somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্প ও তার অন্তরালের গল্প

২৯ শে জুলাই, ২০২১ সকাল ১১:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


#ছোটগল্প
আজকে যে গল্পটি বলবো সেটি আমার লেখালেখি জীবনের একেবারে শুরুর দিকের একটি গল্প। নানা জায়গাতেই ইতিমধ্যেই বলেছি। শুধু এই গল্পটির পেছনে চমৎকার একটি অন্তরালের গল্প বলতে পারেন নতুন সংযোজন। আগে তাহলে অন্তরালের গল্পটিই শুনে নিন।
#অন্তরালের_গল্প
সেটা ছিল ২০১৫। আমার লেখালেখি তখন সবে হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগুচ্ছে। লিখছি। মনে আশার বাতি জ্বলছে, হয়ত সেগুলো গল্পও হচ্ছে। কিন্তু প্লট পাচ্ছি না মনের মতো।
মান্ধাতার যুগের গল্প লিখে কাজ হবে না। এই একবিংশ শতাব্দিতে এসে আমি যদি বঙ্কিমচন্দ্র কিংবা শরৎচন্দ্রের মতো করে গল্প শোনাই সেই গল্প শুনতে কেউ আগ্রহী হবে না। চলিত ভাষাতেই তো সবাই লিখছে এখন, কিন্তু সবার গল্পই কি সেই অর্থে আধুনিক গল্প হয়ে উঠছে? লেখাতে আধুনিকতা মানে হলো ভাবনায় আধুনিকতা। অন্তত আমি তো তাই বুঝি। তাই যেটাকে আমি আমার অস্ত্র হিসবে বেছে নিতে চাইলাম সেটি হলো প্লট।
চিত্রশিল্পীরা নাকি তাদের আঁকার স্টাইল পাল্টে ফেলতে পারে। কিন্তু একজন লেখক চাইলেই নিজের লেখার ধরণ আমূল বদলে ফেলতে পারে না। যেটা নিজের স্টাইল বা নিজস্বতা সেটা কিন্তু থেকেই যায়। তাই আধুনিক লেখা লিখবার ইচ্ছায় নিজের স্বকীয়তা জলাঞ্জলি না দিয়ে অন্যদিকে মুখ ফেরানোই ভালো। নতুন নতুন যুগোপযোগী প্লট খোঁজার দিকে মন দেওয়াই আমি উচিত মনে করলাম।
কিন্তু সেই কাজটাও কি এত সহজ?
সামাজিক অনাচারের গল্পও তো অনেক বলা হচ্ছে। এই যে ধর্ষণ, হত্যা, পরকীয়া...এসব তো আতিপাতি নাসপাতি সব লেখকের হাতে পড়েই মুড়ি মুড়কির মতো প্রতিনিয়ত ভাজা হচ্ছে আর পাঠকেরাও সেগুলো চিবুতে চিবুতে মাঝে মাঝেই রুচি কমে যাওয়ার দোষে ভুগছে।
এমন কিছু বলা যাক, যাতে আবহমান বাংলার গল্প আছে... কিন্তু শুনতে পুরনো লাগে না।
আমার বাবা তখনো বেঁচে ছিলেন। এক ছুটিতে বাড়ি গিয়েছি। বাবার কাছে এক ভদ্রলোক এসেছেন দেখা করতে। উনি নাকি আমার দাদার বাড়ির অঞ্চলের লোক। আগে স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। যতদূর মনে পড়ে, শুনেছিলাম উনার বড়ছেলেও শিক্ষকতা পেশাতেই আছে। সম্ভবত কলেজের ইংরেজী শিক্ষক। আর ছোটছেলে বুয়েটে ট্রিপল ই তে পড়ছে। অর্থাৎ খুব মেধাবী। কিছুক্ষণ আলাপচারিতা হওয়ার পরে বাবা আমাকে ডাক দিলেন। উনি নাকি আমার সাথেই পরিচিত হতে চান। তার ছেলে ফাইনাল ইয়ারে পড়ছে। বিদেশে যেতে ইচ্ছুক। আমার হাজবেন্ড বুয়েটের ট্রিপল ই'র টিচার। আর আমিও বুয়েটের প্রাক্তন ছাত্রী। সব মিলিয়ে উনি কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করলেন। বিদেশে যাওয়ার আগে আমার হাজবেন্ডের কাছে রিকোমেন্ডেশন লেটার পাবে কী না বলতেই আমি অভয় দিলাম। বললাম, এই ব্যাপারে সে কার্পন্য করে না। তার কারণ নিজে ছাত্রাবস্থায় সে এই ব্যাপারে ভুক্তভোগী। তাই ছাত্রদের কষ্টটা বোঝে।
উনি খুশি হলেন। তারপর কিছু সময় গল্প চললো। সহজ সরল উদার মনের একজন মানুষ। শিক্ষার আলোতে আলোকিত। মনটা বড় তা কথা শুনেই বোঝা যায়। উনি আমাকে গল্পচ্ছলে বললেন,
'এখন আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্য কীই না করি! যা চায় তাই দিতে চেষ্টা করি। কিন্তু জানো, আমি কত কষ্ট করে পড়ছি? আমার বাপ আমাকে কলেজে পড়াতে চাচ্ছিলো না। বলছিল এত নাকি পড়ে কাজ নাই। আমি তখন মাটির দেওয়াল ভেঙ্গে চোঙ্গা বের করছিলাম।'
গল্পের এই পর্যায়ে আমি উনাকে থামালাম। বললাম,
'বুঝলাম না। চোঙ্গা ভাঙলেন মানে? তাও আবার মাটির দেওয়াল ভেঙ্গে কেন?'
উনি বললেন,
'আরে বুঝলা না...আগে ত আর দামী কিছু রাখার জন্য এত আলমারি ছিল না। তাই এভাবেই টাকাপয়সা রাখা হতো। বাঁশের চোঙ্গায় ভরে টাকা পয়সা রাখা হতো আর সেই চোঙ্গা মাটির দেওয়ালে গুঁজে লেপে দেওয়া হতো। কেউ টের পাইতো না।'
আমি অবাক। বললাম,
'তারপর?'
'তারপর আর কী? সেই চোঙ্গা ভেঙ্গে টাকা বাইর করে নিয়ে শহরে পালাইয়া গেলাম। গিয়ে কলেজে ভর্তি হলাম!'
আমি বিস্মিত হয়ে উনাকে দেখলাম কিছুক্ষণ। একেই বলে ক্ষুধা! জ্ঞানের ক্ষুধা! এই ক্ষুধা না থাকলে কি আর প্রকৃত শিক্ষিত হওয়া যায়?
পরবর্তীতে সেই বুয়েটে পড়ুয়া ছেলেটি আমার ভাগ্নি জামাই হয়েছে। কিন্তু সে আরেক গল্প।
আমি ঐ ভদ্রলোকের গল্প নিয়ে কোন গল্প লিখেছিলাম...বুঝতে পারছেন কি কেউ?
'দায়মুক্তি'... আমার নিজের লেখা 'উল্লেখ করতে চাই' এমন একটি ছোটগল্প। উনাকে অশেষ ধন্যবাদ ও শ্রদ্ধা লেখালেখির সেই ক্রান্তিক্ষণে উনি আমাকে এমন একটা গল্প শুনিয়েছিলেন।
আমার গল্পের সজল সেই টাকাটা খরচ করতে পারেনি। উনি কিন্তু করেছিলেন। হয়ত তার অনেকগুণ নিজের বাবাকে ফিরিয়েও দিয়েছেন যোগ্য সন্তান হয়ে ফিরে এসে।

#গল্প_দায়মুক্তি
আগুন আগুনঃ
‘ও সজল, আগুন লাগছে রে বাপ। আগুন লাগছে। পানি আন জলদি। পুইড়্যা গেল, বেবাক পুইড়্যা গেল রে বাপ ... খাড়াইয়া থাগিস না! জলদি কইরা পানি আন...ওহ আল্লাহ্‌!...’
‘মা, বাজান কই? বাজান?...’
‘তোর বাপজান ভিতরে গ্যালো। আর বাইরাইলো না! পানি আন...পানি আন জলদি!’
কাগজের পাখিঃ
বিরক্তির সাথে নিউজপেপারে চোখ বোলাচ্ছিলেন ডাঃ আশফাক উদ্দীন। রোজ রোজ সেই একই খবর! সড়ক দূর্ঘটনায় সাত জনের প্রাণহানি, বেড়েই চলেছে ঢাকার যানজট, অজ্ঞাতপরিচয় তরুণীর লাশ উদ্ধার, শিক্ষক কতৃক ছাত্রীর শ্লীলতাহানির চেষ্টা...শহরে মানবন্ধন।
একই খবর। কোন বৈচিত্র নেই। এ যেন নতুন বোতলে পুরনো মদ বিক্রির চেষ্টা। মেজাজ খারাপ করে পেপারটা একপাশে সরিয়ে রাখলেন আশফাক উদ্দীন। এমনিতেই ঘুম হয়নি রাতে। কালরাতে আবার দেখেছেন স্বপ্নটা। এই স্বপ্নের হাত থেকে তার কি এই জীবনে মুক্তি মিলবে না?
সাইকেলের ক্রিং ক্রিং আওয়াজে চমক ভাঙলো। দুধওয়ালা এসেছে। কাজের ছেলেটাকে ডাক দিলেন দুধ নিয়ে যেতে। হাজার অনিয়মেও এই একটি নিয়ম বহাল রেখেছেন তিনি। দুধ তার চাইই চাই। প্রায় লোকালয় বিবর্জিত এই এলাকায় ভাগ্যিস ভাল একটা কাজের ছেলে পেয়েছিলেন। ছেলেটা বড্ড কাজের। তার যা যা প্রয়োজন, ঠিকঠাক জোগান দিয়ে যাচ্ছে। এই দুধওয়ালাকে কোত্থেকে যেন ধরে এনেছে। দুধের মান একেবারে একনম্বর। ঢাকায় বসে এই দুধ আশাই করা যায় না।
‘কেরামত মিয়া, খবর কী তোমার? আজ আসতে এত দেরি করলা কেন?’
‘একটু বাজার গেছিলাম স্যার। ছোড়াডার জন্য খাতা কিনতি।’
‘তোমার ছেলে স্কুলে যায়? বাঃ বেশ। পড়ালেখা করে তো ঠিকমত?’
‘কী কন স্যার? পোলা আমার বইয়ের উইপোকা। গিট্টু দিয়া লাইগ্যা থাকে।’
সাইকেলের প্যাডেল ঘুরিয়ে ফিরতি পথ ধরে কেরামত মিয়া। আশফাক উদ্দীন চেয়ে থাকেন তার পথের দিকে। মনের মধ্যে দোল দিয়ে যায় ভাসা ভাসা কত ছবি! সুর করে কবিতা পড়া... আমাদের ছোটনদী চলে আঁকে বাঁকে। বাংলা বইয়ের পাতায় হাশেম খানের আঁকা হাসিখুশি ছেলেমেয়েদের মুখ... সুখী সুখী জীবনের প্রতিচ্ছবি...আর কাগজের পাখি। সালমা আপা বানাতে শিখিয়েছিলেন হাতের কাজ ক্লাসে। কী জীবন্ত ছিল সেই কাগজের পাখি! যেন এক্ষুনি পাখা মেলে উড়াল দেবে! তার কৈশোরের নানা রঙের দোল-দোলানো কত শত ভাবনা সেই পলকা কাগজের ডানায় ভেসে হারিয়ে গেছে দূর দিগন্তে, আজ আর কোন খোঁজও জানা নেই তার।
প্রথম পাপঃ
‘বাজান আমি হালের কাজ করুম না। আমি পড়ালেখা করমু। আমার খুব ভালা লাগে পড়তে।’
‘হেইডা ক্যামনে হইবো বাপ। আম্‌গো তো ওত ট্যাকাপয়সা নাই। একদিন না একদিন তো ছাইড়াই দেওন লাগবো। আমাগো চৌদ্দগুষ্টির কেউ স্কুল পাস দেয় নাই। তুই দিছিস বাপ। আর পড়নের কাম কী? অহন আমার লগে জমির কামেত মন দে বাপ।’
ঘাড় গোঁজ করে দাঁড়িয়ে থাকে সজল। নরম শরম ছেলে সে। বাবার মুখে মুখে তর্ক করে না। কিন্তু ঝড় বইতে থাকে মনের মধ্যে।
স্কুলের হেডমাষ্টার এসে কথা বলেন সজলের বাবার সাথে।
‘বুঝলা সজলের বাপ, তোমার ছেলে তো হীরা একটা। এই গ্রামে তো দূর, পাশের দু’দশটা গ্রামেও তোমার ছেলের সমতুল্য ছেলে একটাও নাই। না প্রাইভেট, না কোচিং, অথচ তোমার ছেলের রেজাল্ট দেখছো তুমি? আমি বোর্ড অফিসে খোঁজ নিছিলাম। তোমার ছেলের মার্ক জোগাড় করছি। দুই নম্বরের জন্য বোর্ড স্টাণ্ড করেনি তোমার ছেলে। তোমার ছেলে একদিন আমাদের সবার মুখ উজ্জল করবো। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়া তোমার ছেলের জন্য কোন বিষয়ই না।’
ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সজলের বাবা আলতাফ উদ্দীন। শিক্ষার আলো বঞ্চিত তার দুই চোখে রাজ্যের বিস্ময়। হেডমাষ্টার স্যার এগুলো কী বলেন? ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়া তার ছেলের জন্য কোন বিষয়ই না? তার বংশে পড়াশুনার নামই শোনেনি কেউ। সাত পুরুষ হালচাষ করে খেয়েছে। সেই একই বংশে জন্মে তার ছেলে কিভাবে পারলো পড়াশুনাকে এত ভালবাসতে?
সজল মুখ কালো করে ঘুরে বেড়ায় সারাদিন। তার দুই বন্ধু কলেজে ভর্তি হতে শহরে যাবে। সেও যেতে চায় তাদের সাথে। শহরের কলেজে পড়তে চায় সে। অনেক টাকার ব্যাপার। বাবা কোথা থেকে ব্যবস্থা করবে? বাবা তো তাকে আর পড়াতেই চায় না।
ওদিকে শান্তি নাই আলতাফ উদ্দীনের মনেও। এমন একটা ছেলের পড়াশুনা তিনি বন্ধ করে দিবেন? তার যে মহা পাপ হবে! কিন্তু পড়াবেনই বা কিভাবে? কী আছে তার? সম্পত্তি বলতে বাপের রেখে যাওয়া অল্প কিছু জমি। তাও আবার তিন ভাইয়ের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা শেষে সামান্যই অবশিষ্ট আছে তার ভাগে। অসহায় চোখে তাকান জমিটুকুর দিকে। মনের মধ্যে খেলা করে হাজার ভাবনা।
কিছুদিন পরে এক রাতে কথা বলেন সজলের মা’র সাথে।
‘ভাবতাছি উত্তরের ধানী জমিটা বেইচা দিমু। ফসলপাতি তেমুন আসে না। কী কও সজলের মা?’
‘কী কন আপনি! উত্তরের জমি বেচলে আমরা খামু কি? বেচবেন ক্যান? ফসলপাতি এ বছর ভালা হয়নি, পরেরবার হইবো।’
‘কিছু ট্যাকা পয়সা হাতে থাকন ভালা। বিপদ-আপদ কি বইল্যা কইয়্যা আসে? হাতে কিছু ট্যাকা-পয়সা থাকলে ভরসা পাওন যায়।’
পাশের ঘরে বসে সজলের কানে আসে সব কথা। বাবা জমি বিক্রি করবে? সে জানে জমির দাম এখন অনেক চড়া। বাবাকেই বলতে শুনেছে অনেকবার। টাকার জন্য বাবা তাকে কলেজে ভর্তি করতে চায় না। অথচ জমি বিক্রি করে দেবে ভবিষ্যতের বিপদ-আপদের কথা ভেবে!
সজলের মনের মধ্যে কিসের যেন কালো ছায়া ঘিরে আসে। প্রথম পাপের নয় তো?
ভ্রান্তির অনলঃ
‘অ মা, আমি একটু আইতাছি।’
‘এত রাইত্তে কই যাইবি?’
‘আমার এক বন্ধুর কাছে একটা কাম আছে। এক্ষুনি আইসা পড়ুম।’
বুকের ধুকধুকুনি নিত্য সঙ্গী হয়ে গেছে সেদিনের পর থেকে। সজল জানতো বাবা তার টাকা-পয়সা কোথায় রাখে। অনেক নিরাপদ একটা জায়গা আছে বাবার। ঘুনাক্ষরেও কেউ জানতে পারবে না কখনো। একদিন বাবাই সজলকে বলেছিল এই জায়গার কথা। বাঁশের চোঙে টাকা ভরে মাটির দেওয়ালে ঢুকিয়ে আবার লেপে দিলেই হল। সিন্দুকের চেয়েও নিরাপদ কুঠুরি।
একদিন সেই পাপের ডাক অগ্রাহ্য করতে পারে না সজল। বাবার অনেক কষ্টের জমি বিক্রির টাকা সজল সরিয়ে ফেলে। চোঙাটা আবার রেখে দেয় আগের জায়গায়। যত্ন করে লেপে দেয় সরে যাওয়া মাটি।
অনেক টাকা। প্রায় পঞ্চাশ হাজারের মত। নিজের কাছে রাখার সাহস পায় না সজল। তার এক বন্ধুর কাছে টাকাটা আমানত রাখে। ঠিক করে একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবে। শহরে গিয়ে কলেজে ভর্তি হবে। অনেক বড় হতে হবে ওকে। বাবাকে একদিন আবার ফিরিয়ে দেবে উত্তরের ধানি জমিটা।
কিন্তু অনুশোচনার অনল বড় কঠিন। ভীষণ তীব্র তার তেজ। এভাবে সে পারবে না বাবাকে ফাঁকি দিতে। থাক্‌, নাই বা হল তার পড়ালেখা। বাবার কথাই মেনে নেবে সে। হাল চাষ করবে। টাকাটা আবার রেখে দিবে আগের জায়গায়।
সেদিন টাকাটা ফেরত আনতেই বন্ধুর বাড়িতে যায় সজল। ফিরে এসে দেখে দাউ দাউ আগুন জ্বলছে ওদের বাড়িতে। উঠোনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদছে সজলের মা। সজলের চোখের সামনে পুড়ে খাক হয়ে যায় সবকিছু।
রাতে সজল বাইরে যাওয়ার পর সজলের বাবা ওর মাকে বলে,
‘বুঝলা সজলের মা, পোলারে পড়ামু আমি। আমার পোলা অনেক বড় হইবো। হেডমাষ্টার স্যার আমারে কইছেন। জমি আবার কেনা যাইবো। আমার পোলার ভবিষ্যৎ তো আর ফিরা আইবো না। সজলরে অহনো কই নাই। ওর বন্ধুরা যেদিন শহরে যাইবো তার আগের দিন দিমু ট্যাকাটা। কেমুন খুশি হইবো পোলাটা কও তো?’
রাতের খাওয়া শেষে কুপিটাকে একপাশে সরিয়ে রাখে সজলের মা। মনটা কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগে। একটাই তো ছেলে। কোনদিন মুখ ফুটে একটা কিছু চায় নি। খেতে দিলে খেয়েছে, না দিলে কিছুই বলেনি। বুদ্ধি হওয়ার পরে প্রথম বাবার কাছে একদিন স্লেট আর চক চেয়েছিল। সেগুলো পেয়ে ওর খুশী কে দেখে! সারাদিন ঐ নিয়েই মেতে থাকে, নাওয়া খাওয়া ভুলে। শান্তশিষ্ট ছেলেটা পড়তে বসলে এক্কেবারে অন্য মানুষ। ওর খুশীর জন্য বাপ-মা হয়ে এর বেশী করার কি সামর্থ্য আছে তাদের?
তবু দুশ্চিন্তাটা কামড়াতে থাকে মনের ভেতরে। উত্তরের জমিটা অনেক বড় একটা অবলম্বন ছিল। সামনের দিনগুলো না জানি কিভাবে কাটবে!
সজলটা এখনো আসলো না। ওর বাপ গিয়ে শুয়ে পড়েছে। কতক্ষণ খাবার নিয়ে বসে থাকা যায়?
বাইরে অনেক বাতাস। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে ধরে আসে চোখের পাতা। হঠাৎ কেমন যেন গরম লাগতে থাকে। চোখ মেলে তাকিয়ে সামনে যেন বিভীষিকা দেখতে পায় সজলের মা। বাতাসে কুপি একপাশে পড়ে গেছে। আর তা থেকে সারা ঘরে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। কোনমতে ডাক দেয় সজলের বাবাকে। কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে হতবুদ্ধির মত তাকিয়ে থাকে আলতাফ উদ্দীন। আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। কিচ্ছু করার উপায় নাই। প্রাণ নিয়ে কোনমতে বেরিয়ে আসে বাইরে।
‘সজলের মা, ট্যাকা তো ঘরে আছে। হায় হায়! কী করি ওহন! ও আল্লাহ্‌! আমি ভিত্‌রে যাই। ট্যাকা পুইড়া যাইবো।’
‘আপনে যাইয়েন না। ট্যাকা পুড়বো না। মাটির ভিত্‌রে আছে।’
না না...যদি পুইড়া যায়। আমি ভিত্‌রে ঢুকমু।’
আলতাফ উদ্দীন কিচ্ছু শোনে না। তার উপরে যেন ভূত ভর করে। জোর করে ভিতরে ঢুকে পড়ে। ঠিক তখনই প্রচণ্ড শব্দে ঘরের চালা ভেঙ্গে পড়ে।
ততক্ষণে ছুটে এসেছে আশেপাশের বাড়ির সবাই। যে যেভাবে পারে পানি ঢালতে থাকে। ততক্ষণে সব শেষ। পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া আলতাফ উদ্দীনের লাশ ভেতর থেকে নিয়ে আসা হয়।
সজলের মা পাগলের প্রলাপ বকতে থাকে,
‘কত কইলাম, ঢুইকো না। ট্যাকা পুড়বো না। শুনলো না আমার কথা। জমি বিক্রি করছে। সজলরে পড়াইবো। ও আল্লাহ্‌...সব পুইড়া গেল, সব শ্যাষ হইয়া গেল...’
বাকরুদ্ধ পাথর হয়ে যাওয়া সজলের হাতে ধরা টাকার থলিটা মাটিতে পড়ে যায়।
বিষম সে দায়ঃ
জীবন থামতে জানে না। এটাই নাকি জীবনের বৈশিষ্ট্য!
মাটির সেই খুপুরি ভেঙ্গে টাকা পাওয়া যায়নি সেদিন। মার জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সজল বলতে পারেনি সে টাকার কথা। ভীষণ প্রয়োজনের মুহুর্তেও নয়। জীবন বাঁচাতে ঠাঁই নিতে হয় মামাদের সংসারে। জীবনের সেই অধ্যায়ের কথা আজ আর মনেও করতে ইচ্ছে করে না সজলের। ভেবেছিল আর কোনদিন পড়াশুনার নাম মুখেও আনবে না। কিন্তু ভাগ্য তাকে গিঁট দিয়ে রেখেছে যার সাথে, তাকে সে ছুটাবে কিভাবে?
সজলের স্কুলের হেডমাষ্টার চেষ্টা তদবির করে ওকে একটা শিক্ষাবৃত্তি জোগাড় করে দেন। কষ্টকে নিত্য পুঁজি করে পড়াশুনা করে সে। পদে পদে আসে বাধা। থেমে যেতে চায় সবকিছু। সেই সবকিছুকে জয় করে আবার উঠে দাঁড়ায় ভাগ্য। ভাগ্য তাকে ছাড়বে না। পড়াশুনা তাকে করতেই হবে। অসামান্য মেধার পরিচয় দিয়ে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে সজল। তারপরের টুকু পুরোটাই ইতিহাস। তার মামাদের আচার-আচরণ পুরোপুরি বদলে যায়। মার প্রতি হঠাৎ করেই বিশেষ সম্মান দেখাতে শুরু করে সবাই। এত প্রতিকূলতাকে জয় করে এভাবে যে নিজেকে প্রমান করা সম্ভব, এ যেন কেউ কল্পনাই করতে পারেনি।
পাশ করে সরকারী চাকরী পেয়ে মাকে নিয়ে আসে নিজের কাছে। জীবনের শেষ ক’টি নিঃশ্বাস মা তার কাছেই ফেলে যায়।
উঁইপোকাঃ
‘এই তুই কে রে?’
বাসার সামনের আমগাছ টার নীচে ঘুরঘুর করছে একটা বার-তের বছরের কিশোর। হাতে একটা ডিব্বা মত কিছু। চালচলন দেখে আসল উদ্দেশ্য বোঝা যাচ্ছে না। আশফাক উদ্দীনের ভারিক্কি আওয়াজে ছেলেটা চমকে তাকায়। হকচকিয়ে উঠে কিছু বলতে পারে না। তার আওয়াজ শুনে কাজের ছেলেটা দৌঁড়ে আসে।
‘স্যার, ও হল দুধওয়ালার ছেলে। ওর বাবা আজ আসে নাই। ঐ আজকে দুধ নিয়ে এসেছে।’ কাজের ছেলেটা জানায়।
‘ ও, তা চুপ করে আছিস কেন? তুই নাকি স্কুলে যাস? আজ যাসনি স্কুলে?’
‘স্কুলে আর যামু না। নাম কাটায় দিছে।’ মাথা নীচু করে বলে ছেলেটা। চলে যায় ধীর পদক্ষেপে।
আশফাক উদ্দীন কাজের ছেলেটাকে বলে ওর বাবাকে ডেকে পাঠায়। সঙ্গে সঙ্গে সে হাজির হয়। সাথে তার ছেলে।
‘স্যার, এ্যাই কি কুনো গণ্ডগোল করছে?’
‘আরে না। তোমার ছেলের নাকি নাম কাটিয়ে দিয়েছো স্কুল থেকে? কেন? তোমার ছেলে না পড়তে ভালবাসে?’
‘স্যার গরীবের পোলার আর পড়া! আজ দুইমাস হইল তিনটা দুধেল গাভীর একটা মইরা গেছে। হঠাৎ বলা নাই, কওয়া নাই এক রাইতের ভিতর মুখে ফেনা তুইল্যা গরুটা মইরা গেল। আরো দুইখান পোলাপান। সবার মুখে খাওন জোটামু না এরে পড়ামু?’
আশফাক উদ্দীন চেয়ে থাকেন ছেলেটার দিকে। বড় বড় চোখ দুটিতে রাজ্যের কৌতুহল। তাকে আপদমস্তক নিরীক্ষণ করছে। অনেক আগের একটা কিশোরের মুখ তার মনের কোণে ভেসে ওঠে। আয়নায় দেখা তার নিজের মুখ!
‘কী রে তুই নাকি উঁইপোকা? গিট্টু দিয়ে লেগে থাকতে পারবি তো? গিট্টু ছাড়া যাবে না কিন্তু।’
ছেলেটা কিছু বুঝতে পারে না। মাথা চুলকাতে থাকে।
‘অনেক পড়তে হবে। পারবি তো?’
ছেলেটা কিছু একটা আশায় আশান্বিত হয়ে ওঠে। খুশীতে দাঁত বের করে ফেলে।
আশফাক উদ্দীন এগিয়ে যান তার আলমারি টার কাছে। যেখানে গচ্ছিত রেখেছেন তার এত বছরের বিষম কঠিন এক দায়। আনন্দিত পায়ে দ্রুত এগুতে থাকেন তিনি। চোখের দু’কূলে প্লাবন নামতে চায়। নাঃ আজ কাঁদবেন না তিনি। আজ তার খুশির দিন।
আজ যে তার দায়মুক্তির দিন!
#ফাহ্‌মিদা_বারী
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুলাই, ২০২১ সকাল ১১:০১
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×