আজ থেকে ৬ বছর আগে ২০০৩ সালের এই সময়ে (২৬ শে জুন), প্রচন্ড ব্রৃষ্টি হচ্ছিলো। চট্টগ্রাম শহরের আনেক রাস্তা পানিতে সয়লাব। সগরিকা রোডের কাছেই এক হোটেলে দুপুরের খাবার জন্য রিক্সা থেকে নেমে এলো একটি ছেলে। ফুটপাথের নিচের নালায় প্রচন্ড গতিতে পানি বয়ে যাচ্ছে। আনেক জায়গাতে পানির জন্য কোনটা ড্রেন কোনটা রাস্তা/ফুটপাথ বোঝা মুশকিল। ফুটপাথ পার হতে গিয়ে ছেলেটি এরকম একটি নালায় পা দিয়ে ফেলেছিলো। মুহুর্তের মধ্যেই দূরন্ত গতির পানি তাকে আপন করে নিলো .........................
এভাবেই আমাদের ছেড়ে চলে গেলো এনামুল আজিম রানা, আমার অত্যন্ত প্রিয় এক বন্ধু; কায়কোবাদ স্যারের মতে যে হতে পারতো আরেকজন রামানুজন
এনাম এর সাথে পরিচয় স্কুল জীবন থেকে। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে একই সেকশনে পড়তাম আমরা। আমাদের সাথে কখনো ফুটবল ক্রিকেট খেলতে আসত না সে, বরং তার আকর্ষন ছিলো ভিডিয়ো গেইমস-এ। টিফিন পিরিয়ডে প্রায়-ই চলে যেত স্কুলের পাশেই ভিডিয়ো গেইমস-এর দোকানে। আনেক সময় দেরি করে আসায় শাস্তি পেত স্যারদের কাছে। ওই সময় পর্যন্ত এনামকে এরকম-ই জানতাম।
ক্লাস এইট পর্যন্ত লেখাপড়াতে তেমন নজরে না আসলেও নাইন এ উঠার সময় ফাস্ট হয়ে আমাদের সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। তার পর থেকেই আমরা আবিস্কার করলাম ওর গণিত প্রতিভা। ও সেই সময়ে গণিতের এমন আনেক বিষয় নিয়ে কথা বলতো যেগুলোর মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারতাম না। তবে ওকে আমরা যারা ভাল জানতাম, তারা মনে করতাম আমাদের আনেক গণিত স্যারকে ও পড়াতে পারবে। ক্লাস নাইন-টেন-টেস্ট পরিক্ষায় ফাস্ট হয়েও ও SSC তে অল্পের জন্য stand করতে না পারাটা আমাদের কাছে অদ্ভুত লেগেছিল (সেই বার আমাদের স্কুল থেকে science থেকে মাত্র ২ জন stand করেছিল )।
SSC পরিক্ষার পর আনেক বার ওদের বাসায় গিয়েছিলাম। ও তখন ধর্ম আর দর্শন নিয়ে লেখাপড়া করছিলো। ওই বয়সে এই সংক্রান্ত এত এত বই দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। সেই সময়ে ও কার থেকে যেন একটা Programmable Calculator পেয়েছিলো। তাই দিয়ে একটা গেইম এর প্রোগ্রাম করে আমাকে অবাক করে দিয়েছিল।
কলেজ লাইফ এ আলাদা হয়ে গেলেও মাঝে মাঝে ওদের বাসায় যেতাম। তখন দেখেছিলাম গণিতের প্রতি ওর তীব্র আকর্ষন। ওকে মাঝে মাঝে বলতাম, "এইসবে এত সময় দিলে বইয়ের পড়া কবে করবি? " ও হাসতো আর বলতো "এত পড়তে হয় না, পরীক্ষার আগে কয়দিন পড়লেই হবে।"
বুয়েট ভর্তি পরীক্ষার দিন হল থেকে বের হয়েই ওর সাথে দেখা। ও এমন একটা প্রশ্ন নিয়ে আলাপ করছিলো যেট ছিলো সবচেয়ে সহজ। দুই-তিন লাইনেই যেটা হয়ে যায়; আর ও বলছিলো ওর জায়গায় (বুয়েট ভর্তি পরীক্ষায় প্রতিটা প্রশ্নের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা দেয়া থাকে) পোষায় নাই !!! আমি ওকে সমাধান বলে দিতেই ও হাসতে হাসতে বলল এতো সহজ সমাধান যে করতে পারে নাই সে কিভাবে বুয়েটে চান্স পাবে!!! সে ঠিক-ই চান্স পায় এবং তা প্রথম দিকেই।
বুয়েটে ভর্তির পর ওর সাথে দেখা সাক্ষাত খুব কম হোত। সে মাত্র দুইবার আমার রুমে এসেছিল। আমিও খুব কম যেতাম। বুয়েটে ভর্তির বেশ কিছুদিন পর ওর সাথে দেখা, জিজ্ঞাস করলাম কম্পিউটার কিনেছে কিনা? সে বলে ২ বছর না কিনলেও হবে ...... এই সময় যা শিখাবে তা তার মাথাতেই আছে। আমিও অবলিলায় তা বিশ্বাস করলাম। কারন এইটা এনাম। তার রুমে দেখতাম তার ঘুমানোর জায়গা ছাড়া সব জায়গাতে শুধু বই আর বই। বেশীর ভাগ-ই ইংরেজী ..... সাইন্স ফিকশন থেকে শুরু করে গণিত, ধর্ম ইত্যাদি। বই পড়ার নেশার সাথে সিনেমা দেখার-ও নেশা ছিল, বিশেষ করে বাংলা সিনেমা। সবসময় হাসি খুশী দেখতাম ........ তবে পরীক্ষার সময় মনে হোত কিছুই খেয়াল করতো না। কোন এক টার্ম ফাইনালের সময় একদিন ক্যান্টিনে ওর পাশে বসেই খেলাম, আরেক বন্ধুর সাথে গল্প ও করছিলাম, কিন্তু ওর কোন হূস নাই, গভীর ভাবে কি যেন চিন্তা করছে.................
রূঢ় বাস্তবতা হচ্ছে ও আজ আমাদের মাঝে নেই। এই সব কিছুই আজকে স্ম্রৃতি। ওর মোটা চশমা, হাসি মাখা মুখ, গভীর চিন্তার চেহারা মাঝে মাঝেই মনকে নাড়া দিয়ে যায়। আমি প্রার্থনা করি এনাম কে আল্লাহ বেহেস্ত নসিব করুক। ওকে কবরের আযাব থেকে রক্ষা করুক।
ওর অনেক কাজের কথা আমি শুনেছি, আশা করি সেগুলো আলোর মুখ দেখবে।
এনাম এর বড় ভাই, সহব্লগার শ্রদ্ধেয় পারভেজ ভাই কে এই ব্যাপারে সর্বাত্মক সহায়তা করার ইচ্ছা রাখি।
এনাম কে নিয়ে কায়কোবাদ স্যারের লেখা - পারভেজ ভাই এর ব্লগ থেকে
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুন, ২০০৯ ভোর ৫:৩৬