somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দ্বিচারিণী একজন....... [দ্বিতীয়]

১৫ ই আগস্ট, ২০০৯ সকাল ১০:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঘুম ভেঙে চোখ খুলেই দেখলাম বিছানার সাথের জানালাটার পাশে রাখা ছবির স্ট্যান্ডটায় পর্দার ফাঁক দিয়ে সকালের নরম আলো এসে পড়ছে। বেশ কদিন পর সূর্যের দেখা মিলল আজ। দেখেই মনটা ভালো হয়ে গেলো। বেড সাইড টেবিলের ড্রয়ার থেকে বালা দুটো আর বিয়ের আংটি টা বের করে পরলাম, মন ভালো একটা অনুভূতি নিয়ে শুরু হল আমার আজকের দিনটি।

ওনার জন্যে গার্লিক ব্রেড টোস্টে এ দিলাম কিচেন এ গিয়ে সেই সাথে গরম করলাম এক বাটি বেক্ড বীন্স। নিজের জন্যে করলাম ধোঁয়া ওঠা গরম এক মগ কফি। এক টুকরো গার্লিক ব্রেড ছিঁড়ে মুখে দিয়ে কফির মগটা নিয়ে চলে এলাম নিজের পড়ার টেবিলটায়। পড়ার এই যায়গাটা একান্তই আমার নিজস্ব যায়গা। আমি এখানে থাকলে উনি খুব একটা বিরক্তও করতে আসেন না। যদিও উনি কখনোই আমাকে বিরক্ত করতে আসেন বললেই ভুল বলা হবে।
মনে হল ওঘরে যেন খুট খাট আওয়াজ হচ্ছে কোন? উনি বোধহয় উঠলেন। ওনার নাস্তার সবকিছু ঠিকমতো টেবিলে দেয়া হয়েছে কিনা এটা একবার ভেবে নিয়ে আমি মনোযোগ দিলাম নিজের কাজে। খুব দ্রুত হাতে কিছু জিনিষ টুকে নিচ্ছিলাম একটা নোট বুকে।
বেশ কয়েকটা বই খুঁজতে হবে আমাকে,, দেখি সময় পেলে লাইব্রেরীটা একটু ঢু মারবো আজকে ক্লাস শেষে। শহরেও যেতে হবে একবার।
লিখতে লিখতে নিজের চিন্তায় কখন যে ডুবে গিয়েছিলাম টেরই পাইনি। হঠাৎই বোধ ফিরল।
মনে হল নাহ্‌ দেরি হয়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালাম, ভাবলাম, এখুনি বাড়ি থেকে না বেরোতে পারলে ভার্সিটিতে গিয়ে তোমার গোমড়া মুখ দেখতে হবে। তুমি যে কেন ভোর বেলা ক্লাস নিতে গেলে তা তুমিই জানো! আটটার মধ্যে ক্যাম্পাসে না থাকলেই তোমার মুখ কালো হয়ে যায়। নাহ্‌ তুমিটা একদমই যাচ্ছেতাই স্বেচ্ছাচারী।
কিন্তু তোমার ঐ শান্ত চাহনিটাই,,,

থমকে গেলাম আমি... কি ভাবছি এগুলো?

আমিতো... আমিতো আমার চেনা শহর আর তুমি থেকে হাজারো মাইল দূরে আজ।
কতকাল হল তোমায় ছেড়ে এসেছি, কতকাল হল নিজেকে ছেড়ে এসেছি, সে কতকাল হল.....।
ভেতরটা আমার হুহু করে উঠলো। আমি আবার
বসে পরলাম।

মনে আছে প্রায় বছর চারেক আগে যখন দুজনে একই ডিপার্টমেন্টে পড়তাম তখন ভোর বেলা ক্লাস করা নিয়ে তোমার সাথে খুব লাগতো আমার। তুমি বলতে ঘুম ঘুম চোখে ক্যাম্পাসে এসে আমায় দেখাতেই তোমার আনন্দ। আমাকে ঘিরে কতো তুচ্ছ ব্যাপারেও যে তুমি আনন্দ পেতে আমি এখনো ভেবে অবাক হই!
ভাবতে ভাবতে কেমন যেন অস্থির হয়ে গেলাম আমি। সেই কতবছর আগেকার কথা অথচ এখনো আমার মনে হয় তুমি অপেক্ষা করে আছো আমার জন্যে। এখনো চার বছর পুরনো আমিটা আমার সামনে এসে দাড়ায় আমার অজান্তেই। নিজেকে খুব অসহায় লাগতে থাকে আমার।

মনের ভেতর থমথমে একটা ভাব নিয়েই বাড়ি থেকে বের হলাম। বরের সাথে ঠিকমতো কথা বলতেও যেন ভুলে গেলাম। দুপুরে ক্লাস শেষে যখন শহর এর জন্যে রওনা হলাম বাসে। ওনার ফোন এলো।

- আমিতো রওনা হয়ে গেছি।

এই উত্তরে উনি যেন কিছুটা অবাক হলেন, হয়তো ভাবলেন গাড়িতে করে নামিয়ে দিতে চাইলেও কেন আমি কিছু না জানিয়েই রওনা হয়ে গেলাম। তাড়াহুড়া করে অগোছালো একটা জবাব দিয়ে ফোনটা কেটে দিলাম। আসলে কিছুই ভালো লাগছে না। বারবারই মনে পরে যাচ্ছে সকালের ঘটনাটা।
গত তিনটা বছর ধরেই আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি নিজেকে তোমার থেকে আলাদা করতে। চেষ্টা করছি পেছনে ফেলে আসা অতীত থেকে নিজেকে নিয়ে আসতে আজকের বর্তমানে। নিজের সাথে এই যুদ্ধে আমি ক্লান্ত। তবুও তোমার স্মৃতি থেকে নিজেকে এতটুকুন ও আলাদা করতে পারি না। ভেতরে ভেতরে আমি জানি এ ভীষণ অন্যায়। যে জীবন আমি বেছে নিয়েছি তা নিয়েছি নিজের ইচ্ছাতেই। সেখানে তোমার অবস্থান থাকা কোনভাবেই উচিত নয়।

বাইরে ভীষণ ঠাণ্ডা আজ। শীতের এই দুপুরটা ও কেমন ধোয়াটে অন্ধকার হয়ে আছে। সকালের মিষ্টি রোদটা কোথায় উধাও হয়ে গেছে যেন এখন। বাসের ভেতর হিটার অন করা থাকলেও বাইরের শীতলতা আমার ভেতরকে ছুঁয়ে রয়েছে।
আমি গলার স্কার্ফটা হাত দিয়ে আরো একটু উঁচু করে নিজেকে ডুবিয়ে দিলাম পুরনো দিনগুলিতে। চোখ বন্ধ করতেই সামনে এক এক করে ভেসে উঠলো ফেলে আসা কষ্টের ছবিগুলো।

তখন আমি আমার বরের রেস্টুরেন্টে কাজ করি পার্ট টাইমার হিসেবে। সারাদিন ক্লাস করে এসে সন্ধ্যে থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত বারে দাড়িয়ে ড্রিঙ্ক সার্ভ করি।
কালো জিনসের সাথে সাদা শার্ট পরে বারের পেছনটায় দাঁড়াতাম। টেবিলগুলো থেকে একের পর এক অর্ডার আসতো আর আমি বিভিন্ন সাইজের গ্লাসে সাজিয়ে দিতাম নানান রকম সোনালি তরল। মাঝে মাঝে গ্লাসের সেই সোনালি ঝিকিমিকির মধ্য দিয়ে হঠাৎ চোখে পড়তো টেবিল গুলোয় বসে থাকা ছেলেমেয়েগুলোর খুনসুটি, আমার তখন মনে হতো তোমার কথা। মনে পরে যেত রোকেয়া হলের সামনে দাড়িয়ে তোমার ডাবের শাস খাওয়া নিয়ে পাগলামি করা কিংবা ঝুম বৃষ্টিতে সংসদের পেছন থেকে কারণ ছাড়াই বিশাল তোড়া গন্ধরাজ বেশি দামে কিনে আমায় দেয়ার সময় তোমার গজগজ করতে থাকা আবার নিজেই হেসে ফেলা। অজান্তেই চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়তো মুক্তোর কণা।
তবু ঐ সময় বারের কাজটা আমার ভালোই লাগতো। কাজের পুরোটা সময় বেশ হইচই এর মধ্যে থাকা যেত। আর তাছাড়া সেই সময়টায় ঐ কাজটাই ছিল আমার একমাত্র সম্বল। দিনের বেলায় ক্লাস করতে হত বলে কোথাও কাজ করার কথা ভাবতাম না। আর এই দেশের নিয়ম অনুযায়ী সন্ধ্যায় সব দোকান পাট বন্ধ হয়ে যায় তাই চাইলেও রেস্টুরেন্ট ছাড়া সন্ধ্যায় অন্য কোথাও কাজ করার উপায় ও ছিলোনা তখন। স্কলারশিপ এর কারণে ইউনিভার্সিটির ফী দিতে না হলেও বেঁচে থাকার জন্যে তখন একটা কাজের খুব দরকার ছিল আমার।
আচ্ছা তোমার মনে আছে, একমুঠো বেলি আমার হাতে দিয়ে বলেছিলে
তোমাকে আমার বাসরে নিমন্ত্রণ।
আমি কিন্তু তখন বুঝতেও পারিনি যে তুমি কোন প্ল্যান করেছ। হটাৎই ফোন করে বললে যেন দু ঘণ্টার মধ্যে দেখা করি।
ভাবলাম, তোমার কত যে পাগলামি। কার্জন হলের লাল ইটে হেলান দিয়ে যখন মিটি মিটি হাসছিলে তখনো বুঝিনি ব্যাপারটা। পকেটের কয়েকটা পাঁচশ টাকার নোট দেখিয়ে যখন বললে, সব মিলিয়ে এই ই আছে। বিয়ে করতে চাই যাবা কিনা বল?
তখনও কিন্তু আমি তোমার পাগলামিই ভেবেছিলাম। সাথে সাথেই হেসে হ্যাঁ ও বলেছিলাম।
সেদিনই আমরা বিয়ে করলাম।

কাজী অফিসে যখন সিগনেচার করার জন্যে খাতাটা আমার দিকে এগিয়ে দেয়া হল, কাঁপছিলাম আমি।
কাজী সাহেব স্নেহ মাখা সুরে বলেছিলেন, "মাগো আল্লাহর নাম নিয়ে লিখেন, ইনশাল্লাহ উনি সব ঠিক করে দিবেন"। ঐ সময়টায় ভয়ের সাথে সাথে কি প্রচণ্ড আনন্দ ও যে হচ্ছিল আমার তা আমি তোমাকে কখনোই জানাতে পারিনি।
জানাতে পারিনি, কাজী অফিস থেকে বের হয়ে রাস্তায় যখন হাঁটছিলাম দুজন তখন খুব ইচ্ছে করছিলো তোমায় বলতে ভালোবাসি।
অন্য যে কোনো সময় হলে হয়তো এক মুহূর্তেই বলে ফেলতাম কিন্তু সেদিনটা খুব বেশিই অন্যরকম ছিল। তুমি আমার এতো কাছে ছিলে তবু তোমায় দেখতেও লজ্জা লাগছিলো আমার। ভাবছিলাম তোমায় কি বলবো। এই তোমায় কি বলা যায়।

তুমিই প্রথম বললে। বললে, নতুন বউ দাড়াওতো একটা রিক্সা ঠিক করি, তোমাকে নিয়ে আজকে রিক্সা ভ্রমণ করবো।
আমি দেখছিলাম। দেখছিলাম সাইন্স ল্যাব এর ঐ পুলিশ বক্সটার সামনে দাড়িয়ে খুব খুশি খুশি গলায় তুমি কোন এক রিক্সা ওয়ালাকে কিছু বলছ।
তখনই তোমার একটা ফোন আসলো। তুমি ফোন কানে ঠেকিয়ে কথা বলতে বলতেই আমার দিকে তাকিয়ে দুষ্টুমির হাসি দিচ্ছিলে। আমি তাকিয়েই ছিলাম।
কি যেন একটা ভাবছিলাম আমি। তোমার পাঞ্জাবির কথা ভাবছিলাম বোধহয়। ঐ সবুজ ডোরা পাঞ্জাবিতে তোমায় এতো সুন্দর কেন লাগছে তাই ভাবছিলাম আমি।
কি যেন একটা হল হঠাৎ। আমি আবছা চোখে দেখলাম তুমি খুব মনোযোগ দিয়ে ফোনে কথা বলেই যাচ্ছ আর রাস্তার মাঝখান থেকে একটা ট্রাক বিচ্ছিরি ভাবে তোমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমি চিৎকার করে তোমায় বলতে চাইলাম কিছু একটা, কিন্তু তার আগেই তুমি,,,,,,,,,,

- ক্যান আই সি ইওর ওয়েস্টার কার্ড প্লিজ?
বাসের টিকেট চেকার।
আমি চমকে উঠলাম। চোখ খুলে অবাক চোখে তাকালাম লোকটার দিকে।








ক্রমশ......।









সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মার্চ, ২০১২ বিকাল ৪:২৭
৩৯টি মন্তব্য ২১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মানুষের জন্য নিয়ম নয়, নিয়মের জন্য মানুষ?

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৪৭



কুমিল্লা থেকে বাসযোগে (রূপান্তর পরিবহণ) ঢাকায় আসছিলাম। সাইনবোর্ড এলাকায় আসার পর ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি আটকালেন। ঘটনা কী জানতে চাইলে বললেন, আপনাদের অন্য গাড়িতে তুলে দেওয়া হবে। আপনারা নামুন।

এটা তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

একটা গাছ কাঠ হলো, কার কী তাতে আসে গেলো!

লিখেছেন নয়ন বড়ুয়া, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:০৬



ছবিঃ একটি ফেসবুক পেইজ থেকে

একটা গাছ আমাকে যতটা আগলে রাখতে চাই, ভালো রাখতে চাই, আমি ততটা সেই গাছের জন্য কিছুই করতে পারিনা...
তাকে কেউ হত্যা করতে চাইলে বাঁধাও দিতে পারিনা...
অথচ... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। কালবৈশাখী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:২৪



গত পরশু এমনটি ঘটেছিল , আজও ঘটলো । ৩৮ / ৩৯ সে, গরমে পুড়ে বিকেলে হটাৎ কালবৈশাখী রুদ্র বেশে হানা দিল । খুশি হলাম বেদম । রূপনগর... ...বাকিটুকু পড়ুন

একজন খাঁটি ব্যবসায়ী ও তার গ্রাহক ভিক্ষুকের গল্প!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৪


ভারতের রাজস্থানী ও মাড়ওয়ার সম্প্রদায়ের লোকজনকে মূলত মাড়ওয়ারি বলে আমরা জানি। এরা মূলত ভারতবর্ষের সবচাইতে সফল ব্যবসায়িক সম্প্রদায়- মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ীরা ঐতিহাসিকভাবে অভ্যাসগতভাবে পরিযায়ী। বাংলাদেশ-ভারত নেপাল পাকিস্তান থেকে শুরু করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×