সিনেমা তো অনেক দেখি। যখন শুনলাম রাম গোপাল ভার্মার নতুন সিনেমার নাম ‘বীরাপ্পন’ তখনই স্মৃতির অতল থেকে একটা নাম বেরিয়ে এল – দস্যু বীরাপ্পন! মনে আছে স্কুলে থাকার সময় নিয়মিত পত্রিকা পড়তাম আর পত্রিকার পাতায় আলোড়ন তোলা এক নাম ছিল দস্যু বীরাপ্পন। দক্ষিণ ভারত তছনছ করে ফেলা ডাকু এই বীরাপ্পন। সেই আলোড়ন তুলে ফেলা বীরাপ্পনকে নিয়ে সিনেমা ! ইন্টারনেট ঘেঁটে বুঝতে পারলাম এটাকে ক্রাইম, বায়োগ্রাফি জনরাতে ফেলা হলেও এটা আসলে বীরাপ্পনকে হত্যা করার অপারেশনের স্টোরি, বীরাপ্পনের তান্ডবের খুব কমই এতে দেখানো হয়েছে। অবাক হলাম যখন জানলাম চেন্নাইতে এই সিনেমা মুক্তিতে বাধা দেওয়া হয়েছে। অভিযোগে জানানো হয়েছে, এ ছবিতে অনেক ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে, পাশাপাশি ছবিটি মুক্তি পেলে ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে! এতটুকু পড়ার পরে আপনি আগ্রহী হয়ে ট্রেলার দেখতে চাইবেন। বিলিভ মি, ট্রেলার দেখলেই আপনার শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠবে!
ট্রেলার !
ট্রেলার ত দেখলেন, সিনেমাও দেখবেন তবে তার আগে একটু ইতিহাস জেনে যান।
কে এই বীরাপ্পন ?
কর্ণাটক, কেরল ও তামিলনাড়ুর প্রায় ৬০০০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে ছিল এই বীরাপ্পনের রাজত্ব। পেশা ছিল বেআইনিভাবে চন্দনকাঠ ও হাতির দাঁত পাচার। ‘চন্দন দস্যু’ বীরাপ্পন ১০ হাজার টনেরও বেশি চন্দনকাঠ পাচার করেছিল বিদেশে। সেই চন্দনকাঠের সে সময়ের বাজারমূল্য শুনলে মাথা ঘুরে যাবে। দু’কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি। প্রায় ১০০০টি হাতি মেরেছিল সে। হাতি চোরাশিকার করে বীরাপ্পন পাচার করে আয় করেছিল ২৬ লক্ষ মার্কিন ডলার। বীরাপ্পনের আগে দক্ষিণের জঙ্গলে দাপট ছিল আর এক দস্যু সেলভি গুন্ডারের। সেলভি ছিল বীরাপ্পনের আত্মীয়। তার হাত ধরেই অপরাধে হাতেখড়ি বীরাপ্পনের। মাত্র ১০ বছর বয়সেই গুলি করে একটি হাতি মেরে ফেলেছিল ‘চন্দন দস্যু’ বীরাপ্পন। ১৭ বছর বয়সে এই দস্যু জীবন শুরু হয়েছিল বীরাপ্পনের। স্রেফ শুকনো পাতায় পায়ের শব্দ শুনেই বীরাপ্পন বুঝতে পারত কোন প্রাণী আসছে। বীরাপ্পনের স্ত্রীর নাম মুথুলক্ষ্মী । বীরাপ্পনকে কেন মুথুলক্ষ্মী বিয়ে করেছিলেন জানেন? স্রেফ দৌরাত্ম্য আর গোঁফের প্রেমে পড়ে। পরপর তিনটি মেয়ে হওয়ায়, তৃতীয়টিকে হত্যা করেছিল বীরাপ্পন। (সিনেমাতে এই দৃশ্য আছে ) কাঠ আর হাতির দাত পাচারের সঙ্গে ছিল হত্যালীলা। ৯৭ জন পুলিশকর্মী ও সরকারি অফিসার খুন হয়েছিলেন তার হাতে। প্রাণ হারিয়েছিলেন ২০০ সাধারণ মানুষ। যাকেই পুলিশের চর বলে সন্দেহ হয়েছে, তাকেই নির্বিচারে খুন করেছে বীরাপ্পন। ২০০০ সালে কন্নড় মেগাস্টার রাজকুমারকে অপহরণ করেছিল বীরাপ্পন। ১০৯ দিন আটকে রেখেছিল। তার পরে ৩০ কোটি টাকা এবং বিপুল সোনার বিনিময়ে তাঁকে মুক্তি দেয়। ২০০২ সালে কর্নাটকের মন্ত্রী এইচ নাগাপ্পাকে অপহরণ করেছিল। মুক্তিপণ নিয়ে দরাদরিতে পোষায়নি বলে তাঁকে হত্যা করে। জানা যায়, মেগাস্টার রজনীকান্ত সহ আরো অনেক ভিআইপিকে অপহরণ করার পরিকল্পনা ছিল তার। ১৯৯০ থেকেই তাকে জীবিত বা মৃত ধরার চেষ্টা শুরু করে ভারত সরকার। কিন্তু সরকারি মহলে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ এবং সাধারণ মানুষের ওপর বীরাপ্পনের ভয়মিশ্রিত প্রভাবের কারণে বারবার ব্যর্থ হতে থাকে বীরাপ্পনকে ধরার অভিযান। অবশেষে, তামিলনাড়ুর স্পেশাল টাস্ক ফোর্সের অপারেশন কোকুনে এক মুখোমুখি লড়াইতে নিহত হয় বীরাপ্পন ও তার তিন সঙ্গী সেথুকুলি গোবিন্দা, চন্দ্রা গৌধা ও সেথুমনি। কিন্তু ততদিনে বীরাপ্পনকে দমন করার জন্য ভারত সরকারের খরচ হয়ে গেছে ৭৩৪ কোটি টাকা! বীরাপ্পনের পাবলিক রিলেশন্স বা জনসংযোগের কাছে নামজাদা কোম্পানিও ফেল করবে। সুন্দরী মহিলাদের সে নিয়োগ করেছিল জনসংযোগ রক্ষা করতে। সাংবাদিক থেকে শুরু করে সাহিত্যিক, সকলের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল। বিদেশেও জনসংযোগের জন্য লোক নিযুক্ত করেছিল বীরাপ্পন। লন্ডন এবং নিউ ইয়র্কেও তার লোক ছিল। মৃত্যুর আগে শেষবার বীরাপ্পনকে যখন ঘিরে ফেলেছিলেন স্পেশাল টাস্ক ফোর্সের জওয়ানরা, তখন রচিত হয়েছিল এক টানটান নাটক। বীরাপ্পনের এক সঙ্গীকে মেরে ফেলেছিল এসটিএফ। বীরাপ্পন সেই সময়ে সঙ্গীর মোবাইল (সেই সময়েও মোবাইল ব্যবহার করত বীরাপ্পন, যা একমাত্র পুলিশ এবং সামরিক বাহিনীর কাছে ছিল) থেকে কোনও এক ভিভিআইপি-কে ফোন করে। তৎক্ষণাৎ নির্দেশ আসে বন্দুক নামানোর। বীরাপ্পন ফসকে যায়। ২০০৪ সালের ১৮ অক্টোবর বীরাপ্পনকে তার তিন সঙ্গী-সহ গুলি করে হত্যা করা হয়। সেই সময়ে তার মাথার দাম ছিল পাঁচ কোটি টাকা। আজকের হিসেবে তা প্রায় ১১ কোটি টাকা!
হ্যাপি সিনেমা ওয়াচিং। আশা করি ভাল লাগবে।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মে, ২০১৬ রাত ১০:১৯