somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রিক্তের বেদন

০৭ ই আগস্ট, ২০১৬ দুপুর ২:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

২১শে ডিসেম্বর। রাত ৯ টার মত বাজে।
লেগুনার পেছনে দাঁড়িয়ে আছি – আর ছুটছি। অদ্ভুত একটা বাতাস – শরীরের সবকিছু যেন ধুয়ে নিয়ে যাচ্ছে। রাতের এই সময়ে শ্যামলী-টেকনিক্যালের রাস্তাটা অনেক নির্জন থাকে। বেশ লাগে একা একা ঘুরতে। যেমন আজকে লাগছে । একটা ঘোর লাগা আবছা বিষন্ন অনুভূতি- মনকে অবশ করে রাখে সবসময়। ভাল লাগে।
শত-সহস্র অগোছালো চিন্তাকে আরেকটু উস্কে দিতেই যেন লেগুনা থেকে নেমে পড়লাম – একটু হাঁটি । বাসায় পরেও যাওয়া যাবে । মিরপুর-১ এর ঘিঞ্জি মার্কেটগুলোর সামনে এসে দাঁড়ালাম – দুরে একটু নিরিবিলি । শান্ত । যেন অনেক অনেক পিছিয়ে আছে সময়ের দৌড়ে । গুটি কয়েক নিয়ন লাইট, রাস্তার হলুদ-কমলা আলোর সাথে মিশে গেছে ছোপ ছোপ হয়ে । দূরের সেই আবছা কমলা আলোগুলো চোখে এসে পড়ে হারিয়ে যাওয়া পুরোনো ভালবাসার মত – আবছা, ম্রিয়মান । কিন্তু জ্বলছে- ধিকিধিকি জ্বলছে । এর থেকে মনে হয় কোন “মানুষের” মুক্তি নেই ।
জ্বলন্ত কমলা আগুনে যখন পুড়ছিলাম, তখন হুট করেই এক দেবদূত হাজির হল । মেয়ে দেবদূত । আচ্ছা, দেবদূতের স্ত্রীলিঙ্গ কি? দেবীদূত? উহু । এতে যার দূত সে স্ত্রী হল, কিন্তু দূত তো দূতই আছে । তাহলে ? “দেবদূতি” ? নাকি “দেবদুদু” ? হুম... শেষেরটায় একটা মেয়ে মেয়ে ভাব আছে । নাহ, শুধু ভাব না। শব্দটা প্রকটভাবে নারীকেন্দ্রিক । কিন্তু এটার মানে তো দাঁড়ালো “দেবতার দুদু” । আহ… হচ্ছে না। আবার সেই দেবতার উপরই পড়ল সবকিছু । আর দেবতার তো মনে হয় সেভাবে দুদুও থাকে না । ফালতু একটা শব্দ । তারচেয়ে “দেবদূত” উভলিঙ্গই থাক ।
যা বলছিলাম- দেবদূত । আমি এর আগে কখনো দেবদূত দেখিনি । অন্য কিছুকে দেবদূত মনে করে ক্ষণিকের ভ্রম হয়েছিল । কিন্তু সত্যিকারের দেবদূত?? উহু । নেভার। খুব শান্তভাবে সে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো । শুভ্র ডানাজোড়া গুটিয়ে একটা সিগারেটে কড়া এক টান দিলো ।
“দেবদূতে বিড়ি খায় ??” আমি তো পুরাই টাস্কি । তবে সামনে নিলাম । ডিজিটাল যুগে হতাশা এখন সর্বত্র । হয়ত আসমানেও তাই… যাই হোক, দেবদূত আমার একদম পাশে এসে দাঁড়ালো । দূরের ওই কমলারঙ্গা কুয়াশার দিকে তাকিয়ে বলল- “চলবে?”
“নাহ। ছেড়ে দিয়েছি”
একটা প্যাকম্যান হাসি হেসে সে আবার ঠোঁটের মাঝে রাখল সিগারেটটা । তারপর একটা লম্বা টান দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলো ফিল্টারটাকে । বেচারা ফিল্টার । যতক্ষণ তার সামনে তামাক থাকে – মানুষ তাকে মুখে ঢুকিয়ে, চুষে-টেনে-ভিজিয়ে একেবারে অস্থিররর অবস্থা । সেই ভালবাসা তখন ফিল্টারের প্রতি । কিন্তু যখনি তামাক শেষ- যেন প্রতিযোগিতা চলতে থাকে কে কত বেশী অবজ্ঞা নিয়ে সেটাকে ছুড়ে ফেলে দিতে পারে…
হিহিহি । নারীবাদীরা চাইলে তাদের শ্লোগানে এটাকে ইউজ করতে পারে ।
“বস ঠিকই বলছে- ইউ আর গুড” ।
আমি চমকে উঠলাম – “মানে?”
“মানে তোমার চিন্তা ভাবনা- ভালই । চলে”
“চললেই হবে । আমার কোন তাড়া নেই” বলে একটা চোখ টিপ দিলাম আমি ।
“ওহ… নো । সিরিয়াসলি সিয়াম? শেষ পর্যন্ত দেবদূতের সাথেও ফ্লার্ট করতেছো ?”
আমি এবার পুরাই লজ্জা পেয়ে গেলাম । শিট । এটা কোন কাজ করলাম আমি ? কি বলব বুঝতে না পেরে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকলাম – “সরি”
“আমার দিকে তাকাও”- দেবদূত এখন আমার একদম সামনে – খুব কাছাকাছি । যতটা কাছে দুটো ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে ঢাকার রাস্তায় মানুষ ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে- তার থেকেও বেশী কাছে । কিন্তু আজকে কেন জানি কেউ তাকাচ্ছে না – ঘটনা কি ? মানুষ এত ভাল হল কবে?
আমি ভাল করে বেদদূতকে দেখতে থাকলাম- খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে । মসৃণ রেশমের মত চুল, লাল পুরু ঠোট, হাল্কা খয়েরি রঙের চামড়া ... একদম পারফেক্ট । আমি লোভে পড়ে গেলাম । একটু ইতস্তত করে চোখ নিচের দিকে নিয়ে গেলাম এবং বুঝতে পারলাম দেবদূতের শেষ যে স্ত্রীলিঙ্গটা মাথায় এসেছিল- সেটাই আসলে পারফেক্ট । আমি নেশায় বুদ হয়ে গেলাম । জীবনে এত সুন্দর কিছু আমি দেখিনি ।
“দেখেছো?”
“হুম”
“কোন কমেন্ট?”
আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে সোজাসুজি বললাম- “সুন্দর । সবথেকে সুন্দর”
“সবথেকে?” আবারো সেই প্যাকম্যান হাসি ।
“হুম ।”
দেবদূত হাসতেই থাকলো । আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম- “তুমি কেন এসেছো আমার কাছে?”
“জানতে এসেছি তুমি কি চাও”
“আমি তোমাকে চাই- সারা জীবন থাকতে চাই তোমার কাছে, প্রত্যেকটা মুহুর্ত”
“কিন্তু মানুষ আর দেবদূত তো বিয়ে করা যায় না”
“কতটুকু করা যায়?”
“বাকি সবকিছু”
“আমি করতে চাই- যতটুকু সম্ভব”
হাহাহাহা… খিলখিল করে হেসে উঠলো দেবদূত । এত মধুর শব্দ আর শুনিনি আমি ।
“পুরো কোশ্চেন না পড়েই উত্তর লিখছো? ভুল হলে?”
আমি জিজ্ঞাসু চোখ নিয়ে তার চোখের দিকে তাকালাম । সে এগিয়ে এসে আমার হাত ধরল । বলল- “আমাকে ধর”
“মানে?” আমার হার্টবিট তখন মোটামুটি ৫০০ হবে…
“আরে, আমাকে জড়িয়ে ধর । গিভ মি এ হাগ”
আমি আশপাশে তাকালাম- অস্বস্থি নিয়ে ।
“ভয় নেই, আমাদেরকে আর কেউ দেখতে পারবে না”
হুট করে মনে হল জীবনে যা চেয়েছিলাম- তা আমি পেয়ে গেছি । লাইফের সবথেকে বড় ফ্যান্টাসি- আমরা সবাই দেখি । কিন্তু কখনো পুরন হবে- কেউ আশা করি না । আমি অবাক হয়ে চারদিকে একবার চোখ বুলালাম। তারপর ধরলাম- জাপটে ধরলাম শরীরের সাথে । লেপ্টে গেলাম তার শরীরের প্রতিটি বাঁকে । আহ… এর থেকে সুখ আর হতে পারে না – ফর শিওর ।
.
.
দেবদূত তার পাখা মেলল । হ্যাঁচকা টানে আমাকে নিয়ে সে সাঁই করে উঠে গেল সোজা আকাশের দিকে। ঘটনার ধাক্কায় আমার মোহ ভেঙ্গে গেল । দেবদূতদের ওড়া আমি অন্যরকম কল্পনা করেছিলাম । আচ্ছা, কল্পনা বাদই দিলাম । পাখার অ্যারোডাইনামিক্সই তো এটার জন্য সুইটেবল না – এরকম ডানা নিয়ে রকেটের মত কিভাবে উড়ে মানুষ?
“আমি তো আর মানুষ না” – দেবদূত নিচের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল ।
আমিও নিচের দিকে তাকালাম- ঢাকার আকাশে ভেসে ভেসে আমি আমার চিরচেনা রাস্তাগুলোকে দেখতে থাকলাম নতুনভাবে - একদম অচেনাভাবে – অচেনা একটা দৃষ্টিতে।
“আমি আরো নীচে যাব- আর শোনো, এরকম রকেটের মত না- পাখির মত”
দেবদূত আমার দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসির সাথে চোখ টিপে বলল- “তোমার ইচ্ছাই আমার আদেশ…”
এসবের মানে কি?? সে করলে কোন সমস্যা নাই?? শুধু আমি করলেই দোষ? রাগ লাগলো একটু...
.
.
আমরা নিচে নামছি- পাখির মত- ডাইভ দিয়ে- ধীরে ধীরে । ঠান্ডা বাতাসের বুলিয়ে দেয়া আরামে আমি একদম নিস্তেজ হয়ে গেলাম । দেবদূত আমাকে তার আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করে দিলো- শুধু একটা হাত আলতো করে ধরে রাখলো সে । আমি ভাসছি- আমি নিজেই এখন ভাসছি, উড়ছি …
বাতাসে উপুর হয়ে আমি দু চোখ ভরে ঢাকাকে দেখতে থাকলাম । অনুভব করতে থাকলাম একে আমার সারা শরীর দিয়ে -
একদম নতুন এক অনুভূতি যা আমি কোনদিন পাইনি। সম্ভবত কেউই কোনদিন পায়নি। হঠাৎ আমার সারা মাথা পরিষ্কার হয়ে গেল – আমি আর কিছু চিন্তা করছি না – শুধু উপভোগ করছি- এই মুহুর্তটাকে ।
ধানমন্ডি লেক পার হয়ে আমরা চলে গেলাম জিগাতলার দিকে । বাস স্ট্যান্ডে বিশাল একটা জটলা । কিন্তু আমি একই সাথে সবাইকে দেখতে পাচ্ছি আলাদা আলাদা করে- শুনতে পাচ্ছি তাদের সব কথা, চিন্তা । ভেতরের দিকে গেলাম- নির্জন কিছু রাস্তা – দুটো বিল্ডিঙ্গের মাঝের একটা অন্ধকার সরু রাস্তায় দু জন মানুষ ছিনতাই করে পালাচ্ছে। ঠিক সেই সময়েই পাশের রাস্তায় এক যুগল আশপাশে তাকিয়ে ছোট্ট করে চুমু খেল। তাদের পাশের বিল্ডিঙ্গে এক তরুনী সেই মুহুর্তে ফোনে উত্তপ্ত কথাবার্তায় ব্যস্ত। তার ছোট বোন তার কোন অভিজ্ঞ বান্ধবীকে আই পিলের দাম জিজ্ঞেস করছে ফোনে। বাবা মা বসে আছে ড্রয়িং রুমে- চিন্তিত। ছোট ছেলের রেজাল্ট দিয়েছে- ভবিষ্যৎ অন্ধকার… আর ছোট ছেলে? সে পড়ে আছে পর্নসাইটে।
একই সময়ে একই যায়গায় থাকা কিছু মানুষ । কিন্তু কত আলাদা তাদের জীবন, তাদের ভেতরের জগৎটা । কত কাছে থেকেও কত দূরে । প্রতিটি জানালার ভেতরে আলাদা আলাদা কিছু গল্প – সবগুলোই সমান মূল্যবান । ঠিক যেমন আমার কাছে আমারটা । কিন্তু এর কয়টাই বা আমরা দেখি? জানি ?
হুট করে খুব উদাস লাগছে আমার । সুখী উদাস । আমি দেবদূতের দিকে তাকালাম- “তুমি কখনো টাকিলা খেয়েছো?”
দেবদূত একটা স্নিগ্ধ হাসি দিলো আমার দিকে তাকিয়ে । কিছু না বলে নিচের দিকে তাকাতে ইঙ্গিত করল । আমি তাকালাম- আমার নীচে বিশাল এক মরুভুমি । মরুভুমির মাঝের একটা মাত্র রাস্তা । সেই রাস্তা ধরে উড়ে যাচ্ছি আমরা সামনের দিকে- সামনে কি আছে দেখা যাচ্ছে না । কিন্তু ওখানকার আকাশে লাল রঙ । আমি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকলাম সামনের দিকে। অপেক্ষা করতে থাকলাম সেই রঙ্গিন সাইনবোর্ডের জন্য – যাকে সারাজীবন শুধু মুভিতেই দেখে এসেছি ।
রংচঙ্গে অদ্ভুত একটা জগৎ । দামী দামী গাড়ি, চকচকে জামাকাপড় পড়া মানুষজন । ছেলেরা সারা শরীর ঢেকে রেখেছে আর মেয়েরা যতটা সম্ভব উল্টা । অন্যসময় এটা নিয়ে আমার মাথাব্যাথা থাকলেও আজ নেই- আজ কিছুতেই কিছু নেই । আজ শুধু আনন্দ । আর রোমাঞ্চ ।
.
.
.
“এটা ভেগাসের সবথেকে দামী বার”- দেবদূত বলল ।
“আমি একা যাব না”
“তোমাকে আমি একা যেতেও দেব না, সোনা”
হিহি… দেবদূতের চোখের দিকে তাকিয়ে আমি আমাদের মাঝের সব পার্থক্য ভুলে গেলাম। পার্কিং লটে দাঁড়িয়ে একটু আগে আমরা ঠিক করেছি আজকের বাকি রাত আমরা কাটাবো একদম মানুষের মত- যাদেরকে চোখে দেখা যায় এবং অবশ্যই যাদের কোন ডানা থাকে না । আমাকে অবাক করে দিয়ে নিমিষে দেবদূত তার ডানাজোড়া ভ্যানিশ করে দিয়েছিল । তারপর আমার কনুই জড়িয়ে ধরে মানুষের মত হেঁটেছিল আবছা আলোর মধ্যে ।
আমরা বারে ঢুকলাম । মাতাল হলাম, নাচলাম, চুমু খেলাম। তারপর গলা ধরাধরি করে রাস্তায় বের হয়ে আসলাম । আমি কখনো আগে খোলা রাস্তায় কাউকে চুমু খাইনি, মাতাল হইনি, নগ্ন মানুষকে দেখিনি – আজ সব হল । সময়ের সব রস আমরা নিংরে নিংরে পান করতে থাকলাম । সারা রাত আমরা কাটালাম রাস্তায় খুনসুটি করে, মাতলামি করে, থিম পার্কের মাতাল করা রাইডে চড়ে আর উম্মত্ত প্রেম করে ।
.
পরের ১ মাস আমরা সারা পৃথিবী চষে বেড়ালাম । বৃষ্টির অ্যামাজন, ঝড়ের মরুভুমি, উত্তাল সমুদ্র, মাছখেকো সাদা ভাল্লুক- আমাকে সবকিছু দেখালো এই দেবদূত । জীবনকে আমি নতুনভাবে দেখলাম, পেলাম এমন এক জীবনের খোঁজ যেখানে আনন্দ, উত্তেজনা, রোমাঞ্চ- এসব চির আরোদ্ধ্য জিনিস যেন জাস্ট জীবনেরই প্রতিশব্দ । আর এ জীবনে দেবদূত আমার একমাত্র বন্ধু, আমার সবকিছুর সাথী ।
দেবদূত এখন আর আমার কাছে স্বর্গের অপ্সরী না- সে আমার প্রেয়সী । জীবনের সবথেকে বড় আনন্দ আমি তার কাছে পেয়েছি । অবশ্য তার এই অপ্সরী থেকে প্রেয়সী হওয়ায় অনেক কিছু বদলে গেছে হুট করে । তার শরীরের রঙ, গড়ন, বিভিন্ন অংশের ও অঙ্গের আকার-আকৃতি যা দেখে আমি লোভে পড়েছিলাম প্রথম দিন- সবই এখন অনেক বেশী পার্থীব...অনেকটা সাধারণ । কিন্তু সে আমার কাছে এখন আগের থেকে আরো অনেক বেশী সুন্দর, মোহনীয় ও মূল্যবান । সে পাশে থাকলে এখন আর আমার হার্টবিট বেড়ে ৫০০ হয় না, কিন্তু আমি স্নিগ্ধ একটা আনন্দ পাই। তার চোখের দিকে তাকালে আমি আড়ষ্ট হই না- কিন্তু আমার বুক ধরফর করে- কোমল একটা ছন্দে কেঁপে ওঠে সবকিছু ...
আমি ভালবাসি – প্রচন্ড ভালবাসি এই ডনাকাটা পরীকে, আমার এই বন্ধুকে ...
.
.
সকালে উঠে আনমনে ভাবছিলাম গত এক মাসের কথা –হাত বুলাচ্ছিলাম বুকে এঁকে থাকা গতরাতের ভালবাসার চিহ্নগুলোতে। দেবদূত আমার পাশে নেই- আমি তার গোসলের শব্দ শুনতে পাচ্ছি... জাইলোফোনের মত রিনরিনে কিছু শব্দ...
দেবদূত বের হল । তার সদ্যসিক্ত মসৃণ শরীরের দিকে আমি তাকিয়ে থাকলাম ঘুম জড়ানো এক আড়ষ্ট ভালোবাসা নিয়ে। “তাড়াতাড়ি ওঠো- একখানে যেতে হবে” মোলায়েম অনিন্দ্য সুন্দর দেহটাকে ঢাকতে ঢাকতে সে বলল.. আমি উঠলাম । নিজের কম্বলে ঢাকা শরীরের উষ্ণতা দিয়ে তাকে আবদ্ধ করলাম নিজের সাথে, আলতো করে চুমু খেলাম তার ঘাড়ে।
.
গোসল করে বের হয়ে দেখি চারদিক অন্ধকার । “আল্লাহ... রাত হল কিভাবে?”
“কারন শুরুটাও রাতে হয়েছিল” – আমার পাশ থেকে বলে উঠলো শ্বেতশুভ্র ডানাওলা এক নারী। আমি চমকে উঠলাম । ভয় পেলাম কোন অজানা আশংকায় । “তুমি?? এভাবে ? ” আমি আর কিছু বলার পেলাম না... খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে থাকলাম তার সবকিছু । ধবধবে সাদা শরীর, সাদা জামা, সাদা চুল, সাদা ডানা... শুভ্রতা যেন ঠিকরে বের হচ্ছে তার শরীর থেকে। এমন এক শরীর থেকে যা আমার সম্পুর্ন অজানা, অচেনা । বাঁকহীন নির্জলা এক শরীর। যাকে তার পবিত্রতার ঔজ্জ্বলে শুধু সমীহ করা যায়, শ্রদ্ধা করা যায়, ভয় পাওয়া যায়, কিন্তু ভালাবাসা যায় না...
“হ্যা, আজকে এভাবেই। কেন? এখন আর ভালবাসতে পারবে না?”
আমি তার দিকে এগিয়ে গেলাম। গালের উপর পড়ে থাকা শুভ্র চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে চুমু খেলাম তার ঠোঁটে, উষ্ণ ভালবাসায় নিভিয়ে দিলাম তার উগ্র পবিত্রতাকে, এঁকে দিলাম এক পঙ্কিল কুসুম...
সে হাসল । হাসলাম আমিও । সুখ পেলাম ।
চল... আমার হাত ধরে সে হেঁটে গেল বারান্দার দিকে, উড়ে গেল পাখির মত- সাথে আমি।
আজ আর আমি নিচের দিকে তাকালাম না- তাকিয়ে থাকলাম এই অতিমানবীর দিকে- তার নতুন শরীরের দিকে । নির্লাজ শুভ্রতা আমার ভালবাসাকে কমাতে পারেনি, কমাতে পারেনি কামনাকে। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকলাম আমার এই নতুন প্রেয়সীকে... নতুন ?? নাহ... ভুল বললাম- সেই পুরনো প্রেয়সীকেই দেখতে থাকলাম নতুন এক মোড়কে। ভাবতে থাকলাম তাকে নিয়েই – যাকে আমি চিনি, ভালবাসতে থাকলাম তাকেই- যাকে আমি বাসতাম...
.
.
আমরা থামলাম। সোজা হয়ে দাঁড়ালাম বাতাসে ভর দিয়ে, হাতে হাত রেখে, চোখে চোখ রেখে। পায়ের সামান্য কিছুদূর নিচে একটা ছোট পাহাড়ের চুড়া । পাথুড়ে পাহাড়। কোন ঘাস- লতাপাতা নেই। আশপাশের ১০০ কিলোমিটারে বোধহয় আমরাই একমাত্র জীবিত প্রাণী। চাঁদের লজ্জাভরা আলোতে চারিদিকে শুধু একটাই রঙ- ধুসর। কোনটা হাল্কা, কোনটা গাড়। এ যেন গ্রে স্কেলে কনভার্ট করা কোন ছবির জগৎ। বিষন্ন, মৃত একটা সৌন্দর্যে মন নিভু নিভু হয়ে থাকে কোন এক অজানা আবেগে। সেই শুন্যতাঘেরা আবেগের সাথে আজ মিশে গেছে কোমল এক করুণ ভালবাসা । ধুসর পাথরের বাটিতে কিছু জমে থাকা কিছু পানি- লাজুক চাঁদটাকে দেখিয়ে দিচ্ছে তার প্রকৃত সৌন্দর্য। দূরে কিছু লম্বা গাছ। ডাল-পাতা নড়ছে মিহি বাতাসে। আমি শুনতে পাচ্ছি তার খসখস আওয়াজ... বছরের পর বছর ধরে চলছে এই শব্দ- নিরবধি। আমি কখনো শুনিনি। কখনো বুঝিনি এর স্বাদ। কখনো বুঝবো না পাতা হয়ে এই মিহি বাতাসে ঝুলতে থাকার সুখ, নিজের প্রেয়সীর শরীরে শরীর ঘষে খসখস শব্দ তৈরী করার নির্মল আনন্দ, তীব্র এক অসহ্য আবেগে আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে । এই মুহুর্তটিকে সারা জীবন হাতড়ে বেড়ানোর চেয়ে মরে যাওয়া ভাল। জীবন নামক অনিবার্য দন্ডটাকে শেষ করার জন্য এর থেকে সুন্দর মুহুর্ত আর হতে পারে না...
“তুমি আমার একটা অনুরোধ রাখবে?” আমি হাহাকার ভরা অবাক চোখে তার নরম গালে আঙ্গুল বুলাতে থাকলাম...
“বল...”
“আমাকে পিষে গুড়ো করে ফেল। তারপর জোড়ে এক ফুঁ দিয়ে সেই গুড়োগুলো ছড়িয়ে দাও চারদিকে- আমি মিশে যাই... প্লীজ... আমি মিশে যেতে চাই এর সাথে, এই পাথরের সাথে, ওই গাছের সাথে, শব্দ করা পাতার সাথে... থাকতে চাই অনন্তকাল- এদের অংশ হয়ে... প্লীজ...”
আমার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া পানি বাতাসে ভর করে সরে গেল বেশকিছুদূর- মিশে গেল পাহাড়ের সাথে।
আমিও চাই মিশে যেতে- হতে চাই এক বিন্দু তরলের ফোঁটা, এক গুচ্ছ বালি...
“আমারও প্রতিবার তাই মনে হয় – যখন এখানে আসি”। দেবদূত আমার মুখটা তার দুহাতের কোটরে করে কাছে নিয়ে গেল, চুমু খেল আমার কপালে, চোখে...
“কিন্তু তা হয়না, আমরা পারি না... কখনো মিশে যেতে পারি না, পালাতে পারি না এই আমৃত্যু শূন্যতা থেকে। জীবনের দৌড়ে আমরা সবাই দন্ডপ্রাপ্ত। জানি না কোন অজানা পাপে...”
আমি কাঁদতে থাকলাম । কাঁদতে থাকলাম হু হু করে... তার হাত দুটো শক্ত করে ধরে চুমু খেলাম। আস্ফালন করে শেষ মুহুর্তের নিষ্ফল অনুনয় জানালাম - “প্লীজ আমাকে ছেড়ে যেও না...”
সে মৃদু হেসে আমার চুলে হাত বুলালো। “তুমি পারবে। সবাই একসময় পারে...”
আমার দম আটকে আসছিল। দমকে দমকে কান্নার মাঝে শ্বাস নেয়ার চেষ্টা করছিলাম... “সব মুছে দিতে পারবে না?”
“পারবো।”
“তবে এখনই সব মুছে দাও- আমি সবকিছু ভুলে যাতে চাই- স...ব কিছু”
“তাই? ভেবে বল। আসলেই তাই চাও”
আমি ভাবলাম। চোখের সামনে দিয়ে বয়ে গেল গত ত্রিশ দিনের প্রত্যেকটা মুহুর্ত। কে বলে সময়ের গতি স্থির? দুই সেকেন্ডের মাঝে আমি ঘুরে এলাম আমার গোটা এক মাসের অতীত থেকে। অনুভব করলাম সবকিছু- নির্জন বনের বৃষ্টি, নির্জন সাগরে নির্লিপ্ত তিমির নৃত্য, মরুভূমির আকাশ কেটে যাবার সময় মুখে লাগা শীতল বাতাসের স্পর্শ আর উদ্দাম কিছু যৌনতা...
ভুলে যাব?
তবে বাঁচবো কি নিয়ে?
দন্ডিত আসামীর কাছে স্মৃতিই তো সব...
আমি নিজেকে সামলে নিলাম। মুখ তুলে তাকালাম ওর আনত মুখের দিকে।
“ভাল থেকো সিয়াম” শেষবারের মত জড়িয়ে ধরল সে আমাকে। আমার ঘুম পেল । অবশ হয়ে আসলো সারা শরীর। ঢলে পড়লাম ওই অতিমানবীর কোলে। এক মুহুর্তের জন্য আমাকে ধরে রাখল সে। তারপর উড়ে চলে গেল- ধীরে ধীরে- শান্ত ভঙ্গিতে- পাখির মত...
আর আমি পড়তে থাকলাম নিচের দিকে। আর আধবোজা চোখে তাকিয়ে থাকলাম তার দিকে- অনেকক্ষণ... একসময় আর ধরে রাখতে পারলাম না চোখের পাতাকে... ভাবতে পারলাম না কিছু...
শুধু পড়ছি... অনেক্ষণ ধরে পড়ছি আর অনুভব করছি মুক্তভাবে পড়ন্ত কোন বস্তুর অনুভুতি... এরপর হঠাৎ এক মুহুর্তের একটা ঘুম।
.
.
পতনের তীব্র একটা অনুভুতি থেকে ধরফর করে উঠে ঘুম ভাংলো। বুক ধরফর করছে। কিছুক্ষন লাগলো ধাতস্থ হতে। ফুটপাথের মানুষজন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। সেই ফুটপাথ- যেখানে দাঁড়িয়ে দেখা হয়েছিল দেবদূতের সাথে, সেই ফুটপাথ যেখানে আমি তাকে প্রথম জড়িয়ে ধরেছলাম, উড়ে গিয়েছিলাম তার হাত ধরে...
সব মনে পড়লো আমার। স...ব। মোবাইলে সময় দেখলাম- রাত ৯ টার মত বাজে। ২১শে ডিসেম্বর।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই আগস্ট, ২০১৬ দুপুর ২:৩৩
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×