সকাল সকাল হোটেলে পৌঁছে গাড়ি থেকে লাগেজ নামিয়ে সুইস হোটেলের নিচ তলায় কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। রিসিপশনিস্ট আসার পর তাকে আগে বুকিং দেয়ার কথা জানালে পরে সে পাঁচ তলায় একটা এয়ার কন্ডিশনড রুমের ব্যবস্থা করে দেয়। রুমের জানালা দিয়ে কুয়ালালামপুরের মিনারা টাওয়ার আর পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার দেখতে পেলাম। যে টুইন টাওয়ারকে এতদিন ছবিতে দেখেছি এখন চোখের সামনে দেখছি, তাও আবার রুমের জানালা দিয়ে দেখছি এটা ভাবতেই অন্যরকম একটা ভালোলাগা কাজ করলো। যাই হোক রুমে এসে কিছুক্ষণ পর ফ্রেশ হয়ে নীচে নামলাম কারণ ক্ষুধার জ্বালায় পেট চো চো করছিল অনেকটা সময় ধরে। রাস্তা পাড় হয়ে একটা রেস্টুরেন্টে গেলাম। রেস্টুরেন্টোটারর মালিক একজন বাঙালি। তিনি যথাসাধ্য আদর–আপ্যায়ন করলেন। খাবার হিসাবে নিলাম রাইস, সার্ডিন ফিস, বিশেষ মসলা দিয়ে রান্না করা মুরগী আর সবজি। সার্ডিন ফিস মালয়েশিয়ায় খুব জনপ্রিয়। মোটামুটি সব রেস্টুরেন্টে সার্ডিন ফিসের একটা আইটেম থাকবেই। সবশেষে চা খেলাম। ঘন দুধ দিয়ে বানানো চা খেতে দারুণ ছিল।

ভাত, সার্ডিন ফিস, ডিম, আচার, বাদাম আর ড্রাইড ফিস
খাওয়া–দাওয়ার পর আশাপাশে কিছু জায়গায় ঘুরলাম, রাস্তার পাশেই একটা সুন্দর ফোয়ারা ছিল। সেখানে বসে কিছু সময় কাটালাম। প্ল্যান করলাম বিকালে কুয়ালালামপুর সিটি গ্যালারী আর সন্ধ্যায় পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার ঘুরে দেখব। অবশ্য মাঝখানে শহরের রাস্তায় হেঁটে বেড়িয়েছি কিছুটা সময়। আমার মনে হয় নতুন কোন শহরে ঘুরতে গেলে হেঁটে হেঁটে ঐ শহরটা ঘুরে দেখার চেয়ে মজার আর কিছু হতে পারে না। বিদেশ-বিভূঁইয়ে মানুষ দেখার মাধ্যমেও অনেক কিছু আইডিয়া করা যায়। মানুষের কালচার, আচার–আচরণ, পছন্দ–অপছন্দ এসব ব্যাপারে কিছুটা হলেও শেখা যায়। ইউরোপিয়ানরা যেটা করতে পছন্দ করে তা হল তারা ব্যাপক হাঁটাহাঁটি করতে পছন্দ করে। পারলে হেঁটেই পুরো শহর এক্সপ্লোর করে ফেলে এমন অবস্থা। কিন্তু আমরা বাঙ্গালিরা সামান্য দূরত্বের জায়গাতেও হেঁটে যেতে ইচ্ছুক না, বরং কোন না কোন যানবাহন ব্যবহার করি।

রাস্তার পাশের ফোয়ারা। ফোয়ারাটি যে হোটেলে ছিলাম সেখান থেকে বের হয়ে ১-২ মিনিট হাঁটলেই চোখে পড়ে।
দুপুরবেলা হোটেলের কাছে একটা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে খেয়ে আবার হোটেলে চলে গেলাম। বিকালের দিকে বের হলাম সিটি গ্যালারী দেখব বলে। সিটি গ্যালারী আমাদের হোটেলের পাশেই ছিল। মারদেকা স্কয়ারের রাস্তা ধরে কিছু দূর সামনে এগুলেই এই গ্যালারী। গ্যালারীতে পাঁচ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত টিকিট কেটে ঢুকলাম। এক রিঙ্গিত মানে বাংলাদেশী টাকায় প্রায় বিশ টাকা। গ্যালারীতে মনোমুগ্ধকর লেজার শো এর মাধ্যমে মালয়েশিয়ার স্বাধীনতার ইতিহাস, বিখ্যাত মানুষদের অবদান, বিখ্যাত স্থাপনা, ট্যুরিস্ট স্পট এসবের ব্যাপারে ট্যুরিস্টদের আইডিয়া দেয়া হয়। আর ভবিষ্যতে আরো কি কি করা হবে সারা দেশ জুড়ে সে ব্যাপারেও ব্রিফ করা হয় দর্শকদের। এই লেজার শো এর দিকে মুগ্ধনয়নে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে বিশ মিনিট পাড় হয়ে গেল টের পেলাম না। লেজার শো দেখে গ্যালারীর ভেতরের দোকান থেকে কিছু স্যুভিনিয়র কিনলাম। দোকানের সব প্রোডাক্টই একবারে জেনুইন এবং ফিক্সড প্রাইস, তাই কোন প্রকার বার্গেইনিং করা গেল না। তবে মালয়েশিয়াতে কিছু মার্কেট আছে যেখানে বার্গেইন করা যায় কেনাকাটার সময়। সিটি গ্যালারীর সামনের রাস্তায় ‘ আই লাভ কেএল’ লেখা নামক একটা স্থাপনার সামনে ছবি তোলার জন্য মানুষের ভীড় লেগেই ছিল যেটা গ্যালারীতে ঢুকার সময়ই লক্ষ্য করেছিলাম। তাই গ্যালারী থেকে বের হয়েই ছবি তোলার জন্য দৌড় দিলাম যদিও ছবি তোলার সুযোগের অপেক্ষা আসতে আসতে বেশ খানিকটা সময় চলে গেল।

কুয়ালালামপুর সিটি গ্যালারী

সিটি গ্যালারীতে প্রবেশের পূর্বে এই 'আই লাভ কেএল' লেখা মনুমেন্ট চোখে পড়বে। দারুণ ভিড় থাকের সামনে ছবি তোলার জন্য
সিটি গ্যালারীতে ভালো কিছু সময় কাটিয়ে ট্যাক্সিতে করে রওয়ানা দিলাম পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারের উদ্দেশ্যে। আর তখন ও সন্ধ্যা নামেনি। সন্ধ্যা নামার কিছু পূর্বেই চলে আসলাম টুইন টাওয়ারের কাছে। টুইন টাওয়ার একসময় বিশ্বের উচ্চ–তম বিল্ডিং ছিল ছিল। বিশ্বের উচ্চ–তম বিল্ডিং এর খেতাব হারালেও এখনো বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু টুইন টাওয়ারের খেতাব ধরে রেখেছে এই পেট্রোনাস টাওয়ার। ফ্রান্সের যেমন আছে আইফেল টাওয়ার, দুবাইয়ের যেমন আছে বুর্জ খলিফা, তাইওয়ানের যেমন আছে তাইপে ১০১ ঠিক তেমনি মালয়েশিয়ার ও আছে পেট্রোনাস টাওয়ারস। সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে এই পেট্রোনাস টাওয়ার দেখতেই প্রতিবছর কয়েক লাখ ট্যুরিস্ট কুয়ালালামপুরে বেড়াতে আসেন। লিফটে করে উঠে টুইন টাওয়ারের উপর থেকে কুয়ালালামপুর শহরটাকে দেখা যায়। টিকেটের জন্য লাইন থাকায় আর দাম বেশি হওয়ায় এই যাত্রায় দেখা হল না। টুইন টাওয়ারের সামনে যথারীতি অনেক ভীড় ছিল, মানুষজন যে যার মন মত ছবি তুলে যাচ্ছে টাওয়ারকে ব্যাকড্রপ করে। রাতের টুইন টাওয়ার দেখতে অসাধারণ।

রাতের পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার

কেএলসিসি পার্কের লাইট এন্ড সাউন্ড শো
শুধু টুইন টাওয়ারই নয় এর আশে পাশের স্কাই–স্ক্রেপার গুলো ও রাতের বেলা বিভিন্ন রঙের আলোতে সুন্দরভাবে আলোকিত করা হয়। পেট্রোনাস টাওয়ারসের সামনের ফোয়ারার সামনে কিছুক্ষণ বসে থেকে তারপর গেলাম সুরিয়া কেএলসিসি শপিং মলে। অনেক গুছানো বিশাল একটা শপিং মল, কিন্তু দাম প্রায় আকাশ–ছোঁয়া। তাই কিছু না কিনে ঘুরে দেখতেই ভালো লাগলো। বিশ্বের সব বিখ্যাত ব্র্যান্ডের আউটলেট আছে এই শপিং মলে। শপিং মল থেকে বের হলে কেএলসিসি পার্ক। বিকেলে ভালো সময় কাটানোর জন্য দারুণ একটা জায়গা। যে যার মত বসে গল্প করছে, আড্ডা দিচ্ছে। বাচ্চাদের জন্য একটা ওয়াটার পার্ক আছে পাশে। সন্ধ্যার দিকে পার্কের ফাউন্টেইনে লাইট আর সাউন্ড শো হয়। শুধু এটা দেখার জন্যই অনেকে পার্কে বেড়াতে আসে। সারাদিন ঘুরাঘুরি করে সেদিনের মত হোটেলে ফিরলাম । ফিরে রাতের খাবারের জন্য বাইরে না গিয়ে হোটেলেই খেলাম। খাবার দারুণ মজা যদিও দাম খানিকটা বেশি ছিল। মুরগীর ঝাল ক্বারী, সবজি ভাজি, ডাল, আলু ভর্তা আর সাথে গরম ধোঁয়া উঠা ভাত। খেয়ে–দেয়ে ঘুমিয়ে পরলাম রুমে গিয়ে পরের দিনের ঘুরাঘুরির প্ল্যান ফাইনাল করে।
১ম পর্বঃ Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ১:২৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



