somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মুক্তিযুদ্ধ এবং এক মা

০২ রা ডিসেম্বর, ২০০৮ সকাল ৯:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আজ যার কথা লিখতে বসেছি ,উনার নাম লতিফা বানু। লালমনিরহাট বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতালের একজন সিনিয়র নার্স ছিলেন উনি। আব্বা রেলওয়ে ডাক্তার হওয়াতে এক সময় চট্রগ্রাম ও সৈয়দপুর হাসপাতালে থাকলেও আমি জন্মাবার পর আব্বা কখনো আর লালমনিরহাট ছাড়েন নি। আমার জন্মের সময় লতিফা খালাম্মা মায়ের পাশে ছিলেন। সময়ের প্রায় আড়াইমাস আগে জন্ম নেয়াতে আমার বাঁচার সম্ভাবনা ছিলো না।আব্বা আর এই সিস্টার খালাম্মা যত্ন করে আমাকে বড় করেছেন।আমি এত ছোট ছিলাম যে মা ঠিক বুঝতে পারতো না আমাকে কিভাবে কি করবেন। প্রতিদিন খালাম্মা আসতেন কাজের পর।

ছোটবেলা থেকে মায়ের কাছে উনার গল্প শুনতে শুনতে এত ভালো লাগতো উনাকে। মনে হতো উনি আমাকে ছুঁয়েছেন বলে আমি বেঁচে উঠেছি। সবসময় সাদা শাড়ী সাদা ব্লাউজ পড়া কি অদ্ভুত সুন্দর মায়াময় একজন মানুষ। মাথার চুল একদম ছোট্ট করে কাঁটা। মাথায় কাপড় দিয়ে রাখতেন।
কোথাও বসলে আঁচলটা নামিয়ে মাথার মধ্যের চুল টেনে উঠাতেন। তাই উনার মাথার মাঝখানে একদম ফাঁকা হয়ে গেছিল। আর প্রায়ই একা একা কথা বলতেন উনি।
বাসায় আসলে মা উনাকে খুব যত্ন করতেন।আমাদের বাসার ঠিক পিছন দিয়ে বের হলে উনার কোয়ার্টার দেখা যেতো। অনেক সময় সিড়িতে বসে থাকতেন। আমাদের খেলতে যাওয়ার মাঠ এ যাবার রাস্তা ছিলো উনার বাসার সামনে দিয়ে। মাঝে মাঝেই যাবার সময় উনার চোখে পড়লে হাত ইশারা করে ডাকতেন। কাছে গেলে ঘরে গিয়ে কৌটা খুলে টোস্ট বিস্কিট খেতে দিতেন। ঘরে একটা বিছানা ছিলো। একটা আলমারী ছিলো। যার উপর দুইটা ছবি। দুইটা ফ্রেমে বাঁধানো। খালাম্মার দুই ছেলে। লুটু আর টুটু।

আমি হয়তো দাঁড়িয়ে বিস্কিট খাচ্ছি। উনি পানি নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে আছেন। আঁচল দিয়ে ছবির ধূলা মুছছেন আর বিড় বিড় করে কথা বলছেন। আমার পরিচিত বন্ধুরা কেউ আসতো না। সবাই ভয় পেতে উনাকে।কিন্তু আমার ভয় লাগতো না।মায়ের কাছে তো সব জেনেছি উনার সম্পর্কে।বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে উনি হারিয়েছেন উনার দুই ছেলে। দুজনের একজন তখন এস এস সি পরীক্ষার্থী ছিলো আর একজন সম্ভবতঃ ক্লাস টেন এ। আমার আপা আর ভাইজানের বন্ধু ছিলো ওরা। ভাইজান রাজশাহী ক্যাডেট এ পড়তো । কিন্তু বাড়ী এলে এদের সাথে সময় কাটাতো।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হতেই আমাদের পরিবারের সবাই লালমনিরহাট শহর থেকে একটু দুরে আমাদের গ্রামের বাড়ীতে চলে যায়। আব্বা খালাম্মাকে অনেকবার বলেছিলেন সাথে যেতে কিন্তু খালাম্মা যেতে চান নি। এই রকম আরো দুই একটি পরিবার যারা কোথাও যেতে চায়নি।যুদ্ধ শুরু হবার প্রথম দিকেই উনার ছেলেদুটোকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানী আর্মিরা। লালমনিরহাট রেলওয়ে ষ্টেশনের পাশে রিকশা ষ্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে চোখ বেঁধে গুলি করে মারে।
কি ভয়াবহ ! কি নির্মম!
শুনেছি দুটো ভাই ই খুব শান্ত স্বভাবের ছিলো। কে জানে সেই সময় উনাদের মনে কি কথা ছিলো? খবর পেয়ে খালাম্মা ছুটে গিয়েছিলেন। লাশের স্তুপে ছেলেদের খুঁজে বেড়িয়েছেন ।পান নি। যুদ্ধের পুরো সময় কোথাও আর্মি এসেছে খবর পেলেই তাদের কাছে গিয়ে বলেছেন ,"আমাকে মেরে ফেলো।ওদের পায়ে ধরে ধরে বলতেন," একটা বুলেট খরচ করো আর।"
নাহ উনাকে কেউ মারে নি। উনাকে মেরে ফেললে আমরা কি করে দেখতাম মুক্তিযুদ্ধে সন্তান হারানো মায়ের বিলাপ?
কি ভীষন কষ্ট ! কি নিঃসীম একাকীত্বতা!
ভাইজান যখন ঢাকায় মেডিকেলে পড়ে ও বাড়ী আসলেই খালাম্মা আসতেন। ভাইজানকে দেখতেন আর হয়তো ভাবতেন নিজের ছেলেদের কথা।ওরাও তো এত বড় হতো!
আব্বা চাকরী ছেড়ে দেবার পর আমরা রেলওয়ের বাসা ছেড়ে দেই। আমি কলেজে পড়তে চলে যাই ঢাকায়।এর পর খালাম্মার সাথে দেখা হতো খুব কম। আমার ছোটবেলার বান্ধবী তনাদের বাড়ীর কাছে উনি ছোট্ট একটা বাড়ী বানিয়েছিলেন। যেখানে অবসর গ্রহনের পর চলে যান। দুই একবার দেখা হয়েছিলো ওখানে।আমাকে দেখলেই গান শুনতে চাইতেন......
"তোমার গীতি জাগাল স্মৃতি নয়ন ছলছলিয়া"।ছোটবেলায় চাইলেই শুনিয়ে দিতাম গান। বড় হবার পর আর শোনানো হয়নি।

খালাম্মাকে শেষ কবে দেখেছিলাম মনে পড়ে না। খুব চেষ্টা করি মাঝে মাঝে। শুধু ঘুরে ফিরে ছোটবেলার দিন গুলোর কথাই মনে পড়ে যায়। খালাম্মার ছিমছাম চেহারা। লুটু টুটু ভাই এড় সাদা কালো ছবিগুলো ঝাপসা মনে পড়ে।
মুক্তিযুদ্ধে সব হারানো এই মা জীবনে যতদিন বেঁচে ছিলেন শুধু সন্তাপ নিয়ে চলে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধ তো শুধু নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ নয়। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের চেতনাকে নাড়া দিতে পারা ভীষন এক তাৎপর্যময় ইতিহাস। যেখানে সিস্টার খালাম্মার মত মানুষেরা এক একজন কিংবদন্তী।
যত বছর বেঁচে ছিলেন একটা রাত ও ঘুমাতে পেরেছেন কি নির্বিঘ্নে?
উনার মত অনেক মায়ের চোখের ঘুম কেড়ে নিয়ে তো আমাদের ঘুমাতে পারা! কে তার খবর রেখেছি?
কত গভীর বেদনা নিয়ে খালাম্মা চলে গেছেন।চলে গেছেন আমার এক মামাকে হারিয়ে আমার নানি। আমার নানির তো তাও ১২ জনের মধ্যে ১১ জন সন্তান ছিলো তখন। তবুও তিনিও কি কষ্ট ,কি অপেক্ষা নিয়ে চলে গেছেন।
আর লতিফা খালাম্মা তার বুকের ছেলে দুটোকে হারিয়ে কি নিঃসীম একাকীত্বতার মধ্যে দিয়ে গেছেন। উনার স্বামী কে ছিলেন কি ছিলেন কখনো আমার মা জানেন নি।একা যুদ্ধ করা এই মাকে স্যালুট জানাই।
যদি ও প্রায় ৩৭ বছর পার হয়ে গেলো দেশ স্বাধীন হবার তবু আমরা সেই একই তিমিরে পড়ে আছি। দেশের নেতৃত্বে এমন একজন এলো না যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে! অন্ততঃ লতিফা খালাম্মার আত্মা শান্তি পেতো তাতে।
আর সেই লুটু টুটু ভাই যারা এক একজন সম্ভাবনা ছিলো। তারা.....তাদের স্মৃতির কাছে আমাদের কি বলার থাকলো? মুখ নীচু করে থাকা ছাড়া?

ছবি লিন্ক:
Click This Link









সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০০৯ দুপুর ১২:৪৪
৭৪টি মন্তব্য ৭১টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদী নামের এই ছেলেটিকে কি আমরা সহযোগীতা করতে পারি?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১০:০৪


আজ সন্ধ্যায় ইফতার শেষ করে অফিসের কাজ নিয়ে বসেছি। হঠাৎ করেই গিন্নি আমার রুমে এসে একটি ভিডিও দেখালো। খুলনার একটি পরিবার, ভ্যান চালক বাবা তার সন্তানের চিকিৎসা করাতে গিয়ে হিমশিম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভালোবাসা নয় খাবার চাই ------

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:০৬


ভালোবাসা নয় স্নেহ নয় আদর নয় একটু খাবার চাই । এত ক্ষুধা পেটে যে কাঁদতেও কষ্ট হচ্ছে , ইফতারিতে যে খাবার ফেলে দেবে তাই ই দাও , ওতেই হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতীয় ইউনিভার্সিটি শেষ করার পর, ৮০ ভাগই চাকুরী পায় না।

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৭



জাতীয় ইউনিভার্সিটি থেকে পড়ালেখা শেষ করে, ২/৩ বছর গড়াগড়ি দিয়ে শতকরা ২০/৩০ ভাগ চাকুরী পেয়ে থাকেন; এরা পরিচিত লোকদের মাধ্যমে কিংবা ঘুষ দিয়ে চাকুরী পেয়ে থাকেন। এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×