সাব্বাস সিইসি, আপনাকে অভিনন্দন!
ড. রোজোয়ান সিদ্দিকী
আমাদের সিইসি (প্রধান নির্বাচন কমিশনার) কথা রেখেছেন। সব দুর্মুখের মুখে চুনকালি লেপে দিয়ে তিনি ২৯ ডিসেম্বরই জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করেছেন। এ জন্য তাকে একবার সাবাসি দিলাম। তিনি বলেছিলেন, কোনো শক্তিই নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধা সৃষ্টি করতে পারবে না। সত্যি সত্যি আমাদের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী সিইসিকে নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধা দিতে কেউ সাহস করেনি। কার অমন বুকের পাটা আছে যে সিইসিকে বাধা দেয়!
তা ছাড়া সিইসি ড. এ টি এম শামসুল হুদা নির্বাচন খুবই শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করেছেন। নির্বাচনে ভোট কেন্দ্র দখলের ঘটনা ঘটেনি বললেই চলে। নির্বাচন নিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা। ভোর থেকে মানুষ এসে নির্বাচনী কেন্দ্রে হাজির হয়েছিল ভোট দেয়ার জন্য। সুশৃঙ্খল সারি। নারী ভোটারদের ব্যাপক উপস্থিতি, তরুণ ভোটারদের ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা এই নিয়ে চমৎকার নির্বাচনী পরিবেশ। যারা ভোট দিতে পেরেছেন, শান্তিপূর্ণভাবেই পেরেছেন। সে জন্য সিইসিকে আরেক দফা সাবাসি।
ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা তৈরি করতে পারা নির্বাচন কমিশনের সাফল্যের এক বিরাট পিরামিড বলে চিহ্নিত করেছেন সিইসি সাহেব। যদিও এ তালিকা তৈরিতে নির্বাচন কমিশনের কোনো ভূমিকা ছিল না। তা সত্ত্বেও এটাকে একটা ভালো কাজ বলে প্রশংসা করেছেন অনেকেই। আমাদেরও ধারণা জন্মেছিল যে, এবার আর জাল ভোট দিতে কেউ ভোট কেন্দ্রে আসার সাহসই পাবে না। কিন্তু ভেতরে যে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের চমৎকার কৌশল লুকানো ছিল, সেটা প্রথম প্রথম কেউ বুঝতে পারেনি।
ভোট কেন্দ্রে প্রিজাইডিং অফিসার ও সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারকে হাতে দেয়া হয়েছিল ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা। পোলিং এজেন্টদের কাছে যে ভোটার তালিকা দেয়া হয়েছিল তাতে ভোটারের ছবি ছিল না। প্রিজাইডিং অফিসারের পক্ষে যেমন সব ভোটার চেনা সম্ভব ছিল না, তেমনি সম্ভব ছিল না পোলিং এজেন্টদের পক্ষেও সব ভোটারকে চেনা। তা ছাড়া রঙিন ছবি সাদাকালোতে ছাপা হওয়ায় তা ছিল অস্পষ্ট। উপরন্তু ন্যাশনাল আইডি কার্ডের ছবির মতোই সেগুলো ছিল ডিশেপড, চ্যাপ্টা বা লম্বা হয়ে যাওয়া। ফলে ছবি দেখে ভোটার শনাক্ত করা খুব একটা সহজ ছিল না। তা সত্ত্বেও পোলিং এজেন্টদের হাতে ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা সরবরাহ না করে জাল ভোট দেয়ার দরজাটাই কি খোলা রাখা হয়েছিল? খোলা যে রাখা হয়েছিল, তা প্রমাণ মিলল অনেক ভোটারের অভিযোগ থেকে। তারা জানিয়েছেন, বুথে গিয়ে দেখেছেন যে, তাদের ভোট দেয়া হয়ে গেছে।
নির্বাচন কমিশন প্রার্থীদেরও ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা সরবরাহ করেনি। যুক্তি হিসেবে তারা বলেছেন, ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা সরবরাহ করা হলে ভোটারদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। কিন্তু এসব ডামাডোলে কখনো স্পষ্ট হয়নি যে, কেমন করে ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা প্রার্থীদের হাতে গেলে ভোটারদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। এই অদ্ভুত যুক্তি মেনে নিলেও ভোট কেন্দ্রের ভেতরে ভোটারদের শনাক্ত করার জন্য কেন এজেন্টদের কাছে সরবরাহ করা গেল না ছবিযুক্ত ভোটার লিস্ট। এমনকি ভোট গ্রহণ শেষে সেগুলো ফিরিয়েও নিতে পারত নির্বাচন কমিশন। সিইসি’র জবাব আছে কিছু?
আবার পোলিং অফিসারের কাছে রাখা ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা ও পোলিং এজেন্টদের কাছে দেয়া ভোটার তালিকায় ভোটারের নম্বরের মিল পাওয়া যায়নি অনেক জায়গায়। ছবি না হয় নেই, কিন্তু নম্বরে গোলমাল হলো কেন? নাকি পোলিং অফিসারের কাছে রাখা ভোটার তালিকায় ভোটারের সংখ্যা বেশি ছিল? যেগুলো কোনো একটি দল বা জোটের পক্ষে সিল মেরে বাক্সে ফেলা হয়েছে?
তবে কোনো একটি দলের প্রার্থীকে জেতাতে খুব বেশি কারচুপির প্রয়োজন হয়নি। কারণ গড়ে প্রতিটি আসনের ভোট গ্রহণের জন্য কেন্দ্র ছিল ১১৬টি। প্রতিটি কেন্দ্রে যদি মাত্র ১০০টি ভোট জালিয়াতি করা যায়, তাহলে কোনো বিশেষ দল বা জোটের প্রার্থীকে ১১ হাজার ৬০০ ভোটে জিতিয়ে দেয়া সম্ভব। বেহুলার বাসরের নিশ্ছিদ্র আয়োজনে মনসার ঢোকার সূক্ষ্ম পথ ঠিক ঠিকই করে রেখেছিল নির্বাচন কমিশন?
এরও প্রমাণ পাওয়া যায় অন্তত ৮৫টি আসনে। নির্বাচন কমিশনের হিসাব অনুযায়ী এবারের নির্বাচনে ৮৭.১৬ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছেন, যা অতীতে কখনো ঘটেনি। এ কথা যদিও সত্য যে, ভোট দানের ব্যাপারে এবার নাগরিকরা অনেক বেশি সচেতন ছিলেন। ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন করতে চাইছিলেন সাধারণ মানুষ। তবু একেবারে ৮৭ শতাংশ মানুষ সর্বত্র ভোট দিয়ে ফেলল এমন কাহিনী একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য হতে চায় না। দুই-চার কেন্দ্রে এ রকম ঘটনা ঘটলেও হয়তো কোনো প্রশ্ন উঠত না। কিন্তু ২৯৯টি আসনে ৩৫ হাজার ভোট কেন্দ্রেই এমন বিপ্লব কেমন করে ঘটল সেও এক বিরাট প্রশ্ন। এ রকম বিপ্লব ঘটানোর জন্য নির্বাচন কমিশনকে আরো একবার সাবাসি না দিয়ে পারা যায় না। এ ছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৯০ শতাংশ থেকে ৯৫.৪৩ শতাংশ ভোট পড়েছে। ভোট প্রদানের এই বিস্ময়কর হার এক সময় বিএনপি’র দুর্গ হিসেবে পরিচিত খুলনা ও রাজশাহী বিভাগের আসনগুলোতেই বেশি। এবারের নির্বাচনে ওইসব এলাকার আসনগুলোর মাত্র সাতটিতে বিএনপি, একটিতে স্বতন্ত্র ও ৭৭টি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট জয়ী হয়েছে। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৯০ শতাংশ থেকে ৯২.৮০ শতাংশ ভোট পড়ে পাঁচটি আসনে। তা নিয়ে কিছু দিন আগেও তত্ত্ববাব এক পত্রিকার সে যে কী নাঁকি কান্না? কেয়ামত হয়ে গেছে। জালিয়াতি হয়ে গেছে। ব্যাপক কারচুপি হয়ে গেছে। এ ঘটনা সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনের এক কর্মকর্তা ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, কোনো আসনে যদি ৯০ শতাংশের বেশি ভোট পড়ে থাকে তাহলে কোনো কোনো কেন্দ্রে ১০০ ভাগ ভোট দেয়া হয়ে থাকতে পারে, যা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। এবার ৮৫টি আসনে ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ ভোট দেয়ার ব্যবস্থা করে নির্বাচন কমিশন সেই রকম অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছে। ত্রি চিয়ার্স ফর সিইসি। আপনার জয় হোক।
এ দিকে নানা স্থানে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যাচ্ছে বিএনপি’র পক্ষে সিল দেয়া ব্যালট পেপার যেসব জায়গায় এই ব্যালট পেপারগুলো পাওয়া যাচ্ছে, সেসব জায়গায় সামান্য ভোটের ব্যবধানে হেরেছে চারদলীয় জোটের প্রার্থীরা। কোনো সন্দেহ থাকে না যে, এই ভোট কেন্দ্রগুলোতে ধানের শীষের পক্ষে দেয়া ব্যালটগুলো ফেলে দিয়ে মহাজোটের পক্ষে সিল দেয়া ব্যালট পেপার ঢোকানো হয়েছে। ধানের শীষের পক্ষে সিল দেয়া এসব ব্যালট পেপার উদ্ধারের পর সেখানে হাজার হাজার লোক বিক্ষোভ করছেন। সিলেটের বিশ্বনাথ তার একটি উদাহরণ।
বিএনপি’র দফতর সম্পাদক অভিযোগ করেছেন যে, অনেক কেন্দ্রে কিভাবে রেজাল্ট শিট তৈরি হয়েছে তা তাদের পোলিং এজেন্টরা জানেন না। রেজাল্ট শিটও তাদের হাতে দেয়া হয়নি। ফলাফল ঘোষণার সময় নির্বাচন কমিশনের ফ্যাক্স রুমে তাদের এজেন্টদের ঢুকতে দেয়া হয়নি। ফ্যাক্সের কপির সাথে প্রকাশিত ফলাফলের মিল আছে কি না সে ব্যাপারেও গভীর সন্দেহ দেখা দিয়েছে। কমিশন যে পরিমাণ ভোট পড়েছে বলে দেখিয়েছে তাতে একজন ভোটারের ভোট দিতে সময় লেগেছে ৪০ থেকে ৪৫ সেকেন্ড। অথচ বাস্তবে একজন ভোটারের ব্যালট পেপার সংগ্রহ করে পর্দায় ঢোকা কক্ষে গিয়ে সিল দিয়ে ব্যালট পেপার ভাঁজ করে ব্যালট বাক্সে ঢোকানো পর্যন্ত সময় লেগেছে আড়াই থেকে পাঁচ মিনিট। কিন্তু নির্বাচন কমিশন ৮৭ শতাংশ ভোট দেয়ার এক তেলেসমাতি কারবার নির্ধারিত সময়েই সম্পন্ন করেছে। সে জন্য তাদের আরো একবার সাবাসি।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কথা রেখেছেন। ১৯৯১ না, ১৯৯৬ না, ২০০১ না, তিনি কথা দিয়েছিলেন নির্বাচন করবেন ১৯৭০ সালের মতো। যে নির্বাচনে আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের জন্য এ দেশের সব মানুষ আওয়ামী লীগের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। সিইসি’র স্বপ্ন ছিল আওয়ামী লীগের তেমন একটি বিজয় নিশ্চিত করে দেয়া। যদিও ২০০৮ সালে সে রামও নেই, সে অযোধ্যাও নেই। কিন্তু ছি ছি সাহেব তেমন বিজয় নিশ্চিত করে দিয়েছেন। সে জন্য তাকে আরো একবার সাবাসি। নির্বাচনে জয়-পরাজয় তো আছেই। বাংলাদেশে সে জয়-পরাজয়ের ধারার সাথে আমরাও পরিচিত। কিন্তু সিইসি’র এমন রেজাল্ট নির্বাচন সব মহলকে তাক্ লাগিয়ে দিয়েছে এমনকি এই বিজয়ে আওয়ামী লীগও খানিকটা লজ্জার মধ্যেই পড়ে গেছে। এতটা তারা আশা করেননি। সিইসি’র ডিজাইন বড় চমৎকার। তারা বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট।
একেবারে স্বৈরাচারী এরশাদের সমপর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। এরশাদের লাঙ্গল মার্কা ৬.৯৭ শতাংশ ভোট পেয়ে ২৭ আসনে জয়লাভ করেছে। আর ধানের শীষ ৩২.৯৪ শতাংশ ভোট পেয়ে ২৭ আসনে জয়লাভ করেছে। বৃহত্তর নোয়াখালীতে বরকত উল্লাহ বুলু ২৬ হাজার ভোট বেশি পেলেও তাকে নির্বাচিত ঘোষণা না করার জন্য দু’দিন ধরে নির্বাচন কমিশন দারুণ কোশেশ করেছে। কারণ? নির্বাচনের দিন বুলুর এক সমর্থকের কাছে ৭১ হাজার টাকা পাওয়া গেছে। টাকা থাকবে ব্যাংকে। টাকা তার পকেটে কেন? নিশ্চয়ই এ টাকা কাউকে প্রভাবিত করার জন্য আনা হয়েছিল। অথচ এক আওয়ামী প্রার্থীর গাড়িতে ৫৯ লাখ টাকা পাওয়া গেল। নির্বাচন কমিশন ঘুমিয়ে পড়া শিশুটির মতো চুপটি করে পড়ে থাকলেন। কী নিদারুণ নিরপেক্ষতা!
সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের জন্য আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটকে অভিনন্দন জানাই। নির্বাচন কমিশন এখানে যে ইঞ্জিনিয়ারিং করল সেটা হয়তো তারা জানতেন, কিন্তু ধারণা করি এই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে তাদের প্রত্যক্ষ কোনো হাত ছিল না। সে দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। স্বপ্রণোদিত হয়ে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল। মহাজোট নেত্রী নির্বাচন কমিশনের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সাফল্যের ব্যাপারে সম্ভবত খুবই নিশ্চিত ছিলেন।
সে কারণে ভোটের দিন সকাল-বেলা তিনি অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সাথে বলেছিলেন যে নির্বাচনের ফলাফল যা-ই হোক সবারই তা মেনে নেয়া উচিত। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক জীবনে এ ধরনের উদার কথা এই প্রথম। মহাজোট সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। রাজনীতিতে তাদেরও অভিজ্ঞতা কম তিক্ত নয়। যেভাবেই হোক তারা বিজয়ী হয়েছেন। যেন প্রজ্ঞা, বুদ্ধিমত্তা, সহনশীলতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ মিলিয়েই তারা রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্রতী হন। তার ভেতরেই দেশ ও জনগণের কল্যাণ।
লেখকঃ সাংবাদিক, চেয়ারম্যান, সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড মিডিয়া
e-mail: [email protected]
(নয়া দিগন্ত ০৩/০১/২০০৯)