্তমান নয়া ঔপনিবেশিক বাস্তবতা এক নিদারুন বহুমুখি আধিপত্বের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বাস্তবতা। এই বহুমুখি আধিপত্ত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করা কঠিন। তবে এই লড়াই সহজ হয় যদি আগে নিজের মন মগজে এটে বসা ঔপনিবেশিক আধিপত্ত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করা যায়। সম্প্রতি কনকো ফিলিপ্সএর সাথে চুক্তি বিরোধী আন্দোলনের সময় বাংলাদেশের প্রতিবাদী তরুনদের টোকাই আখ্যা দিলেন নয়া উপনিবেশের এক দেশীয় দালাল। এই ‘টোকাই’ শব্দের মাঝেই আমাদের আশাবাদ। কে এই টোকাই? নগর সভ্যতার বিত্ত বৈভবের মাঝে ময়লা ফেলা আস্তাকুরে তার আবাস। দুই চোখ ভরে এই বিত্ত বৈভব আর প্রাচুর্য দেখে সে আর ক্ষুধা মেটায় ডাস্টবিন থেকে খাবার তুলে। ঔপনিবেশিকতার দালালী না করা বাঙলা’র প্রতিটা মানুষই কি পশ্চিমা পুজিবাদী ভোগবাদী ঐশ্বর্যমন্ডিত এই সভ্যতায় এক একজন টোকাই নয়? সভ্যতার ডাস্টবিন থেকে যতটুকু কুড়িয়ে পাই পশ্চিমা ভোগ তাই দিয়ে কি আমাদের বর্তমান বেহেশতো আমরা বানাই না? কিন্তু এই টোকাইএর মোহমুক্তি ঘটলে সে প্রতিবাদী হতে পারে, গুড়িয়ে দিতে পারে ভোগবাদী ঐশ্বর্য। পশ্চিমা ভোগবাদী ঔপনিবেশিক ক্ষমতা কাঠামোর প্রতি আমাদের মোহমুক্তি চাই তাই সবাই আগে।
ফ্রাঞ্জ ফানো দাবি করেছিলেন যে ঔপনিবেশিক বাস্তবতায় উপনিবেশের শোষিত মানুষই হচ্ছে সত্যিকারের প্রলেতারিয়েত, আমরা বলতে পারি টোকাই। সম্প্রতি খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হয়ে গেলো বিরাট পুজিবাদ বিরোধী আন্দোলন। সারা দুনিয়াতেই হচ্ছে। কিন্তু উপনিবেশকে টিকিয়ে রেখে কখনো পুজিবাদকে হঠানো সম্ভব না। এই উপনিবেশের হাত ধরেই পুজিবাদ বেরে উঠেছে, এই উপনিবেশের পতন হলেই পুজিবাদের পতন হবে। আমাদের মোহমুক্ত টোকাই ভাবনা দিয়ে তাই আমাদের মন, মগজ, শিক্ষা, আইন, প্রতিষ্ঠানকে আমাদের উপনিবেশের প্রভাব মুক্ত করতে হবে, চালাতে হবে বি-উপনিবেশায়নের ধারাবাহিক সংগ্রাম। আর সেই সংগ্রামের ধারাবাহিকতায়ই ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের পর্যায় পার হয়ে আমরা এখন লড়ছি জ্বালানি সম্পদের মালিকানা প্রতিষ্ঠার লড়াই। বি-উপনেবিশায়নের সচেতন প্রয়াস যদি না থাকে তাইলে এই লড়াইয়ের ফলও বেহাত হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা থেকে যাবে। এক দালাল শ্রেণীর জায়গায় হয়তো উঠে আসবে আরেক দালাল শ্রেণী।
উপনিবেশ বিরোধী লড়াই চাই মাঠে, চাই মনে। বাঙলার খেটে খাওয়া মানুষরাই নিজেদের মাটি খুড়ে তুলে আনতে পারে উত্তর পুজিবাদী দুনিয়া তৈরির মুক্তা। তবে তার আগে নিজের মাটির নিচের জ্বালানি সম্পদ, তা সে যতটুকুই হোক, বাচাতে হবে।
প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুন, ২০১২ রাত ৯:২৬