somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

সৈয়দ মেহেদী হাসান
পেশায় সাংবাদিক। ‘জল পরীর ডানায় ঝাপটা লাগা বাতাস’ (২০১৩), ‘সাদা হাওয়ায় পর্দাপন’ (২০১৫) দুটি কবিতার বই প্রকাশিত। তার লেখা নাটকের মধ্যে ফেরা, তৎকালীন, আদমের সন্তানেরা উল্লেখযোগ্য। লেখালেখির জন্য ২০১৫ সালে হত্যার হুমকি প্রাপ্ত হন।

শর্ষিণার রাজাকার পীরের ‘স্বাধীনতা পদক’ প্রত্যাহার করা হোক

০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ইাতহাসের আড়ালেও কখনো কখনো থেকে যায় ভিন্ন কোন ইতিহাস। এই ঘাপ্টি মেরে থাকা ইতিহাসের বিষক্রিয়া জাতিকে সরল পথ ভেঙ্গে যুগান্তরের প্রশ্নের মুখে দাড় করায়। স্বাধীনতার ৪৪ বছর শেষেও বাংলার ও বাঙালীর ভিতরে বিষাক্ত কিছু ইতিহাসের খল চরিত্র থেকে গেছে মুন্সিয়ানায়। সরকার বদল হয়েছে-তারা খোলস পাল্টেছে। কখনো আড়মোড়া ভেঙ্গে পাকিস্তানিজম ঢুকিয়েছেন ধর্মীয় বয়ানে। কখনো দেশ নিয়ে খেলেছেন মড়ক লাগার খেলা। এমনি এক চরিত্র ছিলেন শর্ষিণার পীর আবু সালেহ মোহাম্মদ জাফর। নরঘাতক এই কুখ্যাত রাজাকার একাত্তর পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন বাংলায় ইসলাম সাধনার প্রবাদ পুরুষ। জাতিগতভাবে ওনার মত বেঈমানকে কেউ কোনদিন বিচারের মুখোমুখি দাড় করায়নি। তার বংশ পরম্পরায় টিকে যাওয়া শর্ষিণা দরবার শরিফের নাম বদলে হয়েছে ছারছিনা। কিন্তু হাজার হাজার বাঙালী খুনের নায়ক, হিন্দু নারী/নারী গনিমতের মাল করে রাখা মাওলানা আর দক্ষিনাঞ্চলে তাণ্ডব চালানো ধর্মীয় নেতা আবু সালেহ মোহাম্মদ জাফর এখন বাংলাদেশের বিরোধী কেউ নন, উল্টো তার নাম স্মরণ করলে পুন্ন্য হয় এমন মতবাদও প্রচারিত হচ্ছে সমাজে। ভাবতে অবাক লাগে ইতিহাসের খল চরিত্র যিনি মানব প্রেমে নয়; মানুষ হত্যায় মেতে উঠেছিলেন তিনি কি করে ধর্মগুরু হয়?


‘সব সম্ভবের বাংলাদেশ’-সচারচার এ ধরনের কিছু কথ্য প্রবাদ বাজারে চলছে। এখানে দুর্বৃত্তায়ন ও অপ-রাজনীতি এতটাই গুরুতরভাবে আকড়ে ধরেছে যে জাতি হিসেবে প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতে আমরা অসহায় হয়ে আছি। রাজাকার শর্ষিণা পীরের অপকর্মের শাস্তি হয়নি বরংছ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দুধে ভাতে রাখা হয়েছিল। চিহ্নিত এই স্বাধিনতাবিরোধী ‘রাজাকার মাওলানা আবু জাফর মোঃ সালেহ’কে স্বাধীনাতার মাত্র ৯ বছর পর ১৯৮০ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ‘জনসেবার’ জন্য স্বধীনতা পদক দেন। এরপর ১৯৮৫ সালে শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের জন্য স্বৈরশাসক এরশাদ তাকে আবার স্বাধীনতার পদকে ভূষিত করেন। জিয়াউর রহমান বা এরশাদ কেন শর্ষিণা পীরের মত একজন খুনিকে দফায় দফায় স্বাধীনতা পুরস্কার দিয়েছিলেন সে প্রশ্ন দিন দিন স্পষ্ট হচ্ছে। পুরষ্কার প্রদান যে পুরো জাতিকে ছোট, হেয় প্রতিপন্ন করেছিল তা হয়তো প্রেসিডেন্টরা নিজেরাও জানতেন। তবুও অত্যান্ত জাকজমকভাবে করেন সেই কর্মটি। রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ স্তর থেকে স্বাধীনতা পদকের মত একটি পুরষ্কার রাষ্ট্রীয় খুনির হাতে তুলে দিয়ে কৌশলে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে কিংবদন্তী করে ফেলা হয় শর্ষিণা পীরকে। এই পুরষ্কার অন্য কোন অবদানের জন্য না হলেও এটা অনুমান করা যায় যে ১৯৭১ সালে পাকবাহিনীকে সহযোগীতা করার কথা মনে রেখেই হয়তো জিয়াউর রহমান ও এরশাদ স্বাধীনতা পদক প্রদান করে শর্ষিণার পীরের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছিল। পুরষ্কারের মাধম্যে যুদ্ধার্জিত স্বাধীনতার ইতিহাসের সাথে চরমভাবে রসিকতা করা হয়। মুছে ফেলার চেষ্টা চলে ঘাতকদের নাম। কারন স্বাধীনা পদক মাওলানা আবু সালেহ মোহাম্মদ জাফর এর হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল সে খুনি রাজাকার ও দেশদ্রোহী হিসেবে গ্রেফতার হবার নয় বছরের মাথায়।


১৯৭২ সালের ৫ জানুয়ারি ‘পূর্বদেশ’ পত্রিকার রিপোর্ট বলছে,‘শর্ষিণার পীর আবু সালেহ মোহাম্মদ জাফর ধরা পড়েছেন। গত শনিবার পয়লা জানুয়ারি শর্ষিণা থেকে তাকে গ্রেফতার করে বরিশাল সদরে নিয়ে যাওয়া হয়। গত ১২ই নবেম্বর ৫ শতাধিক রাজাকার, দালাল ও সাঙ্গপাঙ্গসহ মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলে তখন থেকে পীর সাহেবকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়।’ প্রসঙ্গত, টিক্কা খানের আমলে ঢাকার ফরাসগঞ্জের লালকুঠিতে যে সকল পীর, মাদ্রাসার মোহান্দেস-মোদাররেস ও দক্ষীণপন্থী রাজনীতিক রাজাকার বাহিনী গঠন করা, প্রতিটি মাদ্রাসাকে রাজাকার ক্যাম্পে পরিণত করা এবং সকল মাদ্রাসার ছাত্রকে রাজাকার ও পুলিশ বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় যারা তাদের মধ্যে শর্যিণার পীর ছিলেন অন্যতম।’



ঐ সংবাদে আরো লেখা ছিল, ‘শর্ষিণার পীর সাহেব দাওয়াতে হানাদার বাহিনী বরিশালের বিভিন্ন স্থানে হত্যাযজ্ঞ চালায় এবং অগ্নি সংযোগ ও লুট করে এবং শর্ষিণা মাদ্রাসার ৫ শতাধিক তালেবে এলেম প্রায় ৩০টি গ্রামে হামলা চালায় এবং বাড়ি ঘর ও বাজার লুট করে কয়েক কোটি টাকার সোনা, খাদ্যদ্রব্য, আসবাবপত্র ও নগদ টাকা এনে পীর সাহেবের ‘বায়তুল মালে’- ‘গনিমত হিসেবে’ জমা দেওয়া হয়। তারা হিন্দুদের বাড়ির ভিটা পর্যন্ত নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। পীর সাহেবের নির্দেশেই তালেবে এলেম রাজাকার এবং হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের একমাত্র পেয়ারা সরবরাহকারী হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চল আটঘর, কুড়িয়ানা ও ধলারে পাঁচ দিক থেকে একযোগে হামলা চালিয়ে হাজার হাজার পুরুষ, মহিলা, শিশুকে হত্যা করে এবং তাদের সর্বস্ব লুট করে। সেখানে বাড়ি-ঘরের তেমন চিহ্ন নেই। মাদ্রাসার ছাত্র রাজাকার সেখানে লোহার রড, লাঠির সাহায্যে হত্যা করা ছাড়াও জঙ্গল ও ধান ক্ষেতে লুকিয়ে থাকা অসংখ্য মহিলার উপর পাশবিক অত্যাচার চালায়। তারা প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে লোক ধরে এনে বেয়নেট চার্জ ও গুলি করে হত্যা করতো। গত রোজার শেষের দিকে পীর সাহেবের নির্দেশক্রমেই হানাদার বাহিনী ৬ দিক থেকে হামলা চালিয়ে স্বরূপকাঠির শিল্প শহর ও বন্দর ইন্দরহাট পুড়িয়ে দেয়। এবং প্রায় এক হাজার নিরীহ লোককে হত্যা করে। তবে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধে এখানে ২২ জন হানাদার সৈন্য ও শর্ষিণার রাজাকার নিহত হয়। এখানকার স্থানীয় তরুণদের মধ্যে শতকরা ৯০ জনই ছিল মুক্তিবাহিনী ও মাদ্রাসার কয়েকজন স্থানীয় ছাত্রও মুক্তিবাহিনীতে সদস্য ছিল। গত নয় মাস কাল শর্ষিণার পীরের বাড়ি ছিল হানাদার বাহিনীর একটি দুর্ভেদ্য দুর্গ। এখানে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য ও পাঞ্জাবী পুলিশ অবস্থান করে বিভিন্ন এলাকায় হামলা চালায় এবং রাজাকার ট্রেনিং দান করে। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের জন্যে পরে এখানে স্বরূপকাঠি থানা স্থানান্তরিত করা হয়। বর্তমানে শর্ষিণার রাজাকার এবং দালালরা মুক্তিবাহিনীর তত্ত¡াবধানে রয়েছে। তবে পীর সাহেবের অনেক সাঙ্গপাঙ্গ ঢাকা, বরিশালে ও অন্যান্য শহরে আত্মগোপন করে আছে। পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের আমল থেকে শর্ষিণা গণ-বিরোধী চক্রের একটি শক্তিশালী আখড়া ছিল।’


এমনকি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে শর্ষিণার পীর সম্পর্কে লিখেছেন: ‘সময় ১৯৫৪ এর নির্বাচন। জামান সাহেব ও মুসলিম লীগ যখন দেখতে পারলেন তাদের অবস্থা ভাল না, তখন এক দাবার ঘুঁটি চাললেন। অনেক বড় বড় আলেম, পীর ও মওলানা সাহেবদের হাজির করলেন। গোপালগঞ্জে আমার নিজের ইউনিয়নে পূর্ব বাংলার এক বিখ্যাত আলেম মওলানা শামসুল হক সাহেব জন্মগ্রহণ করেছেন। আমি তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে খুবই শ্রদ্ধা করতাম। তিনি ধর্ম সম্বন্ধে যথেষ্ট জ্ঞান রাখেন। আমার ধারণা ছিল, মওলানা সাহেব আমার বিরুদ্ধাচরণ করবেন না। কিন্তু এর মধ্য তিনি মুসলিম লীগে যোগদান করলেন এবং আমার বিরুদ্ধে ইলেকশনে লেগে পড়লেন। ঐ অঞ্চলের মুসলমান জনসাধারণ তাকে খুবই ভক্তি করত। মওলানা সাহেব ইউনিয়নের পর ইউনিয়নে স্পিড-বোট নিয়ে ঘুরতে শুরু করলেন এবং এক ধর্ম সভা ডেকে ফতোয়া দিলেন আমার বিরুদ্ধে যে,‘আমাকে ভোট দিলে ইসলাম থাকবে না, ধর্ম শেষ হয়ে যাবে।’ সাথে শর্ষিণার পীর সাহেব, বরগুনার পীর সাহেব, শিবপুরের পীর সাহেব, রহমতপুরের শাহ সাহেব সকলেই আমার বিরুদ্ধে নেমে পড়লেন এবং যত রকম ফতোয়া দেওয়া যায় তাহা দিতে কৃপণতা করলেন না। দুই-চার জন ছাড়া প্রায় সকল মওলানা, মৌলভী সাহেবরা এবং তাদের তালবেলেমরা নেমে পড়ল।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী-পৃষ্ঠা:২৫৬)


ওদিকে মুক্তিযুদ্ধের অষ্টম খণ্ডে এই পীরের ইতিহাস লিপিবদ্ধ আছে। অষ্টম খণ্ড থেকে ভারতী রাণী বসু’র কথাগুলো তুলে দিচ্ছি।

ভারতী রাণী বসু
গ্রাম স্বরুপকাঠি
জেলা বরিশাল
২৭শে এপ্রিল আমি কাঠালিয়া থানার মহিষকান্দি গ্রামে যাই আত্মরক্ষার জন্য। তখন চারদিকে সব বিচ্ছিন্ন অবস্থা। হিন্দু বাড়ি বিভিন্ন স্থানে লুট হচ্ছে, হত্যা চলছে। ওখানে পৌছানোর পরপরই স্থানীয় কিছু লোক হিন্দু বাড়ি লুট শুরু করে দেয়। ২০/২৫ জনের বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে সকালে, দুপুরে, রাতে, ভোরে যখন তখন বল¬ম, দা এবং অন্যান্য ধারালো অস্ত্র নিয়ে হিন্দু বাড়ি আক্রমণ করে সব লুট করে ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। আমি স্বরুপকাঠিতে ফিরে আসি ৫ই মে। সেদিন ছিলো হাটবার। ঐ দিনই সমস্ত এলাকা লুট করে নেয় দুষ্কৃতিকারীরা। ৬ই মে সকালে পাক সেনা প্রথম স্বরূপকাঠিতে যায়। ওখানকার পীর শর্ষিনার বাড়ীতে গিয়ে পাক বাহিনী ওঠে। ওখান থেকে থানায় আসার পথে শর্ষিনার পুল থেকে থানা পর্যন্ত (সাহাপারা) সমগ্র হিন্দু বাড়ী প্রথমে লুট করে জ্বালিয়ে দিয়েছে। ওখান থেকে পাক বাহিনীর একটা দল অলঘারকাঠির দিকে গিয়ে ঘর বাড়ী জ্বালানো ও সেই সাথে মানুষ হত্যাও শুরু করে। আর একটা দল স্বরূপকাঠি এসে শুধু হিন্দু বাড়ী বেছে বেছে সকল হিন্দু বাড়ী লুট করে পুড়িয়ে দেয়। কালী প্রতিমার উপর অসংখ্য গুলি চালিয়ে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে। বহুজনকে হত্যা করে। তারপর পাক বাহিনী ফিরে যায়। তারপর থেকে ক্রমাগত সাত দিন পাক বাহিনী স্বরূপকাঠিতে যায়। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে আর লুট করেছে। স্থানীয় কিছু লোক এবং পীরের দল পাক বাহিনীর সাথে থাকতো। লুট করতে বলে তারা যখন লুট করতে আরম্ভ করে তখন পাক সেনারা ছবি তুলতো। কুড়িয়ানা আটঘর, জলাবাড়ী, সমুদয়কাঠি, জুলুহারা, নান্দিঘর, সোহাগদল, ইন্দেরহাট, মণিনাল, বাটনাতলা ইত্যাদি গ্রামসহ ৯টি ইউনিয়নে পাক বাহিনীরা গ্রামের প্রতিটি কোনাতে ঘুরে সব ধ্বংস করেছে, লুট করেছে। কুড়িয়ানা আটঘরে পেয়ারার বাগানে বহুজন আশ্রয় নিয়েছিল। পাক বাহিনী হঠাৎ করে ঘিরে ফেলে অসংখ্য লোককে হত্যা করে। এক মেয়েকে পেয়ারা বাগান থেকে ধরে এনে সবাই মিলে পাশবিক অত্যাচার চালায়। তারপর তিনদিন যাবৎ বে¬ড দিয়ে শরীর কেটে কেটে লবণ দিয়েছে। অশেষ যন্ত্রণা লাঞ্ছনা দেওয়ার পর মেয়েটিকে গুলি করে হত্যা করে। মেয়েটি ম্যাট্রিক পাশ ছিল। অন্য একজন মহিলাকে ধরে নিয়ে অত্যাচার চালিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এখানে অধিকাংশ লোককে গুলি করে এবং বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করেছে। শত শত লোককে এই এলাকাতে হত্যা করেছে। কাউখালি স্টেশনে আমি নিজে দেখেছি একজনকে মুক্তিবাহিনী সন্দেহে রাজাকাররা কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে। স্বরূপকাঠিতে টিকতে না পেরে মহিষকান্দিতে যাই। ওখানে গেলে আমাকে সবাই মুক্তিবাহিনীর চর মনে করলো এবং অস্ত্র আছে বললো। আমি ওখান থেকে রাতে পালিয়ে যাই রাজাপুরে। রাজাপুর থানাতে হামিদ জমাদার সমগ্র থানাতে সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছিল। সমস্ত বাড়িঘর লুট করে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ধ্বংস করেছে, হত্যা করেছে। হিন্দু কোন বাড়িঘর ছিল না। সব ধ্বংস করেছিল। ওখানে শুক্কুর মৃধা শান্তি কমিটির সেক্রেটারী ছিল। আমি সহ আরো তিনজন তিন হাজার টাকা দিয়ে কোন রকম সেবারের মতো বাঁচি। আমি তখন কুমারী ছিলাম। সবাইকে মুসলমান হতে হবে এবং মুসলমান ছেলেকে বিয়ে করতে হবে। এমনি একটি পরিস্থিতিতে সুনীল কুমার দাস নামে এক ভদ্রলোককে আমি বিয়ে করি সে সময় দুষ্কৃতিকারীর হাত থেকে বাঁচবার জন্য। সময়টা ছিল জুন মাসের শেষ অথবা জুলাই প্রথম। রাজাপুরে আছি স্বামীসহ। ভোরবেলা রাজাকার, পুলিশ মিলে প্রায় ৩০/৪০ জন আমাদের বাড়ি ঘিরে ফেলে। স্বামীকে লুকিয়ে রাখি। ওরা এসে সব কিছু লুট করে গালাগালি করে চলে যায়। কিছুক্ষণ বাদে আবার এসে আর যা ছিলো সব নিয়ে অত্যাচার চালায়। পাশের একটি লোককে হত্যা করলো। নৈকাঠি রাজাপুর থানা গ্রামে শতকরা ৯৮ জনকে হত্যা করে। ওখানকার সব হিন্দু। ৯৮% মহিলা আজ বিধবা। নৈকাঠির প্রায় সব পুরুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করে তাদের যথাসর্বস্ব আত্মসাৎ করে হামিদ জমাদার ও তার দল। ঐ বিপদের মাঝে জঙ্গলে জঙ্গলে এ বাড়ি ও বাড়ি করে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম। আমার সব কিছু লুটে নেয় রাজাকার আর পাক বাহিনী। আমি কোন মতে পালিয়ে বাহিরচরে যাই জুলাই মাসের ১৭ তারিখে। আমি আমার কাজে যোগ দেই। তার পরপরই আমাকে সাসপেন্ড করে রাখে তিন মাস । বাহিরচরে সমগ্র এলাকা খুন, ডাকাতিতে ভরা। সমগ্র এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলো। অক্টোবর মাসে কুদ্দুস মোল্লাকে (মুক্তিবাহিনী) চিকিৎসা করার জন্য কর্ণেল আমাদের সবাইকে ডেকে লাঞ্ছনা দেয়। যাবার পথে গানবোট থেকে আমাদের হাসপাতালে শেল ফেলে। আমরা দারোয়ান পাহারা রেখে মুক্তিবাহিনীর চিকিৎসা করেছি। আমাদের ডাঃ শামসুল হক মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে গোপনে গিয়েও তাদের চিকিৎসা করেছেন। আমরা সবাই সবকিছু দিয়ে তাদের সাহায্য করতাম। বাহিরচরে পাক বাহিনীরা মেয়েদের উপর চালিয়াছে অকথ্য নির্যাতন। বোয়ালিয়া, কাঁদপাশা, রাজগুরু, বাবুগঞ্জ থানা, দুয়ারিকা ইত্যাদি এলাকা থেকে বহু মেয়ে ধরে এনে ভোগ করেছে। আমার জানা এক হিন্দু মহিলাকে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় ধরে নিয়া যায়। মহিলা খুব সুন্দরী ছিল। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় চারদিন ক্রমাগত অকথ্য দৈহিক নির্যাতন চালায়। অসহ্য যন্ত্রণায় মহিলা ছটফট করেছে। চারদিন পর মহিলা ছাড়া পায়। আমরা তার চিকিৎসা করে ভালো করি। আমি স্বামীসহ বাস করছিলাম। আমার সর্বস্ব যাওয়া সত্ত্বেও স্বামী নিয়ে কোন রকমে দিন কাটাচ্ছিলাম। আমার স্বামী স্বাধীনতা সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন। আমাকে প্রায় বলতেন ডিসেম্বর মাস যদি বাঁচি জানুয়ারীর মধ্যে নিশ্চয় স্বাধীনতা পেয়ে যাবো। ৯ ই ডিসেম্বর গৌরনদী থানার মাহিলারার ব্রিজের উপর দিয়ে আমার স্বামী যাচ্ছিলেন। তখন পাক বাহিনী প্রায় আত্মসমর্পণ করে এমন অবস্থায় ব্রিজে ডিনামাইট স্থাপন করে রেখেছিলো। সেই ডিনামাইট ফেটে ব্রিজ ধ্বংস হয়। আমার স্বামী ওখানেই নিহত হন। সব হারিয়ে একমাত্র স্বামী ছিলো তাও স্বাধীনতার পূর্বমুহূর্তে হারাতে হলো।
আমি বাহিরচর থেকে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর জন্য খাবার পাঠিয়েছি। রাতে যখন তখন আমার ওখানে তারা এসে থাকতো, যেতো। আমার স্বামী মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পে মাঝে মাঝে যেতেন। আমার স্বামীর বড় সাধ ছিলো স্বাধীন বাংলার মাটিতে বাস করা। তার সে সাধ পূর্ণ হলো না।

স্বাক্ষর/-
ভারতী রাণী বসু
১৮/৮/৭৩


স্থানীয়দের ভাষ্য মতে, ৭ দিন ধরে স্বরুপকাঠী ও তার আশে পাশের এলাকায় তাণ্ডব চলে। এলাকার ৩০ টি হিন্দু গ্রামজুড়ে হয় এই বর্বরতা। লুটকৃত সব মালামাল চলে আসত শর্ষিণা পীরের গুদামে। হিন্দু মা-বোনদের পাকসেনারা ধর্ষণ করে নির্বিচারে। পাকবাহিনীর সঙ্গে লুটপাট এ অংশ নেয় শর্ষিণা মাদ্রাসার ছাত্র এবং পীরের অনুসারীরা। এই মোল্লা বাহিনীকে নেতৃত্ব দেন পীর মোঃ মোহেবুল্লাহ (পীর মাওলানা আবু জাফর মোঃ সালেহ এর ছেলে)। তখন তার বয়স ছিল ২২ বছর। পীর সাহেব তখন ঘোষণা করেছিলেন, হিন্দুদের সম্পত্তি গণিমতের মাল, ঐ সম্পদ দখল করা হালাল।


স্বরুপকাঠির প্রাচীণ ঐতিহ্যবাহী ব্যবসা কেন্দ্র ইন্দেরহাটের বড় বড় হিন্দু মহাজনরা ব্যবসা করত। পীরের নির্দেশে বাজারটি মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হয়। পাক সেনা এবং মোহেবোল্লাহ বাহিনী ৬ দকি থেকে এক যোগে ইন্দের হাটের হামলা চালায়। দোকানের মালামাল, টাকা, গচ্ছিত সোনা, রুপা, সব লুট করে শর্ষিনা নিয়ে যাওয়া হয়। একটি সূত্র জানায়, ঐ দিন হিন্দুদের কাছ থেকে ১৮০ তোলা সোনা লুট করা হয়। এছারা ২৫ মণ তামাক পাতা, ৩ শাতাধিক শাড়ি, প্রচুর পরিমান দামি সিঁদুর কাঠ লট করে শর্ষিনা গুদাম ভর্তি করা হয়। লুটকৃত সোনা মাটিতে পুতে তার উপর নারিকেল গাছ লাগিয়েছেন মোহেবুল্লাহ। স্বরুপকাঠিতে ‘আট ঘর-কুরিয়ানা’ নামে একটি বিশাল পেয়ারা বাগান আছে। যেটি দেশের সবচেয়ে বড় পেয়ারা বাগান মনে করা হয়। এখানকার পেয়ারা যেমন বড় তেমন সুস্বাদু। এই পেয়ারা বাগানে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের শক্ত ঘাটি। পাক ও পীর বাহিনী মিলে গাছ কেটে আগুন জালিয়ে বাগানটি ধবংস করতে চায়। কিন্তু এলাকাবাসীর প্রতিরোধ পুরোপুরি ধবংস করতে পারেনি। যুদ্ধের ৯ মাস শর্ষিনা পীরের বাড়ি ছিল পাকবাহিনী ও রাজাকারদের দুর্ভেদ্য ঘাটি। সেখানে মাদ্রসার ছাত্রদের প্রশিক্ষণ দিয়ে অস্ত্র তুলে দেয়া হতো মুক্তিযোদ্ধাদের খুন করতে। এমনকি মুক্তিযোদ্বাদের আক্রমন থেকে স্বরুপকাঠি থানা অফিসটি রক্ষার জন্য পীরের বাড়িতে স্থানান্তর করা হয়। যুদ্ধের সময় শর্ষিনা বাহিনীর নির্যাতনে শত শত হিন্দু পরিবার সম্পত্তী ফেলে ভারত অথাবা অন্যত্র পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। হিন্দুদের ফেলে রাখা জমি দখল করে নেয় পীর। পরবর্তীতে পীর নানা জালিয়াতের মাধ্যমে জমি নিজেদের নামে রেজিস্ট্রি করিয়ে নেন। শর্ষিনা মাদ্রাসার মূল একাডেমিক ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনা বর্তমানে হিন্দুদের জায়গায়। এসব কারণে শর্ষিনার আশপাশে মানুষ তাদের পছন্দ করেন না। যে সব হিন্দুর জমি পীর দখল করেন তাদের মধ্যে কয়েকজন হলেন, শর্ষিনা মৌজার ১২৫ নং খতিয়ানের গনেশ চন্দ্র সমাদ্দার, সতীশ চন্দ্র সমাদার, হিরা লাল সমাদ্দার, নীল রতন সমাদ্দার, নকুল চন্দ্র সমাদ্দার, মেহেন্দ্র নাথ গুপ্ত, ১৩২/১ খতিয়ানে ময়না বিবি এবং ৫৫/১ খতিয়ানের শান্তি রঞ্জন গুহ।’


স্বরূপকাঠি উপজেলার কৌড়িখাড়ার পাশেই ইন্দেরহাট। তার পাশে বরসাকাঠি। এইগ্রামে তহশিল অফিসের পাশে বধ্যভূমিতে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা ঐ গ্রামের ১৬ জনকে দড়ি দিয়ে বেঁধে গুলি করে। ১৪ জন ঘটনাস্থলে মারা যান। এদের মধ্যে সাতজন হলেন মাঝিবাড়ির। হত্যাকাণ্ডের পরে ৩/৪ জন সাহস করে ঐ সাতজন শহীদকে এক কবরে দাফন করেন। তারা হলেন, মুজাফ্ফর আলী (৬০), তার ভাই সোলায়মান (৫২), সোলায়মানের ছেলে শাহ আলম (১৬), মফিজউদ্দিন (৫৯) ও তার ছেলে আবুয়াল (১৭), মফিজের ভাই রফিজউদ্দিন (৫৫) এবং জয়নাল আবেদীন (৪০)। শত্র“ বাহিনীর গুলিতে নিহত অপর ব্যক্তিরা হলেন আনোয়ার হোসেন (৬২), নূরে আলম (৩০), নিলু আলম (১৭), চাঁন মিয়া (২৬), আব্দুল কাদের (৩০), আব্দুর রহমান (২৭), সৈয়দুর রহমান (৩০)। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া গুলিবিদ্ধরা হলেন কাঞ্চন মিয়া (৪০) ও রুস্তম আলী (৪৮)। গুলিবিদ্ধ রুস্তুম আলী কয়েক বছর পর মারা গেলেও কাঞ্চন মিয়া বুকের গুলির চিহ্ন নিয়ে স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়ার আশায় আজও বেঁচে আছেন। এছাড়াও ঐ দিন বরসাকাঠির ইয়ার হেসেন (৬৮), জবেদ আলী (৫৫), কাবারেক আলী (৫০), মোকাম্মেল হোসেন (৫০), হাবিব সরদার (৪০) আজিজুল হক (৩২) ও কাঞ্চনকে (১৫) পাষন্ড পাক হানাদার বাহিনী নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। বরসাকাঠির এই বধ্যভূমিটি কালিবাড়ির খালপাড়ে এখনো রয়েছে। দিনটি হল ৭ নভেম্বরের ১৯৭১। এই হত্যাকাণ্ডে পাকহানাদার বাহিনীর দোসর হলেন স্বরূপকাঠির শর্ষিণার পীর।



বাংলাদেশের জনপ্রিয় উপন্যাসিক হুমায়ূন আহমদের পিতা ছিলেন পিরোজপুরের এসডিপিও আহমেদ ফয়জুর রহমান। তাকে হত্যা করে বলেশ্বর নদীতে। হুমায়ূন আহমেদরা তখন প্রথমে পিরোজপুরের কলাখালি গ্রামে চলে যান। সেখান থেকে চলে যান স্বরূপকাঠির গুয়ারেখাতে। যে বাড়িতে তারা আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি ছিলেন রাজাকার। তিনি হুমায়ূন আহমেদ আর তার ভাই মুহাম্মদ জাফর ইকবালকে নিয়ে যান স্বরূপকাঠির শর্ষিণার পীর সাহেবের কাছে। হুমায়ূন আহমেদ ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ গ্রন্থে লিখেছেন:
‘শর্ষিণার পীর সাহেবের আস্তানা চমৎকার। জায়গাটা নদীর তীরে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। মাদ্রাসার ছাত্রদের থাকার জন্যে বিশাল হোস্টেল। পাড়া গাঁ’র মতো জায়গায় বিরাট কর্মযজ্ঞ। আর হবে নাই বা কেন? পাকিস্তানের সব রাষ্ট্র প্রধানই এখানে এসেছেন। কিছু সময় কাটিয়েছেন।
আমরা ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত হয়ে শর্ষিণা পৌঁছলাম বিকেলে। মাদ্রাসার ছাত্ররা দুধে রুটি ছিঁড়ে চিনি মাখিয়ে খেতে দিল। গপাগপ করে খেলাম। তাদের যে মিলিটারিরা কিছুই বলছে না এজন্যে তাদের মধ্যে আনন্দ ও উল্লাসের সীমা নেই। তাদের কাছেই জানলাম, পিরোজপুরের সঙ্গে শর্ষিণার পীর সাহেবের সরাসরি টেলিফোন যোগাযোগের ব্যবস্থা আছে। ক্যাপ্টেন সাহেব দিনের মধ্যে তিন-চার বার টেলিফোন করেন। অপারেশনে যাবার আগে পীর সাহেবের দোয়া নিয়ে যান। আমরা দু’ভাই মাদ্রাসায় ভর্তি হতে এসেছি শুনে তারা যথেষ্ট আনন্দ প্রকাশ করল। আমরা আমাদের পরিচয় প্রকাশ করলাম না। সঙ্গের মাওলানা সাহেব সন্ধ্যার আগে আগে আমাদের দু’জনকে পীর সাহেবের কাছে উপস্থিত করলেন। পীর সাহেব চারদিকে কিছু লোকজন নিয়ে গল্প করছেন। কাছে যাওয়ার সাহস হলো না। শুনলাম, মৌলানা পীর সাহেবকে নিচু গলায় কিছু বলছেন এবং পীর সাহেব রেগে যাচ্ছেন। সব কথা বুঝতে পারছি না। পীর সাহেব বেশিরভাগ কথার জবাবই দিচ্ছেন উর্দুতে। আমার বাবার প্রসঙ্গে কী কথা যেন বলা হলো। পীর সাহেব বললেন, আমি এই লোকের কথা জানি। বিরাট দেশদ্রোহী। ক্যাপ্টেন সাহেবের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। যাও যাও, তুমি চলে যাও। মাওলানা সাহেব আরো নিচু গলায় সম্ভবত আমাদের দু’ভাই সম্পর্কে কিছু বললেন। পীর সাহেব ভয়ঙ্কর রেগে বললেন না, না। এদের কেন এখানে এনেছ? মাওলানা সাহেব আমাদের নিয়ে ফিরে চললেন। কী কথাবার্তা তাঁর হয়েছে তিনি কিছুই ভেঙ্গে বললেন না। নৌকায় করে ফিরছি এবং প্রার্থনা করছি খুব তাড়াতাড়ি যেন চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। অন্ধকারে মিলিটারিরা গানবোট নিয়ে বের হয় না। খোলা নৌকার পাটাতনে বসে আছি। ভরা জোয়ার, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। হঠাৎ মাঝি বলল, দেহেন দেহেন। তাকালাম। দুটি মৃতদেহ ভাসতে ভাসতে যাচ্ছে। এমন কোন দৃশ্য নয় যে অবাক বিস্ময়ে দেখতে হবে। খুবই সাধারণ দৃশ্য। রোজই অসংখ্য দেহ নদীতে ভাসতে ভাসতে যায়। শকুনের পাল দেহগুলির উপর বসে বসে ঝিমোয়। নরমাংসে তাদের এখন আর রুচি নেই। কিন্তু আজকের মৃতদেহ দু’টির উপর শকুন বসে নেই। আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। চোখ ফেরাতে পারছি না। সবুজ শার্ট গায়ে দেয়া ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছরের একজন যুবকের মৃতদেহ। তার গলা জড়িয়ে ধরে আছে সাত-আট বছরের একটি বালিকা। বালিকার হাতভর্তি লাল কাচের চুড়ি। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে হয়তো পরম নির্ভরতায় এই বালিকা তার বাবার গলা জড়িয়ে ধরে রেখেছিল।’


অবাক বিস্ময় হল যে, দেশের প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লাশ শুরুর আগে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া বাধ্যতামূলক। শর্ষিণা এবং তাদের অনুসারীদের মাদ্রাসাগুলোতে দেশের জাতীয় সঙ্গীতের পরিবর্তে গাওয়া হয় তাদের নিজেদের মনগড়া সঙ্গীত। সঙ্গীতটি পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীতের আদলে তৈরি। যার শুরু এই ভাবে-‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’। এই সঙ্গীতটির রচয়িতা রাজাকার মাওলানা মান্নানের পত্রিকা দৈনিক ইনকিলাবের নির্বাহী সম্পাদক কবি রুহুল আমিন খান। অর্থাৎ দেশ স্বাধীন হলেও, শর্ষিনা আজও স্বাধীন হয়নি।


বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত খবর থেকে জানা যায়, পিরোজপুরের জগৎ পট্টী, জগন্নাথকাঠি এবং শর্ষিণা মৌজায় পীর সাহেবর নামে-বেনামে ৪০০ বিঘার মতো জমি আছে। এর মধ্যে কয়েকশ’ বিঘা হিন্দুদের কাছ থেকে একাত্তুরে দখল করা। এছাড়া বরিশাল, পটুয়াখালী, কুয়াকাটাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে ২০০বিঘার মতো জমি। বরিশাল শহরে পীর সাহেবের রয়েছে একটি রাজকীয় প্রাসাদ। ঢাকার তেজকুনি পাড়া মৌজায় আছে ৩ একর ৯শতংশ জমি, বনানী আবাসিক মডেল টাউনে ১০ কাঠা এবং প্যারিদাস রোডে একটি বিশাল বাড়ি।


দেশের বাইরে সৌদি আরবের মদিনায় ২টি এবং করাচিতে ১টি বাড়ির কথা জানা গেছে। তবে করাচির বাড়িটি বর্তমান পীর বেচে দিয়েছেন কিন্তু ওয়ারিশদের ভাগ দেননি। প্রয়াত পীর মৃত্যুর আগে ২০০ তোলার গচ্ছিত সোনা রেখে গেছেন, তাও বর্তমান পীর একক ভাবে আতœসাৎ করেছেন-এ অভিযোগ তার স্বজনদেরই।


দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শর্ষিণার পীরেরা তাদের নীতি বারবার পরিবর্তন করেছেন। প্রথমে মুসলিম লীগ দালালি, তারপর জেনারেল আইয়ুব এবং ইয়াহিয়া সহচর। এর মধ্যে শেরেবাংলা ক্ষমাতায় থাকাকালীন তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ৭৫- এ আওয়ামিলী লীগ বিদায়ের পর জেনারেল জিয়ার সঙ্গে দহরম-মহরাম। অবশেষে স্বৈরশাসক এরশাদের দলালিও করতে পিছপা হননি শর্ষিনার পীররা।

পরিহাসের কথা হল, আমরা জাতি হিসেবে এতোটাই দুর্ভাগা যে, রাষ্ট্রীয়ভাবে এই দেশে একজন স্বাধীনতা বিরোধী, রাজাকার, খুনি’কে দফায় দফায় স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। জিয়াউর রহমান ও এরশাদ যুদ্ধাপরাধীদের জেল থেকে ছেড়ে দিয়েছেন, রাজাকারদের প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছেন এবং রাজাকারের দোসরদের স্বাধীনতার পুরষ্কারও প্রদান করেছেন। স্বাধীনতা বিরোধীদের স্বাধীনতা পুরষ্কার দিয়ে দেশের স্বাধীনতার জন্যে প্রাণ দেওয়া সকল মানুষকে, স্বাধীনতার জন্যে যুদ্ধ করা সকল মানুষকে অপমান করা হয়েছে। বাস্তবতা হল পরবর্তীতে কোন সরকার এই পুরষ্কার বাতিল করার উদ্যোগ গ্রহণ করে নি। এমনকি আওয়ামী লীগও না। রাজনীতিবিদরা ভোটের স্বার্থে এসব পীর, ধর্মব্যবসায়ীদের সাথে সম্পর্ক রেখে চলে। বর্তমানে পিরোজপুরের এই পীরের আশীর্বাদ পাওয়ার জন্যে সকল রাজনৈতিক নেতা পীরের কাছে হাজিরা দেন।


ঐতিহাসিকভাবে শর্ষিণার পীরের অপকীর্তির কথা প্রমাণিত হলেও কেন বাংলাদেশ সরকার আজও এই রাজাকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে না তা অজানা রহস্য। যেহেতু মাওলানা জাফর বেচে নেই তবুও স্বাধীনতা বিরোধী তাকে ১৯৮০’র এবং ১৯৮৫’র রাষ্ট্রপ্রধানরা যে সম্মান দেখিয়েছে তা কেড়ে নেয়া হোক। স্বাধীনতার পদক যেমন দেয়া যায় তেমনি তা ফিরিয়ে নেয়াও সম্ভব। যতদ্রুত সম্ভব শর্ষিণার পীরের স্বাধীনতা পদক ফিরিয়ে নেয়ার দাবী তরুণদের। আমরা যারা স্বাধীনতা দেখিনি কিন্তু ইতিহাস দাড়িয়ে আছে অভিভাবক হয়ে সেই ইতিহাসের দায় মুক্তি হিসেবেও যেন বাঙালী নিধনকারী শর্ষিণা পীরের সম্মান ফিরিয়ে নেয়া হয়, এই দাবী জানাচ্ছি। এর মাধ্যমে আমরা চাই ইতিহাসের আড়ালে ঘাপ্টি মেরে থাকা ইতিহাস মুছে যাক।

সহায়তায়-
১. পত্রিকার ছবিগুলো: International Crimes Strategy Forum (ICSF) and Center for Bangladesh Genocide Research (CBGR) থেকে নেওয়া।
২. মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড)।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:২৪
৭টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×