somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রবীন্দ্রনাথ বিতর্ক ও ক'টি কথা – একটি যৌক্তিক বিশ্লেষণের চেষ্টা।

২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৫:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। প্রতিটি মানুষের রয়েছে ভিন্ন চিন্তা ভাবনা এবং দর্শন। যার কারণে একজন মানুষের সৃষ্টিকর্ম তার ব্যক্তি জ্ঞান এবং চেতনার প্রকাশ ঘটায়। হাতের পাঁচটি আঙ্গুল যেমন সমান নয় তেমনি মানুষের মত প্রকাশের রয়েছে ভিন্নতা। পৃথিবীতে যখন কোন ভাল বা মন্দ কোন ঘটনা ঘটে তখন তার নিমিত্তকরণের ব্যাখ্যাও একরকম হয় না। অভিজ্ঞতা এবং বুদ্ধিবাদের সাহচর্যে মানুষ এইসব ঘটে যাওয়া ঘটনার তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ দেয়ার চেষ্টা করেন। কালেভদ্রে অনেকের মতামতের সাদৃশ্য পাওয়া গেলেও তা যোগ করার বিষয় নয়। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে বর্ষাকালে যেমন বসন্তের ফুল ফোটে না তেমনি বসন্তে বর্ষার ফুলও ফোটে না। আমার আজকের এ লেখা প্রকৃতি বা মানুষের নিয়ম ভাঙার বিষয়ে নয়। আমাদের বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর সৃষ্টিকর্ম এবং দর্শন নিয়ে, ইদানীং পত্র পত্রিকায়, টেলিভিশন টক্শো এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটা ঠাণ্ডা বিতর্ক রয়েছে। বিতর্কের মূল আলোচ্য বিষয় হলো কে শ্রেষ্ট? রবীন্দ্র না নজরুল? বিগত দিনে ফেইসবুকে নজরুল ইসলামকে নিয়ে একটি মন্তব্য আমাকে ভীষণ কষ্ট দিয়েছে। শালীনতাবর্জিত বলে তা লিখার সাহস দেখালাম না। আমাদের চিন্তাভাবনার সীমাবদ্ধতা হয়তো আছে কিন্তু পর্যাপ্ত গবেষণা না করে এবং জ্ঞান লাভ না করে হঠাৎ কোন মন্তব্য করা কতটুকু সমীচীন তা পাঠকরাই বিচার করবেন। রবীন্দ্র-নজরুলের সাহিত্যকর্ম নিয়ে আমার জ্ঞানেরও যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা আছে। তাই আমার মত করে আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বিরুদ্ধে কিছু যুক্তি দিলাম, তা অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে কিন্তু আমার কাছে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য নয়। এক জীবনে যার সৃষ্টিশৈলীকে জানা এবং জ্ঞানলাভ করার সুযোগ থাকে না সেই মহান কবিকে নিয়ে অল্পকথায় কী সমালোচনা করা যায় তা আমার বোধগম্য নয়। স্মৃতিতে যতটুকু মনে আছে, তাই এখানে পেশ করলাম। গ্রহন করার দায়িত্ব আপনাদের।

এক।
শুনতে খারাপ শোনা গেলেও এটা সত্য, রবীন্দ্রনাথের পৈতৃক ব্যবসার মধ্যে অন্যতম সফল ব্যবসা ছিলো পতিতালয় ব্যবসা। রবীন্দ্রনাথের দাদা দ্বারকানাথের কলকাতা নগরীতে ৪৩টা বেশ্যালয় ছিলো। এছাড়া ছিলো মদ আর আফিমের ব্যবসাও। (সূত্র: এ এক অন্য ইতিহাস, অধ্যায়: অসাধারণ দ্বারকানাথ, লেখক: গোলাম আহমদ মর্তুজা, পৃষ্ঠা: ১৪১)
"রবীন্দ্রনাথের দাদা দ্বারকানাথ ছিলেন দেড়শ টাকা বেতনের ইংরেজ ট্রেভর প্লাউডেনের চাকর । দ্বারকানাথ ধনী হয়েছিলেন অনৈতিক ব্যবসার দ্বারা। রবীন্দ্রনাথের দাদা দ্বারকানাথ ঠাকুরের তেতাল্লিশটা বেশ্যালয় ছিল কলকাতাতেই।(তথ্যসূত্র: কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা,২৮শে কার্তিক,১৪০৬, রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়)"
তবে রবীন্দ্রনাথ পতিতাদের মধ্যেও যে সাহিত্য রস খুজে পেয়েছেন সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। রবীন্দ্রনাথ ঢাকায় বুড়িগঙ্গার পাশে বিখ্যাত গঙ্গাজলী’র (একটি এলাকার নাম যেখানে ঐ সময় বিশাল পতিতালয় ছিলো) পাশে এসে লিখেছিলেন “বাংলার বধূ বুকে তার মধু”। সত্যি কথা বলতে, ঐ সময় কলকাতায় বিশেষ কারণে যৌনরোগ সিফিলিস খুব কমন ছিলো। তাই ১৯২৮ সালে অবতার পত্রিকায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সিফিলিস রোগের খবরটা তেমন গুরুত্ব পায় নি।
(রবীন্দ্রনাথের সিফিলিস হয়েছিলো এর সূত্র: বই-নারী নির্যাতনের রকমফের, লেখক: সরকার সাহাবুদ্দিন আহমদ, পৃষ্ঠা: ৩৪১,)
রবীন্দ্রনাথকে যারা দেবতা ভাবতে চান, তাদের বলছি, সিফিলিস-গনোরিয়া কাদের হয়? বলবেন দয়া করে!

দুই।
আজকাল ভারতের উগ্র জাতীয়তাবাদী দল বিজেপি প্রায়ই বলে থাকে ভারতের সকল মুসলমানই হিন্দু। ফলে তাদেরকে ঘরে ওয়াপসি করতে হবে। পুরোপুরি হিন্দু হয়ে যেতে হবে। কথাটা কিন্তু ভারতের জাতীয় কবি রবীন্দ্রনাথই প্রথম চালু করেছিলেন।
তিনি বলেছিলেন: মুসলমানরা ধর্মে ইসলামানুরাগী হলেও জাতিতে তারা হিন্দু। কাজেই তারা ‘হিন্দু মুসলমান’। (সূত্র: আবুল কালাম শামসুদ্দিনের লেখা অতীত দিনের স্মৃতি, পৃষ্ঠা: ১৫০)
গোড়া হিন্দুদের মত সতীদাহ প্রথাকে সমর্থন করে কবিতাও লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। লিখুন, সমস্যা নেই। কিন্তু স্বামীর চিতায় জীবন্ত স্ত্রীর পুড়ে যাওয়াকে মুসলমানরা অপছন্দ করেন বলে তিনি 'যবন ' গালি দিয়ে মুসলমানদের হুমকি দিচ্ছেনঃ “জ্বল জ্বল চিতা ! দ্বিগুন দ্বিগুন পরান সপিবে বিধবা বালা জ্বলুক জ্বলুক চিতার আগুন জুড়াবে এখনই প্রাণের জ্বালা শোনরে যবন, শোনরে তোরা যে জ্বালা হৃদয়ে জ্বালালি সবে স্বাক্ষী রলেন দেবতার তার এর প্রতিফল ভুগিতে হবে” (জ্যোতিন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা জ্যোতিন্দ্রনাথের নাট্য সংগ্রহ, কলকাতা: বিশ্ব ভারতী ১৯৬৯, পৃষ্ঠা: ২২৫)
যারা রবী ঠাকুরকে অসাম্প্রদায়িক বানাতে চান, দয়া করে বলুন কোন অর্থে তিনি অসাম্প্রদায়িক?

তিন।
"রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনে এক সময় কোনো মুসলমান ছাত্রের প্রবেশাধিকার ছিল না। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে চাঁদা চেয়েছিলেন হায়দরাবাদের নিজামের কাছেও। নিজাম তাকে চাঁদা দেন এক লাখ টাকা। এক লাখ টাকা সে সময় ছিল অনেক। রবীন্দ্রনাথ ভাবতে পারেননি নিজাম এতটা চাঁদা দেবেন। নিজামের চাঁদার সুত্র ধরেই সামান্য কিছু মুসলিম ছাত্র সুযোগ পায় বিশ্বভারতীতে লেখাপড়া শেখার।
সাহিত্যিক মুজতবা আলী হলেন যাদের মধ্যে একজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্হাপিত হয় ১৯২১ সালের জুলাই মাসে। হিন্দুরা চাননি ঢাকাতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্হাপিত হোক। এমনকি ঢাকার হিন্দুরাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্হাপনের বিরুদ্ধে ছিলেন। তারা মনে করেছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হবে আসলে একটি মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়। শোনা যায়, রবীন্দ্রনাথও চাননি ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্হাপিত হোক (সেক্যুলারদের অতিমাত্রায় রবীন্দ্রপুজার রহস্য উন্মোচন-এবনে গোলাম সামাদ :০৭ মে,২০১১, শনিবার, বিডিনিউজ টুয়েন্টি ফোর ডট কমে প্রকাশিত)।
১৯১২ খ্রিস্টাব্দের ২৮ মার্চ কলিকাতার গড়ের মাঠে এক বিরাট সমাবেশ করা হয়। ঠিক তার দু’দিন পূর্বে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং হয়েছিল। সেখানেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে, ঢাকায় ইউনিভার্সিটি হতে দেওয়া যাবে না। উক্ত উভয় সভার সভাপতি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ (তথ্যসূত্র: কলকাতা ইতিহাসের দিনলিপি, ড. নীরদ বরণ হাজরা, ২য় খণ্ড, ৪র্থ পর্ব)।
" ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে কলকাতার গড়ের মাঠে যে সভা হয়, তাতে সভাপতি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এসব বাধার কারণে ১৯১১সালে ঘোষণা দিলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবটি আঁতুর ঘরে পড়ে থেকে মৃত্যুর প্রহর গুনছিল। অবশেষে নানা বিষয়ে সমঝোতা হয়, যার মধ্যে ছিল মনোগ্রামে ‘সোয়াস্তিকা’ এবং ‘পদ্ম’ ফুলের প্রতীক থাকবে। প্রতিবাদকারীরা খুশি হন। এরপর ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়"(তথ্যসূত্র: ডক্টর কাজী জাকের হোসেন: দৈনিক ইনকিলাব, ১০ মার্চ, ২০০২)।"
১৯১২ সালের ২৮শে মার্চ কলিকাতা গড়ের মাঠে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিবাদে এক বিশাল জনসভার আয়োজন করা হয় [তথ্যসূত্র: আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিকতা এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা, লেখক, মেজর জেনারেল(অব.) এম এ মতিন (সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা)]।
যারা এ দেশে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য লবেজান, দয়া করে বলুন কীসের ঋন পরিশোধে তাঁর নামে বিশ্ববিদ্যালয়?

চার।
‘প্রায়শ্চিত্ত’ নাটকে প্রতাপাদিত্যের মুখ দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলাচ্ছেন- "খুন করাটা যেখানে ধর্ম, সেখানে না করাটাই পাপ। যে মুসলমান আমাদের ধর্ম নষ্ট করেছে তাদের যারা মিত্র তাদের বিনাশ না করাই অধর্ম।"
‘রীতিমত নোবেল’ নামক ছোটগল্পে মুসলিম চরিত্র হরণ করেছেন-“আল্লাহু আকবর শব্দে বনভূমি প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠেছে। একদিকে তিন লক্ষ যবন (অসভ্য) সেনা অন্য দিকে তিন সহস্র আর্য সৈন্য।
... পাঠক, বলিতে পার...
কাহার বজ্রমন্ডিত ‘হর হর বোম বোম’ শব্দে তিন লক্ষ ম্লেচ্ছ (অপবিত্র) কণ্ঠের ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি নিমগ্ন হয়ে গেলো। ইনিই সেই ললিতসিংহ। কাঞ্চীর সেনাপতি। ভারত-ইতিহাসের ধ্রুব নক্ষত্র"
রবীন্দ্রনাথ তার ‘কণ্ঠরোধ’ (ভারতী, বৈশাখ-১৩০৫) নামক প্রবন্ধে বলেন, "কিছুদিন হইল একদল ইতর শ্রেণীর অবিবেচক মুসলমান কলিকাতার রাজপথে লোষ্ট্রখন্ড হস্তে উপদ্রবের চেষ্টা করিয়াছিল। তাহার মধ্যে বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে-উপদ্রবের লক্ষ্যটা বিশেষ রুপে ইংরেজদেরই প্রতি। তাহাদের শাস্তিও যথেষ্ট হইয়াছিল। প্রবাদ আছে-ইটটি মারিলেই পাটকেলটি খাইতে হয়, কিন্তু মূঢ়গণ (মুসলমান) ইটটি মারিয়া পাটকেলের অপেক্ষা অনেক শক্ত শক্ত জিনিস খাইয়াছিল।"(রবীন্দ্র রচনাবলী, ১০ খন্ড, ৪২৮ পৃষ্ঠা)।
ঐতিহাসিক ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদারকে তাই লিখতে হলো-“হিন্দু জাতীয়তা জ্ঞান বহু হিন্দু লেখকের চিত্তে বাসা বেঁধেছিল, যদিও স্বজ্ঞানে তাঁদের অনেকেই কখনই এর উপস্থিতি স্বীকার করবে না। এর প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হচ্ছে, ভারতের রবীন্দ্রনাথ যাঁর পৃথিবীখ্যাত আন্তর্জাতিক মানবিকতাকে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে কিছুতেই সুসংগত করা যায় না। তবুও বাস্তব সত্য এই যে, তার কবিতাসমূহ শুধুমাত্র শিখ, রাজপুত ও মারাঠাকুলের বীরবৃন্দের গৌরব ও মাহাত্ম্যেই অনুপ্রাণিত হয়েছে, কোনও মুসলিম বীরের মহিমা কীর্তনে তিনি কখনও একচ্ছত্রও লেখেননি। যদিও তাদের অসংখ্যই ভারতে আবির্ভূত হয়েছেন।”(সূত্রঃ Dr. Romesh Chandra Majumder, History of Bengal, p-203.)

পাঁচ।
কয়েক পুরুষ ধরে প্রজাদের উপর পীড়ন চালিয়েছেন জোড়াসাকোর ঠাকুর পরিবার। রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর ব্যতিক্রম ছিলেন না। "১৮৯৪ সনে রবীন্দ্রনাথ চাষীদের খাজনা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, খাজনা আদায়ও করেছিলেন [তথ্যসূত্র: শচীন্দ্র অধিকারি, শিলাইদহ ও রবীন্দ্রনাথ পৃঃ-১৮, ১১৭]।"
সব জমিদারা খাজনা আদায় করত একবার, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এলাকার কৃষকদের থেকে খাজনা আদায় করত দুইবার। একবার জমির খাজনা দ্বিতীয় বার কালী পূজার সময় চাদার নামে খাজনা। (তথ্যসূত্র: ইতিহাসের নিরিখে রবীন্দ্র-নজরুল চরিত, লেখক সরকার শাহাবুদ্দীন আহমেদ)।
কর বৃদ্ধি করে বল প্রয়োগে খাজনা আদায়ের ফলে প্রজাবিদ্রোহ ঘটলে তা তিনি সাফল্যের সঙ্গে দমন করেন।
"শোষক রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে শিলাইদহের ইসলাইল মোল্লার নেতৃত্বে দু’শঘর প্রজা বিদ্রোহ করেন। [তথ্যসূত্র: অমিতাভ চৌধুরী, জমিদার রবীন্দ্রনাথ, দেশ শারদীয়া, ১৩৮২।]"
কবিতায় তো মানবতার কথা বলেছেন খুব সবলে। কিন্তু জীবনাচারে যিনি এমন, তিনি কেমন মানবতাবাদী?

ছয়।
"মরহুম মোতাহার হোসেন চৌধুরী শান্তি নিকেতনে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আপনার লেখায় ইসলাম ও বিশ্বনবী সম্পর্কে কোনো কথা লেখা নেই কেন? উত্তরে কবি বলেছিলেন, ‘কোরআন পড়তে শুরু করেছিলুম কিন্তু বেশিদূর এগুতে পারিনি আর তোমাদের রসুলের জীবন চরিতও ভালো লাগেনি।[তথ্যসূত্র: বিতণ্ডা, লেখক সৈয়দ মুজিবুল্লা, পৃ-২২৯]"।
অবাক হই, যখন কোনো কোনো মুসলিম রবীন্দ্রচর্চাকে ইবাদত বলে ঘোষণা করেন !

সাত।
রবীন্দ্রনাথ বর্ণবাদী নন এমনকি হিন্দুত্ববাদী নন, তা প্রমাণ করার জন্য ব্রাম্মধর্মকে হাতিয়ার বানানো হয়, ভুলে যাওয়া হয়, ব্রাম্মধর্ম হিন্দুত্ববাদেরই এক শাখা।রবীন্দ্রনাথের বাবা দেবেন্দ্রনাথকে বলা হয় ব্রাহ্ম সমাজের প্রচারক ও দার্শনিক (উইকি দেখুন) অথচ ইতিহাস কি বলে!
"পুরো পরিবারকে দুর্গা পূজার ব্যবস্থা করে দিয়ে নিজে একটু আড়লে থাকতেন এই আরকি। (তথ্যসূত্র: বসন্তকুমার চট্টপাধ্যায়ের লেখা জ্যোতিন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি, ১৯২০ পৃষ্ঠা:-৩৬)।
নিজে ব্রাহ্ম দাবি করলেও বাবার শ্রাদ্ধ হিন্দু পদ্ধতিতেই করেছেন দেবেন্দ্রনাথ। ব্রাহ্মদের মধ্যে পৈতা ত্যাগ করা জরুরী ছিলো, অথচ রবীন্দ্রনাথকে অনুষ্ঠান করে পৈতা দেওয়া হয়েছিলো। (তথ্যসূত্র: এ এক অন্য ইতিহাস, লেখক: গোলাম আহমদ মর্তুজা)।
শুধু তাই না, ব্রাহ্ম সমাজে জাতিভেদ নিষিদ্ধ। অথচ রবীন্দ্রনাথের পৈতা পরার অনুষ্ঠানে রাজনারায়ণ বসু নামক এক ব্যক্তিকে শূদ্র বলে অপমানিত করে বের করে দেওয়া হয়। (তথ্যসূত্র: রাজনারায়ন বসুর লেখা আত্মচরিত, পৃ:-১৯৯)
বর্নবাদ ও হিন্দুত্বে যিনি মজ্জমান, তার পিছে আমাদের সংস্কৃতিকে হাকিয়ে নেয়ার আগে পরিণতি ভেবে নেয়া উচিত নয় কি মুসলমান?

আট।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ইংরেজি লেখার কারিগর ছিলো সি. এফ অ্যানড্রুজ । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একজন প্রধান সহযোগী ছিল মি. অ্যানড্রুজ। রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর যার নাম দিয়েছিলেন ‘দীনবন্ধু’। (তথ্যসূত্র: আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ-অখণ্ড সংস্করণ, দ্বিতীয়খণ্ড, কলকাতা, পৃষ্ঠা-১০৮)।
এই রবীন্দ্রনাথই ড.ডেভিসের মধ্যস্থতায় এন্ডারসনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ‘চার অধ্যায়’লেখেন। শুধু তাই নয়, ‘ঘরে বাইরে’ও তাকে টাকা দিয়ে লেখানো হয়।”(তথ্যসূত্র: দৈনিক বাংলাবাজারে প্রকাশিত ড.আহমদ শরীফের সাক্ষাৎকার, তারিখঃ ০১/০৫/১৯৯৭ইং)।
"কালীপ্রসন্ন বিদ্যাবিশারদ তার 'মিঠেকড়া'তে পরিষ্কার বলেই দিয়েছিলেন যে, রবীন্দ্রনাথ মোটেই লিখতে জানতেন না, স্রেফ টাকার জোরে ওর লেখার আদর হয়। পাঁচকড়ি বাবু একথাও বহুবার স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথের প্রায় যাবতীয় সৃষ্টিই নকল। বিদেশ থেকে ঋণ স্বীকার না করে অপহরণ। (তথ্যসূত্র: জ্যোতির্ময় রবি ও কালোমেঘের দল, লেখক: সুজিত কুমার সেনগুপ্ত, পৃ-১১১)।)
এ বক্তব্যের সাথে একমত নই রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩ সালে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিল গীতাঞ্জলির জন্য নয়, বরং গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ 'Osong Offerings'-এর জন্য। রবীন্দ্র হলো বাংলা ভাষী, ইংরেজিতে কবিতা লিখে নোবেল প্রাইজ পাওয়াটা তার মতো ব্যক্তির পক্ষে একদমই অসম্ভব। কিন্তু এই অসম্ভবটাই সম্ভব হয়েছিল, কারণ পর্দার আড়ালে থেকে কলম ধরেছিল সি. এফ. অ্যানড্রুজ। ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরেজি অনুবাদ কিন্তু বাংলা থেকে হুবহু অনুবাদ ছিল না, বরং তা ছিল ভাবানুবাদ। সেই ইংরেজি অনুবাদের ভাব সম্পূর্ণ মিলে গিয়েছিল খ্রিস্টানদের বাইবেল ও তাদের ধর্মীয় সাধকদের রচনার সাথে। যে প্রসঙ্গে গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদের ভূমিকার লেখক, কবি ইয়েটস বলেছিলেন- ‘Yet we are not moved because of its strangeness, but because we have met our own image’ অর্থাৎ ‘গীতাঞ্জলি’র ভাব ও ভাষার সাথে পশ্চিমাদের নিজস্ব মনোজগতে লালিত খ্রিস্টীয় ভাবধারা সম্পূর্ণ মিলে গিয়েছিল। ইয়েটস তার বক্তব্যের যৌক্তিকতা তুলে ধরতে সেন্ট বার্নার্ড, টমাস-এ- কেম্পিস ও সেন্ট জন অফ দি ক্রসের সাথে ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরেজি অনুবাদের মিল উল্লেখ করেছিলেন। অন্যান্য পশ্চিমা সাহিত্য সমালোচকরাও ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরেজি অনুবাদের ২৬নং কবিতা ও ইংরেজি বাইবেলের Songs of Solomon – এর ৫: ২-৬ নম্বর শ্লোক, তাছাড়া সেন্ট ফ্রান্সিসের রচিত খ্রিস্টীয় গান Canticle এবং ইংরেজি গীতাঞ্জলির ৮৬নং কবিতা এই দুটো পাশাপাশি রেখে তাদের মিল দেখিয়েছেন। (তথ্যসূত্র: আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ-১ম খণ্ড,পৃষ্ঠা-১৪৫)।
ভাগ্য রবী ঠাকুরের! ইংরেজী অনুবাদটি রবীন্ড্রোজের নবসৃষ্টি হলেও নোবেল পেয়েছেন শুধু রবীন্দ্রনাথ, এতে আমরা বেজার হবার কে ?

দর্শনশাস্ত্রে একটি কথা প্রচলিত আছে যে, ‘‘সব কিছুকেই সন্দেহ করা যায়, কিন্তু সন্দেহকে কখনো সন্দেহ করা যায় না। কোন না কোন এক জায়গায় আমাদের থামতে হবে”। আর সেটাই হলো আমাদের ‘স্টপিং পয়েন্ট’।
এটা বলা ভুল হবে না যে রবীন্দ্রনাথের কালো দিক নিয়ে লেখার তেমন সনির্বন্ধ কারণ নেই যেমনটি আছে রাজনৈতিক/ধর্মীয় নেতার ক্ষেত্রে। রবীন্দ্রনাথ তো একজন শিল্পী মাত্র। এবং একজন উদার ও সার্বজনীন শিল্পী। তাঁর ভক্তরা যদি তাঁকে ত্রুটিমুক্ত কোন মহামানব মনেও করে তাতেও খুব বিরাট কোন ক্ষতি বা ঝুঁকি নেই সাধারণ মানুষের। তাঁর নামে তো সন্ত্রাস করতে পারবে না কেউ। তার ছবি দেয়ালে টাঙ্গান বাধ্যতামূলক করা, বা তাঁকে কবিগুরু না বললে দন্ডণীয় অপরাধ বলে আইন জারী করা এগুলির কোনটাই হবে না, রবীন্দ্রভক্ত কেঊ ক্ষমতায় আসলেও। এটা রাজনৈতিক বা ধর্মীয় নেতার ক্ষেত্রেই সম্ভব । কারণ রাজনৈতিক বা ধর্মীয় নেতা ও তাদের অনুসারীদের উদ্দেশ্যই হল মানুষকে ডগমা ভিত্তিক আইনের আওতায় এনে একত্রিত করে নিয়ন্ত্রণ করে তাদের নিজেদের আর্থিক বা সামাজিক স্বার্থ হাসিল করা। রাজনৈতিক বা ধর্মীয় নেতার সমালোচনার জন্য তাদের অনুসারীদের যেরকম অসহনশীল সহিংস্র হুমকি প্রদর্শন দেখা যায় (এবং বাস্তবেও তা ঘটা) সেটা রবীন্দ্র ভক্তদের কাছ থেকে আশা বা ভয় করার নেই। কেবল রবীন্দ্র ভক্তদের মোহ ভাঙ্গানই যদি লেখার কারণ হয়ে থাকে তাহলে লেখাতে এতটা সনির্বন্ধ বা urgent সুর বা উত্তেজনার ভাব থাকাটা অনাবশ্যক। এটা অবশ্য আমার ব্যক্তিগত মত।
তাই লেখার শেষ প্রান্তে বলব, সমালোচনা নয় বরং আমাদের সৃষ্টিশীল মনের শুদ্ধতা দিয়ে রবীন্দ্র-নজরুলের চর্চা চাই। নিজের জ্ঞান এবং আত্মাকে জানার সমুদ্রে নিমজ্জিত করি। মেঘ যেমন সূর্যের আলোকে ঢেকে রাখতে পারে না তেমনি যতদিন বাঙালি ও বাঙালির মনে সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা থাকবে ততদিন রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকবেন। তাই সকল বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে আজ এই মুহূর্ত থেকে এই জ্ঞান সাগরে আমরা সাঁতার কাটতে থাকি। হয়তো একদিন সাগরের মোহনা খুজে পাবে আমাদের নিদ্রিত মন। পরিশেষে সবার উদ্দেশ্য রবীবাবুর কবিতা:-
তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা,
এ সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা।।
যেথা আমি যাই নাকো তুমি প্রকাশিত থাকো,
আকুল নয়নজলে ঢালো গো কিরণধারা।।
তব মুখ সদা মনে জাগিতেছে সংগোপনে,
তিলক অন্তর হলে না হেরি কুল-কিনারা।
কখনো বিপথে যদি ভ্রমিতে চাহে এ হৃদি
অমনি ও মুখ হেরি শরমে সে হয় সারা।।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:০৮
১২টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

হামাস বিজয় উৎসব শুরু করেছে, ইসরায়েল বলছে, "না"

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:০৮



গতকাল অবধি হামাস যুদ্ধবিরতী মেনে নেয়নি; আজ সকালে রাফাতে কয়েকটা বোমা পড়েছে ও মানুষ উত্তর পশ্চিম দিকে পালাচ্ছে। আজকে , জেরুসালেম সময় সন্ধ্যা ৮:০০টার দিকে হামাস ঘোষণা করেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ২:৩১


আশেপাশের কেউই টের পাইনি
খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে ।

প্রথমবার যখন খুন হলাম
সেই কি কষ্ট!
সেই কষ্ট একবারের জন্যও ভুলতে পারিনি এখনো।

ছয় বছর বয়সে মহল্লায় চড়ুইভাতি খেলতে গিয়ে প্রায় দ্বিগুন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×