somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একজন কালো মানুষের কথা ভুলতে পারিনা।

২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সকাল ১০:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একজন কালো মানুষের কথা ভুলতে পারিনা।

নাম জানা হয়নি সেই কালো মানুষটির, কোন পরিচয়ও না। সেটা ২০১২ সালের হজ্ব মওসুমের কথা। আল্লাহ্ তায়ালার অশেষ মেহেরবাণীতে ঐ বছর আমি হজ্বে গিয়েছিলাম আমার স্বামীর সাথে। আরাফাত দিবস অর্থাৎ হজ্বের পরের দিনের ঘটনা এটি। যারা টেলিভেশনে হজ্বের অনুষ্ঠান কিংবা এখন যেমন হজ্ব পূর্ববর্তী অনুষ্ঠানসমূহ পবিত্র মক্কা থেকে সরাসরি সম্প্রচারিত হচ্ছে, সেগুলো দেখেন তারা খেয়াল করবেন যে দীর্ঘদেহী কালো নারী-পুরুষেরা দল বেঁধে চলাফেরা করছে। এরা হাবসী সম্প্রদায়, হযরত বেলাল (রাঃ) এর বংশধর। ওরা বলা যায় অনেকটা বিনা খরচে হজ্ব করতে আসে। সৌদি সরকার হযরত বেলাল (রাঃ) এর প্রতি সম্মান দেখিয়ে নিজ খরচে এদেরকে নিয়ে আসে এবং হজ্বশেষে নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। শুধু নিজেদের থাকা-খাওয়ার খরচটা ওরা বহন করে। সেটা বহন করার সুযোগও সৌদি সরকার ওদেরকে করে দেয়। যারা হজ্বে গিয়েছেন তারা ভাল জানবেন। হজ্ব মওসুমে হেরেম শরীফের আশেপাশের রাস্তায় কিংবা মদিনা মনোয়ারায় মসজিদে নববী এর চারপাশে নানা জিনিস পত্রের পসরা সাজিয়ে বসে এরা। হজ্বে এসে এই ধরনের উপার্জনশীল কাজে একমাত্র এরাই নিয়োজিত হতে পারে।

আজ এমনি একজন কালো মানুষের কথা বলব। হজ্বের পরদিন মুযদালিফা থেকে মিনার দিকে হেঁটে যাচ্ছিলাম আমরা। এর আগের দিন আরাফার মাঠ থেকে হেঁটে মুযদালিফা এসে রাত্রি যাপন করেছি। সঠিক বলতে পারবনা, তবে সম্ভবত পাঁচ থেকে ছয় কিলোমিটার হেঁটে রাত দশটায় মুযদালিফায় এসে পৌঁছেছিলাম। রওনা দিয়েছিলাম সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে। খাওয়া-দাওয়ার ঠিক থাকেনা এ সময়। আরাফার মাঠে দুপুরের খাবার হিসেবে খেয়েছিলাম সৌদি সকোরের দেয়া ভাত-মাংস। আর আমাদের সংগে আছে খেজুর, বিস্কুট, চিড়া ইত্যাদি। তাছাড়া আরাফার মাঠ থেকে আসার সময় পথে পথে দিয়েছিল জুস প্যাক। সেগুলো কিছু খেয়েছিলাম, কিছু সাথে রয়ে গেছে।

যাই হোক। রাত দশটায় মুযদালিফায় পৌঁছে শরীর যেন আর চলছিল না। কোনমতে একটু শোয়ার জায়গা করে চাদর বিছিয়ে শুয়ে পড়েছিলাম খোলা আকাশের নিচে। কিন্তু হজ্বের আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে একটি হলো মুযদালিফায় এসে মাগরেব আর এশার নামাজ একসাথে পড়তে হবে। কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার পর উঠে সেই আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করলাম। তারপর বিস্কুট, খেজুর, জুস ইত্যাদি দিয়ে রাতের খাবার সারলাম। রাত কাটল ঘুম-অঘুমের মাঝে। ফজরের আজানের সাথে সাথে উঠে জামায়াতে নামাজ পড়ে কিছু খেজুর, বিস্কুট আর পানি খেয়ে আবার রওনা দিলাম আমরা মিনার উদ্দেশ্যে। ওখানে গিয়ে শয়তানকে পাথর মারতে হবে। আমরা দলে ছিলাম চার জন মহিলাসহ আটজন। যার যার সাথে থাকা বোতলে খাবার পানি নিয়ে নিলাম আমরা। কিন্তু কতই বা আর নেয়া যায় ? এমনিতেই ক্লান্ত শরীর। তার উপর সবার সাথে মোটামুটি ভারী একটা ব্যাগ। তবু সাধ্যমত খাবার পানি সাথে নিলাম আমরা।

লাখ লাখ মানুষের সাথে হাঁটতে লাগলাম। একটু পর পর আমার গলা শুকিয়ে আসছিল আর আমি একটু একটু করে পানি বোতল থেকে মুখে দিচ্ছিলাম। আমার হাজব্যান্ড আবার লো প্রেসারের মানুষ, প্রতিদিন সকালে একটি করে খাবার স্যালাইন খেতে হয় তাকে। ঘন্টাখানেক হাঁটার পর দেখলাম ওর শরীর কেমন যেন দুর্বল হয়ে আসছে। আমি ব্যাগ থেকে একটা স্যালাইনের প্যাকেট বের করে সেটা দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে আমাদের কাছে থাকা সর্বশেষ পানির বোতলে ঢেলে নেড়েচেড়ে ওকে খেতে দিলাম। আমাদের সাথের এক ভাই আবার ওর কাছ থেকে অর্ধেকটুকু চেয়ে নিয়ে খেল। স্যালাইন খেয়ে আমার স্বামী একটু সুস্থ বোধ করল। আবার হাঁটতে লাগলাম আমরা। আমার উৎসুক দৃষ্টি কেবল খুঁজে বেড়াতে লাগল দুরত্ব লেখা ডিজিটাল সাইনবোর্ড। আর কতদূর হাঁটতে হবে ? শুরু করেছিলাম যেখান থেকে সেখান থেকে ঘন্টাখানেক হেঁটে এসে বোধহয় দেখেছিলাম মিনার দূরত্ব ছয় কিলোমিটার।

খোলা আকাশের নিচে মানুষের ভীড়ে তা-ও হাঁটা যায়। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই ঢুকতে হলো একটি টানেলের ভিতর। যারা হজ্ব করে এসেছেন এবং হেঁটে মিনা অবধি গিয়েছেন, তারা জানেন যে এই টানেলের ভিতর কি অবস্থা হয় ! সীমাবদ্ধ জায়গা ধরে লাখ লাখ মানুষ হাঁটছে। হাঁটা তো নয়, একজনের ঠেলায় অন্য জন এগিয়ে যাচ্ছে। জানতে পারলাম এই টানেল গিয়ে শেষ হয়েছে মিনায়। কিন্তু টানেল যেন আর শেষ হয়না। ঠেলাঠেলিতে আমাদের দলের সবাই তখন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আমি শক্ত করে আমার স্বামীর কোমড়ের বেল্ট ধরে এগোতে লাগলাম। আর মনে মনে আল্লাহ্কে ডাকতে লাগলাম।

কিন্তু খাওয়ার পানি তো নেই। ব্যাগে দুটো চকলেট ছিল, একটা একটা করে দুটোই শেষ করলাম। এতে পিপাসা না মিটলেও মুখের ভিতরটা একটু ভিজল। কিন্তু এখন সেই চকলেটও নেই। আমার স্বামী বরাবরই কষ্টসহিষ্ণু মানুষ। মুখে কিছু বলছেনা, শুধু দোয়া পড়ছে। কিন্তু ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম, ওর অবস্থাও আমার মতো। আমার জিহবা শুকিয়ে মুখের ভিতর আটকে যাবার যোগাড় হয়েছে, ঠিকমতো কথা বলতে পাচ্ছিনা। তবু কোনমতে বললাম, একটু খাবার পানি যদি পেতাম ! আমার স্বামী বলল, আল্লাহকে ডাক, তিনি সব কষ্ট দূর করে দিবেন। আমি তো প্রথম থেকে তাই করছি। আল্লাহকে ডাকা ছাড়া এখানে তো আমাদের করার মতো আর কিছু নেই।

এভাবেই হাঁটছি মানে পেছনের দিকের ঠেলায় সামনে এগোচ্ছি। কোথাও বিরতি দিয়ে একটু বিশ্রাম নিব সেই উপায় নেই। আমি হাঁটছি আর এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি কারও কাছে একটু খাবার পানি পাওয়া যায় কি-না। এমন সময় দেখি আমার পাশ দিয়ে হাঁটছে দীর্ঘদেহী একজন কালো পুরুষ। হাঁটছে আর বোতল থেকে পানি পান করছে সে। আমি ওর পানির বোতলের দিক থেকে দৃষ্টি ফেরাতে পারলামনা। তখনও একটু পানি বোতলে রয়ে গেছে। এমন সময় লোকটির দৃষ্টি পড়ল আমার দিকে। আমার পিপাসা কাতর দৃষ্টির অর্থ সে বুঝতে পারল। ইশারায় জিজ্ঞেস করল, আমি পানি চাই কি-না। আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। সে সাথে সাথে বোতলটি আমার হাতে দিয়ে দিল। বোতলের তলায় একটুখানি পানি। সেটার অর্ধেকটা আমি পান করলাম, অর্ধেকটা আমার স্বামীকে দিলাম। তারপর কৃতজ্ঞতা জানাবার জন্য ফিরে তাকিয়ে দেখি লোকটি আমাদেরকে ছেড়ে এগিয়ে গেছে অনেকটা। (এখানে একটু বলে রাখি যে, আমরা হাঁটছিলাম টানেলের মাঝ দিয়ে। এরপর কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে আমরা ডানদিকে সরে গিয়ে টানেলের পাশ ধরে হাঁটতে গিয়ে পানির ব্যবস্থা পেয়েছি, একটুখানি বসে বিশ্রামও নিতে পেরেছি। তাই মনে হয়েছে যে, প্রথম থেকে একপাশ ধরে হাঁটলে বোধহয় এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হতনা)।

আমরা জানি যে, হজ্বের আর এক অর্থ হচ্ছে পারস্পরিক সম্প্রীতি, সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধে উদ্বুদ্ধ মুসলিম উম্মাহর মিলন। হজ্বে যাবার প্রথম দিন থেকে সেটা আমরা দেখে থাকি এবং উপলব্ধিও থাকি। কিন্তু পিপাসার চরম মুহূর্তে সেই কালো মানুষটি তার পান করা পানির খানিকটা আমাদেরকে দিয়ে যে উপকার করেছিল তা বলে বুঝানোর মতো নয়। ভুক্তভোগী ছাড়া এর সত্যিকার মমার্থ হৃদয়ঙ্গম করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। সাধারণভাবে মনে হতে পারে একটু খাবার পানি দিয়ে সে এমন কি করেছে ? কিন্তু সেই মুহূর্তে পারিপার্শ্বিকতার বিচারে সেই একটু পানি আমার কাছে শুধু একটু পানিই ছিলনা, এর মূল্য ছিল অন্যরকম, টাকা-কড়ির মূল্য মানের উর্ধ্বে। একথা বলতে আজ আমার দ্বিধা নেই যে, এমনিতে অর্থাৎ সাধারণ অবস্থায় একজন কালো মানুষের পান করা পানির বাকী অংশ একই বোতল থেকে আমি হয়তো কখনই পান করতাম না। কিন্তু সেদিন যে সহমর্মিতা দেখিয়েছে আমাকে ঐ কালো মানুষটি, সেটা আমি যতদিন বেঁচে থাকব কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করব। আর মনপ্রাণ দিয়ে ঐ কালো মানুষটির মঙ্গল কামনা করে যাব।
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×