somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিশ্বাসের মূল্য - ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

০২ রা মে, ২০১৩ রাত ৯:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

খলিফা হারুন-অর-রশীদ আজ খোশবাগে (প্রমোদকানন) যাচ্ছেন। সঙ্গে বেগম জোবায়দা খাতুন। উভয় পার্শ্বে খোলা তলোয়ার হস্তে খোজাগণ। রাজপথের দু'ধারে রাজপ্রাসাদ থেকে উপবন পর্যন্ত বসরার গোলাপতরু সারি সারি সজ্জিত। গোলাপবর্ণ মখমলে (চিকন বস্রবিশেষ) সমস্ত পথ মণ্ডিত। দক্ষিণে বামে গৃহপ্রাচীরসমূহ গোলাপী রঙে রঞ্জিত।

অগ্রে আরব ঘোটকপৃষ্ঠে খলিফা, পশ্চাতে মহিষী (বেগম)। রাজাজ্ঞায় পথ জনপ্রাণীশূন্য।

কোথা থেকে পাগল বহ্‌লুল এল। বহ্‌লুল ধীরে ধীরে খলিফার দিকে অগ্রসর হতে লাগলো।

কেউ বলে বহ্‌লুল পাগল। কেউ বলে কামেল ফকির। বিশেষত রাজ অন্তঃপুরে তার অব্যাহত গতি। কেউ বাধা দিলো না। প্রধান দেহরক্ষী একবার খলিফার মুখের দিকে তাকালো। খলিফা বললেন, "আসতে দাও।"

বহ্‌লুল অগ্রসর হয়ে বলল, "ওগো বেহেশত কিনবে?"
-কত দাম?
-লাখ টাকা।
-কই তোমার বেহেশত?
বহ্‌লুল ভিতর থেকে হিজিবিজি আঁকা একখানা মলিন কাগজ বের করলো।

খলিফা অবজ্ঞার হাসি হেসে বললেন, "যাও পাগল। এ তোমার পাগলামি করবার সময় নয়।"

বহ্‌লুল সরে গেলো। কাগজখানা নিয়ে বেগমের কাছে ধরলো। বেগম দ্বিরুক্তি না করে গলা থেকে হীরের হার খুলে বহ্‌লুলের হাতে দিলেন। বহ্‌লুল চলে গেলো।


* * *



বাগদাদের আদালতে আর কখনো বুঝি এতো লোক জমেনি। সকলেই প্রায় কাঙ্গাল গরীব। তারা এখানে কেন? এতক্ষণ ভিক্ষা করলে তাদের দু'পয়সা রোজগার হতো। কি জন্য সকলে সজলনেত্রে বসে আছে?

আজ আলী হুসাইন সওদাগরের বিচারের রায় দেয়া হবে। এমন দিন ছিল যখন প্রত্যেক বেলায় আলী হুসাইনের দস্তরখানে হাজার লোক বসত। দানের জন্য আলী হুসাইন আজ ঋণী। দেনাও কম নয়, লাখ টাকা। শহরে এমন আমীর-ওমরাহ্‌ গরীব-দুঃখী ছিল না, যে একবার আলী হুসাইনের পোলাও-কোর্মার আস্বাদ গ্রহণ করেনি। আলী হুসাইনের ধনী বন্ধুরা আজ কোথায়? এমন একটা অপব্যয়ী দেনাদার দেউলিয়ার সাথে সম্পর্ক রাখাটা লজ্জার কথা। তাই তারা কেউ আসেনি। এসেছে কেবল কতকগুলো লোক, হৃদয় ব্যতীত যাদের আর কোনো ধন নেই। তারা কি দেবে? দু'ফোঁটা চোখের পানি বৈত কিছু নয়। দুনিয়ায় তার মূল্য কি?

কাজি-উল-কুজ্জাত (প্রধান বিচারক) রায় দিলেন, "দেনার দায়ে আলী হুসাইনের কারাদণ্ড।"

গরীব-দুঃখী হাহাকার করে উঠলো।

জনতার মধ্য থেকে কে চিৎকার করে বলল, "দোহাই আল্লাহ্‌র। মাফ চাই। আমি টাকা দেবো।"

সকলের নজর সেদিকে গেলো। এ যে বহ্‌লুল পাগল !

আলী হুসাইন খালাস।


* * *



রাজপুরী কোলাহলশূন্য। শয়ন-প্রকোষ্ঠে খলিফা ও বেগম। অন্য কেউ নেই। স্বর্ণনির্মিত শামাদানে একটি কর্পূরের বাতি স্থির আলো দিচ্ছে। একপাশে একটি আগরবাতি সুগন্ধ ছড়াচ্ছে।

খলিফা - "বেগম, তোমার মতো নির্বোধ তো দেখিনি। কি বলে তুমি লাখ টাকার হীরের হার দিয়ে একটা পচা কাগজ কিনলে?"

বেগম - "জাঁহাপনা, আমি কাগজ কিনি নি, বেহেশত কিনেছি।"

খলিফা - "বহ্‌লুল একটা পাগল, আর তুমি তারও বাড়া।"

বেগম - "হতে পারে। আমি কিন্তু বহ্‌লুলকে সত্যবাদী বলে জানি।"

খলিফা - "সে একটা মস্ত বড় জোচ্চর (প্রতারক)।"

বেগম - "সে যা হোক, আমি কিন্তু সরল বিশ্বাসে তাকে হার দিয়েছি। আল্লাহ আমার দিল দেখবেন।"

খলিফা - "তোমাদের মেয়েলোকের বুদ্ধিই এই প্রকার। আমি আর তোমার সাথে বৃথা বাক্য ব্যয় করতে চাই না।"


* * *



রাজপুরীতে হাহাকার পড়ে গেলো। বেগম জোবায়দা খাতুন আর নেই। খলিফাও কাঁদছেন। তাকে সান্ত্বনা দেয় কে? মৃতদেহ সমাহিত করা হল।

খলিফা বললেন, "কবর খোঁড়। আমি একবার বেগমের মুখখানি দেখে নিই।

খালিফার আদেশ। কবর খোঁড়া হল।

খলিফা কবরে নামলেন। কিন্তু লাশ নেই। কবরে এক বড় সুড়ঙ্গ। তিনি সুড়ঙ্গ পথে চলতে লাগলেন।

কোথায় সুড়ঙ্গ? এ যে প্রশস্থ মাঠ। সেখানে অসংখ্য ফুলের গাছ। পাখির মধুর কাকলীতে ঘাসগুলো পর্যন্ত যেন আনন্দ-হিল্লোলে নাচছে। তার ওপর আবার মৃদু মধুর সমীরণ (হালকা হাওয়া)। এমন ফুল গাছ, এমন বাতাস তিনি তো কখনো দেখেন নি, শোনেন নি, অনুভব করেননি। কিন্তু তার চিত্তে আনন্দ কোথায়? জোবায়দা যে নেই।

সামনে একটি বালাখানা। পৃথিবীর রাজা তিনি, তবুও সে বালাখানার শোভা দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলেন।

ঐ যে জোবায়দা ! ঐ যে প্রাণের জোবায়দা ! জানালার নিচে দাঁড়িয়ে তার দিকে চেয়ে আছেন।

খলিফা আনন্দে দৌড়ে ভিতরে প্রবেশ করতে গেলেন। দারোয়ান বাধা দিলো। খলিফার রাগ হলো। কিন্তু তিনি এখানে কে? অনুনয় করে বললেন, "আমার সমস্ত রাজত্ব তোমায় দেবো, আমার বেগমের নিকট আমাকে যেতে দাও।"

নিষ্ঠুর সে। খলিফার কথায় কর্ণপাত করলো না। খলিফা কেঁদে বললেন, "বেগম তুমি আমায় ভিতরে নিয়ে যাও।"

উত্তর এলো - "জাঁহাপনা, এই আমার সে বেহেশত যা আমি হারের বদলে কিনেছি। অন্যের এখানে আসবার অধিকার নেই।"

খলিফা কাতরভাবে কেঁদে উঠলেন। ঘুম ভেঙে গেলো। পাশে বেগম নিদ্রা যাচ্ছেন। খালিফার মাথার বালিশ চোখের জলে ভিজে গেছে।


* * *



তখন ভোর হয়েছে। সিংহ দরজায় নহবত বাজছে। চারদিকে সুস্বরে পাখি গান করছে। কর্পূরের বাতি নিভে গেছে। আগরবাতি পুড়ে গেছে। কিন্তু তখনো একটা সুগন্ধ ঘরময় ভেসে বেড়াচ্ছে।

খলিফা ডাকলেন, মশরুর।
-জাঁহাপনা, গোলাম হাজির।
-যাও, বহ্‌লুলকে রাজসভায় নিয়ে আসো।

খলিফা সিংহাসনে বসে আছেন। চারদিকে উজির-নাজির উপবিষ্ট। এমন সময় বহ্‌লুল এসে উপস্থিত।

খলিফা - "এসো বহ্‌লুল, এসো এখানে বসো।"

বহ্‌লুল - "কি গো, কি জন্য ডেকেছ? গর্দান নিবে নাকি? তোমাদের তো ঐ ই কাজ। হি হি হি।"

খলিফা - "না, বহ্‌লুল। তুমি বেহেশত বিক্রি করবে?"

বহ্‌লুল - "নাগো না। তোমার বাদশাহী দিলেও না।"

খলিফা - "তবে বেহেশত কিসে পাওয়া যায়?"

বহ্‌লুল - "সরল বিশ্বাসে। আমি যাই।"



(সংক্ষেপিত ও চলিত ভাষায় রূপান্তরিত)
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মে, ২০১৩ রাত ৯:৪৬
৯টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×