ভারতের নির্বাচন একই সাথে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে। এটা এ অঞ্চলের রাজনীতি সচেতন মানুষের মধ্যেও বেশ উত্তাপ ছড়াচ্ছে। এবং অনেকের জন্য বিব্রতকর। কারণ ভারতের মত একটি দেশের কাছ থেকে এ অঞ্চলের মানুষ এমন প্রচারণা আশা করে না। অন্যদিকে ভারতে যে গণতন্ত্রের আড়ালে ব্যাপকভাবে সাম্প্রদায়িকতার চর্চা হয় এটা গোটা বিশ্ব বুঝতে পারছে। হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষ ছড়াতে ভারত যে কত ওস্তাদ সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। ভারতের নির্বাচনি প্রচারণা এটাও প্রমাণ করে দিচ্ছে- হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার জন্মভূমিও ভারত। বিশ্বের বড় এই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রটি শুধু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে বড় নয় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্যও বড় ভূমিকা রাখছে।
জনগণ যদি ভয়ঙ্কর স্বভাবের হয় তাহলে রাষ্ট্রের যেমন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি হয় তেমনি আশেপাশেও সঙ্কট তৈরি হয়। ভারতের বিভিন্ন জরিপ যখন বার বার বিজেপির ক্ষমতারোহণের সম্ভাবনাকে পরিস্কার করছে তখন ভারতীয় জনগণের চেহারা ও চাহিদাও সহজে বোঝা যায়। তারা-জনগণ মানে ভোটাররা- কতটা অসাম্প্রদায়িক? তারা যদি সাম্প্রদায়িকতা লালন না করত তাহলে বিজেপির ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনাটা তৈরি হত না। কারণ ভারতীয় জনগণই ভোটার। তারা আরও সঙ্কট তৈরি করেছে। বিজেপি ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনার কথা শোনার পরও, বিজেপির কর্মকা-ের অতীত স্মরণ করিয়ে দেওয়ার পরও ভারতের জনগণ শেষ সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি বিজেপিকে ভোট না দেয়ার। এবং ভারতের জনগণ সাম্প্রদায়িকতার জন্য বিজেপির কাছে কোন ক্ষমা প্রার্থনার দাবিও করেনি। কোন ধরনের কায় ক্লেশ ছাড়াই বিজেপি ক্ষমতারোহণের সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। বলতে গেলে ভারতীয় জনগণের ভয়ঙ্কর বদান্যতা। এটা ভারতীয় গণতন্ত্রের আশীর্বাদ!
যেমন বিজেপির নির্বাচনী ইশতেহার -যেখানে রামমন্দির নির্মাণের বিষয়টি তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ বলে দাবি করেছে। এছাড়া কোরবানির ঈদে গরু জবাই নিষিদ্ধ করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। যা এক ও অভিন্ন নাগরিক নীতির নামে চালানোর চেষ্টা হচ্ছে। মোদির ঘনিষ্ট বলে পরিচিত অমিত শাহ বলেছেন, বিজেপিকে ভোট দিয়ে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য যেখানে হিন্দুদের হত্যাকারিদের কংগ্রেস সরকার রক্ষা করেছে এবং পুরস্কৃত করেছে।
আর একজন কলামিস্ট মোদির সম্পর্কে বলেছেন, আধুনিক ভারতের সবচেয়ে সংগঠিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাগুলোর একটি মোদির পৌরহিত্যে সংঘটিত হয়েছে। এজন্য তার রাজ্য মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্যের বিরুদ্ধে দাঙ্গায় প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভূমিকার অভিযোগ আদালতে প্রমাণিত হয়েছে। এবং যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে মোদির প্রবেশের ওপর কার্যত ১০ বছর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। ২০০২ সালে গুজরাটে দাঙ্গা এবং পরবর্তি কয়েক বছর এ নরেন্দ্র মোদির বক্তব্য ছিল অনেক বেশি সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে ভরা।
এবং‘নরেন্দ্র মোদি তাঁর নির্বাচনী প্রচারকালে নিজেই স্বীকার করেন যে সোনিয়া গান্ধীর সামনে এক বছরে প্রায় ৭০০ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছে এবং উত্তর প্রদেশে প্রায় ২৫০টি হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার রেকর্ড করা হয়েছে।’
এভাবে বিজেপি সাম্প্রদায়িকতার বাইরে প্রতিবেশিদের মধ্যেও উত্তেজনা ছড়াচ্ছে। বাংলাদেশ দখল করার কথা বলছে। পাকিস্তান নিয়েও নানা কথা বলছে।
বিজেপির সাম্প্রদায়িক উস্কানি শুধু ভারতেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। তার আশে পাশের রাষ্ট্র ও বিশ্বের মানুষ জানছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মত প্রতিবেশি দেশগুলোতে যেখানে ভারতের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূত্র ধরেই বহু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে সেখানকার সুযোগসন্ধানী সাম্প্রদায়িক অপশক্তির জন্য একটি হাতিয়ার তৈরি করে দিচ্ছে। এবং তাদের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য ডাক দিয়ে যাচ্ছে। এরমধ্যে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় বহু সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ব্যাপক ক্ষতির স্বীকার হয়েছে। আর মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বর্বর নির্যাতন চালিয়েছে বৌদ্ধরা। যেখানে বৃহৎ রাষ্ট্র হিসাবে ভারতের অসাম্প্রদায়িকতার নজির সৃষ্টি করার কথা সেখানে তারা ব্যাপক সাম্প্রদায়িক বীজ বপন করছে এ অঞ্চলের মানুষের মনে। হয়তো যার এক ভয়ঙ্কর পরিণতি অপেক্ষা করছে। তাদের এ উস্কানি শুধু ভারত ছারখার করবে তা নয়, প্রতিবেশি সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে শক্তি যোগাচ্ছে। অর্থাৎ এমন নির্বাচনি প্রচারণা অন্য দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকেও হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। ভারতের গণতন্ত্র ও নেতৃত্ব এত বেশি সমৃদ্ধ হলে সেখানকার নেতাদের মুখ দিয়ে এমন বক্তব্য বের হয় কিভাবে। এটা ভারতের মত কোন রাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা বলেও মনে হয় না।
এখানে একটা কথা আছে। সেখানকার জনগণ। তারা যদি এমন সাম্প্রদায়িক নেতাদের আশ্বাস না দেন তাহলে তারা এমন উদ্বাহু হয় কিভাবে। নিশ্চয়ই কোন কারণে ভারতীয় জনগণ এই সাম্প্রদায়িকতাকে লালন করে। প্রশ্রয় দেয়। হয়ত অনেক সময় সাম্প্রদায়িকতায় তারা খুশিও। না হলে কেন তারা বিজেপির মত একটি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠিকে শক্তিশালী করে তুলছে।
দুর্নীতিই কংগ্রেস সরকার ও বর্তমান কংগ্রেস দলের নির্বাচনি ভরাডুবির সম্ভাবনার কথা জরিপগুলো বলছে। জরিপগুলো বার বার কংগ্রেসকে সতর্ক করলেও কার্যত কংগ্রেস নিজেদের রক্ষার জন্য কোন পূর্ব প্রস্তুতি নেয়নি। সোনিয়াকে অনেক প্রভাবশালি বলা হলেও কার্যত তার নেতৃত্বে নিজের পুত্র রাহুলকে গড়ে তুলতে পারেননি। বিজেপির এক নেতা রাহুলকে এখনও ‘শিশু’ বলে মন্তব্য করেছেন। দুর্নীতি এবং সোনিয়ার ব্যর্থতাই মূলত ভারতে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে উৎসাহ যোগাচ্ছে। এবং জোর সম্ভাবনার উপর দাঁড়িয়ে আছে সাম্প্রদায়িক শক্তি।
শুধু তাই নয় ভারতীয় বংশোদ্ভূত যুক্তরাজ্যের ৭২ জন বরেণ্য অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ ‘মোদি ক্ষমতায়’ এমন ভাবনা আমাদের শঙ্কিত করে তোলে শিরোনামে একটি খোলা চিঠি লিখেছেন যা যুক্তরাজ্যের ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকায় ছাপানো হয়েছে। এসব বিশ্ববরেণ্য ভারতীয়রা বলেছেন, বিজেপি সরকার গঠন করলে ভারতে গণতন্ত্র, বহুগোষ্ঠির সহাবস্থান, মানবাধিকারের কি হবে তা নিয়ে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। তারা বলেছেন, মোদির সংঘগোষ্ঠির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় ইন্ধন দেয়ার ইতিহাস আছে। ইত্যাদি নানা শঙ্কা প্রকাশের পরও ভারতীয় ভোটাররা নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে উদ্বাহু। যা ভারতের বাইরেও শঙ্কা তৈরি করছে।