somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নতুন বিশ্বে বিএনপির রাজনৈতিক সম্ভাবনা

১৪ ই জানুয়ারি, ২০১৬ ভোর ৬:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

তিনটি ধারণা-ভিত্তিক বিশ্ব-কাঠামোর অস্তিত্ব আমরা বড় পরিসরে দেখতে পাই। প্রথম বিশ্ব, দ্বিতীয় বিশ্ব ও তৃতীয় বিশ্ব। প্রথম বিশ্ব বলতে আমরা প্রায় সবাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর আমেরিকার নেতৃত্বে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলির একটি সমন্বিত বিশ্বকে বুঝি। আবার অনেকে প্রথম বিশ্ব বলতে পশ্চিমা বিশ্বকে বোঝেন। দ্বিতীয় বিশ্ব হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলি যেগুলোর সবই প্রায় এখন পুঁজিবাদী কাঠামোর অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ বেছে নিয়েছে। তৃতীয় বিশ্ব হল অনুন্নত ও দরিদ্র রাষ্ট্রগুলি। তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলির অধিকাংশের অবস্থান এশিয়া ও আফ্রিকায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলি নিজেদের সমাজের উপর একটি ধাতব আস্তরণ দিয়ে রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছিল। আস্তরণটি বহু-দর্শনভিত্তিক মূল্যবোধের সমন্বয়ে নির্মিত। সেই মূল্যবোধের একপাশে যেমন গণতন্ত্র ও মানবিকতা ছিল, তেমনি ছিল তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে পুঁজিবাদ সম্প্রসারণ-বান্ধব রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক নীতিসমূহ। লক্ষণীয় যে, প্রথম বিশ্বের এই রাষ্ট্রগুলি নিজেদের সমাজকে বিশ শতকের শেষাবধি প্রশ্নাতীতভাবে উদার ও মানবিক মতাদর্শে পরিচালিত করতে সমর্থ হয়।

প্রথম বিশ্বের দেশগুলি শাসন ব্যবস্থায় উৎকৃষ্ট পন্থা হিসেবে গণতন্ত্রের ‘বাজারজাতকরণ’ শুরু করে। কিন্তু এ প্রক্রিয়ায় তাদের প্রধান বাধা হিসেবে সামনে আসে সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক বিশ্বাস ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাগুলি। বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্রের প্রসার ও অস্তিত্ব মোকাবেলার লক্ষ্যে অন্যান্য রাজনৈতিক কৌশলের পাশাপাশি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির দুটি মৌলিক অনুষঙ্গের অপব্যবহার করে পুঁজিবাদী বিশ্ব। প্রথমটি হল সামাজিক বিশ্বাস; দ্বিতীয়টি শাসন ব্যবস্থা।

প্রথম বিশ্বের এই রাষ্ট্রগুলি নিজেদের সমাজকে বিশ শতকের শেষাবধি প্রশ্নাতীতভাবে উদার ও মানবিক মতাদর্শে পরিচালিত করতে সমর্থ হয়
প্রথম বিশ্বের এই রাষ্ট্রগুলি নিজেদের সমাজকে বিশ শতকের শেষাবধি প্রশ্নাতীতভাবে উদার ও মানবিক মতাদর্শে পরিচালিত করতে সমর্থ হয়
সমাজতন্ত্রের সঙ্গে ধর্মীয় বিশ্বাস সাংঘর্ষিক এমন একটি প্যারামিটার পুঁজিবাদী বিশ্বের সহজাত লালসা তৃপ্ত করার লক্ষ্যে ব্যবহার করা হয়। ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে দরিদ্র দেশগুলির বিজ্ঞানবিমুখ সমাজ সমাজতন্ত্রই প্রধান শত্রু বলে জ্ঞান করে। নব্বই দশকে গোটা বিশ্ব আফগানিস্তানে অবলোকন করেছে পুঁজিবাদী সত্তার কৌশলী প্রযোজনায় গণতান্ত্রিক আদর্শের মোড়কে ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে সমাজতন্ত্রকে সাংঘর্ষিক করে তোলার ইতিহাস।

শাসন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে আরেকটি রূপ প্রত্যক্ষ করা যায়। সমাজতান্ত্রিক বলয় ও পুঁজিবাদী বিশ্বের মধ্যকার স্নায়ুযুদ্ধে পুঁজিবাদী বিশ্ব তৃতীয় বিশ্বের শাসন ব্যবস্থায় রাজতন্ত্রের পাশাপাশি সামরিক শাসক প্রকল্পে বিশেষ প্রণোদনা দিয়েছিল। পাকিস্তানের জিয়াউল হক, বাংলাদেশের জিয়াউর রহমান, লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফি, ইরাকের সাদ্দাম হোসেন এই প্রকল্পের পণ্য।

দুটি বিশ্বযুদ্ধ এবং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির আদর্শিক দ্বন্দ্বই ছিল বিশ শতকের বিশ্বব্যাপী অস্থিরতার মূল কারণ। পাশাপাশি, তৃতীয় বিশ্বে গণতন্ত্র বাজারজাতকরণের নামে সাধারণ মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস ও শাসন ব্যবস্থাগুলি প্রথম বিশ্বের পুঁজিবাদী স্বার্থ সম্প্রসারণ-বান্ধব হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বিশ শতকেই বহু দেশের সমাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় রূপ নিয়েছে। গণতান্ত্রিক শক্তিগুলি কার্যত সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক বিশ্বাস কোনঠাসা করতে সমর্থ হয়েছে।

তৃতীয় বিশ্বের সঙ্গে প্রথম বিশ্বের গণতান্ত্রিক সমাজের মৌলিক সমস্যা দেখা দেয় ২০০১ সালের নাইন-ইলেভেনের পর থেকে। নানা প্রণোদনার মাধ্যমে পুঁজিবাদী সমাজ যে ধর্মীয় উগ্রবাদের সঙ্গে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে সেটির ব্যবহার করে আসছিল, সেই অপশক্তির ক্লোনিং ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংস করে নিজেদের আদর্শিক ক্রোধ ও সক্ষমতার জানান দিল। ঠিক তখন থেকেই প্রথম বিশ্ব ও তৃতীয় বিশ্বের মধ্যকার পুরানো সম্পর্কে অবিশ্বাস ও সন্দেহ জন্ম নেয়। সর্বশেষ আইএসের উত্থানের ফলে প্রথম বিশ্বের সঙ্গে তৃতীয় বিশ্বের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সামরিক সম্পর্ক একেবারে তলানিতে চলে এসেছে।

অবিশ্বাস এবং সন্দেহ যে কেবল প্রথম বিশ্ব ও তৃতীয় বিশ্বের সমাজে সীমাবদ্ধ, তা নয়– উভয় সমাজের শাসক গোষ্ঠীর মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে তা। তৃতীয় বিশ্বের অভিযোগ, সমাজের অস্থিতিশীলতার জন্য দায়ী প্রথম বিশ্বের পররাষ্ট্রনীতি, বিশেষ করে আমেরিকা এবং তার মিত্র রাষ্ট্রগুলির। এমনকি এই সমাজের অধিকাংশ সুশীল সম্প্রদায়ের মধ্যেও তৃতীয় বিশ্বে অস্থিরতার জন্য কেবল পশ্চিমা বিশ্ব দায়ী, এমন একটি ন্যারেটিভ বহুল প্রচলিত।

অন্যদিকে পশ্চিমা সমাজও ক্রমশ অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। দেশগুলির মানবিক চেহারায় একটি নব্য ভীতি ছড়িয়ে পড়ছে। সমাজের সাধারণ বাসিন্দারা তাদের সামাজিক রীতিনীতি চরম হুমকিতে রয়েছে বলে মনে করছেন। কিন্তু নব্য জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদরা সাধারণ মানুষের ভীতি নিয়ে রাজনৈতিক খেলা খেলছেন।

পশ্চিমা সমাজও ক্রমশ অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে, দেশগুলির মানবিক চেহারায় একটি নব্য ভীতি ছড়িয়ে পড়ছে
পশ্চিমা সমাজও ক্রমশ অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে, দেশগুলির মানবিক চেহারায় একটি নব্য ভীতি ছড়িয়ে পড়ছে
এই প্রেক্ষিতে কথিত প্রথম বিশ্ব ও তৃতীয় বিশ্বের সমাজের শাসক গোষ্ঠীও নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছেন। কেউ আর নৈতিকভাবে সঠিক থাকতে চাচ্ছেন বলে মনে হয় না। সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহাসিক বন্ধু। সামরিক সহায়তা দিয়ে দেশটির রাজতান্ত্রিক শাসক গোষ্ঠীকে গত পঞ্চাশ বছর ওরাই নিরাপদ রেখেছে। কিন্তু কয়েক বছর ধরে দেশ দুটির নেতাদের মধ্যে অবিশ্বাস ও সন্দেহ চরম মাত্রায় দানা বেঁধেছে।

শিয়া ধর্মীয় গুরু নিমরের বিতর্কিত মৃত্যুদণ্ড সৌদি আরব কার্যকর করার পর ইরানের বিক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ তেহরানে সৌদি আরবের দূতাবাস জ্বালিয়ে দেয়। জবাবে সৌদি আরব ইরানের সঙ্গে সকল কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। এ নিয়ে সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল আল জুবায়ের তো স্পষ্টতই বললেন যে, এই সম্পর্ক ছিন্ন করায় যুক্তরাষ্ট্র কী মনে করল তাতে তাদের কিছু যায় আসে না।

সৌদি আরব দীর্ঘদিন ধরে ইরানের উত্থানের পিছনে যুক্তরাষ্ট্রের নিষ্ক্রিয়তার বিষয়টি দায়ী করে আসছে। যুক্তরাষ্ট্র তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে ইরানে হামলা চালাক, গত দশক থেকেই সৌদিরা এ দাবি জানিয়ে আসছে। সিরিয়াতেও হামলা চালাতে যুক্তরাষ্ট্রকে বহুবার অনুরোধ করেছিল ওরা। যুক্তরাষ্ট্র তাতে রাজি হয়নি।

আবার পশ্চিমা বিশ্ব ক্রমশ সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যে তার মিত্র দেশগুলির উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিচ্ছে। কারণ সারা বিশ্বের আজকের যে জঙ্গিবাদ, তার মৌলিক উৎস হল মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির উগ্র ওয়াহাবিজম ও সালাফিজম। আদর্শিকভাবে এগুলোর মোকাবেলা দূরের বিষয়, সৌদি আরব ও তার মিত্র দেশগুলি কয়েক দশক ধরে এর পেছনে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অনুদান ও নানা প্রণোদনা দিয়ে আসছে। প্যারিসের জঙ্গিবাদীদের হামলার পর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির বিষয়ে পশ্চিমা সমাজের সন্দেহ আরও জটিল আকার ধারণ করেছে।

নাইন-ইলেভেনের পর থেকেই প্রথম বিশ্বের উদার ও মানবিক পোশাক ক্রমশ খুলতে শুরু করে। উল্লিখিত সমাজের প্রতিটি দেশই জাতীয়তাবাদের দিকে দ্রুত ধাবিত হচ্ছে। এমনকি পূর্ব ইউরোপের যে দেশগুলি গত কয়েক দশকে সমাজতন্ত্র ছেড়ে গণতন্ত্র ধরল, সেই দেশগুলিতেও জাতীয়তাবাদ স্থান করে নিচ্ছে। বিশেষ করে মিশরে জঙ্গি সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুডের শাসন ক্ষমতায় যাওয়া এবং সিরিয়া-ইরাকে আইএসের উত্থানের ফলে পশ্চিমা বিশ্বে জাতীয়তাবাদের শিকড় সমাজের গভীরে প্রবেশ করছে। আর তাই ইউরোপব্যাপী মেরিন লি পেন, ভিক্টর ওরবান, গ্রেট উইল্ডারস, নাইজেল ফারাজ, মিলশ জামান এবং খোদ আমেরিকায় ডোনান্ড ট্রাম্পের মতো কট্টর জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদের জনপ্রিয়তা বাড়ছে দ্রুত।

প্রথম বিশ্বের উদার রাজনৈতিক দলগুলি কেবল নিজেদের অভ্যন্তরীন নানা সামাজিক ইস্যুতে জাতীয়তাবাদী দলগুলির তুলনায় ভিন্ন অবস্থান থাকলেও, তৃতীয় বিশ্বের বিশেষ করে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলির ক্ষেত্রে নীতির পার্থক্য খুব একটা দেখা যায় না। পশ্চিমা সমাজে কতিপয় রাজনীতিবিদ এখনও রাজনৈতিকভাবে সঠিক থাকার চেষ্টা করলেও ভোটের হিসাব-নিকাশের কারণে নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছেন। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হওয়ার পরও জঙ্গি সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুডকে ক্ষমতার এক বছরের মাথায় সরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে প্রথম বিশ্বের সকল দেশ সায় হয়েছে। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমা দেশগুলি সামরিক শাসককে বেছে নিয়েছে।

বলা যায়, পশ্চিমা গোষ্ঠী নিজেদের পুঁজিবাদ সম্প্রসারণের কারণে বিশ শতকে তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশে ধর্মীয় উগ্রবাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিলেও একুশ শতকে এই ফ্যাসিস্ট অপশক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। আগে ধর্মীয় উগ্রবাদ-বান্ধব সামরিক শাসক তৈরি করলেও এখন কেবল ধর্মীয় উগ্রবাদ মোকাবেলায় সক্ষম সামরিক শাসকদের সমর্থন দিচ্ছে তারা। ধর্মীয় উগ্রবাদীদের সমান্তরালে অবস্থিত রাজনৈতিক দলগুলিকে আগে প্রণোদনা ও সমর্থন দিলেও এখন তাদের অবস্থান ১৮০ ডিগ্রি বিপরীতে।

আমরা এক নতুন বিশ্বে রয়েছি। বিশ শতকে সমাজতন্ত্র পশ্চিমা পুঁজিবাদীদের প্রধান টার্গেট ছিল; একুশ শতকে সেটি হল ধর্মীয় জঙ্গিবাদ। মোটা দাগে বলা যায়, কাল্পনিক প্রথম বিশ্ব ও দ্বিতীয় বিশ্ব এক হয়ে তৃতীয় বিশ্বের বিরুদ্ধে লড়ছে। কথাটি এ জন্য বলছি যে, তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশের শাসন ব্যবস্থা ও সামাজিক বিশ্বাসের সঙ্গে কথিত এই ধর্মীয় জঙ্গিবাদের সম্পর্ক সহজাত।

বিশ্বের এই নব্য সামাজিক এবং রাজনৈতিক চিত্রে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির অবস্থান ১৯৭৮ কিংবা ১৯৯১ সালের মতো নেই। ১৯৭৮ কিংবা ১৯৯১ সালে পশ্চিমা বিশ্বের আশা-আকাঙ্ক্ষার সমান্তরাল পর্যায়ে ছিল বিএনপি ও তাদের সমগোত্রীয় রাজনৈতিক দলগুলির আদর্শিক বিশ্বাস।

খোদ আমেরিকায় ডোনান্ড ট্রাম্পের মতো কট্টর জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদের জনপ্রিয়তা বাড়ছে দ্রুত
খোদ আমেরিকায় ডোনান্ড ট্রাম্পের মতো কট্টর জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদের জনপ্রিয়তা বাড়ছে দ্রুত
হেনরি কিসিঞ্জাররা বিএনপির ‘জিনোমে’ কী কী প্রোটিন রয়েছে তা পড়ে ফেলতে পারার পরই দলটির প্রতি দৃষ্টি দিয়েছিলেন। তখনকার ভূ-রাজনীতিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের মাখামাখি সম্পর্ক পশ্চিমাদের মাথাব্যথার কারণ ছিল। তাই ভারতের সীমান্তের চারপাশে যে কোনো ভারতবিরোধী তথা সোভিয়েতবিরোধী রাজনীতিতে আমেরিকার প্রশাসন সমর্থন দিয়ে গেছে।

তাছাড়া, বাংলাদেশে যদি পাকিস্তানি রাজনৈতিক দলগুলির ভাবধারার একটি রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব হয়, সেটি দক্ষিণ এশিয়ায় আমেরিকার ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের পক্ষেই যাবে। বাংলাদেশে ধর্মীয় রাজনীতির নামে উগ্রবাদের জন্য দুয়ার উন্মুক্ত করে দেওয়ার পিছনে একই রাজনৈতিক আশা-আকাঙ্ক্ষার চিত্র প্রতিফলিত হয়েছিল।

পুঁজিবাদী বিশ্ব সত্তর দশক থেকে বিশ শতকের শেষাবধি এশিয়া ও আফ্রিকার রাজনৈতিক সমাজে যে সকল সামরিক শাসককে নৈতিক ও রাজনৈতিক সমর্থন, প্রণোদনা ও অনুপ্রেরণা দিয়েছিল, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মেজর জিয়াউর রহমান তাদের অন্যতম। তার শাসনের পুরো সময়টিতে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে লড়ছিল। সে সময় ধর্মীয় উগ্রবাদ পশ্চিমা বিশ্বের জন্য ‘ব্যাকল্যাস’ হয়ে উঠেনি। চীনের অর্থনৈতিক উত্থানও ঘটেনি। ভারতের অর্থনীতি তেমন শক্তিশালী ছিল না। তাই পশ্চিমা বিশ্বের এক সময়কার বন্ধু চীনের একুশ শতকের উত্থান মোকাবেলার জন্য চির-বৈরী ভারতকে পশ্চিমা বিশ্বের প্রয়োজনও পড়েনি।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপির জন্মের মৌলিক কারণ মোটামুটি এ রকমই– স্বাধীন বাংলাদেশে জিয়াউর রহমানের সময় আবারও ধর্মের নামে রাজনীতি উন্মুক্তকরণ, ভারত-বিরোধিতার বীজ বপন ও চাষাবাদ, জাতির পিতাকে হত্যা এবং মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারদের নির্বিচারে ফাঁসিতে ঝুলানোর রাজনীতিসহ বিএনপির রাজনীতির ‘জিনোমের’ প্রতিটি প্রোটিনের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে পশ্চিমা বিশ্ব ভালো করেই ওয়াকিবহাল।

সময়, চিন্তা-চেতনা এবং বিশ্ব-রাজনীতির নানাবিধ সমীকরণ পরিবর্তন হলেও বিএনপির রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং কার্যকলাপ অপরিবর্তিত অবস্থায় রয়েছে। দলটির ভোট আহরণ পদ্ধতির বহুমাত্রিক টার্মিনালে পুষ্টিহীনতা দেখা দিয়েছে। এর একটি হল, বহির্বিশ্বে দলটির ইমেজ সংকট। ২০০১ সাল থেকে আজ অবধি দলটি ধর্মীয় জঙ্গি-বান্ধব দল হিসেবেই পরিচিত। এই তকমা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সামান্যতম পদক্ষেপ নিতে বিএনপিকে দেখা যায়নি। বরং নিজের জঙ্গি-বান্ধব তকমা নিয়েই দলটি ভারত ও পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে দেশের ক্ষমতায় ফিরে যাওয়ার দেন-দরবারে লিপ্ত।

বিদ্যমান ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি যদি পশ্চিমাদের পকেটে ঢুকেও পড়ে, আগের অবস্থানে ফিরতে পারবে না। ওরা নিদেনপক্ষে আগামী দু দশক পশ্চিমা বিশ্বের কাছে অপাংক্তেয় হিসাবে বিবেচিত হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল। পশ্চিমা বিশ্ব এখন নিজেদের স্বার্থে ধর্মীয় জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কার্যত যুদ্ধে রয়েছে। আর বিএনপি সেই জঙ্গিবাদের ম্যানুফ্যাকচারার জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র শিবিরের পতাকাতলে অবস্থান করে আদর্শিক ক্ষুধা মিটাচ্ছে।

হেনরি কিসিঞ্জাররা বিএনপির ‘জিনোমে’ কী কী প্রোটিন রয়েছে তা পড়ে ফেলতে পারার পরই দলটির প্রতি দৃষ্টি দিয়েছিলেন
হেনরি কিসিঞ্জাররা বিএনপির ‘জিনোমে’ কী কী প্রোটিন রয়েছে তা পড়ে ফেলতে পারার পরই দলটির প্রতি দৃষ্টি দিয়েছিলেন
ঢাকাস্থ পশ্চিমা কূটনীতিবিদেরা বিএনপির হতাশা এবং ক্রমশ বিপন্ন হওয়ার নানান আলামত দেখে হয়তো কিছুটা সহানুভূতিশীল, তবে তারা এবং তাদের দেশের সরকারগুলি নতুন বিশ্বে ধর্মীয় উগ্রবাদে বিএনপির অবদান সম্পর্কে ভালো করেই ওয়াকিবহাল। তারা ২০০৬ সালের বিউটেনিস এবং আনোয়ার চৌধুরীর মতো সকাল বিকাল নির্বাচনের ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলার সাহস দেখাবেন না।

২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোটের শাসনামলটি বিএনপির জন্য শাঁখের করাত হিসেবে দেখা দিয়েছে। সেই সময় দলটি ক্ষমতায় না গেলে হয়তো আজকের মতো পরিস্থিতিতে পড়তে হত না। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বাংলাদেশ ধর্মীয় জঙ্গি গোষ্ঠীর জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিল। আমেরিকার নেতৃত্বে বহুজাতিক বাহিনী আফগানিস্তানে আক্রমণের ফলে বহু জঙ্গি গোষ্ঠী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল বলে পশ্চিমা গণমাধ্যমে উঠে এসেছিল।

জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির উত্থানের পিছনে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের একটি প্রভাবশালী অংশের সমর্থন ছিল, তা খোদ মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের নথিসহ পশ্চিমা বিশ্বের অন্যান্য সরকারের নথিপত্রেই উল্লেখ রয়েছে। আর এই জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থানের পিছনের মূল কারিগর ছিল জামায়াত। বিএনপিরও এখন আদর্শিক গুরু জামায়াত। তাই বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসা মানেই আরেকটি মুসলিমপ্রধান বড় দেশকে জঙ্গিবাদের লাইসেন্স দেওয়া।

ভারত পশ্চিমা বিশ্বের কৌশলগত বড় অংশীদার ও বিশ্বস্ত বন্ধু। চীনের উত্থান রুখতেই পশ্চিমা বিশ্বের ভারতকে প্রয়োজন। মিয়ানমার গত কয়েক দশক ধরে চীনের কাছে ছিল। চীনের অনেক বড় বড় বিনিয়োগও রয়েছে মিয়ানমারে। সে দেশ কয়েকটি মেগা-প্রকল্প থেকে চীনকে সরিয়ে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে দিয়েছে।

বিএনপি কেবল নৈতিকভাবে অভ্যন্তরীন রাজনীতিতে ভারত-বিরোধিতার চাষাবাদ করেনি, ভারতের বিরুদ্ধে প্রক্সি-ওয়ারে অংশ নিয়েছিল। দশ ট্রাক অস্ত্র এবং বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। ভারতের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রক্সি-ওয়ারের বিষয়টি পশ্চিমা বিশ্বের প্রতিটি সরকারই জানে। ফলে ভারতকে ডিঙ্গিয়ে পশ্চিমা কোনো গোষ্ঠী জঙ্গি-বান্ধব তকমা পাওয়া বিএনপিকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিবে না।

আগেই উল্লেখ করেছি, কাল্পনিক প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্ব এখন মিলেমিশে প্রায় একাকার হয়ে গেছে। এই দুই বিশ্ব মিলে এখন তৃতীয় বিশ্বের ধর্মীয় জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় এক ধরনের যুদ্ধ নিয়োজিত। ফলে এই নতুন বিশ্বে জঙ্গিবাদের সমর্থন দেয় অথবা জঙ্গি-বান্ধব রাজনীতি উস্কানি দেয় এমন রাজনৈতিক দলের প্রতি পশ্চিমা বিশ্ব সমর্থন দিয়ে নিজেদের সমাজের জন্য সামান্যতম বিপদ ডেকে আনবে না।

বিশ্লেষণের আলোকে নতুন এই বিশ্বে বিএনপির রাজনৈতিক সম্ভাবনা কোথায়, তা নির্ধারণের দায়িত্ব পাঠকের উপর-ই ছেড়ে দিলাম। সুত্র
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জানুয়ারি, ২০১৬ ভোর ৬:৪৩
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

টের পেলে

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৫৭

টের পেলে
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

টের পেলে গুটিয়ে যায় লজ্জাবতী/ পরিপূর্ণ যৌবনে যুবতীর নিখুঁত অনুভূতি। আমার চাওয়া, ইচ্ছে, স্বপ্ন! আমার পছন্দ বুঝদার, সুন্দর হৃদয়ের রূপ! সৌন্দর্য সুন্দর যা চিরন্তন সত্য। কিন্তু সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের চার খলিফার ধারাবাহিকতা কে নির্ধারণ করেছেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৭




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব)... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×