আমি কাট-পেস্টের সংস্কৃতির বিরোধী। তবে ইউনুস প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক বিতর্কের প্রেক্ষিতে মনে হলো এই লেখাটি সকলের পড়া কর্তব্য। লেখাটি ভোরের কাগজের সৌজন্যে।
ড. ইউনূসের নোবেল
এম এম আকাশ
খবরটা যখন পেলাম তখন বিষয়টা অপ্রত্যাশিত ছিল না। তবে খবরটা পেয়ে কেউ কেউ যেমন এতো উল্লসিত হয়েছেন যে তার মনে হয়েছে ্তুবাংলাদেশের সকল মানুষ সহসা ১০ ফুট লম্বা হয়ে গেছে!্থ ততোটা উৎসাহ আমি যে বোধ করিনি তা অকপটে স্বীকার করছি। আবার কেউ কেউ যেমন ্তুসাম্রাজ্যবাদের অনুগত একজন শিষ্য নোবেল পেয়েছে_ তাতে গৌরব বোধ করার কি আছে?্থ এ রকম ভাবতে অভ্যসত্দ তাদের খাতাতেও আমি নাম লেখাতে উৎসাহ বোধ করিনি। আমার হিসাবটা সংক্ষেপে নিম্নরূপ :
ড. ইউনূস বাংলাদেশের একজন নাগরিক। তাই তিনি যখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো কোনো একটি পুরস্কার পান তখন বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ গর্বের বিষয়ে এবং আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয় এবং তাতে অভাগা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষেরা আনন্দিত হবেন সেটাই স্বাভাবিক। সেই দিক থেকে আমিও আনন্দিত। কিন' ্তুআনন্দে আত্মহারা্থ হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। কারণ ড. ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে আমার এবং আমার মতো অনেকেরই বহু পুরোনো কিছু বিশেষ সমালোচনা রয়েছে। সেগুলো সংক্ষেপে একে একে নিচে তুলে ধরা হলো :
বিশেষ সমস্যা_ এক : গ্রামীণ ব্যাংক গরিবদের ্তুমাইক্রো ক্রেডিট্থ দিয়ে থাকেন।
এতে এ কথা সত্য যে তারা গরিবদের দলবদ্ধ হতে, ঘর থেকে বার হতে এবং গ্রামীণ মহাজনদের হাত থেকে মুক্ত হতে সাহায্য করেছেন। কিন' এ কথাও সত্য যে, সুদ-আসল বাবদ সব কিছু দিয়ে-থুয়ে এই ক্ষুদ্রঋণ থেকে যে অপর্যাপ্ত আয় হয় তা দিয়ে একজন দরিদ্র লোক নির্মম দারিদর্্যচক্র থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হতে পারেন না। হয়তো ঐ ঋণ না পেলে তিনি একদম ডুবে যেতেন, কিন' ঋণ পাওয়ার ফলে তিনি বড়জোর নাক ভাসিয়ে বেঁচে থাকার সুযোগ পান। অর্থনৈতিকভাবে নিজের পায়ে স্থায়ী ও সবলভাবে দাঁড়াতে সক্ষম হন না। একটি ক্ষুদ্র ঢেউ বা যেকোনো অর্থনৈতিক দুর্যোগ তাকে আবার ধাক্কা দিয়ে নিচে নামিয়ে দেয়। তাই আমরা বলেছি, ্তুমাইক্রো ক্রেডিট মাইক্রো মবিলিটি্থ সৃষ্টি করে মাত্র, এ দিয়ে দারিদর্্য সমস্যার ্তুম্যাক্রো্থ সমাধান সম্ভব হবে না। অর্থনীতির সামপ্রতিক লিটারেচারে বিশেষত বাংলাদেশের দারিদর্্য বিশে্লষণে এই সমস্যাটিকে দারিদ্র্যের ক্ষেত্রে ্তুম্যাক্রো-মাইক্রো মিসম্যাচ্থ (গধপৎড়-গরপৎড় গরংসধঃপয) নামে অভিহিত করা হয়েছে।
বিশেষ সমস্যা_ দুই : এক নম্বর সমস্যা সমাধানের একটা সম্ভাব্য উদ্যোগ হতে পারতো দরিদ্রদের ক্ষুদ্রঋণ দেওয়ার পরিবর্তে তাদের জন্য ্তুবৃহৎ ঋণ্থ (গধপৎড় ঈৎবফরঃ)-এর সুযোগ সৃষ্টি করা। অথবা দরিদ্রদের সঞ্চয় একত্র করে তাকে বৃহৎ যৌথ পুঁজিতে রূপান্তরিত করে সেটা যৌথ বৃহদায়তন উদ্যোগে বিনিয়োগ করা। এভাবে দরিদ্রদের ্তুপ্রান্তিক অর্থনীতি্থ থেকে ক্রমোন্নতির (এৎধফঁধঃরড়হ) মাধ্যমে টেনে উঠিয়ে অর্থনীতির মূলধারায় তাদেরকে স্থাপন করা গেলে দারিদর্্য সমস্যার একটা স্থায়ী সমাধান সম্ভব হতো। কিন' প্রশ্ন হচ্ছে, গ্রামীণ ব্যাংক কি সেদিকে আদৌ অগ্রসর হচ্ছেন। সুখের বিষয় যে অধ্যাপক ইউনূস ্তুগ্রামীণ ফান্ড্থ-এর মাধ্যমে অনেক আধুনিক বৃহদায়তন প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করা শুরু করেছেন (যেমন গ্রামীণ সাইবারনেট, গ্রামীণ টেলিকম, গ্রামীণ টেক্সটাইল ইত্যাদি)। কিন' এখানে অনেকগুলো প্রশ্ন আজো রয়ে গেছে যা পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। প্রথমত, এই বিনিয়োগের অর্থের চূড়ান্ত মালিক কারা? এটা কি ্তুগ্রামীণ ফান্ড্থ? এটি কি ্তুগ্রামীণ ব্যাংক্থ নামে একটি প্রতিষ্ঠান? যদি শেষ উত্তরটি উত্তর হয়, তাহলে যেহেতু গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক হচ্ছেন তার ৬৬ লাখ গরিব সদস্য-সদস্যাবৃন্দ_ তারাই তো হবেন প্রকৃত অর্থে এই বিনিয়োগের অধিকর্তা। তাহলে এই বিনিয়োগ থেকে যে মুনাফা অর্জিত হচ্ছে তারও প্রকৃত প্রাপক হবেন তারাই। কিন' তাদের এই মালিকানার অধিকারটি কার্যকরভাবে প্রয়োগ করার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ কি গ্রামীণ ব্যাংকে গড়ে তোলা হয়েছে? এই দরিদ্র মালিকবৃন্দের কাছে গ্রামীণ ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং কর্মকর্তারা কি কখনো কোনো রকম জবাবদিহি করে থাকেন?
বিশেষ সমস্যা_ তিন : শেষ সমস্যাটি হচ্ছে সুদের হার এবং ঋণ আদায়ে নিষ্ঠুর শক্তি প্রয়োগের সমস্যা। গ্রামীণ ব্যাংকের সুদের হার কাগজে-কলমে বিধৃত আছে ২০ শতাংশ। আর কার্যকর সুদের হার দাঁড়ায় প্রায় ৩০ শতাংশ। আর গ্রাম ও শহরের অপেক্ষাকৃত ধনীরা বাংলাদেশে মাত্র ১২-১৫ শতাংশ সুদের হারে অনেক বড়ো অংকের ঋণ পেয়ে থাকেন। গরিব ও যারা ঠিকমতো ঋণ শোধ করেন তাদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে উচ্চতর সুদ। অথচ বড়োলোকদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে নিম্নতর সুদ_ এটা তো সামাজিক ন্যায়বিচারের লক্ষণ হতে পারে না।
এসব সমস্যার অর্থ এই নয় যে ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন এবং তাদের ক্রিয়াকাণ্ডের কোনো মঙ্গলজনক প্রতিফল নেই। নিশ্চয়ই নারীমুক্তি এবং গ্রামাঞ্চলে দরিদ্র নারীদের উপার্জনমূলক কাজে টেনে আনার ক্ষেত্রে গ্রামীণ ব্যাংকের একটি বিরাট অবদান রয়েছে। কিন' ঋণ শোধ করতে না পেরে ্তুআত্মহত্যা্থ করেছেন বা গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছেন এ রকম ঘটনাও তো ঘটেছে। এক এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে অন্য এনজিওর ঋণ শোধ করেছেন এ রকম ঘটনাও তো বিরল নয়।
তাই নোবেল বিজয়ে আনন্দিত হয়েও আমি সব সময়ই বলবো যে ্তুগ্রামীণ ব্যাংক্থ কোনো সমালোচনার ঊর্ধ্বে সংগঠন নয়। এটাও লক্ষণীয় যে, ্তুঅর্থনীতিতে্থ ড. ইউনূসকে কিন' শেষ পর্যন্ত নোবেল পুরস্কার দেওয়া হলো না_ দেওয়া হলো ্তুশান্তি্থ পুরস্কার! কিন' এই ্তুনোবেল শান্তি পুরস্কারটি্থ অতীতে এমন সব লোককে দেওয়া হয়েছিল যাতে এর মর্যাদা অনেকখানি নিচে নেমে গেছে এবং পুরস্কারটির পেছনে ক্ষেত্র বিশেষে রাজনীতি কাজ করে কিনা তা নিয়েও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। ড. ইউনূসের ক্ষেত্রেও কোনো রাজনীতি কাজ করেছে কি না_ তা আমি জানি না। তবে তিনি যে বিশ্ব-পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ্তুপ্যারামিটার্থগুলো মেনে নিয়ে তার মধ্যেই সংস্কারের মাধ্যমে দরিদ্রদের অবস্থা উন্নত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন_ সে বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই।
এম এম আকাশ : অর্থনীতিবিদ। অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা নভেম্বর, ২০০৬ দুপুর ১:৪২