ছোটবেলা থেকে মায়ের কাছে উনার গল্প শুনতে শুনতে এত ভালো লাগতো উনাকে। মনে হতো উনি আমাকে ছুঁয়েছেন বলে আমি বেঁচে উঠেছি। সবসময় সাদা শাড়ী সাদা ব্লাউজ পড়া কি অদ্ভুত সুন্দর মায়াময় একজন মানুষ। মাথার চুল একদম ছোট্ট করে কাঁটা। মাথায় কাপড় দিয়ে রাখতেন।
কোথাও বসলে আঁচলটা নামিয়ে মাথার মধ্যের চুল টেনে উঠাতেন। তাই উনার মাথার মাঝখানে একদম ফাঁকা হয়ে গেছিল। আর প্রায়ই একা একা কথা বলতেন উনি।
বাসায় আসলে মা উনাকে খুব যত্ন করতেন।আমাদের বাসার ঠিক পিছন দিয়ে বের হলে উনার কোয়ার্টার দেখা যেতো। অনেক সময় সিড়িতে বসে থাকতেন। আমাদের খেলতে যাওয়ার মাঠ এ যাবার রাস্তা ছিলো উনার বাসার সামনে দিয়ে। মাঝে মাঝেই যাবার সময় উনার চোখে পড়লে হাত ইশারা করে ডাকতেন। কাছে গেলে ঘরে গিয়ে কৌটা খুলে টোস্ট বিস্কিট খেতে দিতেন। ঘরে একটা বিছানা ছিলো। একটা আলমারী ছিলো। যার উপর দুইটা ছবি। দুইটা ফ্রেমে বাঁধানো। খালাম্মার দুই ছেলে। লুটু আর টুটু।
আমি হয়তো দাঁড়িয়ে বিস্কিট খাচ্ছি। উনি পানি নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে আছেন। আঁচল দিয়ে ছবির ধূলা মুছছেন আর বিড় বিড় করে কথা বলছেন। আমার পরিচিত বন্ধুরা কেউ আসতো না। সবাই ভয় পেতে উনাকে।কিন্তু আমার ভয় লাগতো না।মায়ের কাছে তো সব জেনেছি উনার সম্পর্কে।বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে উনি হারিয়েছেন উনার দুই ছেলে। দুজনের একজন তখন এস এস সি পরীক্ষার্থী ছিলো আর একজন সম্ভবতঃ ক্লাস টেন এ। আমার আপা আর ভাইজানের বন্ধু ছিলো ওরা। ভাইজান রাজশাহী ক্যাডেট এ পড়তো । কিন্তু বাড়ী এলে এদের সাথে সময় কাটাতো।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হতেই আমাদের পরিবারের সবাই লালমনিরহাট শহর থেকে একটু দুরে আমাদের গ্রামের বাড়ীতে চলে যায়। আব্বা খালাম্মাকে অনেকবার বলেছিলেন সাথে যেতে কিন্তু খালাম্মা যেতে চান নি। এই রকম আরো দুই একটি পরিবার যারা কোথাও যেতে চায়নি।যুদ্ধ শুরু হবার প্রথম দিকেই উনার ছেলেদুটোকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানী আর্মিরা। লালমনিরহাট রেলওয়ে ষ্টেশনের পাশে রিকশা ষ্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে চোখ বেঁধে গুলি করে মারে।
কি ভয়াবহ ! কি নির্মম!
শুনেছি দুটো ভাই ই খুব শান্ত স্বভাবের ছিলো। কে জানে সেই সময় উনাদের মনে কি কথা ছিলো? খবর পেয়ে খালাম্মা ছুটে গিয়েছিলেন। লাশের স্তুপে ছেলেদের খুঁজে বেড়িয়েছেন ।পান নি। যুদ্ধের পুরো সময় কোথাও আর্মি এসেছে খবর পেলেই তাদের কাছে গিয়ে বলেছেন ,"আমাকে মেরে ফেলো।ওদের পায়ে ধরে ধরে বলতেন," একটা বুলেট খরচ করো আর।"
নাহ উনাকে কেউ মারে নি। উনাকে মেরে ফেললে আমরা কি করে দেখতাম মুক্তিযুদ্ধে সন্তান হারানো মায়ের বিলাপ?
কি ভীষন কষ্ট ! কি নিঃসীম একাকীত্বতা!
ভাইজান যখন ঢাকায় মেডিকেলে পড়ে ও বাড়ী আসলেই খালাম্মা আসতেন। ভাইজানকে দেখতেন আর হয়তো ভাবতেন নিজের ছেলেদের কথা।ওরাও তো এত বড় হতো!
আব্বা চাকরী ছেড়ে দেবার পর আমরা রেলওয়ের বাসা ছেড়ে দেই। আমি কলেজে পড়তে চলে যাই ঢাকায়।এর পর খালাম্মার সাথে দেখা হতো খুব কম। আমার ছোটবেলার বান্ধবী তনাদের বাড়ীর কাছে উনি ছোট্ট একটা বাড়ী বানিয়েছিলেন। যেখানে অবসর গ্রহনের পর চলে যান। দুই একবার দেখা হয়েছিলো ওখানে।আমাকে দেখলেই গান শুনতে চাইতেন......
"তোমার গীতি জাগাল স্মৃতি নয়ন ছলছলিয়া"।ছোটবেলায় চাইলেই শুনিয়ে দিতাম গান। বড় হবার পর আর শোনানো হয়নি।
খালাম্মাকে শেষ কবে দেখেছিলাম মনে পড়ে না। খুব চেষ্টা করি মাঝে মাঝে। শুধু ঘুরে ফিরে ছোটবেলার দিন গুলোর কথাই মনে পড়ে যায়। খালাম্মার ছিমছাম চেহারা। লুটু টুটু ভাই এড় সাদা কালো ছবিগুলো ঝাপসা মনে পড়ে।
মুক্তিযুদ্ধে সব হারানো এই মা জীবনে যতদিন বেঁচে ছিলেন শুধু সন্তাপ নিয়ে চলে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধ তো শুধু নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ নয়। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের চেতনাকে নাড়া দিতে পারা ভীষন এক তাৎপর্যময় ইতিহাস। যেখানে সিস্টার খালাম্মার মত মানুষেরা এক একজন কিংবদন্তী।
যত বছর বেঁচে ছিলেন একটা রাত ও ঘুমাতে পেরেছেন কি নির্বিঘ্নে?
উনার মত অনেক মায়ের চোখের ঘুম কেড়ে নিয়ে তো আমাদের ঘুমাতে পারা! কে তার খবর রেখেছি?
কত গভীর বেদনা নিয়ে খালাম্মা চলে গেছেন।চলে গেছেন আমার এক মামাকে হারিয়ে আমার নানি। আমার নানির তো তাও ১২ জনের মধ্যে ১১ জন সন্তান ছিলো তখন। তবুও তিনিও কি কষ্ট ,কি অপেক্ষা নিয়ে চলে গেছেন।
আর লতিফা খালাম্মা তার বুকের ছেলে দুটোকে হারিয়ে কি নিঃসীম একাকীত্বতার মধ্যে দিয়ে গেছেন। উনার স্বামী কে ছিলেন কি ছিলেন কখনো আমার মা জানেন নি।একা যুদ্ধ করা এই মাকে স্যালুট জানাই।
যদি ও প্রায় ৩৭ বছর পার হয়ে গেলো দেশ স্বাধীন হবার তবু আমরা সেই একই তিমিরে পড়ে আছি। দেশের নেতৃত্বে এমন একজন এলো না যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে! অন্ততঃ লতিফা খালাম্মার আত্মা শান্তি পেতো তাতে।
আর সেই লুটু টুটু ভাই যারা এক একজন সম্ভাবনা ছিলো। তারা.....তাদের স্মৃতির কাছে আমাদের কি বলার থাকলো? মুখ নীচু করে থাকা ছাড়া?
ছবি লিন্ক:
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০০৯ দুপুর ১২:৪৪