চৌত্রিশ দিন দেশে ছিলাম অথচ একদিনও মায়ের হাতে ভাত খাইনি। একদিনও জড়িয়ে ধরে মা বলে কাদিনি। কেবল হরতালের কল্যানে তিনদিন সারাদিন বাসায় ছিলাম মায়ের সাথে। আমি বসে বসে ল্যাপটপে কাজ করি, মা এসে পাশে বসে থাকে। বসে থাকে কিন্তু কিছু বলে না। আমি স্বভাব বসত ইগনোর করে যাই। কিন্তু হঠাৎ খেয়াল হল আরে, মা বাবাকে তো সময়ই দেয়া হয়নি। শেষে মায়ের কোলে শুয়ে আমি, মা আর বাবা টিভি দেখলাম কিছুক্ষন। আমার সোনালী মুহর্ুত্ব বালির মত হাতের ফাঁক গলে বেরিয়ে যায়...
এবারে শ্বাশুড়ী আম্মাকেও মিস করেছি অনেক। বিভিন্ন অনুষ্ঠান আর হরতাল, অবরোধে তাকেও সময় দেইনি একদমই।
প্রথম বার আসবার মত কষ্ট লাগেনি এবার। আসবার আগেরদিন দুপুরে খেতে বসেছি। মা ভাত বেড়ে দিচ্ছে। হঠাৎ মনে হল মায়ের সাথে এটাই আমার শেষ দুপুর। বুক ভেঙ্গে কান্না চলে আসল।
আসবার দিন সকালে খুব কষ্ট শুরু হল যখন আমার ভাই তার ঘুমন্ত মেয়েটাকে এনে আমার কোলে দেয়। মা কাঁদছে। আমার স্ত্রী কাঁদছে। কাঁদছে ভাইয়ের স্ত্রী, ভাই, বোন, খালারা। দূরে দাঁড়িয়ে কান্না চাপছে আমার বাবা। গলার কাছে দলাটাকে চেপে জোড় করে ভিতরে ঠেলে দিয়ে বকা দিলাম, এতো কান্নার কি আছে?
এয়ার পোর্টে গিয়ে দেখলাম নতুন নিয়ম করেছে। মালপত্রের সাথে আর ঢুকতে দেয়া হয়না আত্মীয় স্বজনকে। আমার ছোটকাকা বিমানে কর্মরত বিধায় ঢুকতে পারলেন। মালপত্র চেক ইন করতে গিয়ে দেখি চেকইন ব্যাগেজ আন্ডার ওয়েট কিন্তু ক্যারিঅন ওভার ওয়েট। সব ঠিকঠাক করতে করতে দেরী হয়ে গেল। ফিরে গিয়ে আর শেষ দেখা হল না সবার সাথে। এয়ারপোর্টের ভেতর থেকে ফোনেই বিদায় নিলাম।
সব ঝামেলা সেরে যখন বোর্ডিং করেছি প্লেনে তখন হঠাৎ মনটা খারাপ হতে শুরু করল। আমার শৈশব, আমার বেড়ে ওঠা, আমার নাড়ীর বাঁধন সব কিছু ফেলে সীট বেলটের সাথে নিজেকে বেঁধে পাঠিয়ে দিচ্ছি দূরদেশে। প্লেন দৌড়াচ্ছে, গতি বাড়ছে। ছোট ছোট জলাশয় গুলো পেছনে ফেলে ছুটে যাচ্ছে প্লেন। আস্তে আস্তে ছোট হতে শুরু করল মানুষ, বাড়ীঘর, মানচিত্র। সবকিছু ঝাপসা হতে শুরু করল। আহ, চোখে কিছু পড়ল নাকি বাইরে বড্ড বেশী কুয়াশা...?
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০