somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রত্যক্ষদর্শির চোখে সেই নৃশংস জিঞ্জিরা হত্যাকান্ডের ২রা এপ্রিল ১৯৭১ (শেষ পর্ব)

০২ রা এপ্রিল, ২০০৯ দুপুর ১:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আগের পর্বে লিংক

Click This Link

(পুর্ব প্রকাশে পর)

আমার সেই নানা এক সময় মুসলিম লিগ করতেন। কিন্ত বিতশৃদ্ধ হয়ে রাজনীতি ছেড়ে দেন সেই ১৯৬৫ সালেই। এর পরেও স্থানীয় মুসলিম লিগের কিছু নেতার সাথে তার আলাপ পরিচয় ছিল। সেই সুত্রে তিনি আমাদেরকে, মানে আমাদের পাড়ার ছেলে ছোকড়াদের রাতে ঘরে না থাকার পরামর্শ দেন। তার কাছে খবর ছিল যে, ঢাকার পর নদীর এপারেও মিলিটারি ক্রাকডাউন শুরু হবে। বিশেষ করে জিঞ্জিরা থাকা লুট হবার পর থেকে, পাক বাহিনীর বদ্ধমুল ধারণা হয়েছিল যে, জিঞ্জিরায় মুক্তিবাহিনীর বিশাল ঘাটি রয়েছে। তাছাড়া পর পর কয়েকটি রাত আঃ লিগের কিছু দুঃসাহসি কর্মী, রাতে আধারে নদীতে টহলরত পাকিস্থানিদের লুঙ্গি উচু করে দেখিয়ে উর্দু ভাষায় গালাগাল করতো। এবং এপারে আসলে ওদের কচুকাটা করা হবে, সেটাও জানিয়ে দিতো। ফলে পাক বাহিনীর নজর পড়ে জিঞ্জিরার উপর। উল্লেখ্য যে, এরই মধ্যে ঢাকা শহর থেকে প্রচুর মানুষ পালিয়ে জিঞ্জিরায় চলে এসেছিল। এদের অনেকেই আবার ধলেস্বরি নদী পার হয়ে অজানা গন্তব্যে চলে গিয়েছিল।

(জিঞ্জিরা থানা লুট করার অন্যতম নায়ক ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা মহসীন মন্টু। তিনি ছিলেন স্থানিয় আওয়ামী লিগ নেতা। সে সময় থানার বাঙ্গালি ওসির অনুরোধে, তাকে মারধোর করে বেধে রাখা হয়, যেন পাকিস্থানিরা টের না পায়, এতেও ওসিরও সায় ছিল। কিন্ত হায় ! জিঞ্জিরা ক্রাকডাউনের প্রথম লগ্নেই সেই ওসি এবং থানার বাঙ্গালি অফিসার ও সেপাইদের, পাকিস্থানিরা নৃশংসভাবে হত্যা করে।)

আগের রাতে ঠিক করে ঘুমাতে পারিনি। একে তো বাড়ি থেকে একটু দুরে, তার উপর গোয়াল ঘরে গাদাগাদি করে এক সঙ্গে এত লোক...

পুবের আকাশ তখন ঠিক ফর্সা হয়েছে কি হয়নি। হঠাৎ প্রচন্ড গোলাগুলির শব্দ আর আর্তচিৎকারে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠলো। মনে হচ্ছিল খুব কাছেই যেন কেয়ামত নাযিল হয়েছে। সবার আত্মারাম খাচাছাড়া। কে কোথায় কোন দিকে দৌড়াচ্ছিল, ঠিক ছিল না। আমি যে কি করে নিজ বাসায় পৌছেছিলাম বলতে পারবো না। সম্বিত ফিরে পেতে দেখি, ছোট বোনটাকে এক হাতে আর আমাকে এক হাতে নিয়ে উর্ধশ্বাসে মা দৌড়াচ্ছেন। ছোট চাচা আর মামাও (সেই নানার ছেলে, যিনি আমাদের বাড়িতে আগের রাতে এসেছিলেন) আমাদের সাথে সাথে দৌড়াচ্ছেন। চারিদিকে বারুদ আর আগুণের পোড়া গন্ধ। চিৎকার চেচামেচি আর আর্তনাদে বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। হয়তো আগেই ঠিক করা ছিল, তাই গন্তব্য দেখলাম ধলেস্বরী নদীর দিকে। পার হয়ে নিরাপদে এই পথে অনেকেই আগে গিয়েছিলেন। কিন্ত সেখানেও দেখি বন্দুক তাক করে বসে আছে সাক্ষাত যম। আমাদের পেছনেও ধেয়ে আসছে তারা, সামনেও তারা। হঠাৎ আমার কানের পাশ দিয়ে একটা গুলি চলে গেল। ভাগ্যবান আমি। সবাই মাটিতে শুয়ে পড়লাম। এদিকে সময় নেই, যে কোন সময় আজরাইলের দল চলে আসবে। এর পর নির্ঘাত মৃত্যু। শুয়ে শুয়েই দেখতে পাই খানিকটা পরেই একটা হিন্দুদের অর্ধ পরিত্যাক্ত বাড়ি। মাটিতে হেচরে হেচরে অদ্ভুত দ্রুততায় সে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়লাম। সেখানে ঠাই নেই ঠাই নেই অবস্থা। কি হবে হবে কেউ ঠিক করতে পারছিল না। সমাধানে দ্রুত এলেন একজন উর্দুভাষি ঢাকাইয়া। পুরুষদের বললেন ওই বাড়ির পেছন দিকে একটি মসজিদে আশ্রয় নিতে, আর মহিলাদের ঐ বাড়িরই একটি ঘরে তালাবদ্ধ করে নিজে ছোট্ট মেয়েটাকে নিয়ে দাওয়ায় বসলেন। মা কে বোনকে ছেড়ে মন যেতে না চাইলেও, সেই অবস্থায় দ্বিমত করার মত সুযোগ ছিল না।

আমরা সব পুরুষরা মসজিদে নিশ্চিত মৃত্যুর প্রহর ছিলাম। কেউ একজন বলছিল, দরজা আটকে দিতে। মুরুব্বি গোছের অনেকে বাধা দিয়ে বললো এমন কিছু করা ঠিক হবে না, যাতে পাকিস্থানিদের মনে সন্দেহ দেখা দেয়। এওম্নি তো পাগলা কুকুরের মত ওরা ঝাপিয়ে পড়েছে, কোন ছুতা পেলে প্রাণ বাচানোর আর কোন রাস্তাই থাকবে না। মৃত্যু প্রহরকে একটু সহজ করবার জন্যই কিনা জানিনা, তবে একজন খুব হাল্কা শব্দে যিকির শুরু করলেন। এ রকম এক জন দুজন করে সবাই তাকে অনুসরণ করলো। চারিদিকে তখন গুলির শব্দ আর আর্তচিৎকার। যে কোন সময় আমার সময় আসবে চিন্তা করতে করতে যমদুতের মত হাজির হলো পাকিস্থানি আর্মির একজন অফিসার। তাকে দেখে সবাই বাকরুদ্ধ। এক মুহুর্তে কি যেন ভাবলো সেই অফিসারটি। এর পর জিজ্ঞেস করলো, " তুম সাব লোহ মুসলাম হো?" এর মধ্যে অনেক সাহস করে একজন বলে বসলো "হ্যা"।
আরো কয়েক সেকেন্ড লাল চোখে আমাদের দিকে সে বললো, " বোলো পাকিস্থান জিন্দাবাদ, কায়দে আযম জিন্দাবাদ"। মসজিদের সেই পবিত্র ঘরে সবাই উচ্চারন করলো অপবিত্র সেই শব্দগুলি। এর মধ্যে হায়েনার মত আরো কয়েকজন সৈনিক ঢুকে পড়লো। ওদের দেখতে লাগছিল শিকারের রক্তস্নাত কয়েকটি হায়েনার মতই। সেই অফিসারটি ধাক্কা দিয়ে ওদের সরিয়ে দিয়ে বললো " শুয়ার কি বাচ্চে লোগ, তুম লোগ বাহার যাও", বলেই আমাদেরকে মাটিতে শুতে যেতে বললো। শেষবারের মত আল্লাহকে স্মরণ করে নিলাম। চোখে ভাসলো মায়ের ছবিটি। কয়েকটি গুলির শব্দ পেলাম। মসজিদের ছাদ থেকে এক গাদা পলেস্তরা খসে পড়লো। এর পর মসজিদের দরজায় শেকল পড়ানোর আওয়াজ পেলাম। চারদিকে আর্ত চিৎকার আর গুলির শব্দ কতক্ষণ ধরে চলছিল, জানি না। সময় যেন স্থবির হয়ে গিয়েছিল। ভুত বর্তমান ভবিষ্যত যেন স্থবির হয়ে পড়েছিল। খুট করে দরজার শেকল খোলার শব্দে যেন নিজেকে ফিরে পেলাম। চারিদিকে তখন শুনসান নীরবতা। এক জন দু জন করে সাহসে ভর দিয়ে বাইরে তাকালাম। বাতাসে তীব্র বারুদ আর আগুণের গন্ধ। আশপাশ থেকে দেখলাম অনেক কালো ধোয়া। হঠাৎ মার কথা মনে হলো। কেমন আছে? বেচে আছে তো?

দৌড়ে ছুটে গেলাম ওই অর্ধ পরিত্যাক্ত বাড়ির দিকে। দাওয়া পা দিতেই থমকে গেলাম। সেই ঢাকাইয়া লোকটি নিস্প্রাণ বসে আছে। মাথার এক পাশ দিয়ে সরু একটা রক্তে ধারা বয়ে যাচ্ছে। আর কোলের শিশুটি তার বুক আকড়ে ধরে পড়ে আছে। ভাগ্য ভালো বলতে হয়। বাইরে থেকে তালাবদ্ধ থাকায় পাকিস্থানি সেনারা কিছু বুঝতে পারেনি। ফলে একজন প্রান দিয়ে বাচিয়ে দিলেন অনেক মা বোনদের।

ইট এনে তালা ভেঙ্গে দেখা মিললো সবার। সবাই তখন অশ্রু আপ্লুত। সে অশ্রু নতুন জীবন ফিরে পাবার, সেই অশ্রু প্রিয়জনকে ফিরে পাবার। তবে সেদিন সবার সেই সৌভাগ্য হয়নি। বাড়ি ফিরে যাবার পথেই আশে পাশে যে অগুণিত লাশ চোখে পড়েছে, তাতে নিহতদের সংখ্যাটা কোন মতেই দশ হাজারের নীচে হবে বলে মনে হয় না।

(সমাপ্ত)

**** দোসরা এপ্রিল ১৯৭১ সালে জিঞ্জিরায় নিহত অগুনিত মানূষের প্রতি উৎসর্গকৃত।
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×