somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কুরবানির আগের রাতে গরু কেন কাঁদে?

২৮ শে জুন, ২০২৩ রাত ১০:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কাল ঈদ। রাতে খেয়ে ঘুমানোর আগে কোরবানীর গরুটাকে আরেকবার দেখতে এলো সিয়াম। সিয়ামকে দেখেই তার বন্ধু হৃদয় প্রশ্ন করলো, ‘আমাদের গরুটা কাঁদতে শুরু করেছে। তোদের গরুটা কি কাঁদছে?’
সিয়াম তাকিয়ে দেখলো তাদের গরুটার চোখ থেকে পানি বেয়ে পড়ছে। সে খুব অবাক হলো। ‘কাঁদছে কেন?’
‘আমার নানু বলেছেন, কোরবানির আগের রাত্রে ফেরেশতারা নাকি গরুকে জবাইয়ের সংবাদ জানায়, স্বপ্নে ছুড়ি দেখায়। আজকের রাতই জীবনের শেষ রাত বুঝতে পেরে গরু কাঁদতে থাকে’, হৃদয় জানালো। সিয়ামের মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। গরু কেন কাঁদে? গরুগুলো কি সারারাত ধরে কাঁদতে থাকবে?

উপরের এই কথোপকথন কাল্পনিক হলেও কোরবানির আগের রাতে গরুর কান্নার সাথে আমরা সবাই-ই পরিচিত। ফেরেশতা কর্তৃক জবাইয়ের খবর জানিয়ে দেয়ার এই ঘটনাও হয়তো শুনে থাকবে। কিন্তু গরু কি আসলেই কাঁদে? গরু কেন কাঁদে?

এ প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, আমাদের দেশে যেরকম কোরবানির আগের রাতে গরুর কান্নার ঘটনা ঘটে, তেমনি উন্নত বিশ্বে যেখানে মাংস বিক্রির জন্য গরুকে আধুনিক যন্ত্রপাতিসমৃদ্ধ কসাইখানায় জবাই ও কাটাকুটি করা হয়, সেখানেও প্রায় একই গল্প প্রচলিত আছে। কসাইখানায় (ইংরেজিতে বলে স্লটারহাউজ) নেয়ার আগে সেখানকার গরুও নাকি চোখের পানি ফেলে। সম্ভবত সেখানকার গরুগুলোও আগেই মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে শোকে কাতর হয়।

গরুকে মৃত্যুর এই সংবাদ জানিয়ে দেয়া বা কোরবানির আগের রাতে গরু কেন কাঁদে তার কোন ঐতিহাসিক দলিল রয়েছে কিনা এ বিষয়ে জামিয়া কুরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ মাদ্রাসার মুহাদ্দিস মুফতী ফয়জুল্লাহর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। তিনি নিজেও এ ধরণের গল্পের কথা শুনেছেন বলে জানিয়েছেন, কুরআন-হাদীসে এমন কোন ঘটনার উল্লেখ নেই। এটি মূলত লোকমুখে প্রচলিত একটি কাহিনী যার কোন ঐতিহাসিক সত্যতা নেই।

মুফতী ফয়জুল্লাহর এই বক্তব্যকে গ্রহণ করা যেতে পারে কারণ ফেরেশতারা যদি সত্যিই কোরবানির গরুকে আগের রাতে মৃত্যু সংবাদ জানিয়ে থাকেন তাহলে কুরআন-হাদীসে সেই ঘটনার উল্লেখ থাকতো। যেহেতু মানুষ গরুর কথা বুঝতে পারে না, সেহেতু গরুর কাছ থেকে এই তথ্য জানার সম্ভাবনাও নেই। সম্ভবত বহু আগে কোন দুষ্টু লোক কোন বুজুর্গের নাম ভাঙ্গিয়ে এই গল্প চালিয়ে দিয়েছিল যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে লোকমুখেই চলে আসছে।

তাহলে প্রশ্ন জাগে, কোরবানির আগের রাতে কিংবা কসাইখানায় যে গরুগুলোকে নিয়ে যাওয়া হয় সেই গরু কেন কাঁদে?

জানিয়ে রাখি, গরুর চোখে একটি রোগ হয়ে থাকে যার কারণে গরুর চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরতে থাকে। একে অনেকে গরুর কান্না বলে মনে করলেও এটি মূলকত একটি অসুখ এবং নির্দিষ্ট চিকিৎসায় এই কান্না বন্ধ হতে পারে। কোরবানি বা কসাইখানায় যাওয়ার অনেক আগেই গরুর চোখে এই সমস্যা হতে পারে। সেক্ষেত্রে দ্রুত পশুর ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়াই মঙ্গল।

জবাইয়ের আগে গরুর কান্নার পেছনে চোখের অসুখ কারণ হিসেবে নেই। তাহলে গরু কেন কাঁদে? এই প্রসঙ্গে পশুপ্রেমী এবং গোশতপ্রেমীরা তাদের নিজ নিজ ধারণা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। পশুপ্রেমীদের একাংশের ধারণা – নিরীহ শান্ত এই প্রাণীটি ঠিক বুঝতে পারে আর এজন্যই কাঁদে। অন্যদিকে, গোশতপ্রেমীরা জোর গলায় বলে – গরুর এইসব অনুভূতিই নেই, সুতরাং গরু মনের দুঃখে কাঁদে এটা বোগাস কথা।

বিজ্ঞানীরা অবশ্য বলছেন, গরু অনুভূতিহীন নয়। গরু এবং অন্যান্য প্রাণীদের নিয়ে নানা গবেষণা শেষে তারা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, গরুর নিজস্ব কিছু অনুভূতি রয়েছে। গরুও আনন্দিত হয়, ব্যথিত হয় কষ্ট পায়।

তাহলে কি গরু সত্যিই মনের দুঃখে কাঁদে? এ বিষয়ে বিজ্ঞানীরা অবশ্য মাথা নাড়েন। তারা বলেন, মানুষ ছাড়া প্রাণীজগতে আর একমাত্র একটি প্রাণীই রয়েছে যারা মনের দুঃখে অশ্রুপাত করে। সেই প্রাণীটি কিন্তু শিম্পাঞ্জি, গরিলা বা মানুষের সাথে সাদৃশ্য রয়েছে এমন কোন প্রাণী নয়। এই প্রাণীটি হলো স্থলের সবচেয়ে বড় শরীরের অধিকারী – হাতি।

জবাই হয়ে যাবে বুঝতে পেরে মনের দুঃখে গরু কাঁদে – এই ধারণাটা কিছুটা হাস্যকরও বটে। গরু যদি মানুষের সকল কথা বুঝতে পারতো তাহলে কি সে আর ‘গরু’ থাকতো? হয়তো জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মানুষের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দুই একটা আসনে জিতে সংসদে বসতো। অথচ কসাইরা বলে, চোখের সামনে অন্য গরুকে জবাই হতে দেখেও গরু কসাইয়ের আদর উপভোগ করে, জিহবা দিয়ে হাত চেটে দেয়। যদি সত্যিই বুঝতে পারতো তাহলে নিশ্চয়ই শিং দিয়ে গুতিয়ে কসাই ব্যাটার দফারফা করে দিতো, তাই না?

সুতরাং জবাইয়ের পূর্ব সংবাদ না পেলে এবং মনের দুঃখে না কাঁদলে গরু কেন কাঁদে? এই প্রশ্নের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হলো – গরুর প্রতি মানুষের আচরণ। কুরবানির আগে একেকটা গরু কঠিন প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে যায়। নানা রকম শারীরিক কষ্ট তাকে সহ্য করতে হয়। তার উপর নাম নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষ ইত্যাদি কারণে সে ভয় পায়। কসাইখানায় যাওয়ার আগেও একই ঘটনা ঘটে। এই শারীরিক কষ্ট সহ্য করতে না পেরে গরু কাঁদে – এর সাথে জবাইয়ের কোন সম্পর্ক নেই। অন্য সময়ও কষ্ট পেয়ে গরু কাঁদতে পারে। যেমন নিঃসঙ্গতা কিংবা বাছুর হারানোর শোকে গরু সশব্দে কাঁদে।

যেহেতু আমরা জেনে গিয়েছি যে জবাইয়ের সংবাদে গরু কাঁদে না – বরং শারীরিক কষ্টের কারণে কাঁদতে পারে, তাই আমাদের কাজ দুটো। এক, কোরবানির আগের রাতে ফেরেশতা কতৃক জবাইয়ের সংবাদ নিয়ে যে কাহিনী প্রচলিত আছে তার প্রচার না করা এবং দুই, গরুকে, বিশেষতঃ কোরবানির গরুকে, যথাসম্ভব কম কষ্ট দেয়া। এতে আমাদের কোরবানির ঈদ আরেকটু বেশি আনন্দদায়ক হবে আশা করি।
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিপ্লবের নিঃশব্দ মূল্য: অর্থনৈতিক বৈষম্য ও বাংলাদেশি ছাত্র আন্দোলন

লিখেছেন মুনতাসির, ১২ ই অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ৯:২৫

এ লেখাটি বেশ বড়ো। এখানে ছোট করে দেয়া হল। পুরো লেখাটি যদি কেও পড়তে চান, তবে নীচের লিঙ্ক থেকে পড়তে পারবেন।


সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে হতাহতের সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন পর্যালোচনা চলছে। জাতিসংঘের... ...বাকিটুকু পড়ুন

বেঁচে থাকার প্রয়াস।

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ১২ ই অক্টোবর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৮




আমার ভেতরে জন্ম নেয়া বিভিন্ন চরিত্র আজন্ম যুদ্ধে লিপ্ত,যা বিশ্বযুদ্ধ থেকে ভয়াবহ। প্রতি সেকেন্ডে একজন মারছে,একজন উদযাপন করছে, এসব আটকানোর কোনো শান্তি চুক্তি নেই, নেই কোনো মোড়কে বেধে দেয়ে বিভিন্ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিছু কিছু মানুষ বলার শুরু করেছে, "আমরা আগেই ভালো ছিলাম"।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১২ ই অক্টোবর, ২০২৪ দুপুর ২:০২



একাধিক কারণে মানুষ ইহা বলার শুরু করেছেন: (১) সাধারণ মানুষ কোমলমতিদের ক্রমেই চিনতে পারছেন, ইহা ভীতি ও অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করছে; কোমলমতিরা সরকারের গুরুত্বপুর্ণ অনেক পদে আছে ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি - একাল সেকাল

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ১২ ই অক্টোবর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮



টানা বৃষ্টির মধ্যে মরিচের দাম বেড়ে হয়েছে ৪০০ টাকা কেজি । অন্যদিকে ফার্মের মুরগির এক পিছ ডিমের দাম বেড়ে হয়েছে ১৫ টাকা।শুধু মরিচ নয়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কমলা যদি পরাজিত হয়, "দ্রব্যমুল্য"ই হবে ১ নম্বর কারণ

লিখেছেন সোনাগাজী, ১২ ই অক্টোবর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৩৭



দ্রব্যমুল্য হচ্ছে অর্থনৈতিক সুচকগুলোর মাঝে ১ টি বড় প্যারামিটার; ইহা দেশের অর্থনীতি ও চলমান ফাইন্যান্সের সাথে সামন্জস্য রেখে চলে; টাস্কফোর্স, মাস্কফোর্স ইহার মুল সমাধান নয়; ইহার মুল সমাধন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×