আপনাদের সময় নিশ্চয়ই লোকজন বেশি ছিল না যাদের ইন্টারভিউ নেয়া যায়?
আমি কখনও বোধ করিনি যে এটা একটা কাজ হতে পারে। না, লোক কি আর কোন সময় একেবারে শূন্য থাকে? আমার মনে হয় এখনই বরঞ্চ লোক কম, যাদের ইন্টারভিউ নেয়া যায়। ক্রমশ কমছে।
কিন্ত আমরা তো বেশিই নিচ্ছি ইন্টারভিউ।
হবে না? ফেনা বেশি। জিনিস কম।
আচ্ছা আপনি তো একসময় লিখতেন না, এরকম সময় আছে নিশ্চয়ই?
একসময়...?
মানে লিখতেন না যখন, এরকম তো কিছু সময় ছিল আপনার, না?
সে বাল্যকালের কথা বলছো? বলো।
ধরেন লিখতেন, কিন্ত মনে হতো যে লিখতেছেন না। মানে আপনি পজিশনে আসেন নাই তখনও।
না, লিখতাম না মানে কি, লিখতাম তো, ধরো পড়তাম। পড়া সম্পর্কে খুব আগ্রহ ছিল। যখন লিখতে শুরু করেছি তখন পড়া এবং লেখা এই দুটিকেই একেবারে গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে মনে করেছি। কাজেই সচেতন ছিলাম--লিখতাম না কখন আর কখন লিখতাম।
আপনি যখন লেখা শুরু করলেন তখন আপনাদের সামনে কারা ছিল, বড় লেখক?
বিশ্বের সবাই ছিল।
না, সেভাবে তো আর শুরুটা নিশ্চয়ই করেন নাই?
না, সেভাবে শুরু করিনি। বাবার কথাতেই ফিরে আসি। বাবার একটা অদ্ভুত শিক্ষাদান পদ্ধতি ছিল। উনি ভোর রাতে মাঝে-মাঝে আমাকে ঘুম থেকে তুলে দিতেন। তুলে দিয়ে নানারকম গল্প করতেন। মানসিক অংক কষাতেন। যে, 'বাবা ব্ল্যাকবোর্ড দেখতে পাচ্ছো?' 'হ্যাঁ পাচ্ছি।' 'লেখো দুশো সতের। এর নিচে লেখো একশ তের। এবার গুণ দাও।' এবং আই ইউ্ড্ টু ডু ইট। আমি পারতাম করতে। তো বাবা গল্প বলতেন অনেক। ওই সময়ে বাবার কাছে সোহরাব-রুস্তমের গল্প শুনেছি। শুনেছি শাহানামা একটা এপিক। ল্যাম্বস টেল, ওই যে শেক্সপীয়ারের যেটা; প্রত্যেকটা গল্প। এমনকী তুমি জানবে যে আমার বালক বয়সেই আমি জানতাম যে শেক্সপীয়র নামে একজন নাট্যকার আছেন, যাঁর নাটকগুলো তিনভাগে ভাগ করা যায়। ঐতিহাসিক। এবং ট্র্যাজেডি। এবং কমেডি। এটা বিফোর আই কু্যড্ ইভেন স্পেল শেক্সপীয়রস নেইম। তারপর যেমন ধরো দুর্গেশনন্দিনী, শরৎচন্দ্রের বই--শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত, শ্রীকান্তর গল্প। কাজেই বড় লেখক কারা ছিল যখন বলো, আমার ক্ষেত্রে আমি বলব তখন এইরকমই ছিল। তারপরে দেখো আমাদের একেবারেই ছেলেবেলার কথা। আমাদের ওই অঞ্চলে, সেই সময়ে বেশ কয়েকজন উৎসাহী যুবক ছিলেন। যাঁরা নিয়মিতভাবে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন পালন করতো। তারপরে আবার 'পাকিস্তান আন্দোলন' যখন কাছাকাছি চলে আসল, তখন স্থানীয় মুসলিম সমপ্রদায়ের যুবকেরা, তারা ওই আবার বলে কী, একটা প্রতিপক্ষ দাঁড় করানো দরকার। তুমি তো জানই প্রতিপক্ষ কে হবে, নজরুল জয়নত্দী শুরু করলো। এবং আমরা মাঝখান থেকে ভাবতাম, যে একজনের গালে দাড়ি আছে, একজনের গালে দাড়ি নাই, কিন্ত দুজনেই খুব বড় কবি। এবং উই ওয়ার চাইল্ড। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয়, তাঁর কিছু কবিতা পড়তাম, পাঠ্যপুস্তক ছিল। এরকম তো জানতাম যে উনি খুব বড় একজন মানুষ। মারা গেলেন যখন, আমার সেই দিনটার কথা খুব মনে আছে। রবীন্দ্রনাথ মারা গেলেন, আমার তখন অল্প বয়স। কত হবে, ছয় সাত। আই স্টিল রিমেমবার, স্টিল রিমেমবার যে বাবা মাকে বলছেন, 'ওহে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মারা গেছে, বুঝলে?' এটা আমার এখনও মনে আছে। আমি তখনও মনে করছি, আরে সেই তো, 'আমাদের ছোট নদী...' হঁ্যা।
আপনার বয়েস তো তখন খুব বেশি না?
আমার ছ' বছর, ছ' বছর। কিন্ত আমার মনে আছে। এরও আগের অনেক স্মৃতি আমার মনে আছে। একটি ঘটনার কথা বাবাকে যখন বলি বাবা বলে তোর বয়স তখন দু' বছর। দু' বছর। আমি বললাম যে বাবা আপনার সঙ্গে হাত ধরে একটা নদীর পাড়ে দাড়িয়েছিলাম। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। আর আমার খুব ভয় করছে। তো আমি আপনাকে 'বাবা' বলে ডাক দিলাম। আর নিচে নদীর পানি। আপনি আমাকে খপ করে কোলে তুলে নিলেন। তো বলল যে, এটা ছিল তোর যে-বাড়িতে জন্ম, যে বাড়ি নদীতে ভেঙে যায়...ওই নদী কাছে চলে এসেছিল বলে, আমি চলে আসবো। তো আসবার দিন বিকেলবেলায় তোকে নিয়ে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়েছিলাম। যে, বাড়িটা ছেড়ে চলে যাব!...তো যাই হোক, স্মৃতির কথা না। বড় লেখক, ঠাট্টা করছি না, তখন আমাদের কুড়িগ্রামে এমন একটা পরিবেশ ছিল, তুমি জানবে কুড়িগ্রামে তখন প্রায় সব শিক্ষিত পরিবার। এবং অধিকাংশই হচ্ছে...এবং তারা খুব, মানে খুব সাংস্কৃতিক লোক ছিল। এই নাটক করছে। গান করছে। রবীন্দ্রজয়নত্দী করছে। পাড়ায় পাড়ায় লাইব্রেরি করছে। এই মহড়া দিচ্ছে। গানের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। অ্যাটমোস্ফিয়ার ছিল। আমাদের যে পাবলিক লাইব্রেরিটা ছিল কুড়িগ্রামে খুব রিচ পাবলিক লাইব্রেরি ছিল। বাই দা টাইম আই ওয়াজ ইলেভেন, বাবা নিজের নামে বই ইসু্য করে আমার জন্য নিয়ে আসতেন। 'পড়ো, পড়ো।' বাবার পড়ার খুব ঝোঁক ছিল। সেটাই করেছেন। যেমন আমি ক্লাস এইটে যখন পড়ি এক বর্ণও প্রায় না বুঝে 'মেঘনাধ বধ কাব্য' পুরো পড়ি।
ক্লাস এইটে থাকার সময়।
ক্লাস এইট। ক্লাস এইট। আমার তখন বার বছর বয়স। সেটা একটা গরমকালীন ছুটির দুপুরবেলা ছিল পরিষ্কার মনে আছে। এইরকম একটা মোটা রচনাবলী ছিল। সেকালের মোটা কাগজে ছাপা। পড়েছি। তো, কাজেই তুমি যে বলেছ সে সময় বড় লেখক কারা ছিল, সেভাবে দেখা ঠিক হবে না। উই হ্যাভ ওয়ার্ল্ড বিফোর আস। আমাদের সময় ইংরেজি পড়াশুনার চলটা বেশি ছিল। কাজেই সেটাও কিন্ত একটা বিশাল ভাবে আমাদের জানতে হত। এখন কিন্ত খুব ন্যারো। আমাদের ছেলেবেলাতেও, ধরো ক্লাস ফোরে ফাইভে যে-সমস্ত আমাদের কবিতা পড়তে হতো, যে-সমস্ত আমাদের লেখা পড়তে হতো, সেগুলো এখন ক্লাস টেনেও আমি দেখতে পাই না। তো কাজেই, এবং শিক্ষকেরাও তখন আমাদের সময়, বিশেষ করে আমার সময়, আমার স্কুলের শিক্ষক খুব ভাল শিক্ষক ছিলেন। যেমন আমাদের যে ইংরেজি পড়াতেন নীপেন্দ্র কৃষ্ণ বাবু, নৃপেন্দ্র কৃষ্ণ সরকার, তিনি কলকাতাতে খুব ভাল ছাত্র ছিলেন। এবং এখন মনে হয়, বোধ হয় ইংরেজি সাহিত্যেরই ছাত্র ছিলেন। কিন্ত ওই যে এক সময় আছে না 'গ্রামে ফিরিয়া যাও' একটা আন্দোলন হয়েছিল, কংগ্রেসী আন্দোলনের সময়। ওই 'গ্রামে ফিরিয়া যাও' আন্দোলনে উনি চলে এসেছেন আমাদের এখানে। তো লাভটা...
(অসম্পূর্ণ)
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১২:৫৯