'এলেঝেলে' শব্দটা ব্লগার ফেরারী পাখি-র সুযোগ্য কন্যার কাছ থেকে শেখা। 'আউলাঝাউলা'-র তদ্ভব রূপ। দেশে প্রায় দেড় মাস কাটিয়ে আমার টুকরো স্মৃতির কাহিনী এলেঝেলে ছাড়া আর কীই বা হতে পারে?
১। সিংগাপুর থেকে বাংলাদেশের ফ্লাইটে উঠলাম ২৫ নভেম্বর রাতে। প্লেনে উঠার আগে বিশাল লাইন। গাদাগাদি, হুড়োহুড়ি। বাংগালী তো, চেক-ইন করতে সবাই এসেছে একদম শেষ মুহূর্তে। এক বাচ্চা ছেলে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদছে। আমাকে সিকিউরিটির একজন জিজ্ঞেস করলো, এটা তোমার বাচ্চা? বাচ্চার চেহারা দেখে মনে হলো বাপের ডিজাইন বেশী সুবিধার না। তাই সত্যিটা বললাম। আরো দু’তিনজনকে একই প্রশ্ন করার পর বুঝলাম বাচ্চা মা ছাড়া হয়ে গেছে ভীড়ের মধ্যে। বাচ্চার কান্না থামাতে ব্যর্থ অফিসাররা তাই যাকে পাচ্ছে জোর করে মা বানানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। কান্না সপ্তমে চড়ার পর হাঁচড়ে পাঁচড়ে মা বের হয়ে এলেন সিকিউরিটি চেকিং শেষে। কে জানতো এই ক্ষুদে রাগসঙ্গীত শিল্পী শেষমেষ প্লেনে আমারই পাশের আসনে আসীন হবে আর পুরো চারঘন্টা আমাকে নির্ঘুম কাটাতে হবে? হা ঈশ্বর! তবে আমাকে একেবারে নিরাশ হতে হয়নি। বাচ্চার বাপের চেহারা বুড়োকালের সালমান শাহ এর কাছ দিয়ে যায়।
২। কী ব্যাপার, সিরিয়াল ব্রেক করছেন কেনো? নিয়ম মেনে চললে কী হয়? দেশটার এজন্যেই এই অবস্থা। লেডিস বলেই সুবিধা নিবেন?
ভীড় দেখে যাত্রীদের জন্য দু’টো লাইন করে দেয়া হয়েছে আর সুবেশী বংগসন্তানরা মুখে চরম গোবেচারা ভাব ফুটিয়ে কীভাবে সবাইকে টপকে আগে প্লেনে উঠা যায়, এই খাতে সব প্রতিভা ব্যয় করে চলেছেন। অস্ট্রেলিয়া ছাড়ার পর থেকে কেনো যেনো একবারের জন্যও অনুভব করতে পারছিলামনা যে তিনবছর পর দেশে ফেরার স্বাদটা কেমন। এখন মনে হলো, নাহ দেশে ফিরছি।
৩। জুনিয়র রবিশংকরকে পাশের সিটে নিয়ে বসেছি। সবার লাগেজ খোপে ঢোকানো হচ্ছে। এই মুহূর্তটা কটঠিন ছিলো। বিশাল বিশাল ক্যাবিন লাগেজ জায়গামতো ফিট করা নিয়ে কেবিন ক্রু বনাম বাংগালী যাত্রীদের বিতণ্ডা। এয়ার হোস্টেজ বার চারেক ঝাড়ি দিয়ে এক যাত্রীকে নিরস্ত করতে ব্যর্থ হলো। ‘তুমি বসো, আমি লাগেজ রেখে দিচ্ছি’ এই বলে যখনি সে একটু দূরে যায়, শশব্যস্ত ভদ্রলোক স্বউদ্যোগী হয়ে অন্যের লাগেজ সরিয়ে নিজেরটা বসানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেন। আবার এক ঝাড়ি খেয়ে সিটে বসেন। শেষমেষ শক্ত হুমকি খেয়ে বেচারা ঠাণ্ডা হলেন, ‘তুমি কি সিটে বসবে?’ লেডিসের হাতে ধাতানি খেয়ে বড়ভাই আসন গ্রহণ করলেন। ঘোষণা বাজছে, ‘সবাই নিজের আসন গ্রহণ করুন। প্লেন টেক-অফ করবে’। ঘোষণার সাথে সাথে আরেক বড়ভাই হেলেদুলে আইল দিয়ে হাঁটতে লাগলেন, যেন বৈকালিক ভ্রমণে বেরিয়েছেন। দারুণ রিফ্লেক্স আর অদ্ভুত সব আচরণ!
৪। ঈদের আগেরদিন ঢাকা থেকে সিলেট যাচ্ছি সড়কপথে। সবার আশংকাকে সত্যি করে চার ঘন্টার রাস্তা এগারো ঘন্টায় পাড়ি দিয়ে অবশেষে সিলেট পৌঁছালাম। এই অভিজ্ঞতাটা দারুণ ছিলো। সড়কের কিছু সংস্কৃতি খুব কাছে দেখে দেখার সুযোগ হলো। ঢাকা থেকে কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি এবং টেকনাফ যাত্রাপথেও আমার জ্ঞানচক্ষু উন্মেষ হয়েছে নতুনভাবে। ট্রাকের কাছে অন্য সব ছোট গাড়ি যে ‘প্লাস্টিক’ এটা জানলাম। ‘ওস্তাদ, বামে প্লাস্টিক’ এর মর্মার্থ এখন পরিষ্কার। ওভারটেকের ভয়ংকর প্রতিযোগিতা। এক লেনেই দু’দিক থেকে আসা গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়িয়ে চরম নৈপুণ্যের সাথে শ’ শ’ গাড়ি যেভাবে নিরাপদে প্রতিদিন রাস্তা হাঁকাচ্ছে, আমি সত্যি অভিভূত। ডিজনীল্যান্ড, ইউনিভার্সাল পার্কে গিয়ে আমি কী থ্রিল রাইড চড়েছি? বাংলার রাজপথের এসব রাইডের কাছে ওসব কিছুইনা। প্রতি মুহূর্তে প্রাণ হাতের মুঠোয়। কিন্তু চালকরা নির্বিকার। দুধসাদা কুয়াশা বা ঘুটঘুটে অন্ধকার, কুছ পরোয়া নেহি। দামাল ছেলেরা গতিতে অতুলনীয়। বাংলার ড্রাইভাররা জগতের শ্রেষ্ঠ ড্রাইভার, আমার উপলব্ধি।
৫। আবারো রাজপথে। ধূলোয় চারপাশের কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। তার মাঝে দেখলাম আলোর ঝিলিক। চুমকি বসানো শাড়ির চিকমিকি ছড়িয়ে শ্রমজীবী শ্রেণীর চার নারী একসাথে ঝলমল করতে করতে যাচ্ছে। কী অসাধারণ দৃশ্য! ঈদের আগেরদিন সাভার, নারায়ণগঞ্জে রাস্তার পাশেই কাপড়ের অনেক লম্বা মার্কেট। সমাজের একটা শ্রেণীর নানা বয়সের মানুষ কিনছে আর কিনছে। এত যন্ত্রণাময় জনজীবন, এত দুর্ভোগ মানুষের। তবুও কী উজ্জ্বল জীবনের রঙ! কত হাসি ঝরে পড়ছে পথশিশুর নাকের সিকনির সাথে। দুঃখ আর আনন্দের এত সমান্তরাল পথচলা আমার দেশ ছাড়া আর কোথাও আজ পর্যন্ত দেখিনি। আমরা কেনো একবার সবচেয়ে সুখী মানুষের দেশ হয়েছিলাম, এবার দেশে এসে বুঝতে পারলাম।
৬। খাগড়াছড়ি শহরে ঘোরার সময় অংকন নামের একটা ছেলে মাইক্রোবাসের কন্ডাক্টর হওয়ার সুবাদে আমাদের সহযাত্রী হলো। আলাপে জানলাম, অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছে। স্বেচ্ছায় গাইডের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। দেখলাম ওর প্রাণ আকুলিবিকুলি করছে দর্শনীয় স্থানগুলো আমাদের সাথে আরেকবার দেখার জন্য। ড্রাইভারের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে দেয়ার জন্য আমাদের অনুরোধ জানালো। এইটুকুন ছেলে, পড়ালেখার পাট চুকিয়ে সংসারের দায়িত্ব নিয়েছে। চোখে ভাসলো উন্নত বিশ্বের এই বয়সের একটা বাচ্চার জীবনাচরণ। কী বৈপরীত্য! কী অসমতা! মন খারাপ হলো, আমার ঝর্ণা দেখা নিরর্থক হলো। অংকনের সামনে আমি পুরোটা সময় কেন জানি কুঁকড়ে ছিলাম। ভেতরের গ্লানি আমাকে পুড়িয়ে মারছিলো।
৭। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে পত্রিকায় টপটেরর ওয়াদুদ ভুঁইয়ার কীর্তি দেখার পর ভাবিনি উনার প্রাসাদোপম বাড়ি ‘বৈঠক’ দেখার অভাবনীয় সুযোগ হাতের মুঠোয় পাবো। খাগড়াছড়ি শহরে গিয়ে সে সৌভাগ্য হলো। বাড়ির চারপাশের প্রাচীরের বাইরে চক্কর দিয়ে যতটুকু সম্ভব হলো, দেখলাম। কী আর বলবো! পত্রিকার বর্ণনা মিলে গেলো হুবুহু। স্থানীয় মানুষের কাছে জানলাম, পর্যটনের পরেই এটা অন্যতম দর্শনীয় স্থান। আরো জানলাম উনার গুণের কথা। পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম উনার দাপটে কীভাবে কাঁপতো সেসব ইতিহাস।
৮। সেন্টমার্টিন যাওয়া হলো বছরের শেষ সপ্তাহে। এক প্যাকেজ ট্যুর কোম্পানীর কাছে যাত্রা আর হোটেলের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে ‘সেন্টমার্টিন সার্ভিস’ এর মার্সিডিজ বাসে উঠেছি রাত দশটায়। কিছুক্ষণ পরে আবিষ্কার করলাম মাথার উপরের ফ্যানটা কোনভাবেই কমানো বা বন্ধ করা যাচ্ছেনা। সুপারভাইজার সাহেব জানালেন এই ফ্যানের উপরে বিধাতা ছাড়া কারো কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। আমি বুঝলাম কেইস খারাপ। কনকনে শীতের রাতে প্রায় এগারো ঘন্টা যাত্রাপথের পুরোটা সময় আমাকে আক্ষরিক অর্থেই ফ্রিজের ভেতর কাটাতে হলো। এয়ার কন্ডিশনে উঠেছি আর ঠান্ডায় হাড় কাঁপবেনা, এ কেমন কথা! বাসের কন্ডিশনের কথা আর নাইবা বললাম। অনেক সাধনার পর একখানা কম্বল হস্তগত হলো, তাও যা আকার। পা ঢাকে তো মাথা ঢাকেনা। বাসের ঝাঁকুনিতে আমার এনাটমি ডিসপ্লেস হবার যোগাড়। বাংলাদেশের কোন রাস্তায় আমি এত বাজে বাসে কখনো চড়িনি। রাস্তায় একবার সার্ভিসিং করাতে হলো একঘন্টা ধরে। হায়রে মার্সিডিজ! এটা হচ্ছে সেন্টমার্টিন রুটের সবচেয়ে ভালো বাস সার্ভিস।
৯। টেকনাফ থেকে ‘কুতুবদিয়া’-র উপর ভর করে নাফ নদীতে যখন পা দিবো, আবিষ্কার করলাম আমাদের সিটগুলো আরেক গ্রুপের কাছে বিক্রি করা হয়েছে। আমাদের কাছেও টিকেট আছে, উনাদের কাছেও আছে। একই নাম্বার। কী আর করা! পারষ্পরিক সমঝোতায় আসন গ্রহণ করলাম। আমরা লেডিস গ্রুপ ততক্ষণে ‘কী টিকেট কিনলা?’, ‘একটা কাজও যদি ঠিকমত করতে পারো’ ইত্যাদি বলে মাতম জুড়ে দিলে, ‘ট্যুর কোম্পানীর ব্যবস্থা ঢাকা এসে হবে’ এই মর্মে আমাদের পার্টনাররা আশ্বস্ত করলেন।
১০। সেন্টমার্টিন ঘাটে সী-ট্রাক ভিড়লে হোটেল রাজদরবার এর পক্ষ থেকে আমাদের রাজকীয় সম্বর্ধনা নিয়ে এক ভদ্রলোক হোটেলে নিয়ে গেলেন। একটা বস্তির পাশে মেস টাইপের টানা কয়েকটা রুম। নতুন রঙ করা হয়েছে। আমরা লাগেজ রেখে ভাবছি, যাক ওয়েটিং রুমগুলো তো ভালোই। থাকার ব্যবস্থা তাহলে খারাপ না। ভুল ভাংতে দেরী হলোনা। এই আধা-কাঁচা ঘরগুলোই নাকি আমাদের থাকার জায়গা। এই রুমের ভাড়া পিক সিজনেও ৪/৫০০ এর বেশী হওয়ার কথা না। প্যাকেজ কোম্পানী আমাদের কাছ থেকে নিয়েছে ২০০০ টাকা। আমাদের বীরেরা চরম রেগেমেগে হোটেল খুঁজতে বের হলে। রাজদরবারের পাইক-পেয়াদারা তেনাদের হম্বিতম্বিতে রাজকীয় অভ্যর্থনার সব আয়োজন সাঙ্গ দিয়ে লাইন বেঁধে দাঁড়িয়ে রইলো। ভাগ্য ভালো ছিলো, ঘন্টাখানেক খোঁজাখুঁজির পর অন্য হোটেলে রুম পাওয়া গেলো।
১১। আরো এক প্যাকেজের আওতায় বাংগালী ভদ্রলোক কোরিয়ান বা জাপানিজ বউ নিয়ে খুব বড় মুখ করে (নিশ্চয়ই) এসেছেন প্রবাল দ্বীপ দেখতে। হোটেলে পা দিয়েই উনি বুঝতে পারলেন প্রতারিত হয়েছেন। বউ ফ্রেস হওয়ার জন্য টয়লেটে গিয়ে প্রায় ছিটকে বের হয়ে এলো। প্যাকেজ খাবার খেতে রেস্টুরেন্টে গিয়ে মাছির উড়াউড়ি দেখে দু’জনের কেউই খাবার মুখে নিতে পারলেননা। হোটেলে চেক-ইন না করেই একমুহূর্ত দেরী না করে উনারা যে গাড়িতে হোটেলে এসেছিলেন সেটাতে আবার ঢাকার পথে রওয়ানা দিলেন।
এতটুকু লিখে মনে হচ্ছে আমি হয়ত সবমিলিয়ে ঋণাত্বক অভিজ্ঞতার কথাই বেশি বলেছি। এটা ইচ্ছাকৃত ছিলোনা, লিখতে গিয়ে চলে এসেছে। ভালো অভিজ্ঞতার মধ্যে ছিলো ১৯ ডিসেম্বরের ব্লগ দিবসে সবার দেখা পাওয়া, পহেলা জানুয়ারী শাহজালালের সিএসই বিভাগের পুনর্মিলনীতে অনেক বছর পরে বন্ধু আর ছোট ভাইবোনদের সাক্ষাত পাওয়া। সবচেয়ে বড় সঞ্চয়, আরো একটা দীর্ঘ বিরতির আগে প্রিয়জনদের সান্নিধ্য লাভ।
একটু এডিট করতে হচ্ছে। সেন্টমার্টিন দেখে আমার অনুভূতির কথা বলা হয়নি। পুরো তিনদিন সাগরকন্যা চষে বেড়িয়ে আমার মনে হয়েছে এই একটা জায়গা দিয়েই আমাদের পর্যটন প্রথম সারির কিছু একটা হয়ে যেতে পারে। এত সুন্দর!প্রকৃতি এত উদারহস্তে আমার দেশকে এত কিছু দিয়েছে। অবিশ্বাস্য!এই একটা জায়গার বারবার যাওয়ার জন্য আমি হাজারটা হ্যাপা সামলাতে প্রস্তুত। প্রথম রাতে প্রায় ১২ টায় সৈকতে গিয়ে আমার বাকহারা হয়ে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় ছিলোনা। এতটাই সুন্দর নীল জলের আর রূপালী বালির প্রবালদ্বীপ!
খুব ভালো লেগেছে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের সাথে মিলে বলাকা হলে'থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বার দেখতে'। হতাশ হয়েছি রায়ের বাজার বধ্যভূমি-তে ন্যূনতম পরিচিতিমূলক কোন লেখা না দেখে। এতটা দীনতা আশা করিনি!
আমার দেশের সবাই ভালো থাকুন।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জানুয়ারি, ২০১০ দুপুর ১:৪০