ফেব্রুয়ারি, মার্চ, ডিসেম্বর… বারো মাসের বছরের মধ্যে এ মাস গুলো প্রতিবছরই অনেক আবেগ ভালোবাসা নিয়ে হাজির হয় আমাদের সামনে। এ মাসগুলোতে মাতৃভাষা, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বিজয় এগুলো হয় সর্বোচ্চ উচ্চারিত শব্দ। সারাবছর অতটা অনুভব না করলেও এ সময়ে আমাদের অনুভূতি গুলো হয় তীব্র। যখন তখন আনাচে কানাচে আমরা দেশের গান শুনতে পাই। ভালই লাগে শুনতে। তবে সব ভাল লাগা ফিকে হয়ে আসতে চায় যখন বিকট শব্দে মাইক লাগিয়ে জোর করে একই দেশের গান,একই ভাষণ শোনানো হয় বারবার। এবার বিজয় দিবসের দুই দিন আগে থেকে এ অত্যাচারের মুখে পড়তে হয়েছে। অফিসের কাছাকাছি কেউ মাইক লাগিয়ে সারাদিন গান শুনিয়েছে। বাসায় গিয়েও নিস্তার নেই। পনের তারিখ রাত থেকে চলেছে অবিরাম। একই গান শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে ভেবেছি এর নাম ‘বিজয় দিবস’!! যে গান গুলো মনে প্রশান্তি নিয়ে শুনতাম সেগুলো তীব্র বিরক্তি নিয়ে কানে ঢুকাতে হয়েছে। তবে আনন্দের বিষয় হল বিশেষ দিন শেষের সাথে অত্যাচারও শেষ। আবার একটা বিশেষ দিন আসবে আবার একই মহড়া চলতে থাকবে। অদ্ভুত আমাদের উদ্যাপন ভঙ্গি, অদ্ভুত আমাদের দেশপ্রেম!
সে যাই হোক, এত এত গানের মাঝে সেদিন বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে কোন একটা চ্যানেলে আমার অনেক প্রিয় একটা গান শুনলাম বহুদিন পর। মৌসুমী ভৌমিক, যার গান আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনি। ধরতে গেলে সবগানই মুখস্থ ছিল এক সময়। তার গলায় সবটুকু আবেশ মেশানো গানটা যখনই শুনি মনেরত ভেতরটায় নাড়া দিয়ে যায়। অ্যালেন গিন্সবার্গ এর ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতার অনুবাদে সুরারোপ করা গানটা সবার সাথে ভাগ করে নিলাম সাথে কবিতা এবং গান এর পেছনের ছোট্ট একটু গল্প।
অ্যালেন গিন্সবার্গ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ দিকে ভারতের কলকাতায় এসেছিলেন। সেখানে তিনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বাড়িতে উঠেছিলেন। তখন বাংলাদেশ থেকে অনেক শরণার্থী পশ্চিমবঙ্গ ও সীমান্তবর্তী অন্যান্য শহরে আশ্রয় নিয়েছিল। ব্রিটিশ রাজের সময় পূর্ব বাংলা ও পশ্চিমবঙ্গের সংযোগকারী সড়ক হিসেবে কাজ করতো “যশোর রোড”। অনেক বৃষ্টি হওয়ায় তখন যশোর রোড পানিতে ডুবে গিয়েছিল। সড়ক পথে না পেরে গিন্সবার্গ অবশেষে নৌকায় করে বনগাঁ পেরিয়ে বাংলাদেশের যশোর সীমান্তে পৌঁছেন। তার সাথে সুনীলও ছিলেন। তারা যশোর সীমান্ত ও এর আশপাশের শিবিরগুলোতে বসবাসকারী শরণার্থীদের দুর্দশা প্রত্যক্ষ করেন। এই অভিজ্ঞতা থেকেই গিন্সবার্গ এই কবিতাটি লিখেছিলেন। এই দীর্ঘ কবিতার সাথে সুর দিয়ে এটিকে গানে রূপ দিয়েছিলেন তিনি। আমেরিকায় ফিরে গিয়ে তার বন্ধু বব ডিলান ও অন্যান্য বিখ্যাত গায়কদের সহায়তায় এই গান গেয়ে কনসার্ট করেছিলেন। এভাবেই বাংলাদেশী শরণার্থীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন গিন্সবার্গ। পরে এই কবিতাটির একটি বাংলা অনুবাদ করে গানে রূপান্তর করা হয় যেটিতে কন্ঠ দেন মৌসুমী ভৌমিক।
শত শত চোখ আকাশটা দেখে, শত শত শত মানুষের দল,
যশোর রোডের দুধারে বসত বাঁশের ছাউনি কাদামাটি জল।
কাদামাটি মাখা মানুষের দল, গাদাগাদি করে আকাশটা দেখে,
আকাশে বসত মরা ইশ্বর, নালিশ জানাবে ওরা বল কাকে।
ঘরহীন ওরা ঘুম নেই চোখে, যুদ্ধে ছিন্ন ঘর বাড়ী দেশ,
মাথার ভিতরে বোমারু বিমান, এই কালোরাত কবে হবে শেষ।
শত শত মুখ হায় একাত্তর যশোর রোড যে কত কথা বলে,
এত মরা মুখ আধমরা পায়ে পূর্ব বাংলা কোলকাতা চলে।
সময় চলেছে রাজপথ ধরে যশোর রোডেতে মানুষ মিছিল,
সেপ্টেম্বর হায় একাত্তর, গরুগাড়ী কাদা রাস্তা পিছিল
লক্ষ মানুষ ভাত চেয়ে মরে, লক্ষ মানুষ শোকে ভেসে যায়,
ঘরহীন ভাসে শত শত লোক লক্ষ জননী পাগলের প্রায়।
রিফিউজি ঘরে খিদে পাওয়া শিশু, পেটগুলো সব ফুলে ফেঁপে ওঠে
এইটুকু শিশু এতবড় চোখ দিশেহারা মা কারকাছে ছোটে।
সেপ্টেম্বর হায় একাত্তর, এত এত শুধু মানুষের মুখ,
যুদ্ধ মৃত্যু তবুও স্বপ্ন ফসলের মাঠ ফেলে আসা সুখ।
কারকাছে বলি ভাতরূটি কথা, কাকে বলি করো, করো করো ত্রান,
কাকে বলি, ওগো মৃত্যু থামাও, মরে যাওয়া বুকে এনে দাও প্রান।
কাঁদো কাঁদো তুমি মানুষের দল তোমার শরীর ক্ষত দিয়ে ঢাকা,
জননীর কোলে আধপেটা শিশু একেমন বাঁচা, বেঁচে মরে থাকা।
ছোটো ছোটো তুমি মানুষের দল, তোমার ঘরেও মৃত্যুর ছায়া,
গুলিতে ছিন্ন দেহ মন মাটি, ঘর ছেড়েছোতো মাটি মিছে মায়া।
সেপ্টেম্বর হায় একাত্তর, ঘর ভেঙে গেছে যুদ্ধের ঝড়ে,
যশোর রোডের দুধারে মানুষ এত এত লোক শুধু কেনো মরে।
শত শত চোখ আকাশটা দেখে, শত শত শত শিশু মরে গেল,
যশোর রোডের যুদ্ধ ক্ষেত্রে ছেঁড়া সংসার সব এলোমেলো
কাদামাটি মাখা মানুষের দল, গাদাগাদি করে আকাশটা দেখে,
আকাশে বসত মরা ইশ্বর, নালিশ জানাবে ওরা বল কাকে।
ঘরহীন ওরা ঘুম নেই চোখে, যুদ্ধে ছিন্ন ঘর বাড়ী দেশ,
মাথার ভিতরে বোমারু বিমান, এই কালোরাত কবে হবে শেষ।
শত শত মুখ হায় একাত্তর যশোর রোড যে কত কথা বলে,
এত মরা মুখ আধমরা পায়ে পূর্ব বাংলা কোলকাতা চলে,
এত মরা মুখ আধমরা পায়ে পূর্ব বাংলা কোলকাতা চলে॥
'সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড'
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:২০