somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কুবরা

০৬ ই আগস্ট, ২০১৬ রাত ১২:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

খানিক আগে বারান্দায় বসিয়া চা পান করিতে করিতে; আর আকাশের দিকে চাহিয়া তারকারাজির গতিবিধি অবলোকন করিতে করিতে, আমার চেতনা হইলো অনেক দিন তাহাকে নিয়ে ভাবি না। তাই ইচ্ছে করিলো ভাবিতে বসি, ঘরের ভিতর গ্রামোফোন খানায় রবি ঠাকুরের “আমি বহু বাসনায়” বাজিতেছে। আমার মনে তাহাকে নিয়ে এতকাল পরে যে ভাবনার উদয় হইতেছে তাহা কাগজে লিখিয়া ফেলা ব্যঞ্জক মনে হইল। তাই বসিয়া পড়িলাম লিখিতে।
আমার বয়স তখন কুড়ির ঘরে, লেখালেখি শুরু করিয়াছি কিছুকাল হয়েছে। পেটের দায়ে গ্রাম ছাড়িয়া শহরে আসিতে হইয়াছে। গ্রামে বসিয়া লেখালেখি করিলে পেটে দানা পড়েনা। এই ইট পাথরের গোলকধাধায় আসিয়া আমি বেকুব হওয়ার সামিল। দূর সম্পর্কের এক ভাই এই শহরে বাস করেন। পত্রযোগে তাহাকে আমার আসিবার কথা জানাইয়াছি। তিনি তাহার বাড়িতে উঠিতে অনুমতি দিয়াছেন বটে, কিন্তু তাহার ঠিকানা খুজিয়া পাইতে আমার বেশ বেগ পাইতে হইয়াছে। ভাইজান একখানা ছাপাখানায় মুদ্রাক্ষরিক হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি তাহার পরিচিত লোকের সহিত আমার যোগাযোগ করাইয়া প্রুফরিডারের একখানা চাকরি জুটাইয়া দিলেন। চাকরি পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যে ভাইজান আমাকে ডাকিয়া কহিলেন তিনি তাহার স্ত্রীকে গ্রাম হইতে লইয়া আসিবেন তাই আমাকে বসবাসের নতুন ব্যবস্থা করিতে হইবে। আমিও লাগিয়া পড়িলাম বাসা খুজিতে। ইট পাথরের গোলকধাধা হইলেও বসবাসের স্থানের কোন অভাব নাই। তবে শর্ত প্রচুর। এত শর্ত মানিয়াও হাজার হাজার মানুষ এইখানে বাস করিতে প্রতিদিন আসিয়া হাজির হয়, চিন্তা করিয়া আমার অবাক লাগে। আমিও তাহাদের থেকে কিছুমাত্র ব্যতিক্রম নই। অনেক খুজিয়া একটা বাসা পাইলাম। চিলেকোঠার বাসা। বাসায় শুধু একটা রুম, আমার জন্য যথেষ্ট। পরদিনই উঠিয়া পড়িলাম। আট ঘণ্টা করিয়া সপ্তাহে ছয়দিন অফিস করি। অফিস শেষ করিয়া আমি তাতক্ষনাত বাসার রাস্তায় পা বাড়াই না। আমার অফিসের চারপাশে বহু চা দোকান আছে সেইখানে অনেক লেখক আড্ডা দেন। তাহাদিগের সহিত আড্ডা মারিয়া একেবারে রাতের খাবার সারিয়া গৃহে প্রবেশ করি। এতে অনেক সময় মধ্যরাত হইয়া যায়। একদিন এর ব্যতিক্রম হইলো, অফিসের বড় সাহেব কি কারণে যেন সকলকে সকাল সকাল ছুটি দিয়া দিলেন, এই মুহুর্তে মনে পড়িতেছে না কেন ছুটি দিয়াছিলেন। সেইদিন তখনো আড্ডা বসে নাই, তাই বিলম্ব না করিয়া গৃহে ফিরিয়া আসিলাম। আমি যদি জানিতাম সেদিন আমার সহিত কি খেল চলিতেছে তবে আমি সেইদিন অফিস না যাইয়া সারাবেলা আমার গৃহের সামনের খোলা ছাদে কাটাইয়া দিতাম। গৃহে আসিয়া আমি কাপড় চোপড় ছাড়িয়া গোসল করিলাম। গোসল শেষ করিয়া ভেজা কাপড়চোপড় শুকাইতে দিতে গিয়া আমার নজর পড়িলো পাশের বাড়ির ছাদে। আমি তাহাকে দেখিলাম, কাপড় শুকাইতে দিচ্ছে, দড়ি একটু উচুতে হওয়াতে নিজের হাত দুখানা উচু করিয়া কাপড় বালাইয়া দিতেছে। তাহার পরনে শাড়ি, মাথার চুল খোপা বাধা। কাপড় শুকাইতে দেওয়া শেষ হইলে সে ছাদের কিনারে অর্ধউত্তোলিত দেয়ালে হাতে ভর দিয়া দাড়াইয়া নিচের রাস্তার দিকে চাহিলো। এমন সময় সে কি মনে করিয়া আমার ছাদের দিকে তাকাইলো। আমার মনের মধ্যে তাহাকে প্রথম দেখার অনুভুতি এখনো এমন করিয়া গাথিয়া রহিয়াছে যেনো আমি তাহাকে গতকাল দেখিয়াছি। আমার মনে আছে সে আমাকে তাহার দিকে তাকাইতে দেখিয়া চক্ষু দুখানা বড় বড় করিয়া ফেলিলো, আর কিছুক্ষণের মধ্যে সম্ভিত ফিরিয়া পাইয়া তাহার আঁচল খানা মাথার উপর টানিয়া দিয়া, ঠোটের ফাকে কিনার গুজিয়া দাঁত দিয়া চাপিয়া ধরিলো। এরপর নিচু হইয়া বালতি খানা লইয়া দৌড়াইয়া চলিয়া গেলো। আমি চাহিয়া থাকিলাম। সেদিনের পর কিছুদিন পার হইলো আমার আর তার দেখা হয় নাই। আমি সকালে অফিসে যাইতাম আর আড্ডা মারিয়া রাত করিয়া ফিরিতাম। আমার সপ্তাহিক ছুটির দিন। কি মনে করিয়া আমি আগে একদিন যেই সময়ে তাহার সাক্ষাত পাইয়াছিলাম সেই সময়ে ছাদের উপর পায়াচারি করিতে লাগিলাম। সময় কাটিয়া যায় সে আসেনা। আমি সেইদিন সারাবেলা ছাদে কাটাইয়া দিয়াছিলাম। পরদিন অফিস করিয়া আড্ডা না মারিয়া গৃহে ফিরিয়া আসিলাম। তাহার ছাদের দিকে তাকাইয়া দেখি কাপড় শুকাইতে দেয়া। একটু পরই সন্ধ্যা নামবে। আমি ছাদে দাড়াইয়া রইলাম। সে আসিলো, ঐদিন তাহাকে আমি দেখিলাম মিষ্টি নরম রোদে। তাহার বদন খানা দেখিয়া আমার এত প্রশান্তি অনুভব হইয়াছিল আমার মনে হইতেছিলো আমি কতকাল ক্ষুধার্ত আমাকে অন্ন দিয়া মাত্র আপ্যায়ন করা হইলো। সে আমাকে লক্ষ্য করিলো, কাপড়গুলো সব জোগাড় করিয়া সে বালতিতে রাখিলো। এরপর আমার দিকে তাকাইলো, আমার মনে হইলো আমার হৃদয় গলা দিয়া বাহিয়া মুখের ভিতর চলিয়া আসিয়াছে। আমি মুচকি হাসি দিলাম। সেও আমার দিকে চাহিয়া মুচকি হাসলো। আমি বুঝিলাম আমি প্রেমে পড়িয়াছি। আমি রোজ এই সময়ে অফিস থেকে আসিয়া তাহার অপেক্ষা করিতাম। সে মাঝেমধ্যে আসিতো মাঝেমধ্যে আসিতো না। কখনো কখনো সে এমনি এমনি ছাদে আসিতো। সেই দিন ছাদের কিনারের দেয়ালে হাতে ভর দিয়া দাড়াইয়া সে আসমানের দিকে তাকাইয়া থাকিতো। আমি তাহার দিকে তাকাইয়া থাকিতাম। যাওয়ার সময় সে আমার দিকে তাকাইয়া মুচকি হাসিতে ভুলিতো না। এইভাবে মাসখানেক কাটিয়া গেলো, আমি আড্ডা মারা বন্ধ করিয়া দেবার পর থেকে সন্ধ্যা বেলা লেখালেখি শুরু করিলাম। মাঝেমধ্যে রাতে বাহিরে যাইতাম খাবার খাইতে মাঝেমধ্যে মনে থাকিতো না, তখন পানি পান করিয়া রাত কাটাইতে হইতো। একদিন দাড়াইয়া আছি তাহার অপেক্ষায়, কিছুক্ষন পর সে আসিলো। তাহাকে অন্যরূপ সুন্দর লাগিতেছিল। মাথায় তেল দিয়া আঁচড়াইয়াছে কিন্তু খোপা বাধে নাই। মাথায় একটা ছোট টিপ, কানে ছোট দুল, শাড়ি খানা নীল রঙয়ের। মনে হইতেছিলো আসমানে পূর্ণিমা রূপে সে অবির্ভুত হইয়াছে আর তাহার স্নিগ্ধ আলো চতুর্দিক ছড়াইয়া পড়িতেছে। আজকে আমার ছাদের পাশে সে দাড়াইয়া আসমান দেখিতেছে, আমিও তাহার ছাদের পাশে। দুই ছাদের মধ্যে দূরত্ব মাত্র দুই হাত আর আমাদের মাঝে দূরত্ব আড়াই হাত। আসমানের দিকে তাকাইয়া সে বলিয়া উঠিলো, “আমাকে কেমন লাগিতেছে?”
আমি কহিলাম, “সুন্দর লাগিতেছে”
সে কহিল, “শুধু সুন্দর লাগিতেছে?”
আমি কহিলাম, “এর চেয়ে বেশি বলার অধিকার কি আমার আছে?”
সে এবার রাগিয়া গেলো, “কথাতো ভালোই পেচাইতে পারেন দেখিতেছি”
আমি কহিলাম, “রাগিয়া গেলে যে, আমি বুঝিয়া উঠিতে পারি নাই কি কহিবো তাই যা মুখ দিয়া যাহা আসিয়াছে তাহাই বলিয়াছি”।
সে আমার দিকে তাকাইয়া কহিলো, “তখন থেকে দেখিতেছি আমার দিকে আপনি হা করিয়া চাহিয়া রইয়াছেন, অথচ যখন জিজ্ঞাস করিলাম আর বলিতে পারিলেন না। আমি বিশ্বাস করিতে পারিতেছিনা”
আমি লজ্জা পাইয়া গেলাম, নিজেকে স্বাভাবিক রাখিয়া কহিলাম, “তোমার নাম কি?”
সে উত্তর দিলো, “কুবরা”
আমি কহিলাম, “কুবরা তোমাকে দেখিয়া আমার এতই সুন্দর লাগিয়াছে আমি ভাষা হারাইয়া ফেলিয়াছি”
সে কহিল, “সিনেমার ডায়ালোগতো ভালোই শিখিয়াছেন, আমি গেলাম, আপনি ভাষা খুজিয়া বাহির করেন”
সে হনহন করিয়া হাটিয়া চলিয়া গেলো। এরপর বেশ কিছুদিন কুবরার সাক্ষাত পাইলাম না। আমার ঐ কয়টা দিন কিছুমাত্র ভালো লাগিত না। আমি সারাদিন তাহার কথা ভাবিতাম। আমি জানিতাম আমি একটা মোহের মধ্যে পড়িয়া গিয়াছি। এই বয়সে তাহা স্বাভাবিকও বটে। একজন পুরুষ একজন নারীর সঙ্গ যেমন চাই একজন নারীও একজন পুরুষের সঙ্গ চায়। আমি এইটাও জানিতাম, এসব কেতাবি কথা। এসব কথা সবাই কম বেশি জানে। আমি আপনাকে বুঝাই আমার আরো সময়ের প্রয়োজন, প্রয়োজন তাহাকে গভীরভাবে বোঝা তাহার সম্পর্কে জানা, আমার প্রয়োজন তাহার সাথে কথা বলা। কিন্তু সাক্ষাত না হইলে কেমনে হইবে। একদিন হঠাত দেখি সে সাঝের বেলা দাঁড়িয়ে আছে আগের মতোই, চাহিয়া আছে আসমানের দিকে। আমিও দাড়াইলাম, তাহার দিকে চাহিয়া রইলাম। আমার ইচ্ছা হইতেছিলো তাহাকে জিজ্ঞেস করি এতকাল সে কোথায় ছিলো? আমাকে ছটফট করাইয়া সে কিরূপ আনন্দ লাভ করিয়াছে। আমি কিছুই কহিতে পারিলাম না। সে চলিয়া যাইতেছিলো, এমন সময় আমি উচু গলায় তাহাকে ডাকিয়া বসিলাম, “কুবরা...”
সে আমার দিকে ফিরিয়া কহিল, “কি?”
আমি কহিলাম, “কেমন আছো?”
সে কহিল, “আপনার লাভ কি শুনিয়া?”
আমি অনুতপ্ত অনুভব করিলাম। সে চলিয়া গেলো। আমি দাড়াইয়া থাকিলাম, কিছুকাল পর সে আবার আসিলো, তাহার হাত দুখানা পিছনে। আমার ছাদের কাছাকাছি আসিয়া সে কহিল, “এইটা আপনার জন্য খাইয়া বলিবেন কেমন হইয়াছে”
আমার দিকে একখানা টিনের বাটি বাড়াইয়া দিলো, আমি গ্রহণ করিলাম। সে তাতক্ষণাত দৌড়াইয়া চলিয়া গেল। আমি বাটি খানার ঢাকনা খুলিয়া দেখি তাহাতে খিচুড়ি। সে টিনের বাটির ভেতর ছোট একটা বাটিতে করে আমের আচারও দিয়াছে। মায়ের রাধা খিচুড়ির পর এই প্রথম আমি বাহিরে খিচুড়ি খাইয়া মজা পাইলাম। পরদিন আমি বাটি হাতে দাড়াইয়া থাকিলাম, সে আসিলো। আমি বাটি আগাইয়া দিয়া কহিলাম, “আজকে আরো এক বাটি দেওয়া যাইবে?”
কুবরা ঠোট উল্টাইয়া ভেংচি কাটিয়া কহিলো, “শখ কত তাহাকে আমি রাধিয়া খাওয়াই।”
আমি অবাক হওয়ার ভান করিয়া কহিলাম, “তুমি রাধিয়াছ?”
সে হাত বাড়াইয়া দিলো বাটিখানা লইবার জন্য। আমার হাতের আঙ্গুলে তাহার আঙ্গুল লাগিবার সাথে সাথে আমি বাটিখানা ছাড়িয়া দিলাম। বাটিখানা দুই দালানের মাঝের জায়গা দিয়া পড়িয়া গেলো। সে এবার রাগিয়া গেলো, “এইটা কি করিলেন?”
আমি কহিলাম, “ভুল হইয়া গেছে আমি আনিয়া দিতেছি”
সে কহিল, “যাহা ইচ্ছা করেন আমি জানিনা, আমি যাইলাম”
আমি আর কিছু না বলিয়া দৌড়াইয়া গেলাম কোন রকমে যুদ্ধ করিয়া বাটি নিয়া উপরে উঠিতে উঠিতে ভাবিতে লাগিলাম সেতো থাকিবে না। আমি বরং ধুয়ে মুছে আগামীকাল বাটি তাহাকে দিবো। ভাবিতে ভাবিতে কি মনে করিয়া ছাদে আসিয়া দেখি সে দাড়াইয়া আছে। অনেক সাহিত্যিক গল্পকার বলিয়াছেন যখন বিকেলের নরম রোদ ভালোবাসার নারীর গালে পড়ে তাহাকে মানুষ বলিয়া আর গণ্য হয় না। মনে হয় উহা অপ্সরি। আমার কাছে তাহাকে এখন অপ্সরী মনে হইতে লাগিলো। আমি কহিয়া উঠিলাম, “তুমি না চলিয়া যাও?”
সে একটু ইতস্তত করিয়া কহিলো, “আপনি একটা গর্ধব। কই আমার বাটি কই দিয়া দেন আমি লইয়া যাই”
আমি বাটি আগাইয়া দিলাম তাহার আঙ্গুল আবার আমার আঙ্গুল স্পর্শ করিলো। এইবার আমি আর ভড়কাইলাম না বাটি ঠিকঠাক মতই তাহার হাতে তুলিয়া দিলাম। আমার সারা শরীর জুড়িয়া তড়িত খেলিয়া গেলো যেনো। আমি সেইরাত্র নির্ঘুম পার করিলাম। আমার খাইতেও ইচ্ছে করিলো না। ভোর বেলা ফজরের আজানের সময় বাহির হইয়া বারান্দায় দাড়াইয়া থাকিলাম। আমি ভোরবেলা জাগিলেও কখনো সূর্যদোয় উপভোগ করি নাই। আজিকে দেখিলাম কিভাবে অন্ধকার দূরে ঠেলিয়া সূর্যালোক আলোকিত করিয়া তোলে চারিপাশ। অফিসে যাওয়ার সময় হইলে আমার ঘড়িখানা ডাকিয়া উঠিলো। আমি সম্ভিত ফিরিয়া পাইলাম। সেইদিন অফিসেও আমার কিছুমাত্র মন বসিলো না। আমি শুধু মাত্র তাহার কথা ভাবিতে লাগিলাম। আমি একটা বই প্রুফরিড করিতেছিলাম আমার মন বসিতেছিল না। কোন রকমে পড়িয়া যাইতে ছিলাম লাইনের পর লাইন। হঠাত করিয়া একটা লাইনে আমার চোখ আটকিয়া গেলো।

“ভালোবাসা আর মোহ দুটাই ভিন্ন জিনিস। তবে মোহ ছাড়া ভালোবাসা আসেনা। ভালোবাসিতে হইলে প্রথমে মোহে পড়িতে হয়। কিন্তু তুমি কখন বুঝিবে তোমার মোহ ভালোবাসায় রূপান্তর হইয়াছে? যখন দেখিবে তাহার ছোটখাটো খুটিনাটি বিষয় তোমার চোখে পড়িতেছে। তাহার ভালো দিকে তোমার ভালো লাগিতেছে একই সাথে তাহার মন্দ দিক তোমার কাছে মন্দ লাগিতেছে, কিন্তু তুমি তাহা গ্রহণ করিয়া লইতেছ। তুমি তাহার সত্যকার রূপে স্বিকার করিতেছ। তাহার ব্যাপারে আপনার নিকট সত্য কহিতেছ, তাহার নিকটও সত্য কহিতেছ। এমতাবস্থায় বুঝিয়া নিবে তোমার মোহ তাহার প্রতি ভালোবাসায় রূপ নিয়াছে। তুমি প্রেমিক হইয়া গেছ”।

আমি একাধিকবার লেখাটা পড়িলাম। মনে হইলো আমাকে উদ্দেশ্য করিয়া লেখিয়াছে। আমি বুঝিলাম আমি কুবরাকে ভালোবাসিয়া ফেলিয়াছি। আমি খুশি হইলাম এই ভাবিয়া যে আমি শুধু মাত্র মোহের আকর্ষণে তাহার প্রতি আবিষ্ট নই। সেদিনের অফিস খানা শেষ করিয়া বাড়ি ফিরিবার পথে আমার পুরোনো আড্ডার সঙ্গীরা আমাকে ডাকিয়া কহিলেন,“কি জনাব আজকাল আপনাকে এই তল্লাটে দেখিতে পাইনা ব্যাপার কি?”
আরেকজন শুধাইলো, “আরে মশাই বুঝিতে পারেন নাই তিনি বিবাহ করিয়া ফেলিয়াছেন, দাওয়াত দেওয়ার ভয়ে আমাদের জানান নাই”
আমি লজ্জায় পড়িয়া গেলাম। আমার কর্ণ রক্তবর্ণ ধারণ করিলো। আমি কহিলাম, “না মশাই আমাকে ভুল বুঝিতেছেন। আমি কিঞ্চিত ব্যস্ততার কারণে সময় দিতে পারিতেছিলাম না, আজকে আপনাদের সাথে বসিব গোটা পাচ কাপ চা পান করিব এরপর গৃহের দিকে পা বাড়াইবো”
আমি তাহাদের সহিত আড্ডা মারিতে বসিয়া গেলাম। সিগারেট, চা, দু একখানা বিস্কুট এভাবে সেদিন মধ্যরাত পর্যন্ত চলিল আড্ডা। আমি বেমালুম আমার সান্ধব প্রেমের কথা ভুলিয়া গেলাম। গৃহে ফিরিবার পথে আমার তাহার কথা মনে পড়িলো। আমার আপনার উপর রাগ অনুভব হইলো। সেদিন রাত্রিতেও আমার নিদ্রা আসিলো না, সারারাত তাহার কথা ভাবিলাম। কি করিয়া পারিলাম আমি এই ধরনের অন্যায় করিতে, আমি নিশ্চয় জানি সে আমার জন্য অপেক্ষা করিতেছিলো। আমার উপর রাগ করিতেছিলো। ভোরবেলা সূর্যোদয়ের পূর্বে আমি ফের গিয়া ছাদে দাড়াইলাম। গতদিনের ন্যায় আজিকেও আমার ঘড়িখানা অফিসের সময় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডাকিয়া উঠিলো। আমি আমার কক্ষের দিকে যাওয়ার জন্য ফিরিলাম। নূপুরের আওয়াজ পাইয়া আমার খেয়াল ভাঙ্গিলো আমি দেখিলাম সে ছাদে আসিয়াছে। তাহাকে দেখিতে দুর্গার মত লাগিতেছে। তাহার মুখ চাহিয়া বুঝা যাইতেছে সে রাগিয়া আছে, এইমুহুর্তে যদি একখানা ত্রিশূল থাকিত তবে গতকালের অপরাধের শাস্তি স্বরূপ সে আমার হৃদয় উহা দ্বারা এফোড় ওফোড় করিয়া দিত। তাহার চুল গুলো খোলা কিন্তু তাহা ছড়াইয়া আছে। শাড়ির আঁচল খানা পা অবধি ঝোলানো। আমি সাহস করিয়া কহিলাম, “কেমন আছো?”
রাগে তাহার শরীর কাপিতেছে তাহা আমি দশহাত দূরে দাড়াইয়া টের পাইতেছি। বহু লেখকের গ্রন্থে পড়িয়াছি ভালোবাসা অনেক দূর থেকে বোঝা যায়। আমি আজিকে তাহা অনুভব করিতেছি। সে আমার জবাব দিল এই কহিয়া, “আপনাকে আমার দেখিতে ইচ্ছা করিতেছে না। আপনি চলিয়া জান”
আমি কহিলাম, “রাগ করিতেছ কেন? আমার কাজ ছিল বলিয়া আমি দেরি করিয়া গৃহে ফিরিয়াছি”
সে কহিল, “আমি কিছুমাত্র জানিতে চাহি না আপনি কোথায় ছিলেন। সে জানিয়া আমার কর্ম কি?”
কথাখানা বলিয়া সে আকাশের দিকে চাহিয়া রহিল। আমি তাহার দিকে চাহিয়া রহিলাম। আমার ইচ্ছা করিতেছে না আজ তাহাকে ছাড়িয়া কোথাও যাই। এইভাবে সারাবেলা পার করিতে আমার কোন সমস্যা হইবে না। সে কিছুক্ষণ পর আমার দিকে তাকাইয়া কহিল, “আপনি বড়ই খারাপ লোক, আপনাকে কহিলাম চলিয়া যাইতে আপনি জান নাই”
আমি কহিলাম, “আমি আজ কোথাও যাইবো না তোমাকে দেখিবো”
সে ভেংচি কাটিয়া কহিল, “আমাকে দেখিবে! কাল সারা বিকেল দাঁড়াইয়া ছিলাম তখনতো টিকিটিরও খোজ পাই নাই”
আমি মাথা নিচু করিয়া কহিলাম, “আমার ভুল হইয়াছে”
সে জিজ্ঞাস করিল, “আজ আপনার অফিস নাই?”
আমি কহিলাম, “আছে। আজ যাইবো না”
সে কহিল, “অফিসে জান, তবে বিকেলে তাড়াতড়ি ফিরিবেন”
কহিয়া সে চলিয়া গেল। আমি কিছুক্ষন পর অফিসে গেলাম। আমার অনেক উৎফুল্ল অনুভব হইল। সারাদিন কাজ করিলাম। বারবার তাহার অগ্নিমূর্তির কথা মনে পড়িলো। তাহার এই রূপ দেখিয়া আমার তাহার প্রতি ভালোবাসা বিন্দুমাত্র না কমিয়া, তাহা যে বহুমাত্রায় বাড়িয়া গিয়াছে, উপলব্ধি করিতে আমার কিছুমাত্র কষ্ট হইলো না। আমি অফিস শেষে আড্ডাস্থল হতে পালাইয়া বাড়ি ফিরিয়া গেলাম। বিকালে ছাদে দাঁড়াইয়া থাকিলাম কিন্তু সে আসিলো না। সন্ধ্যা নামিয়া গেলো তখনো সে আসিল না। আমি ঘরে ফিরিয়া লিখিতে বসিলাম। হঠাত করিয়া আমার দরজায় টোকা পড়িলো। আমার গৃহে বাড়ির ম্যানেজার ছাড়া কেউ আসেনা। মাসের অর্ধেকে তাহার আসিবারও কথা নয়। আমি সন্দেহ নিয়া দরজা খুলিলাম। তাহাকে দেখিয়া আমি অবাক হইয়া গেলাম হা করিয়া চাহিয়া থাকিলাম তাহার দিকে আমার বিশ্বাস হইতেছে না, সে আমার দরজায় দাঁড়াইয়া আছে। আমি কিছু বলিতে পারিলাম না। সে খিল খিল করিয়া হাসিয়া উঠিলো। আমার ঘরের হ্যালোজেন বাতির আলোয় তাহার মুখ চিকচিক করিতেছে, আজকে সে বেনি করেছে। আমি ভাবিলাম, এক নারীর কত রূপ। কখনো তাহাকে অপ্সরী লাগে, কখনো তাহাকে দুর্গা আজকে তাহাকে লাগিতেছে আফ্রেদিতির ন্যায়। আমাকে কহিল, “দরজায় দাঁড়াইয়া থাকিবো?”
আমি নিজেকে ধাতস্ত করিয়া কহিলাম, “ভিতরে আসো”
সে ভেতরে ঢুকিয়া নাক সিটকাইয়া কহিলো, “বাব্বাহ কি নোংরা”
বলিয়া ঘর গোছাইতে লাগিলো আমি আমার লেখার টেবিলের পাশের চেয়ারে বসিয়া তাহাকে দেখিতেছিলাম। আমার মনে হইতেছিলো আমি স্বপ্ন দেখিতেছি। ঘর গোছানোর জন্য সে তাহার শাড়ির আঁচল কোমরে গুজিয়া দিলো। আমি তাহার কোমরের অল্প একটু উন্মুক্ত অংশের দিকে আনমনে তাকাইয়া থাকিলাম। সে কখন আমার নিকটা আসিয়া দাঁড়াইয়াছে তাহা খেয়াল হয় নাই। আমার মাথায় একখানা চাটি মারিয়া কহিল, “কি দেখা হইতেছে?”
আমি লজ্জা পাইয়া গেলাম, কহিলাম, “কিছু না”
সে আমাকে কহিল, “আপনি বড়ই দুষ্ট হইয়া গেছেন, আর দিন দিন আপনার সাহস বাড়িয়া চলিতেছে”
আমি কহিলাম, “দেবী আমাকে ক্ষমা করেন”
সে লজ্জা পাইয়া গেল, আমি দেখিলাম তাহার মুখখানা লাল হইয়া গিয়াছে। সে আস্তে করিয়া কহিল, “দেবী ডাকিবেন না”
আমি কহিলাম, “কেনো?”
সে কহিলো, “আমি আপনার মত মানুষ। দেবী ভুলের উর্ধে আমি ভুলের উর্ধে নই”
আমি কহিলাম, “আমার নিকট তুমি দেবী তুমি নির্ভুল”
সে অভিমানের সুরে কহিল, “আমি আর আপনার সাথে দেখা করিব না”
আমার চেহারায় করুনার ভাব তুলিয়া কহিলাম, “ঠিক আছে আমি তোমাকে আর কোনদিন দেবী কহিয়া সম্বোধন করিব না”
সে হাসিয়া জিজ্ঞাস করিলো, “আগামীকাল আপনার অফিস ছুটি?”
আমি কহিলাম, “আলবত”
সে কহিল, “ঠিক আছে সকাল দশটায় আমার সহিত রাস্তার কোনে মিষ্টির দোকানের সামনে দেখা করিবেন”
আমি কহিলাম, “ঠিক আছে”
সে শাড়ির আঁচল কোমর থেকে নামাইয়া নিজ হইতে দরজা খুলিয়া চলিয়া গেলো। আমি চেয়ার হইতে উঠিয়া বিছানায় গিয়া শুইয়া পড়িলাম। আমার খুব নিদ্রা পাইতেছিলো। সেই রাত্র আমার খুব ভালো নিদ্রা হইল। পরদিন সকালে মিষ্টির দোকানের সামনে দাঁড়াইয়া তাহার জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। কিছুসময় পর তাহাকে আসিতে দেখিলাম, কপালে টিপ পরিয়াছে আজকে। আমি মনে মনে কহিলাম আমি জীবনানন্দ হইলে তুমি আমার বনলতা। মাথার চুল খোলা। আজকে সে ঠোটে লাল লিপস্টিক দিয়াছে, তাহাতে তাহার রূপ বহুগূণে বাড়িয়া গিয়াছে। আমি বরাবরের মত চোখ ফিরাইতে পারিতেছিলাম না। সে কাছে আসিয়া কহিল, “এমন করিয়া চাহিয়া থাকিলে ফিরিয়া যাইবো কিন্তু”
আমি তাহার চোখের দিকে তাকাইয়া কহিলাম, “সুন্দর অনুভব করিতে হইলে অবলোকন করিতে হয়, আর যাহা অত্যাধিক সুন্দর তাহা অবলোকনে মোহ হারায় না, বরং বাড়িতে থাকে বহু গুণ”
সে কহিল, “তাই নাকি। বুঝিলাম। আমাকে লজ্জায় না ফেলিয়া, চলেন যাই” আমি কহিলাম, “কই যাবো?”
সে কহিলো, “প্রেমিক প্রেমিকারা কোথায় যায়?”
আমি মনে মনে লাফ দিয়া উঠিলাম। রিক্সা ডাকিলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম পার্কে যাইবো, ইহা ছাড়া আমার মাথায় কিছু আসিলো না। সেও কিছু বলিল না। রিক্সায় উঠিয়া আমি তাহার পাশে বসিতে যে লজ্জা পাইতেছিলাম না তাহা বলিবো না। আমি কিঞ্চিত লজ্জা পাইতেছেলাম। অত্মীয় স্বজনের বাইরে কোন নারীর সহিত ইহা আমার প্রথম রিক্সা ভ্রমণ। রিক্সা যাইতে যাইতে মাঝে মাঝে যখন তাহার শরীর আমাকে স্পর্শ করিতেছিলো আমার মনে হইতেছিলো কেউ আমার শরীরে তড়িত প্রবাহ করিতেছে। সে হঠাত করিয়া কহিলো, “আমার রোদ লাগিতেছে”
আমি কহিলাম, “হুড খানা উঠাইয়া দেই?”
সে মাথা নাড়াইয়া সম্মতি দিল, আমি হুড উঠাইয়া দিলাম। হুড খানা হাত দিয়া ধরিয়া রাখিলাম। আমার কিছুক্ষনের মধ্যে উপলব্ধি হইলো হুড খানার হুক গুলো লাগাইয়া দেয়া ছাড়া উপায় নাই। আমার পাশের খানা লাগাইতে লাগাইতে কহিলাম, “তোমার পাশের হুডের হুকখানা লাগাইয়া দাও”
সে দু আঙ্গুল দিয়ে হুক লাগাইবার চেষ্টা করিতেছে দেখিয়া আমি কহিলাম, “এইভাবে করিলে পারিবে না, আমাকে দাও”
আমি হাত আগাইয়া দিলাম, সামনে দিয়া করিলে তাহার বক্ষ স্পর্শ হইবে তাই পিছন দিক দিয়া হাত বাড়াইলাম, সে সামনে ঝুকিয়া জায়গা করিয়া দিলো। কিন্তু আমার হাত তাহার পৃষ্ঠে ঘষা খাইয়া গেল, আমি ঘষা না লাগাইয়া হুক লাগাইতে পারিলাম না। আমার মনে হচ্ছিলো এখনই ও খেপিয়া যাইবে। সে কোন অভিব্যক্তি প্রকাশ করিলো না। রিক্সা আগাইয়া যায়। আমি তাহার পাশে বসিয়া আছি, কেউ কোন কথা বলিতেছি না। সে কহিয়া উঠিলো, “আপনার কি লজ্জা লাগিতেছে?”
আমি কহিলাম, “নাতো কেনো?”
সে আমার দিকে চাহিয়া কহিল, “তাহলে চুপ করিয়া বসিয়া আছেন কেন?”
আমি কহিলাম, “তুমি কি জানো, রাগিয়ে গেলে তোমাকে মোটেই ভয়ংকর লাগেনা”
সে হাসিয়া দিল, আমি সত্য জানি সে প্রচন্ড রাগিয়া গেলে তাহাকে কতটা ভয় পাই। সে কহিল, “আমি রাগিয়া গেলে আপনার ভালো লাগে?”
আমি কহিলাম, “হুম”
ইহা সত্য সে রাগিয়া গেলে আমি ভয় পাই বটে তবে আমার ভালো লাগে মনে হয় তাহার ভালোবাসার গভীরতাটুকু আমার নিকট পরিষ্কার হইয়া যায়। সে আমাকে জিজ্ঞাস করিল, “আপনি কিসের চাকরি করেন?”
আমি কহিলাম, “আমি প্রুফরিডার, মানুষের পুস্তকে ভুল ধরাই আমার কাজ”
সে কহিল, “আমিতো ভাবিয়া ছিলাম আপনি লেখালেখি করেন”
আমি কহিলাম, “তাহা করি কিন্তু এখনো প্রকাশ করিবার উপযুক্ত কিছু লিখিতে পারি নাই। তবে এইবার একটা পুস্তক লেখার কাজে হাত দিয়াছি, দেখি কতদূর যায়”
সে এবার আগ্রহী হইয়া উঠিল, “কি লিখিতেছেন? গল্প না উপন্যাস”
আমি কহিলাম, “একটা প্রবন্ধ লিখিতেছি”
সে কহিল, “ওরে বাবা”
আমিও আশ্চর্য হইয়া গেলাম কহিলাম, “আশ্চর্য হইলে যে!”
সে কহিল, “নাহ কিছু না”
আমার কাধ একটু চাওড়া হওয়ায় তাহার কাধের সহিত তাহা লাগিয়া যাইতেছিলো। কিছুক্ষণ পর আকাশ মেঘে ঢাকিয়া গেল আমি কহিলাম, “হুড নামিয়ে দেই?”
সে আমার দিকে না থাকাইয়া কহিল, “দেন”
আমি হুড নামাইয়া দিলাম। একটু পর তাহার দিকে তাকাইলাম দেখি বাতাস লাগিয়া মুখের পাশটা চুল আসিয়া ঢাকিয়া দিয়াছে। আমার মনে হইলো আমি আমার হাতের উপর হইতে নিয়ন্ত্রণ হারাইয়া ফেলিয়াছে। আপনা হইতে আমার হাত খানা তাহার গাল হইতে চুল সরাইয়া তাহার কানের পিছন গুজিয়া দিলো। সে খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। আমিও হাসিয়া দিলাম। কিছুকাল পর রিক্সা গন্তব্য পৌছাইলো। আমরা পার্কে ঢুকিলাম। বেশ খানিকক্ষন আমরা হাটিয়া চলিলাম কোন কথা কহিলাম না কেহ। হঠাত করিয়া সে কহিলো, “চলেন কোথাও বসি”
একটা বেঞ্চ দেখিয়া আমরা বসিয়া পড়িলাম। আমি আর সে পার্কের ভেতরকার লেকের পাশের একটা বেঞ্চিতে বসিয়াছি। সে কহিলো,“কি চুপ করিয়া বসিয়া আছেন কেন?”
আমি কহিলাম, “চুপ করিয়া আছি কে কহিয়াছে? আমাদের দেহ কথা কহিতেছে আমাদের আত্মা কথা কহিতেছে”
সে কহিলো, “সহজ করিয়া কথা না বলিতে পারিলে আমার সহিত কথা বলিবেন না”
আমি মুচকি হাসিয়া কহিলাম, “তুমি আমাকে কঠিন করিয়া দিয়াছো আমার কি দোষ”
সে অভিমানের সুরে কহিলো, “আমার দোষ হইলে আমার সহিত সঙ্গ না রাখাই আপনার জন্য উত্তম”
হঠাত করিয়া আকাশ কালো হইয়া গেলো যেনো সন্ধ্যা হইয়া গেছে। ঠান্ডা হাওয়া গায়ে লাগিতেছে। আমি বুঝিলাম অল্পক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি নামিবে। সে আমার দিকে তাকাইলো। তাহার দৃষ্টি হতবাক, সে বুঝিতে পারিতেছে না কি করিবে। আমি কহিলাম, “চল উঠিয়া যাই”
সে কোন কথা না কহিয়া উঠিয়া পড়িলো। আমরা হাটিতে লাগিলাম। বজ্র্যপাত শুরু হইলো। প্রকান্ড শব্দে সে ভয় পাইয়া লাফ দিয়া আমার শার্ট পিছন হইতে হাত দিয়া খামচাইয়া ধরিলো। আমি থামিয়া গেলাম, সে ততক্ষনাত শার্ট ছাড়িয়া দিলো। আমরা আবার হাটিতে লাগিলাম। কিছুদূর যাইতে না যাইতে বৃষ্টি নামিয়া পড়িলো। আমি তাহার দিকে চাহিলাম সে মুখে কোন অভিব্যক্তি না ফুটাইয়া হাটিয়া যাইতেছে। আমিও হাটিতে লাগিলাম। কোন ছাউনি ফাকা নাই। কোন বড় গাছও নাই যাহার তলে আমরা দাড়াইবো। হঠাত করিয়া সে আর্তনাদ করিয়া উঠিলো, “আহ! গেলো”
আমি কহিলাম, “কি হইয়াছে?”
সে কহিলো, “স্যান্ডেল ছিড়িয়া গেলো”
আমি তাহাকে আমার স্যান্ডেল জোড়া খুলিয়া দিলাম, সে কহিল, “কি করিবো?”
আমি কহিলাম, “তুমি পড়। আর তোমার স্যান্ডেল জোড়া খুলিয়া হাতে লইয়া লও”
সে আমার স্যান্ডেল লইল না কিন্তু তাহার স্যান্ডেল খুলিয়া ফেলিলো। আমি আমার স্যান্ডেল আর পায়ে পড়িলাম না হাতে লইয়া লইলাম। সে কহিলো, “কি হল আপনি খালি পায়ে হাটিতেছেন কেন?”
আমি কহিলাম, “অত কথা কহিও না”
আমরা আগাইতে লাগিলাম একটা বড় গাছ পাইয়া গেলাম। তাহার তলে দুইজনে দাড়াইলাম। দুইজনেই ভিজিয়া ছুপছুপ হইয়া গিয়াছি। আমার মনে তখন বাজিতেছে রবীন্দ্রনাথের শাওন গগনে,
"শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা, নিশীথযামিনী রে
কুঞ্জপথে, সখি, কৈসে যাওব অবলা কামিনী রে.........”
আমরা দাঁড়াইয়া আছি। বৃষ্টি বেশ জোরেই নামিয়াছে। সমানতালে বিজলী চমকাইতেছে। কুবরা আমার গা ঘেসিয়া দাড়াইলো। তাহার বক্ষ আমার বক্ষ স্পর্শ করিতেছে। আমি তাহার বক্ষের উঠানামা অনুভব করিতে পারিতেছি। সে বৃষ্টির দিকে তাকাইয়া আছে, আমিও তাকাইলাম বৃষ্টির দিকে। আমার ভালোই লাগিতেছে। তাহার শরীরের উষ্ণতা আমার শরীর কে উষ্ণ করিয়া দিতেছে। সে মুখ তুলিয়া আমার মুখের দিকে চাইলো। তাহার নিশ্বাস আমি অনুভব করিতে পারিতেছি। আমার ইচ্ছা করিতেছে তাহাকে জড়াইয়া ধরি। আমি কোন রকমে নিজেকে আটকাইয়া রাখিলাম। আমার কপাল যে ঘামিতেছে আমি টের পাইলাম। আমার কর্ণদ্বয় রক্তবর্ণ ধারণ করিয়াছে তাহাও আমি বুঝিতেছি। হঠাত করিয়া বৃষ্টি থামিয়া গেলো। সে আমার থেকে সরিয়া দাড়াইলো। আমাকে কহিলো, “একেবারে যে ভিজিয়া গেলাম এখন কি উপায়”
আমি কহিলাম, “আমিও তাহা চিন্তা করিতেছি, তুমিতো সমস্যা পড়িয়া গিয়াছ। ভেজা কাপড়ে কেমন করিয়া বাড়ি ফিরিবে। আর তাছাড়া তোমার স্যান্ডেলখানাও ছিড়িয়া গিয়াছে”
সে কহিলো, “তাহলে কি এখানে দাঁড়াইয়া থাকিবো?”
আমার তখন মনে পড়িলো, এক লেখক বন্ধু আছে যাহার বাড়ি নিকটে। তাহার স্ত্রী আছে। আমি একসময় প্রায়ই তাহার গৃহে যাতায়াত করিতাম। এখন তাহাকে নিয়া সেখানে যাওয়াটাই উত্তম হইবে। আমি কহিলাম, “চলো”
সে কহিল, “কই যাইবেন?”
আমি কহিলাম, “আমার এক বন্ধুর গৃহে”
সে আতংকিত হইয়া কহিল, “কেনো?”
আমি কহিলাম, “তাহার স্ত্রী আছেন, তিনি তোমার শ্রুশষা করিবেন। এই অবস্থায় তুমি বাড়ি ফিরিতে পারিবেনা”
সে রাজি হইলো। আমি তাহাকে নিয়া রিক্সায় করিয়া বন্ধুর গৃহে গেলাম। বন্ধুবর সেদিন গৃহে ছিলেন, দরজায় টোকা দিতেই দরজা খুলিয়া দিলেন। আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, “তুমি এইকালে আমার দরজায় স্বপ্ন দেখিতেছি নাতো”
আমি কহিলাম, “আমি সত্যই আসিয়াছি। তবে বিপদে পড়িয়া আসিয়াছি”
বন্ধুবর আমার পিছনে কুবরাকে দেখিলো, কিছু জিজ্ঞাসা না করিয়ে গৃহে প্রবেশ করিতে দিলো। এরই মধ্যে ভাবী চলিয়া আসিলেন। আমাকে দেখিয়া তিনি হাস্যোজ্জল মুখে কহিলেন,
“ভাইজান আসিয়াছেন কি মনে করিয়া?”
আমি কিছু কহিলাম না। তিনি আমার আর কুবরার দিকে তাকাইয়া কহিলেন,
“একেবারে ভিজিয়া গিয়াছেন দেখিতেছি...... এই মেয়ে তোমার নাম কি?...... তুমি ভেতরে চল তাড়াতাড়ি কাপড় ছাড়িতে হইবে না হইলে আবার ঠান্ডা লাগিয়া যাইবে...... আর এই তুমি এখনো দাঁড়াইয়া আছো কেন ভাইজান কে শুকনো কাপড় দাও, তোয়ালে দাও”
এক নিশ্বাসে কহিয়া তিনি কুবরার হাত ধরিয়া তাহাকে ঘরের ভেতর লইয়া গেলেন। আমার বন্ধুবর জাভেদ তাহার একখানা লুঙ্গি, ফতুয়া আর তোয়াল আমাকে দিয়া গোসলখানা দেখাইয়া দিলো। আমি গোসল সারিয়া শুকনো কাপড় পড়িয়া ফেলিলাম। ভেজা কাপড়গুলো বারান্দায় বালাইয়া দেবার জন্য জাভেদ তাহার কাজের লোককে ডাকিলো। এরপর তাহার স্টাডি রুমে গিয়ে আমরা বসিলাম। সে জিজ্ঞেস করিলো, “তাহলে তোমার বিবাহের গুজবখানা সত্য” আমি কহিলাম,
“না আমি বিবাহ করি নাই, তাহাকে ভালোবাসি মাত্র”
সে হাসিয়া কহিল,
“বুঝিলাম। এর আগে কখনো প্রেমে পড়িয়াছো?”
আমি কহিলাম,
“না”
সে মুচকি হাসিয়া কহিল,
“বিবাহ পূর্ব প্রেম বড়ই অসাধারণ। তবে বন্ধু হিসেবে নয় বরং ভাই মনে করি বলিয়া কহিতেছে, যদি কষ্ট না পাইতে চাও যাহাকে ভালোবাসো তাহাকে বিবাহ করে ফেলা উত্তম”
আমি কহিলাম,
“তাহাকে না জানিয়া, না বুঝিয়া আমি কেমনে বিবাহ করিব?”
সে কহিলো,
“ভালোবাসিতে হইলে জানিতে হয় না উহার শরীরের কোথায় কোন তিল আছে, তোমাকে বুঝিতে হইবে তাহাকে ছাড়া তোমার সময় কেমন কাটিতেছে”
আমি কহিলাম,
“শুধু সময়ের বিবেচনায় আমি আরেকজন মানুষের সহিত জীবন কাটাইয়া দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়াটা বোকামী নয় কি?”
সে কহিলো,
“তাহাকে ছাড়া সময় কাটাইতে পারিতেছ না তাহার মানে হইল এই যে তাহার কথা শুনিতে তোমার ইচ্ছা করিতেছে, তাহাকে দেখিতে ইচ্ছা করিতেছে, তাহার সহিত দাঁড়াইয়া থাকিতে মন চাইতেছে”
এই বলিয়া সে একখানা সিগারেট ধরাইলো আমাকেও সাধিলো আমিও একখানা ধরাইলাম। এরপর সে আবার কহিতে লাগিলো,
“তুমি কি তাহাকে তোমার মনের ভাব জানাইয়াছো?”
আমি কহিলাম,
“না”
সে এবার রাগিয়া গেল,
“আমি তোমাকে এতটা বেকুব ধারনা করি নাই”
আমি থতমত খাইয়া গেলাম। আমি আর জাভেদ কোন কথা না বলিয়া সিগারেট টানায় মনোযোগ দিলাম। সিগারেট টানা শেষ হইলে, জাভেদ কহিল,
“যেটুকু তুমি তাহার সম্পর্কে জানো না তাহা বিবাহর পর ছাড়া জানার উপায় নাই”
আমি কহিলাম,
“তোমার কি ধারনা, আমি তাহার সম্পর্কে কতটুকু জানি?”
সে কহিলো,
“তুমি যাহা জানো, তাহা না জানিলে উহার প্রেমে পড়িতা না”
আমি কহিলাম,
“তাহা ঠিক কহিয়াছ”
সে এবার আমার দিকে ঝুকিয়া আসিয়া কহিলো,
“আতি শীঘ্র তাহাকে মনের কথা জানাইয়া দাও, আমি উপলব্ধি করিতেছি সেও তোমাকে ভালোবাসে”
আমি কহিলাম,
“ঠিক আছে তাহাই করিব”
সে কহিলো,
“এরপর মাসখানের মধ্যে তাহাকে বিবাহ করিয়া ফালাও”
এমন সময় জুমার আযান দিল। জাভেদ কহিল,
“তুমি বসো আমি গোসল করিয়া আসি, একসাথে নামাজ পড়িতে যাইবো”
জাভেদ রুম থেকে বাহির হওয়ার সময় দরজা ভিড়াইয়া দিলো। আমি একটা সিগারেট ধরাইলাম। সিগারেট টানিতেছি হঠাত করিয়া দরজার ক্যাচক্যাচ আওয়াজ হইলে দেখি দরজা আলতো করে খোলা, কুবরা দাঁড়াইয়া আছে। তাহার মুখে প্রথমে বিস্ময় ভাব ফুটিয়া উঠিলেও তাহা রাগে রূপ নিতে বেশি সময় লাগিলো না। সে কহিলো,
“আপনি কি করিতেছেন?”
আমি কহিলাম,
“কেনো সিগারেট টানিতেছি”
সে আরো রাগিয়া কহিলো,
“লজ্জা লাগে না, আবার বলিতেছেন”
আমি কহিলাম,
“ঠিক আছে নিভাইয়া দিতেছি”
সে কহিল,
“আপনার সহিত আমার কোন কথা নাই”
কহিয়া সে চলিয়া গেলো। সে ভাবীর একখানা সেলোয়ার কামিজ পড়িয়াছিলো, তাহার চুলগুলো পানি শুকানোর জন্য তোয়ালে দিয়া বাধা ছিলো। কিছুক্ষন পর জাভেদ ফিরিয়া আসিয়া কহিলো, “যাও অজু করিয়া লও” আমি অজু করিয়া লইলাম এরপর নামাজ পড়িতে গেলাম। নামাজ পড়িয়া ফিরিয়া আসার পর ভাবী কহিলেন,
“খাবার ঘরে চলেন, খাইতে বসিয়া যান”
খাবার ঘরে গিয়া দেখি বিশাল আয়োজন। সাদা ভাত থেকে ধোয়া উঠিতেছে, ডাল, শুটকির ভর্তা, বেগুন ভাজি, মুড়ি ঘন্ট, মরিচ ভর্তা, কৈ মাছ ভাজি। আমি কহিলাম,
“ভাবী এত কিছু কখন করিলেন?”
ভাবী কহিলেন,
“ভর্তা আগেই বানাইয়াছিলাম, আর কুবরা মাছ, বেগুন এগুলো ভাজি করিয়া দিলো”
কুবরা লজ্জা পাইয়া গেলো, সে টেবিলের সামনেই দাঁড়াইয়া ছিলো। সে মাথা ওড়না দিয়া ঢাকিয়া রাখিয়াছে। সেই ওড়নার কোনা ঠোটের ফাকে গুজিয়া নিজেকে লুকাইতে চাইলো। ভাবী কহিলেন,
“আর ভাব ধরিতে হইবে না বসিয়া পড়”
আমরা একসাথে বসিয়া খাইলাম। ভাবী আর কুবরা দুজনে মিলিয়া বাড়িয়া দেয়াতে খাওয়া অনেক বেশি হইয়া গেলো। খাওয়া শেষ করিয়া আমি আর জাভেদ স্টাডি রুমে ফিরিয়া গেলাম। জাভেদ সিরাগেট ধরাইতে ধরাইতে কহিলো,
“বিবাহ তুমি করিয়াই ফেলো বুঝলে”
আমি মাথা নাড়িলাম, সে আমার দিকে সিগারেট বাড়াইয়া দিলো। আমি মাথা নাড়াইয়াই না করিয়া দিলাম। সে কহিলো,
“গতকাল সত্বেন বাবুর একখানা প্রবন্ধ পড়িলাম”
এরপর ঘণ্টাখানেক ধরিয়া চলিল প্রবন্ধ লইয়া আলোচনা। আলোচনায় ব্যাঘাত ঘটিল যখন কাজের লোক আসিয়া কহিল,
“মামা আপনার জামা শুকাইয়া গেছে”
দেখিলাম তাহার হাতে আমার জামা ইস্তারি করা। বুঝিলাম সে ইস্তারি করিয়া জামা শুকাইয়া দিয়াছে। ভালো হইয়াছে। আমি কাপড় বদলাইয়া ফেলিলাম। কিছুক্ষণ পর দেখিলাম হাসিতে হাসিতে আর কথা বলিতে বলিতে রুম হইতে কুবরা আর ভাবী বাহির হইলেন। কুবরা তাহার শাড়ি পড়িয়া আছে। ভাবী কহিলেন,
“এই দুষ্ট লোক তোমাকে কিভাবে বশ করিয়াছে সে গল্প করিতে আরেকদিন চলিয়া আসিবা, আর ভাইজান আসা যাওয়া যেভাবে বন্ধ করিয়াছেন এভাবে আর কয়দিন চলিলে দরজায় আসিয়া কড়া নাড়িলে, না চিনিতে পারিয়া আপনাকে ভাগাইয়া দিতে হইবে”
আমি হাসিয়া দিলাম, এরপর বিদায় নিয়া চলিয়া আসিলাম। রিক্সায় করিয়া ফেরার পথে কুবরা কহিলো,
“আজকের পর আর কোনদিন সিগারেট টানিবেন না”
আমি কহিলাম, “ঠিক আছে টানিবো না”
সে কহিলো, “আমি বিশ্বাস করি নাই”
আমি কহিলাম, “সত্যি টানিবো না”
আমার তাহার দিকে তাকাইয়া কহিলাম, “আজকে তোমাকে সুন্দর লাগিতেছে”
সে কহিলো,
“আমি জানি”
আমি কহিলাম,
“আমি তোমার প্রেমে পড়িয়া গিয়াছি”
সে মিটিমিটি হাসিয়া কহিলো,
“আমি জানি”
সে আস্তে করিয়া কহিলো,“এত তাড়াতাড়ি কি প্রেমে পড়া যায়?”
আমি কহিলাম, “যায়”
সে কহিলো, “আমি আপনাকে পছন্দ করি কিন্তু ভালোবাসি না”
আমি কহিলাম, “কেনো?”
সে কহিলো, “ভালোবাসা প্রেমে কষ্ট থাকে, এইটা কোন ভালো বিষয় নয়”
আমি কহিলাম, “তাহলে এখন আমি কি করিবো?”
সে কহিলো, “আমি জানি না”
কহিয়া আমরা দুজন নীরব হইয়া গেলাম। বাসার কাছাকাছি আসিয়া কহিলাম, “আমার তোমার হাত ধরিয়া কিছুকাল বসিয়া থাকিতে ইচ্ছা করিতেছে”
সে কহিলো, “এইটা বাকি আছে তাই না”
আমি লজ্জা পাইলাম। সে কহিলো, “হাত ধরিবেন না, এইটা আরেকদিনের জন্য তুলিয়া রাখিলাম”
রিক্সাকে থামিতে কহিলাম, বাসার কাছাকাছি আসিয়া আমি নামিয়া ভাড়া পরিশোধ করিয়া তাহাকে বাসার সামনে নামাইয়া দিতে কহিলাম। আমি হাটিয়া বাসায় চলিয়া গেলাম। ঘরে ফিরিয়া আমি লিখিতে বসিলাম। সন্ধ্যার আগে ছাদে গিয়া দাঁড়াইলাম। সে আসে নাই। আমি আসমানের দিকে তাকাইয়া রইলাম। সে দিন লেখালেখি করিয়া কাটাইয়া দিলাম। পরদিন থেকে আবার অফিস শুরু হইলো। অফিস শেষে বাহির হইয়া জাভেদ সহ বাকিদের দেখিলাম আড্ডা মারিতেছে। আমাকে দেখিয়া জাভেদ হাসি দিয়া সম্ভাষণ জানাইলো। কিন্তু ডাকিলো না। আমি গৃহে ফিরিয়া গেলাম। কাপড় বদলাইয়া ছাদে গিয়া দাঁড়াইয়া থাকিলাম। সেদিন সে আসিলো না। এভাবে সপ্তাহ কাটিয়া গেলো আমি তাহার দেখা পাইলাম না। আমি ভাবিলাম তাহার সেদিনের বাহিরে হওয়া লইয়া কি বাসায় কিছু ঘটিয়াছে? নাকি সে আমার উপর কোন কারণে রাগিয়া আছে? পরের দিন বিকালে তাহার দেখা পাইলাম। সে আসিয়াছে আজকে। কাপড় দড়ি থেকে লইয়া বালতিতে রাখিতেছে। আমি দাঁড়াইয়া রইলাম, সে আমাকে দেখিলো কিছু কইলো না। আমি তাহার দিকে চাহিয়া রইলাম। একটু পর তাহার কাজ শেষ হইলে সে তাহার অভ্যাস মত আসমান উপভোগ করিতে লাগিলো। আমি তাহাকে কহিলাম, “কই ছিলে?”
সে কহিলো, “ব্যস্ত ছিলাম। আপনি কেমন আছেন?”
আমি কহিলাম, “ভালো ছিলাম না, তবে এখন ভালো লাগিতেছে”
সে হাসিয়া কহিলো, “তাই নাকি!”
আমি কহিলাম, “একেবারে তাহাই”
সে কহিলো, “আপনার কি খুব কষ্ট হইয়াছে?”
আমি কহিলাম, “হুম”
সে কহিল, “আজকে যাই”
আমি কহিলাম, “আর কিছু মুহুর্ত থাকিতে কি সমস্যা হইবে খুব?”
সে কহিলো, “হ্যা সমস্যা হইবে, আগামীকাল বাড়ি তাড়াতাড়ি ফিরিবেন”
আমি কহিলাম, “ঠিক আছে”
সে চলিয়া গেলো, আমি আসমান অবলোকন করিতে লাগিলাম।
পরদিন আমি উৎফুল্ল চিত্তে অফিসে গেলাম। মধ্যাহ্নে আমার নিকট একটা পত্র আসিলো, পত্র আমার এক আত্মীয় পাঠাইয়াছেন। তিনি লিখিয়াছেন আমার মা হঠাত করিয়া ভীষণ অসুস্থ হইয়া পড়িয়াছে, আমাকে অতিসত্তর বাড়ি যাইতে হবে। আমি বড় সাহেবকে জানাইয়া গৃহে ফিরিয়া আসিলাম। তড়িত গতিতে ব্যাগ গোছাইয়া বাড়ি চলিয়া গেলাম। মাসখানেক লাগিয়া গেলো মায়ের সুস্থ হইয়া উঠিতে। আমার তাহার কথা মনে পড়িত। আমি তাহাকে পত্র পাঠাইতাম। কিন্তু কখনো উত্তর আসিতো না। আমি বুঝিতাম সে রাগ করিয়াছে। এই রাগ দেখা করা ছাড়া কমিবে না। আমি পত্রযোগে অফিসের প্রুফরিডিংয়ের কাজ করিয়া দিতাম তাই অফিস থেকে চাপ ছিলো না। মা পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার পর আমি আবার শহরে ফিরিয়া আসিলাম। আসার পথে নিজের মধ্যে একটা উতফুল্লতা অনুভব করিতেছিলাম। আমার হৃদয় পুরো পথ ধরিয়া ধুকপুক করিতেছিলো। আমি মনে মনে ভাবিতেছিলাম, মায়ের বয়স হইয়াছে, তাহার একজন সঙ্গ প্রয়োজন। তাহাকে শহরে আনিয়া একলা বাসায় রাখিতে পারিবো না। আমি বিবাহ করিলে সে একটা উপযুক্ত সঙ্গ পাইবে। এইবার কুবরাকে আমি বিবাহ করিয়া ফালাইবো, তাহার কোন ধানাইপানাই চলিবে না, সেযে আমাকে চায় তাহা আমি ভালো করিয়া বুঝি। গৃহে প্রবেশ করিতে রাত হইয়া গেলো। আমার রাত নির্ঘুমতায় কাটিলো। মনে হইলো সময় কাটিতেছে না। সকাল হইলো আমি ছাদে দাঁড়াইয়া আছি। অফিসের সময় হইলো। অফিসে গেলাম। অফিস শেষে বাড়ি ফিরিয়া আসিলাম। ছাদে দাঁড়াইলাম। আমি জানিতাম না যে, আমার অনন্ত অপেক্ষার প্রহর শুরু হইয়া গিয়াছে। সেইদিন সন্ধ্যাতে সে আসিলো না। দুই সপ্তাহ পার হইয়া গেলো, আমি তাহাকে দেখি নাই। একবার ভাবিলাম তাহার গৃহে গিয়া খোজ নিবো কিনা। সাহস হইলো না। আরো এক সপ্তাহ কাটিয়া গেলো। আমি একদিন সন্ধ্যায় থাকিতে পারিলাম না। তাহাদের বাড়িতে চলিয়া গেলাম। বাড়ির ভিতর ঢুকিয়া দেখি মাটিতে আলপনা আঁকা। দালানের ভিতর ঢুকিয়া দেখিলাম দেয়ালে আলপনা আঁকা। আলপনা আকা হইয়াছে বেশি দিন হয় নাই তাহা বোঝা যাইতেছে। আমি সিড়ি দিয়া উপরে উঠিতে লাগিলাম হাত দিয়া দেয়ালের আলপনা স্পর্শ করিতেছি আর এক ধাপ করিয়া উঠিতেছি। তাহাদের গৃহের সামনে আসিয়া দেখিলাম তাহার পরে উপরের সিড়িতে আর কোন আলপনা নাই। আমি বুঝিয়া গেলাম কি ঘটিয়াছে। আমি না দাঁড়াইয়া নামিয়া চলিয়া আসিলাম। চলিয়া গেলাম জাভেদ এর বাসায়। জাভেদ দরজা খুলিয়া বিধ্বস্ত আমাকে দেখিয়া কহিলো, “কি ঘটিয়াছে?”
আমি কহিলাম, “কুবরা?”
সে কহিলো, “জানি, ভেতরে আসিয়া বস”
আমি ভেতরে ঢুকিলাম। বসিয়া পড়িলাম সোফায়। ভাবী আসিলেন, তাহার মুখে আজ হাসি নাই।
জাভেদ কহিলো, “ফিরিলে কবে?”
আমি কহিলাম, “এইতো মাসখানেক হইতেছে”
সে কহিলো, “বলো কি এই কয়দিন কি তাহার খবর নাও নাই” আমি কহিলাম, “বাড়ি থাকিতে তাহাকে পত্র পাঠাইছিলাম, সে উত্তর দেয় নাই”
জাভেদ কহিলো, “তুমি চলিয়া যাওয়ার সপ্তাহখানেকের মধ্যে তাহার বিবাহ হইয়া গেছে”
আমি কাদিয়া দিলাম। আমার মনে আছে সেই দিনের পর আমি দ্বিতীয়বার কাদিয়াছিলাম মা যেদিন মারা গিয়াছিল ঐদিন। অদ্যবধি আমার চোখ দিয়া পানি বাহির হয় নাই। আমি জাভেদের বাসা থেকে বাহির হইয়া সেদিন রাত্রিতে গৃহে না ফিরিয়া রাস্তায় হাটিয়াছিলাম। আমি দুইদিন বাড়ি ফিরি নাই, অফিসেও যাই নাই। পরে জাভেদ আমাকে খুজিয়া বাহির করিয়াছিল। আমি পার্কের বেঞ্চে চোখ বন্ধ করিয়া শুইয়া ছিলাম, শরীর জ্বরে কাপিতেছিলাম। সে আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করাইলো। সুস্থ হইয়া ফেরার দু মাসের মাথায় আমার প্রথম পুস্তক প্রকাশ পাইলো। আমি নতুন বাসায় উঠিয়াছি। আগের মতো চিলেকোঠার বাসা নয়, খোলা বারান্দার দুই রুমের বাসা। আগের চাকরিটা এখন আর নাই, পত্রিকায় চাকরি নিয়াছি। একদিন বিকালে হাটিয়া বাড়ি ফিরিতেছিলাম। চা পান করিতে মন চাইতেছিলো। বাড়িতে সব উপকরণ আছে কিন্তু বানাইয়া পান করিবো সেই রকম কোন আগ্রহ অনুভব করিতেছি না। আমি চায়ের দোকানে বসিলাম, এককাপ চায়ের অর্ডার করিলাম। আমার চোখ গেলো দোকানদারের সিগারেটের প্যাকেট সাজানো তাকের দিকে আমার তাহার কথা মনে পড়িলো। আমি দোকানদার কে কহিলাম সে যেন একখানা সিগারেট দেয়। সে চায়ের কাপ আর সিগারেটটা আগাইয়া দিলো। আমি ঠোটের কোনে সিগারেট গুজিয়া দিলাম। সিগারেট ধরাইবো মনে হইলো রাস্তায় তাকে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিলাম। দুর্গা রূপি কুবরা আমার দিকে চাহিয়া আছে। আমি সিগারেট ঠোট হইতে নামাইয়া ভালো করিয়া তাকাইলাম, কেহ নাই। আমি হাসিয়া ফেলিলাম সিগারেটটা রাখিয়া দিলাম পকেটে।
আজকে পর্যন্ত সিগারেটটা টানি নাই। একটা কাগজে মুড়িয়া আমার লেখালেখির টেবিলের ড্রয়ারে রাখিয়া দিয়াছি।
--------------------------------------------------------------------------------------
“ভালোইতো লেখেছেন জনাব”
আমি বললাম,
“আরে আমি অনেক বড় লেখক। ভালো না হলে কি খারাপ হবে নাকি”
সে বলল,
“তাই নাকি!”
আমি হেসে দিলাম। ও বললো,
“তুমি আমাকে ঝামেলা মনে কর তাইনা”
আমি বললাম,
“কেনো?” সে বললো,
“এইযে এত প্রেম ভালোবাসা দিলে তারপর নিজে বিয়ে না করে অন্যের সাথে বিয়ে করিয়ে দিলে”
আমি বললাম,
“তুমি বুঝনা কেনো করিয়েছি!”
সে রাগ করার ভান করে বললো,
“না বুঝিনা” আমি বললাম,
“একবার আমাকে বুঝিয়ে দাও ভালোবাসো কিনা তারপর দেখ গল্পের মোড় কেমনে পাল্টে যায়”
ও বললো,
“তুমি একটা গাধা”
আমি আর ও হাসতে লাগলাম। আমি জানি তাকে আমি কখনো হারাতে দিবো না।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই আগস্ট, ২০১৬ রাত ১২:৪৩
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×