তুমি তো সেই কবি, যে আমাকে আমার একাকী মুহূর্তের বেড়াজাল থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে নিয়ে যাও জীবনের খেরোখাতার স্বর্ণালী দিনগুলোতে। তুমি তো সেই কবি, যে আমার মন কেমন করা মুহূর্তগুলোকে নিমিষেই রাঙিয়ে তোল রঙিন জ্যোৎস্নার অরণ্য থেকে ধার করে আনা রং-তুলির টানে। সেই রঙিন জ্যোৎস্নার সাথে জড়িয়ে আছে প্রজাপতির পাখা মেলার দৃশ্যপট, ঘাস ফড়িং এর পিছু ছুটে চলা কয়েক জোড়া চঞ্চল পা, নুপুর পায়ে পদ্মপুকুরে সাঁতারকাটা বালিকা, বৈশাখী ঝড়ে আম কুড়ানো দামাল হাওয়া, বর্ষায় কদম তলার গান আর ঘন ঝোপের আড়ালে পাখির ছানা খোঁজায় ব্যস্ত ক্ষুদে অভিযাত্রী দল। এসব কিছুই আমার শৈশবের সোনালী বন্ধন। আমার অকিঞ্চিৎ ভালোবাসায় এরা সবাই বেঁচে আছে আমার মনে। আমার একাকী মুহূর্তকে সব সময় মুখর করে তোলে এরা। আমার যে কোন মন খারাপ করা মুহূর্তকে উচ্ছল আর প্রাণবন্ত করে তুলতে এরা সদাই ব্যস্ত। কবি যেমন শব্দের কারিগর, ভাবের আয়োজক। তেমনি এরা আমার প্রাণ জাগানিয়া ভাবুক মনের বন্ধন, সুরেলা গুঞ্জন। তাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় কবি হচ্ছে আমার স্বর্ণালী শৈশব।
আমাকে বাঁচতে হলে বার বার ফিরে যেতে হবে এদের কাছে। কারণ, আমার ভিতর যে আমি বাসা বেঁধে আছে, সে এখনও চায় বর্ষাভেজা পিচ্ছিল পথ মাড়িয়ে পাশের বাড়ির আম বাগানে পৌঁছে যেতে। সে এখনও ভালোবাসে পুতুল বিয়ের দিনে মিছিমিছি রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত হতে। সে এখনও চায় ঘুঙুর পায়ে সুর তোলে বউচি খেলার ছলে চারপাশ মুখর করে তুলতে।
আমার মনে বাস করা এই খেয়ালী আমিটাকে কে কি বলবে, কে কিভাবে দেখবে আমি জানি না। হয়তো বলবে আমি নষ্টালজিয়ায় ভুগছি। তাই ভালোবাসি স্মৃতি জাগানিয়া শৈশবকে ঘিরে কল্পনার ফানুস উড়াতে। কিন্তু আমি বলব, না। আমার শৈশব আমার কল্পনার ফানুস নয়। যারা গাছের পাতায় জমে থাকা বৃষ্টির ফোটায় নিজকে দেখতে পায় না, যারা মেঘের আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ দেখেও ঘুমে কাতর হয়ে পড়ে, যারা প্রকৃতির বুকে ষড়ঋতুর আগমনে নিজের ভিতর কোন পরিবর্তন বুঝতে পারে না, তারাই কেবল এমনটা ভাবতে পারে। তারা মেঘের দিকে হাত বাড়িয়েও সেই হাত গুটিয়ে আনে ভিজে যাবার ভয়ে। আর আমি নাগালের বাইরের বৃষ্টিকণাকেও হাতের মুঠোয় পেতে চাই। কারণ, তখন আমার ভিতর কাজ করে শৈশবকে খোঁজে পাবার অদম্য নেশা। তাই মেঘের আড়ালে হারিয়ে যাওয়া চাঁদও আমার দৃষ্টির অন্তরালে চলে যেতে পারে না। কারণ একটাই। আমি সেই মুহূর্তে ফিরে যাই চাঁদনী রাতে উঠোনে বসে নানীর মুখে রূপকথার গল্প শুনার দিনগুলোতে। গাছের পাতায় জমে থাকা বৃষ্টির ফোটায় আমার শৈশবকে আমি দেখতে পাই স্বচ্ছ আয়নার মতো।
এমনিভাবে আমার চারপাশে যা আছে, যা নিয়ে আমার বেঁচে থাকার আয়োজন, সে সবকে জড়িয়ে আছে আমার শৈশব। আমার প্রথম প্রেম আমার শৈশব। আমার প্রথম ভালোলাগা-ভালোবাসা আমার শৈশব। আমার স্বপ্নচারী মনের সবটুকু জুড়ে এমনিভাবে আমার শৈশব জড়িয়ে আছে মায়াবী বন্ধনে। এ বন্ধন কখনও কোন কারণে সামান্যতম আলগা হোক এ আমি চাই না। আমি চাই না সময়ের গভীর নোনাজলে আমার স্মৃতির পানসিখানি ডুবে যাক অনন্তকালের জন্য। তাই তো আমার সর্বক্ষণের আরাধনা আমার শৈশবকে নিয়ে। বর্তমান সময়ের পুঞ্জীভূত বাস্পরাশি থেকে আমাকে নিরেট সুন্দরের পানে টেনে নিতে পারে যে সে আর কেউ নয়। সে আমার স্মৃতি জাগানিয়া শৈশব।
আমি গভীরভাবে চিন্তা করে দেখেছি আমার মনের মুকুরে লালিত সমস্ত স্বপ্নের ভিত্তিভূমি হচ্ছে আমার শৈশব। ভালোবাসার সাতকাহনে জড়িয়ে নিজকে প্রশান্ত সূর্যালোকে মেলে ধরতে পারার যে ক্ষমতা তার শেকড় পোতা রয়েছে আমার শৈশবের স্বর্ণালী দিনগুলোতে। বন্ধুত্ব নামক সম্পর্কের শত পত্র-পুষ্প বেয়ে অবশেষে আমি জেনেছি যে, আমার পরম বন্ধুত্বের আশ্রয় হচ্ছে আমার সেই স্বর্ণালি খেলাঘর। যে ঘরে আজও জীবন্ত হয়ে আছে গোধূলী বেলার সেই ক্ষণ, ঘন বাঁশ ঝাড়ের আড়ালে হুতোম পেঁচার ডাকে সেই গোধূলী ক্ষণটা কেমন যেন রহস্যময় মনে হতো আমার কাছে। পুকুর ঘাট থেকে কিষাণ বৌএর কলসী কাখে পানি নিয়ে ঘরে ফেরার সেই দৃশ্য আমার শৈশবের উচ্ছল মুহূর্তগুলোকে অন্য মাত্রায় ভরিয়ে তুলত। গ্রামের মেঠোপথ, কাকডাকা ভোর, গোধূলীর ঘোমটা টানা মায়াবী সন্ধ্যা, পড়ন্ত বিকেলে ক্ষেতের আইলে লম্বা হয়ে পড়া ছায়া, নিস্তব্ধ রাতে ঝি ঝি পোকার একটানা ডাক, রাতের জমাট নৈঃশব্দবে ভেঙে খান খান করে দেয়া শেয়ালের হুক্কা হুয়া ডাক - এসব কিছুই আমার পিছুটানা শৈশব। বর্তমান সময়ের নিরন্তর টানাপোড়েন থেকে প্রশান্তিময় মুক্তি। এমন শৈশবকে ভুলি কেমন করে !

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




