somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার শহরের গল্প

৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


শহরটিকে আমি চিনি অনেক দিন ধরে, সেই শৈশব থেকে। এর অলিতে-গলিতে, ইট পাথরের ভাঁজে, নদীর প্রতি বাঁকে, বাতাসের গুঞ্জনে, পাখিদের কল-কাকলিতে আমার উপস্থিতি ছিল সদা চঞ্চল। আমি আমাকে নিয়ে উড়ে বেড়াতাম এই শহরের বাতাসের পাখনায় ভর করে। এই শহরের ফুলের ঘ্রাণে, মৌমাছিদের মিতালীতে আমি পলে পলে নিজকে হারাতাম নতুন করে খোঁজে পাবার আনন্দে। আমার শৈশব-কৈশোরের মিতালীর চিত্রপটে এই শহরটিকে আমি প্রতিদিন নতুন করে আপন করে নিতে শিখেছিলাম। চিনে নিয়েছিলাম শহরের প্রতিটি আলোকিত মানুষকে, ভালোবেসেছিলাম তাদের উজাড় করা কাব্যিক মনকে।

এই শহর আমাকে অনেক কিছু দিয়েছিল। আমার শৈশবের চঞ্চলতা, কৈশোরের চপলতা, যৌবনের রঙিন আবেগ-ভালোবাসা--সবকিছু বেড়ে উঠেছিল, পরিপুষ্টতা লাভ করেছিল এই শহরের আকাশে-বাতাসে, ইট-পাথর আর ধূলিকণা থেকে রসদ নিয়ে। জীবনে সমৃদ্ধির শিখরে উঠার হাতেখড়ি আমি প্রথম পেয়েছিলাম এই শহরের কাছ থেকে। ইটের পর ইটের মাঝে মানুষ নামক কীট হয়েই শুধু বেড়ে উঠিনি আমি এই শহরে। আমি বেড়ে উঠেছিলাম অজানাকে জানার, অচেনাকে চেনার, অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলার উদগ্র বাসনা বুকে নিয়ে। আর আমার মনে এই বাসনা তৈরী করে দিয়েছিল আমার প্রিয় এই শহর। এই শহরের আকাশে মুক্ত বিহঙ্গকে ডানা মেলে উড়তে দেখে আমি স্বপ্নের জাল বুনতে শিখেছি। এই শহরে প্রাণের ঠাস বুননে আমি জীবনের রঙিন বসন্তের জন্য অপেক্ষা করতে শিখেছিলাম।

আমার শহর, সেই রেলওয়ে কলোনী- বিকেল হতে না হতেই যেখানে শিশুদের কলকাকলীতে মুখর সন্ধ্যা নেমে আসত আনন্দঘন ব্যস্ততায়। সেই মেঘনার তীর, সেই হাজী আসমত প্রাইমারী স্কুল, সেই রেলওয়ে হাইস্কুল, স্কুলে যাবার পথে কারও বাগান থেকে ফুল চুরি করার স্বর্ণালী মুহূর্ত, কখনওবা ধরা পড়ে গিয়ে আমসিপনা মুখ করে ফিরে আসা। এখনও হাজার স্মৃতির বেড়াজালে বন্দী হয়ে থাকা আমার এই শহরটি হচ্ছে ভৈরব। রেলওয়ে কলোনীর চঞ্চলমুখর দিনগুলো আমার শহর ভৈরবকে আমার বুকের ভিতর জীবন্ত করে তোলে ভুলে না যাবার অঙ্গীকারে। আমার শহরই আমাকে শিখিয়েছিল কিভাবে এই অঙ্গীকার রক্ষা করতে হয়, কিভাবে সময়ের কাছ থেকে নিজের কাঙ্খিত চাওয়াটুকু ছিনিয়ে আনতে হয়। শিখিয়েছিল সময়ের প্রতি কিভাবে ঋণ শোধ করতে হয়।

আমার সেই সময় হচ্ছে আমার শহরের বুকে কাটানো সময়টুকু। সেই সময়ের প্রতি ঋণ শোধ করতে গিয়ে আজ আমি বারবার হোচট খাই। আমার শহর আজ আর আগের মতো নেই। এর বুক থেকে হারিয়ে গেছে চল্লিশ বছর আগের আমার মধুময় সময়টুকু। আমার হেঁটে বেড়ানো পথ আগলে আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে যান্ত্রিক সভ্যতার আধুনিক নিদর্শন। সেখানে আমার স্কুলে যাবার পথটুকু হারিয়ে গেছে চিরতরে। আমার প্রিয় রেলওয়ে হাইস্কুল আজ আর নেই আগের জায়গায় আগের আঙ্গিকে। যে মেঘনাকে ভালোবেসে সমৃদ্ধ করেছিলাম আমার শৈশব-কৈশোরের স্বর্ণালী সময়টুকু, সেই মেঘনার আগ্রাসী থাবার অতল তলে তলিয়ে গেছে আমার প্রিয় এই শিক্ষাঙ্গণ। আজ যেখানে যে আঙ্গিকে দাঁড়িয়ে আছে রেলওয়ে হাইস্কুলটি, সেই স্কুলকে আমি যেন চিনিনা। সেই স্কুলটি যেন আমার নয়। অথচ আমার শিক্ষা জীবনের প্রথম অর্জন তিলক হিসেবে এসএসসির সনদপত্রের গায়ে জড়িয়ে আছে রেলওয়ে হাইস্কুলের নাম।

সেই রেলওয়ে কলোনী- স্মৃতির ঝাঁপি খুললেই যেখান থেকে বেরিয়ে আসে এক ঝাঁক চঞ্চল বলাকা। আমার মন আজও উড়ে বেড়ায় তাদের মুক্ত পাখায় ভর করে। কিন্তু শ্রীহীন রেলওয়ে হাইস্কুল আমাকে আরও বেশী করে আহত করেছে। রেলওয়ে কলোনীতে ব্রিটিশদের তৈরী সরকারী বাসাগুলো আজ জরাজীর্ণ। বাসার ফাঁকে ফাঁকে খোলা জায়গাগুলো তাদের অস্তিত্ব হারিয়েছে ঘন আবাসনের কাছে নতি স্বীকার করে। তবু আমি আমার শহরের চঞ্চলমুখর দিনগুলোর পদধূলি খুঁজি সেখানে। সেই মেঘনার তীর, নদীর ঘাট আগের মতো আর নেই। সেখানে দেশের অগ্রযাত্রার স্বাক্ষর বহন করছে ফেরীঘাট, ভৈরব নদীবন্দর, ব্যস্ততম সময়ের বুকে তারচেয়েও ব্যস্ততম মানুষদের সার্বক্ষণিক জীবন প্রবাহ। আমার শহরের বুকে মেঘনা নদীতে এখন আর জেলেদেরকে নৌকায় মাছ ধরতে দেখা যায়না। বাউল-ভাটিয়ালী হারিয়ে গেছে মাঝি-মল্লারদের কন্ঠ থেকে।

আমি আহত হই, স্মৃতি তাড়িত হই। কিন্তু কাঁদিনা। আমার শহর ছেড়ে আসার পর সেই একদিনই আমি কেঁদেছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে বসে যেদিন শুনেছিলাম যে, আমার প্রিয় রেলওয়ে হাইস্কুলটি মেঘনার ভাঙনে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আমার শহর ছেড়ে আসার পর সেদিন প্রথম আমি ওর জন্যে কেঁদেছিলাম। ছটফট করেছিলাম কবে ছুটে যাব সেখানে আমার শহরের বুকের ভিতরের ক্ষতটা দেখার জন্য। ছুটে গিয়েছিলামও। গিয়ে আমার শহরের গুমট কান্না আমি কাছ থেকে শুনেছিলাম। সেদিন আমার মনে হয়েছিল মেঘনা নদী আমার শহরের বুকে যে ক্ষত তৈরী করে দিয়েছে, সেটা শুধু ওর একার নয়। একই ক্ষত তৈরী হয়েছে আমার বুকেও। এরপর থেকে সুযোগ পেলেই ছুটে যাই আমার প্রিয় শহর ভৈরবে। আস্তে আস্তে সয়ে আসে মেঘনার তৈরী ক্ষতটি। সেখানে দেশের অবকাঠামোগত উন্নতির ছোঁয়া। কত শান্ত-স্নিগ্ধ মেঘনা ! দেখে বিশ্বাসই হয়না যে, এই মেঘনাই ২৩/২৪ বছর আগে এক রাতের মধ্যে গ্রাস করে নিয়েছে আমার শৈশবের স্মৃতি বিজড়িত রেলওয়ে খেলার মাঠ, আমার আব্বা যেখানে চাকুরী করতেন সেই রেলওয়ে কন্ট্রোল অফিস, হাকিম শাহ ইনষ্টিটিউট নামে রেলওয়ে ক্লাবঘরটি, রেলওয়ে হাইস্কুলসহ আরও অনেক স্থাপনা ও জনপদ।

আজ ২০১৩ সালের শেষ দিনে এসে কেন আমার শহরকে নিয়ে এতকিছু লিখতে ইচ্ছে হলো জানিনা। তবে একটা অনুভূতির কথা মন থেকে বলতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। সেটা হলো এই প্রথম আমি অনুভব করলাম যে, আমার সবচেয়ে ভালো, বিশ্বস্ত ও নির্ভরশীল বন্ধু হচ্ছে আমার শহর ভৈরব। যে আমার শৈশবকে পরম যত্নে আগলে রেখেছে, আমার কৈশোরকে নিজের বুকের ওম দিয়ে পরিপুষ্ট করে তুলে রেখেছে আমার জীবনের পড়ন্ত বেলাকে জীবন্ত করে তুলবে বলে। সময়ের প্রবাহমান স্রোতে ভাসতে ভাসতে আমার শহরের সেই উপহারকে গ্রহণ করার কাছাকাছি সময়ে এসে পৌঁছে গেছি বলেই হয়তো আমার আজকের এই উপলব্ধি। আর সেই উপলব্ধি থেকেই এই লেখার অবতারণা। গল্প বলে শুরু করেছিলাম। গল্প না হোক, মনের আবেগের মালা গাঁথা যে হয়েছে সেটা নিশ্চিত।
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পেচ্ছাপ করি আপনাদের মূর্খ চেতনায়

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:৩৮

আপনারা হাদি হতে চেয়েছিলেন, অথচ হয়ে গেলেন নিরীহ হিন্দু গার্মেন্টস কর্মীর হত্যাকারী।
আপনারা আবাবিল হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাড়াতে চেয়েছিলেন, অথচ রাক্ষস হয়ে বিএনপি নেতার ফুটফুটে মেয়েটাকে পুড়িয়ে মারলেন!
আপনারা ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

নজরুল পরিবারের প্রশ্ন: উগ্রবাদী হাদির কবর নজরুলের পাশে কেন?

লিখেছেন মাথা পাগলা, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:০১



প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে কাজী নজরুল ইসলামের দেহ সমাধিস্থ করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে। শনিবার বাংলাদেশের স্থানীয় সময় বিকেল ৪টে নাগাদ সেখানেই দাফন করা হল ভারতবিদ্বেষী বলে পরিচিত ইনকিলাব মঞ্চের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির আসল হত্যাকারি জামাত শিবির কেন আলোচনার বাহিরে?

লিখেছেন এ আর ১৫, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৪


গত মাসের শেষের দিকে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পারওয়ারের ছেলে সালমান, উসমান হাদির সঙ্গে খু*নি ফয়সালের পরিচয় করিয়ে দেন। সেই সময় হাদিকে আশ্বস্ত করা হয়—নির্বাচন পরিচালনা ও ক্যাম্পেইনে তারা... ...বাকিটুকু পড়ুন

দিপুকে হত্যা ও পোড়ানো বনাম তৌহিদী জনতা!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:০৫


পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস বিডি লিমিটেড (Pioneer Knitwears (BD) Ltd.) হলো বাদশা গ্রুপের (Badsha Group) একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। বাদশা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান কর্ণধার হলেন জনাব বাদশা মিয়া, যিনি একইসাথে এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাজানো ভোটে বিএনপিকে সেনাবাহিনী আর আমলারা ক্ষমতায় আনতেছে। ভোট তো কেবল লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।

লিখেছেন তানভির জুমার, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:২২



১০০% নিশ্চিত বিএনপি ক্ষমতায় আসছে, এবং আওয়ামী স্টাইলে ক্ষমতা চালাবে। সন্ত্রাসী লীগকে এই বিএনপিই আবার ফিরিয়ে আনবে।সেনাবাহিনী আর আমলাদের সাথে ডিল কমপ্লিট। সহসাই এই দেশে ন্যায়-ইনসাফ ফিরবে না। লুটপাট... ...বাকিটুকু পড়ুন

×