somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আজ একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী: ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক সমাজ গড়ার অঙ্গিকার

১৯ শে জানুয়ারি, ২০২০ সকাল ১১:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আমি শুরুতেই পাঠককে একটি বইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই। অনেকেই বইটি পড়েছেন, অন্তত বইটির নাম শুনে থাকবেন। বলছি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের লেখা একাত্তরের দিনগুলি বইটির কথা। বইটির কেন্দ্রীয় চরিত্র শাফী ইমাম রুমী, যিনি ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন গেরিলা যোদ্ধা। তিনি ছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমামের জ্যেষ্ঠ পুত্র। শাফী ইমাম রুমি (২৯ মার্চ, ১৯৫১ – ৩০ আগস্ট, ১৯৭১) শহীদ হয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। ধর্মনিরপেক্ষ, মানবিক এবং সমতার বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নে আত্মনিয়োগ করে শুধু রুমি নয়, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন আরো অনেক তাজা তরুণ প্রাণ। তাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তোলার দায়িত্ব আজ আমাদের কাঁধে।
১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১০১ সদস্যবিশিষ্ট একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবী এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় রাষ্ট্র গঠনে শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে আত্মনিয়োগ করেন লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির এবং আলোকিত আরো অনেকে ব্যক্তিবর্গ।
জাহানারা ইমামের আন্দোলনের কারণেই একাত্তরের সেই পরাজিত অন্ধকারের অপশক্তির বিচার করা সম্ভব হয়েছে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি শুধু যে ঘাতকদের বিচারের দাবীই করে গিয়েছে তা নয়, তারা কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক, ধর্মনিরেপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক মানবিক রাষ্ট্র তৈরি হবে সে কাজটিও করে গিয়েছে। তাই বর্তমান লেখাটির মূল অনুপ্রেরণা এবং অবকাঠামো নির্মূল কমিটির লক্ষ উদ্দেশ্য থেকেই নেওয়া। তরুণ সমাজের প্রতি যে আহ্বানটি এই লেখার মাধ্যমে আমি পৌঁছে দিতে চাচ্ছি সেটির চর্চা গত ২৮ বছর ধরে বাংলাদেশে প্রধানত ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিই করে আসছে। ফলে শিশু, কিশোর এবং তরুণ সমাজকে গড়ে তোলার দায়িত্ব নিতে হলে নির্মূল কমিটির লক্ষ, উদ্দেশ্য এবং চর্চা বুঝতে হবে, জড়িত হতে হবে জাহানারা ইমামের এ আন্দোলনের সাথে।
তরুণ সমাজ বলতে আমি কাদেরকে বুঝাচ্ছি, সে বিষয়টি একটু পরিষ্কার করা দরকার। তরুণ বা যুব সম্প্রদায় বলতে আমরা যদিও আঠারো বছর বয়সোর্ধ কাউকে ধরে নিই, আমি বয়সটাকে আরেকটু কমিয়ে ধরতে চাই। চৌদ্দ বছর বয়সীদেরও এই আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করতে চাই। সেক্ষেত্রে লেখাটির শিরোনাম হতে পারত “ধর্মনিরেপেক্ষ মানবিক রাষ্ট্র গঠনে কিশোর এবং তরুণ সমাজকে গড়ে তোলাই এখন মূল কাজ” (লিঙ্গভেদ করছি না, তাই আলাদাভাবে ‘কিশোরী’ বা ‘তরুণী’ বলার প্রয়োজন নেই)।
মুক্তিযোদ্ধা আবু সালেক, মোজাম্মেল হক, বাহাউদ্দিন রেজা, বা বীরউত্তম জহিরুল— অনেকেরই নিশ্চয়ই কিশোর বয়সী এসব মুক্তিযোদ্ধাদের নাম জানা আছে, এছাড়া ইতিহাসের পাতায় লেখা রয়েছে ক্ষুদিরাম এবং আনা ফ্রাঙ্কের মতো কিশোর কিংবদন্তীদের নামও। অবশ্যই অনেকের মনে পড়ে যাবে, প্রসঙ্গক্রমে চলে আসবে সর্বকনিষ্ট নোবেল বিজয়ী মালালা ইউসুফজাইয়ের নাম। এই নামগুলো আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় কিশোর বয়সী তারুণ্যের শক্তির কথা। এ শক্তিকে পাশে সরিয়ে রাখার অর্থ, ভীষণ শারীরিক এবং মানসিক শক্তিসম্পন্ন এবং দেশের সবচেয়ে সঙ্ঘবদ্ধ শক্তিকে মুখস্থ বিদ্যার বিষবৃত্তে বন্দী করে রাখা। এবং যেহেতু আমাদের পরিবারগুলো এখনো সে অর্থে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত নয়, অসাম্প্রদায়িক এবং ধর্মনিরেপেক্ষ মানবিক চেতনা দ্বারা লালিত নয়, তাই পারিবারিক শিক্ষার ওপর ভরসা রেখে এ সকল শিশু কিশোরদের বেড়ে উঠতে দিয়ে আমরা দায়িত্ব জ্ঞানসম্পন্ন এবং আলোকিত তরুণ সম্প্রদায় পাব না। এজন্য অবশ্যই আমাদের কর্মপরিকল্পনায় বিদ্যালয়গামী শিশু কিশোরদের রাখতে হবে। যে কাজটি জামাত এবং অপরাপর ধর্মব্যবসায়ী দলগুলো করেছে, কিশোর কণ্ঠ এবং এরকম আরো অনেক নামে পত্রিকা বের করে, সংগঠন করে শিশুকিশোরদের নরম মনে ধর্মান্ধতা এবং সাম্প্রদায়িকতার বিষ ঢুকিয়ে দিতে সচেষ্ট থেকেছে সবসময়।
জনসংখ্যা বিজ্ঞানের একটি দিক এই মুহূর্তে আমাদের অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে যে ২০০৭ সাল (সালটা একটু এগিয়ে পিছিয়েও চিন্তা করা যায়) থেকে আমাদের দেশে ডেমোগ্রাফিক উইনডো তৈরি হয়েছে, যেটি ২০৪০ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। কর্মশক্তি সম্পন্ন বাড়তি এই তরুণ জনগোষ্ঠী সঠিক পথে সঠিক কাজে লাগানোর মধ্যেই নিহিত রয়েছে দেশের আত্মপরিচয়, ভাবমূর্তি এবং উন্নয়ন। ডেমোগ্রাফিক উইনডো একটা দেশে একবারই তৈরি হয়, যখন কোনো দেশ ক্রমাগতভাবে জন্ম নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়, এবং শিশু মৃত্যুর হারও উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসে তখন দেশটিতে জনসংখ্যার এমন একটি অবস্থা কয়েক দশকের জন্য তৈরি হয় যে সময়ে মোট জনসংখ্যায় কর্মক্ষম, বিশেষ করে তরুণ জনসংখ্যা বেশি থাকে। আমাদের দেশ এখন সে জায়গাটিতে রয়েছে। এটা যেমন সুযোগ, আবার তরুণ সমাজকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে না পারলে, সঠিক পথে রাখতে না পারলে সঙ্কটও। খেয়াল রাখতে হবে, একটি দেশে এমন সুযোগ একবারই তৈরি হয়, তাই হেলাফেলার কোনো সুযোগ নেই। তরুণদেরকে নিয়ে ভাবার, কাজ শুরু করার সময় যাই যাই করছে, সময়টাকে যারা ধরবে, যাদের হাতে এই তরুণেরা পড়বে তাদের মতাদর্শ দ্বারাই তারা পরিচালিত হবে, এটাই স্বাভাবিক।
প্রশ্ন হচ্ছে, ইতোমধ্যে এই তরুণ সমাজ ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর ঘেরাটোপে পড়ে গিয়েছে কিনা? পুরোপুরি না গেলেও, অনেকখানি যে তারা তরুণ মস্তিষ্ক দখল করে ফেলেছে সেটি দৃশ্যমান। ফলে এখনই সময় পরিকল্পনা তৈরি করে সে অনুযায়ী তরুণদের নিয়ে কাজ করার। এটি শুধু বেসরকারি বা কিছু সংগঠনের পরিকল্পনার বিষয় নয়, মূল কাজটা করতে হবে সরকারকে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, মানবিক সুশীল সমাজকে সক্ষম হতে হবে সরকারকে দিয়ে বিদ্যালয়গুলো এমনভাবে পরিচালিত করা, এমন পাঠ্যক্রম নির্ধারণ করা, পাঠ্যাতিরিক্ত বিষয় রাখা, খেলাধুলা এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড রাখা, যাতে শিশু কিশোররা ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক পারিবারিক শিক্ষার বলয় থেকে সচেতনভাবে বের হয়ে আসতে পারে। শিক্ষকদের যথাযথ ট্রেনিং দিয়ে এজন্য উপযুক্ত করতে হবে। শিক্ষক নিয়োগের সময়ও বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে যাতে এমনসব শিক্ষক নিয়োগপ্রাপ্ত না হয় যারা ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক এবং পশ্চাদপদ, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী নয়। বিশেষ করে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বিষয়টি মাথায় রাখা উচিৎ। গণিত, ইংরেজি, বাংলা ব্যাকরণ ইত্যাদি ভালো পড়ানো যেমন জরুরি, তার চেয়ে বেশি জরুরি এইসব শিশু কিশোরদের এমন কথা বলা, এমনভাবে পরিচালিত করা যাতে তারা বিজ্ঞানমনস্ক এবং আধুনিক মানবিক মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠে।
বয়সের কথা বলছিলাম, জোর দিয়ে উল্লেখ করতে চাইলাম যে তরুণদের বয়সের নিম্নসীমা কোনোভাবেই আঠারো ধরে নিয়ে কাজ করা যাবে না, আইনগত বয়স আর ব্যক্তিগত বয়স এক বিষয় নয়, কেউ হয়ত চল্লিশ বছর বয়সে গিয়েও সামাজিক এবং রাজনৈতিক বোধ পরিষ্কার করতে পারে না, অনেকের মধ্যে আবার অনেক আগে থেকেই বোধটা চলে আসে, আর পরিপক্ব এবং আলোকিত তরুণ সমাজ তখনই পাওয়া যাবে যখন স্কুলগামী শিশু কিশোররা সঠিক শিক্ষাটা পাবে। বলে রাখা ভালো, বয়সের উর্ধ্বসীমাটা ভাবার বিষয় নয়, এটা হয়ত পঁচিশ, ত্রিশ বা চল্লিশ, বেশিও হতে পারে, মনের জোর থাকলে শতবর্ষী কাউকেও তরুণ ভাবতে দ্বিধা নেই। কিন্তু যতই অস্বীকার করি না কেন শরীরের জোরের সাথে মনের জোরেরও একটি সম্পর্ক রয়েছে। দৌড়িয়ে ঝাপিয়ে কাজ করতে গেলে শারীরিক উদ্যম থাকা লাগে, সেদিক থেকে একদল কর্মোদ্যমী তরুণ, একদল আলোকিত তরুণ, একদল মুক্তিযুদ্ধের মৌল চেতনাসম্পন্ন তরুণ আমাদের এখন খুবই প্রয়োজন, যারা ধর্মনিরপেক্ষ এবং মানবিক হয়ে বেড়ে উঠে এই দেশটাকে জঙ্গিবাদীদের হাত থেকে উদ্ধার করবে, রক্ষা করবে।
সংবিধানে যেমন এখনো গোলমাল রয়েছে, তেমনি গণ্ডগোল পাকিয়ে রাখা হয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। দ্রুতই এসব গোজামিল ঠিক করে তরুণ সমাজের সামনে উপস্থাপন করতে হবে। একেকজন একেক কথা বললে ওরা কার কথা বিশ্বাস করবে? মুক্তিযুদ্ধ, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং মানবিক বোধ নিয়ে যারা কাজ করে তাদের মধ্যে একটা ঐক্যমত থাকতে হবে, পাঠ্যপুস্তকে বিষয়গুলো সুস্পষ্টভাবে যুক্ত করতে হবে। ঢাকঢাক গুড়গুড় করে ক্ষমতা প্রলম্বিত করা গেলেও সমাজ যেখানে ছিল সেখানেই থেকে যাবে, যদি না পদ্মা সেতুর মতো বিশাল অবকাঠামো গড়ে তোলার পাশাপাশি সামাজিক অবকাঠামোর গড়ে তোলার দিকেও মনোযোগী হওয়া যায়।
ধর্মনিরপেক্ষতা, মানবতাবাদ এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার মতো আধুনিক চর্চানির্ভর অভিধাগুলোকে যারা কঠিন করে রেখেছে, এগুলো নিয়ে বিতর্ক তৈরি করে রেখেছে তাদের মোকাবেলা করতেই এসব নিয়ে পুনঃপুনঃ কাজ করতে হবে। বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে এসব বিষয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করতে হবে। শিশু, কিশোর এবং তরুণদের জন্য উপস্থাপনযোগ্য করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল পাঠ, সবার জন্য প্রযোজ্য বিজ্ঞান এবং গুরুত্বপূর্ণ বিশ^সাহিত্য পাঠের ব্যবস্থা করতে হবে। যুগের সাথে তাল মেলাতে অনলাইন, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ জাতীয় উপাদান বিভিন্ন ফোরাম থেকে যুক্ত করতে হবে, যাতে অবচেতনে মানুষ এগুলোর সাথে পরিচিত হয়।
তরুণদের মধ্যে এই বার্তা কোটি কোটিবার ছড়িয়ে দিতে হবে, বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার মূল বক্তব্যটি তুলে ধরতে হবে— ধর্মনিরপেক্ষতা অর্থ পার্থিববাদ, ইহজাগতিকতা বা ধর্মহীনতা নয়। ধর্মনিরপেক্ষতা অর্থ ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার, নিজ নিজ ধর্ম নিজ নিজ অবস্থান থেকে অন্যকে বেকায়দায় না ফেলে স্বাধীনভাবে পালনের সুযোগ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে সবার রয়েছে। আবার যে কোনো ধর্ম পালন করতে চায় না সেও বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের সমান অংশীদার। নিরীশ্বরবাদও যে একটি উচ্চতর বোধ, সেই বোধের সাথে তাদের পরিচিত করাতে হবে, এটি যে আধাত্মিকতা এবং দার্শনিকতার সর্বোচ্চ স্তর সেটি বুঝতে যাতে তাদের অসুবিধা না হয় এজন্য বিশেষ প্রাজ্ঞতার সাথে পাঠ পরিকল্পনা করতে হবে।
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের মূল কথা ধর্মকে রাজনীতি এবং ব্যবসার হাতিয়ার করা যাবে না, ধর্ম কখনো সাম্রাজ্যবাদের হাতিয়ার হবে না। ধর্ম থাকবে ব্যক্তির অলৌকিক বিশ্বাস, প্রশান্তি এবং আশ্রয় বা শেষ অবলম্বন হিসেবে। পুত্র হারা মায়ের কাছ থেকে তার কাল্পনিক ঈশ্বরকে কেড়ে নিতে নীরিশ্বরবাদীরা কোনো যুগে চায়নি, কেড়ে নিতে চায়নি সুবিচার পেতে ব্যর্থ হওয়া দুর্বল ফরিয়াদীর নালিস জানানোর শেষ আশ্রয় হিসেবে ঘরের কোণে থাকা ছোট্ট মন্দির বা জায়নামাজ পাতা জমিনে বঞ্চিতের বিপন্ন ভাবনার একান্ত আপন ঈশ্বরকে। তারা চেয়েছে ধর্মব্যবসায়ী, জঙ্গিবাদী এবং সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে— তরুণ সমাজের কাছে এ বার্তাটি পৌঁছে দিতে হবে।
‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ আমাদের রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির একটি, তাই রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে এটি অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। ব্যক্তির অপকর্ষ এবং অন্ধত্ব যে পর্যায়েই থাকুক না কেন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে প্রত্যেককে ধর্মনিরপেক্ষ ভাবার সুযোগ রয়েছে, যেহেতু আমরা সংবিধান মেনে চলতে বাধ্য।
একজন ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ অবশ্যই অসাম্প্রদায়িক এবং মানবিক মানুষ, তার কাছে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইহুদি; ধনী, দরিদ্র সবাই নিরাপদ। বলা চলে একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্র গড়ে ওঠার প্রথম এবং প্রধানতম ধাপই হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমাজ জীবনে তার চর্চা করা। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা, আধুনিক রাষ্ট্রকাঠামো এবং সভ্য সমাজের প্রধানতম তাত্ত্বিক অবলম্বন এবং পরীক্ষিত শক্তি হিসেবে আমাদের চাওয়া সমাজের প্রতিটি মানুষ ধর্মনিরপেক্ষ হবে এবং শুদ্ধতম মানুষ হিসেবে সে ব্যক্তিজীবন এবং সামাজিক জীবনে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ এবং মানবতাবাদের চর্চা করবে।
একটি জাতির পরিচয় হতে পারে নৃতাত্তি¡ক, ভাষাভিত্তিক অথবা ভৌগোলিক, কোনোভাবেই শুধু ধর্মীয় পরিচয়ে কোনো জাতির জাতিসত্তা গড়ে উঠতে পারে না। অনেক বাধাবিপত্তি, ধর্মান্ধতা, হিংস্রতা, পশ্চাদপদতার পথ পেরিয়ে মানববিশ্ব আজ মহত্ত্ব এবং মানবতার চর্চায় উদ্যোগী হয়েছে। মত প্রকাশ এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার পথ যেমন আধুনিক সভ্য সমাজে প্রশস্ত হয়েছে, একইসাথে বস্তুগত প্রয়োজন একসাথে মেটানো, মৌলিক চাহিদায় সবার অধিকার এবং অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়েছে। ভেড়ার পালের মতো একই খাবার একইভাবে সবাই খাবে, একইভাবে সবাই ঘুমাবে, একইপথে সবাই পরিচালিত হবে, সবার বিনোদন এবং জীবনাচারণ হবে একই রূপ— এটি আধুনিক সভ্য সমাজে বেমানান। শত রকম ফুলের একটি বাগান এই মানব সমাজ। আধুনিক মানব সমাজে কোনো ধরনের আদিম হস্তক্ষেপ বিশ^সভ্যতা সহ্য করবে না, এটা জঙ্গিবাদী এবং ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক চক্রকে বুঝতে হবে।
বিশ্বসভ্যতার মূলভাবটি এখন আর কোনো একক রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বিশ্বায়নের এ যুগে সব ভালো সবার, পাশাপাশি পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের অন্ধত্ব এবং হিংস্রতা দূর করার দায়িত্বটিও সবার। সে বিবেচনায় আমরা বিশ্বনাগরিক। উন্নত এবং কল্যাণকামী রাষ্ট্রগুলো সঙ্কটময় মুহূর্তে সভ্য এবং আলোকিত মানুষের পাশে এসে দাঁড়াবে— এটি বিশ্বায়নের অন্যতম মূলভাব। তবে আমরা আলো ফোটানোর কাজটি শুরু করতে চাই নিজস্ব বলয় থেকে, যেহেতু পাকিস্তান, মধ্যপ্রাচ্য বা আফ্রিকায় গিয়ে কাজ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতেও মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্মান্ধতা রয়েছে, আবার সেগুলো দূর করতে কাজ করে যাচ্ছে এরকম সচেতন নাগরিক সমাজও সেখানে আছে। ফলে প্রথমত আমাদের দায়িত্বটি আমরা আগে নিতে চাই। পাশের বাড়ির আগুন লাগা ঘরে পানি না ছিটিয়ে, নিজ দেশে পথে পথে রাত কাটানো নারী শিশুদের জন্য কাজ না করে সিরিয়া ইরাকের আগুন নেভাতে গেলে তাতে ভণ্ড অভিধাই শুধু আমাদের জুটবে। আমরা সেটি চাই না। আমরা বুঝতে পেরেছি, অনুভব করতে বাধ্য হয়েছি যে বাংলাদেশ নামক এ দেশটিতে মশাল হাতে নেওয়ার কাজটি এখন আমাদের করতে হবে। এ দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার আর সুযোগ নেই, ঘুমিয়ে থাকলে দেশটি চলে যাবে হিংস্র হায়েনাদের ভয়ঙ্কর নখরের নিচে, বৃথা যাবে ত্রিশ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগ।
শুধু অনুভব করে বা কথা বলে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলব্যাপী ছড়িয়ে পড়া এ অন্ধত্ব মোকাবেলা করা যাবে না। কাজ করতে হবে। ব্যক্তিগত বিশ্বাস, মত এবং পথের উর্দ্ধে উঠে সঙ্ঘবদ্ধ হতে হবে; হাল ধরতে হবে কালের চাকার। ধর্মান্ধতা, ধর্মব্যবসা, সাম্প্রদায়িকতা, উগ্রবাদ এবং জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বিজ্ঞানভিত্তিক, আধুনিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ মতামত গড়ে তুলতে হবে। নতুন প্রজন্মের কাছে বার্তাগুলি পৌঁছে দিতে হবে। এ দায়িত্ব কারো একার নয়, বরং সবার।
তরুণ সমাজের মধ্যে প্রশ্ন জাগতে পারে, তারা এই ভেবে নিরাশ হতে পারে— দেশে এমন কোনো সংগঠন বা ফোরাম কি নেই যারা ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক এবং মানবিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে কাজ করে যাচ্ছে? সেই প্রশ্নের উত্তরটি দিয়েই আমি লেখাটি শেষ করছি। শহীদজননী জাহানারা ইমাম ত্রিশ বছর আগে যে আন্দোলনটি শুরু করেছিলেন, সেটি শুধু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করার আন্দোলন ছিল না, সেটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উৎকর্ষে ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক দেশ গড়ারও আন্দোলন। ২৬ জুন ১৯৯৪ জাহানারা ইমাম প্রয়াত হলে আন্দোলনটি এগিয়ে গেছে সেই সময়ে যারা অপেক্ষাকৃত তরুণ তাদেরই হাত ধরে। বিশেষ করে লেখক-সাংবাদিক শাহরিয়ার কবিরের নাম এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যিনি সবসময় অকুতোভয় থেকে ধর্মান্ধ-সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়ে গিয়েছেন, ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক সমাজ বিনির্মাণের জন্য নিরলস কাজ করেছেন। সময় এসেছে তাদের হাত থেকে মশাল গ্রহণ করার, সময় এসেছে শপথ গ্রহণ করার— ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক, মানবিক এবং সমতার বাংলাদেশ চাই।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জানুয়ারি, ২০২০ সকাল ১১:৩৮
৪টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×