somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্পঃ ক্রান্তির কলরোল

০৫ ই মে, ২০২১ রাত ১২:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বিঘাই গ্রামের আবদুল গনি হঠাৎ একদিন হউদ্যা গনি হয়ে উঠল। তখন মাঘ মাসের দ্বরদেশ। আবদুল গনির বাবা-মা মৃত্যুর পর নিঃসঙ্গ বাড়িটি ক্ষুধার্ত কুকুরছানার মত কুঁইকুঁই করে। কারো সঙ্গে দুদণ্ড আলাপ করবে আবদুল গনির তেমন কেউ নেই। সে কখনো গভীর রাতে ঘুম থেকে জেগে ওঠে, একা একা কথা বলে, গান গায় আর এভাবেই রাতটা ভোর হয়ে যায়। সে একদিন বিকেলে পশ্চিমমুখি হয়ে বাড়ির সীমানার উঁচু ভেড়িতে রোদ পোহাতে পোহাতে ভাবতে লাগল, এই পৃথিবীতে তাকে ভালোবাসার মত কেউ নাই। সে জোড়ে হাঁচি দিয়ে ডানদিকে ফিরে দেখল, একটা মোটাসোটা ইঁদুর শুকনো পাতার ওপর খচখচ করছে। রাতের নিষ্ঠুর অন্ধকারে চোর যেমন অতি সন্তর্পণে পা ফেলে, ইঁদুরটা সেভাবেই ধীর গতিতে চলছে। আর ওটার মুখে ঝুলে আছে একটা সোনালি রঙের চেন। আবদুল গনির মস্তিষ্কের ভেতর বহুদূরের রেলগাড়ীর হুইসেলের মত একটা সুর বাজতে লাগল। হুইসেলের শব্দের অস্পষ্টতাকে অনুবাদ করে সে নিজের জানা একটা গান জুড়ে দিতে চাইল। আর তখন একটু দূর দিয়ে হরেক রকমের মালামাল ভরা সাজি মাথায় নিয়ে দ্রুত চলে গেল এক ফেরীঅলা। সে ইঁদুরটার পেছন পেছন ছুটে চেনটাকে কব্জা করার চেষ্টা করল। ইঁদুরটা গৃহস্থের কাছে ধরা পড়ে যাওয়া পলায়নরত চোরের মত মুহূর্তেই ধানক্ষেতের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল।
শীতকালীন রুক্ষ আর শুষ্ক বাতাসে ধানের পাকা ছড়াগুলো শীতে কুঁকড়ে দাঁড়িয়ে আছে। আবদুল গনি ক্ষেতের ভেতর দিয়ে ছিলা কেটে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। ইঁদুরটাকে না পেয়ে সে আরেকটু এগিয়ে দেখল, কয়েকটা ধানগাছ পাশাপাশি দুলছে। তার নাকে অনুভব করল পাঁকা ধানের মিষ্টি সুবাস। সে অপরিচিত পোঁকার অক্লান্ত মিষ্টি গুঞ্জনের সাথে শুনতে পেল একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর। মেয়েটি ফিসফিস করে কী যেন বলছে যা অস্পষ্ট। আর কর্কশ গলায় মেয়েটিকে অভয় দিয়ে আশ্বস্ত করছে পুরুষ লোকটি। আবদুল গনির দৃষ্টির বিভ্রান্তি ঘটে। সে সামনের দিকে এগিয়ে দেখল কয়েকটা ধানগাছের গোড়া ভেঙ্গে পাতলা আগাছার ওপর ওড়নাটা বিছিয়ে বসে আছে ফেকু মুন্সীর মেয়ে ফুলি। আর ফুলির শরীরের এখানে ওখানে হাতাচ্ছে বনে-জঙ্গলে ঘুঘু শিকারি ধুরন্ধর সফেজ। বিষয়টি আবদুল গনির কাছে অপ্রত্যাশিত ঘটনা। সে পাশে নরম মাটিতে কোপ দিয়ে রাখা সফেজের কাঁচিটা হাতে তুলে একগোছা ধানগাছের গোড়ায় পোছ দিয়ে আগুনের ফুলকির মত জ্বলে উঠল। অনেকটা শাসানোর ভঙ্গিতে বলল- ভালো অইবেনা কইলাম সবেইজ্যা। ভুলাইয়া ভালাইয়া ফুলিরে ধানক্ষ্যাতে লইয়াইছ!
ফুলির জন্য এই ঘটনা হয়ত এবারেই প্রথম। সে লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। অতি পরিচিত লোকটি হঠাৎ চোর সাব্যস্ত হওয়ার মত মুখটা ফ্যাঁকাসে হয়ে উঠল তার। সে বিষয়টিকে ভালোভাবে ব্যাখ্যা করার হয়ত অন্য কোনো উপায় পেলনা। আর তাই হঠাৎ করেই কিছুটা সাহস জমা করে বলল- সবেজ বিয়া হরবে মোরে।
-মুইও হরতে পারি। আবদুল গনি আস্থার সঙ্গেই বলল।
ফুলি কথাটাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে একটু সাহসী হয়ে আবদুল গনির মুখের সামনে এসে একটু তাচ্ছিল্য করল।
-আহা চান্দু! নাড়ার ঘরে থাহো, আবার বিয়া হরতে মোন চায়।
আবদুল গনি সফেজকে কাঁচি নিয়ে ধাওয়া করল আর সফেজ যেতে যেতে বলল- দ্যাক, ভালো অইবেনা কইলাম। তোরে গউন্যা খুন হরমু দেহিস।
সফেজ চলে যাবার পর পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটল। আবদুল গনি কিছুটা শীতল হয়ে ফুলির উঁচু বুকের দিকে তাকিয়ে নদীর ঢেউ গোনার মত ভঙ্গি করল। আর তাতে তার শিশ্নের ওপর দিয়ে হুড়হুড় করে একঝলক শীতল বাতাস বয়ে গেল। সে ফুলিকে ফুঁসলাতে লাগল, তোরে সোনার চেন দেতে পারি জানো? এক্কেরে খাডি সোনা।
যেন হঠাৎ দৃশ্যপট পাল্টে গেল। ফুলি গোল গোল চোখে আবদুল গনির দিকে তাকিয়ে মিনমিন করে কিছু বলতে চাইল। তার লোভাতুর চোখদুটি ঝলক দিয়ে উঠল। আবদুল গনি ধানক্ষেতের বাইরে উজার বিলে হারিয়ে যাওয়া ইঁদুরটাকে আবার খুঁজে পেল এবং স্পষ্ট দেখল, সোনা রঙের চেনটা এখনো ইঁদুরটার মুখে রয়েছে।
সে হুসহুস করে ইঁদুরটাকে তাড়া করল। তাতে তার পায়ের তলায় রুগ্ন ধানগাছের গোড়াগুলো পিষে যেতে লাগল। ইঁদুরটা তাড়া খেয়ে এতটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল পারলে যে কোনো অন্ধ কোটরে লুঁকিয়ে জান রক্ষা করে। ওটা দৌড়াতে দৌড়াতে মূর্ছা খাওয়ার মত তালগোল পাঁকাল আর সামনে একটা গর্ত পেয়ে দ্রুত ঢুকে পড়ল। ইঁদুরটা ঈশ্বরের প্রেরিত আলোর উচ্ছ্বাস থেকে অন্ধকার গর্তের ভেতরে নিস্তব্ধতায় ধুকপুক করতে থাকল।
তখন বিকেলটা লম্বা ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছে, সূর্যটাও টুপ করে হারিয়ে গেছে একটু আগে। বিলের শেষ মাথায় ঝাপসা হয়ে আসা বাড়িগুলোর গাছের মাথায় কুয়াসার সাদাটে রেখা। দিগন্ত বিস্তৃত বিলের দূর থেকে গড়িয়ে আসা সন্ধ্যার ঘোলানো বাতাস আবদুল গনির কলিজায় লাগে। সে কোমড়ে দরদের কারণে কায়দা করে খোন্তা চালাতে পারেনা। তবুও যেটুকু পারে, খোন্তার ফলার সাথে সামান্য মাটিই উপরে উঠে আসে।তাতে ফুলি ভাবে এ আবার কেমন পুরুষ পোলা! কোমড়ে জোড় নাই, খোন্তার ওঠানামায় বুকের ছাতিতে ভূ-কম্পন হয়না আর পেশিগুলো বলহীন রুগ্ন।দৈত্যের মত পুরুষ সফেজ, যে কোনো মেয়েলোক বুকে নিয়ে জাপটে হাড়গোড় মচকে দিতে পারে সে।তবু কোথায় যেন একটা অক্লান্ত সুর আছে আবদুল গনির ভেতর। শান্ত, মার্জিত আর সারাক্ষণ একটা সুখি সুখি ভাবের হাসি ঝুলে থাকে মুখে।
আবদুল গনি খোনতাটা এককোপ দিয়ে হাতলটা আকাশমুখি রেখে বলল- দেখ ফুলি, ভোলাভালা মাইয়া মানু তুই। সবেইজ্যা ডাহাইত এট্টা। দিনে ঘুঘু ধরে আর রাইতে করে ডাহাতি। অর কতায় ভুলিস না কইলাম।
ফুলি খোনতাটা হাতে তুলে কোপ দিতে দিতে বলল-সবেজ ঢাকা লইয়া যাইবে মোরে।কারুনবাজার আনাজ পাতির আড়তে কাম হরবে কইছে।
দিব্যি সুগঠিত চওড়া কাঁধ ফুলির। ছিপছিপে দেহের গাঁথুনি।ঠাণ্ডায় গালদুটো ভেজা আপেলের মত হয়ে গেছে। কোপানোর তালে তালে শরীরটা ঢেউ খেলতে থাকে তার। আবদুল গনি ফুলির দুলে ওঠা শরীরের দিকে হা করে তাকিয়ে রইল।সে ফুলির যৌবনে যে দ্যুতি দেখতে পেল তাতে সোনার চেনের কথা সে অল্প সময়ের জন্য ভুলে যায়। সময়টা এতই ছোট যে, ওটুকু সময়ে মাত্র এক দু’জন মানুষের নামোচ্চারণ করা যায়।তার ঘোরগ্রস্থতা দূর হয় তখন যখন ইঁদুরটা গর্ত থেকে বের হয়ে কিচকিচ শব্দে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।আরেকটু মাটি তোলার পর গর্তের ভেতর থেকে উড়ে আসে ভেপে ওঠা ধানের গন্ধ।তারা দেখল বিস্তর ধানের শীষ এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে আছে সেখানে।
আবদুল গনি শীষগুলো ফুলির ওড়নার ওপর ছড়িয়ে দিল। তার চোখের সামনে ঝিকমিক করে উঠল একটা সরু আলো। সে চেনটাকে হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে ওটা ফুলির গলায় পরিয়ে দিল। তখন বিলের অপর মাথার গ্রামখানা আবদুল গনির চোখে ঝাপসা হয়ে আসে। ধোয়াঁসা হয়ে উঠল পায়ের তলার শিশিরভেজা মাটি। সোনা রঙের ধানের নোয়ানো মাথায় উত্তরা হিম হাওয়া ছুঁয়ে যেতে লাগল আর তাতে আনন্দে ফুরফুরিয়ে উঠল ফুলির মন। সে চ্যাচিয়ে বলল- চেনডা বড় ভালো অইছেরে অউদ্যা গনি। এহন তো দিহি তোর ঘরেই ওডন লাগবে।
যে কোনো ভাবেই হোক, গোস্যা আছে আবদুল গনির ভেতর। বিকেলে সফেজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা সে এখনো ভুলতে পারেনি। সমুদ্দুর থেকে ধেয়ে আসা হিম হাওয়ায় তাদের দাঁতে দাঁত লেগে যায়। ফুলি গালদুটো ফুলিয়ে, নাকের ছিদ্র স্ফিত করে বলল, খোডা দেবানা কইলাম।
আবদুল গনি যুতসই উত্তরটা খুঁজে পেল না। তবু সে বলল, পাপে ধরবে তোরে। মরন তো লাগবে একদিন, নাকি? আল্লার ধারে কি জব দিবি তুই?
আবদুল গনির এমন বাঁকা উত্তর শুনে হণহণ করে বাড়ির পথে হাঁটা ধরল ফুলি। একবারও তাকালো না সে পেছনের দিকে। আবদুল গনি তার আচরণের জন্য সাময়িক অনুতপ্ত হল। সে খোনতাটা ধানগাছের জঙ্গলে লুঁকিয়ে রেখে টুকরিটা মাথায় তুলে বাড়ি চলে যায়।
পরদিন থেকে আবদুল গনি পুরোপুরি হউদ্যা গনি হয়ে উঠল। ইঁদুরগুলো গর্তের ভেতর ধান জমিয়ে লক্ষ্মীর ঘর গড়ে তোলে আর আবদুল গনি ঘরামি হয়ে ভাঙতে লাগল সেই ঘরগুলো। কাজটাকে সে রুটিন হিসেবে নিয়ে এতটা মনযোগী হয়ে পড়ল তাতে অন্যের উপস্থিতি বুঝতেও সময় লাগে তার। মাঝেমাঝে তার মনে হয় কেউ তার সামনে আছে কিংবা জগতে সে ছাড়া কেউ নেই। এমনকি ফুলিও। তাহলে ফুলিরে কি ভালোবাসে সে! কখনো এমন প্রশ্ন মনে আসে তার। তখন বন্ধ চোখদুটো সে ধীরে ধীরে এমনভাবে খোলে যাতে কল্পিত সময়ের পুরো সুখটা শুষে নিতে পারে।
বিলের পর বিল গর্ত খোড়ার পর ভেতরের ভেঁপে ওঠা ধানের গন্ধ তাকে নেশা ধরায়। খোনতা চালাতে চালাতে নোনা জল তার মুখ গড়িয়ে মাটিতে পড়ে। পিঠটা পুড়ে হয়ে যায় তামাটে আর চুলগুলো কাকের বাসা। তখন কেউ এসে দাঁড়িয়ে দুদণ্ড আলাপ করতে চাইলে আবদুল গনি লোকটির সঙ্গে মস্করা করে বলে- হেইয়া, ম্যালা ধান পাইছি মেয়া। উন্দুরব্যাডা এহন মাডি খাইয়া থাকপে।
দিনে দিনে আবদুল গনির তুষের ডাংরি, বাঁশের তৈরি ধানের গোলা আর পোড়া মাটির ঘড়া ধানে ভরে যেতে লাগল। সে ধানগুলো মাড়াই করে বিক্রি করতে হাটে নিয়ে যায় এবং কানের কাছে শোনে নতুন পয়সার ঝুনঝুনানি। সে ভালো দেখে একটা গামছা কিনল এবং ভাঙা রিক্সার এক্সেল দিয়া একটা সাবল বানাল। কামারপট্টি থেকে পাঁকা দেখে কয়েকটা বাঁশের ডোলা কিনল ধান ভরে রাখার জন্য।আবদুল গনি হাট থেকে ফেরার পথে ফুলির জন্য এটা ওটা কিনে নিয়ে আসে। কোনোদিন চিড়ার মোয়া, কখনো লতা ছাপার শাড়ি আর তিন গলির মোড় থেকে মদন মুড়ালি। এসব উপহার পেলে ফুলি খুশি হয়, কখনো রহস্যময় হাসি হাসে। সে হাসির ধরণটা আব্দুল গনি অনেক সময় চিনতে পারে না। ফুলি উপহার পেলে আবদুল গনির খসখসে গালের ওপর নরম ঠোটের স্পর্শ রাখে। তখন সে ভাবে, এটা তার উপহারের প্রতিদান নয়, একটা লকলকে লোভাতুর জিহ্বা তাকে লেহন করার জন্য ছুটে আসছে।
ধানের খনির লালসা আবদুল গনিকে নেশার মত টানে।আর সেই নেশার মাদকতা দিনকে দিন তার মজ্জার সাথে মিশে যেতে লাগল। ফাল্গুনের মাঝামাঝি সে দূর গ্রামের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ল।প্রথমে কাপড়ের তৈরি ঝুলিটা কাঁধে ঝুলিয়ে তারপর সাবলটা পিঠের নিচ দিয়ে খুঁচে লুঙ্গির ভেতর ঢোকায়।আর যেতে যেতে সে দেখল তার খুঁড়ে রাখা পুরনো গর্তগুলোর চিহ্ন।সে পুরো নয়দিন শ্যামপুর, রুনসী, চামটা, দুধলমৌ গ্রামের বিলগুলো খুঁড়ে কয়েক বস্তা ধান পেল। ধানগুলো থেকে ইঁদুরের তোলা গোল গোল শৈল্পিক মাটি আলাদা করতে একটা শক্তপোক্ত ডালা দরকার তার।কিন্তু অন্যগ্রামে কারও থেকে ডালা পাওয়া বিশেষ ভাগ্যের। সে কাছের একটা বাড়িতে গিয়ে আঙিনার কোণে ভ্রাম্যমান চুলার কাছে দাঁড়িয়ে ম্যারম্যারে গলায় এক গেরস্থের বউকে বলল- একখান হাজি দেবা, ভাউজ?
কাজকর্মে ক্লান্ত বউটা আবদুল গনির দিকে তীর্যক চোখে তাকাল। কেমন একটা নীরবতা নেমে এল দুজনার মাঝে। রাস্তায় অপরিচিত কোনো জন্তু দেখলে মানুষ যেমন স্স্থানে দাঁড়িয়ে যায়, তেমন দাঁড়িয়ে রইল দু’জন। তারপর কোনো শব্দ না করে মাঝ বয়সি বউটি চুলা থেকে কয়লা তুলে দাঁত মাজতে মাজতে চলে গেল পুকুরঘাটে।কিন্তু আবদুল গনির সম্পর্কে মেয়েলোকটির কোনো ধারণাই নেই।যে কোনো মুহূর্তে সে ঘরের তৈজসপত্র ছাফা করে দিতে পারে। আর সে ঘটনাটা এত নিঁপুনতার সাথে ঘটাবে, কারো টের পাওয়ার সাধ্য নেই। সে কাঞ্চন চোরার সঙ্গে একবার নদীর ওপার চুরি করতে গিয়েছিল।কুকুরের তাড়া খেয়ে কেমন ভুতের মত দৌড়েছিল বিষয়টি এখনো মনে পড়ে তার। তবে বাইরের নিস্তব্ধতা যখন আঁধারের সাথে মিশে গিয়ে নদীর কলকল শব্দ শোনা যাচ্ছিল, তখন গভীর নিদ্রায় ঢলে পড়া মানুষগুলো টের পায়নি কতকিছু খোয়া গেছিল ওদের। তারপর কাঞ্চন চোরার সঙ্গ ত্যাগ করে পুরান বাজার আড়তে কিছুদিন বস্তা টানার কাজ করল। কোমড়ের দরদটা আরেকটু উসকে যাওয়ার পর ছোট-খাটো চুরি চামারি করে কিছুদিন পাড় করল। শেষে ফিরে এল গ্রামে। আবদুল গনির সেসব দিনের কথা মনে পাড়ায় হঠাৎ অন্ধকারে ছড়িয়ে পড়া গুড়িম গুড়িম শব্দের মত স্নায়ুর ভেতর মেয়েলোকটির প্রতি তীব্র প্রতিশোধ জাপটে ধরল তাকে। কিন্তু আপাতত কয়েকটা বস্তা চুরি করেই ক্ষ্যান্ত হল সে। সন্ধ্যায় জমানো শীষগুলো বস্তায় ভরে উঠানে খামাল দিল। তারপর স্বরচিত গান গাইতে গাইতে ঘুমিয়ে পড়ল সে।
স্বাধীন জীবন যাপন আবদুল গনির কাছে সুখের আর সে মনের আনন্দেই বিলের পর বিল খুঁড়ে সোনার খনি খোঁজে। ভাগ্য তাকে কখনো হতাশ করে আবার কখনো আশীর্বাদ হয়ে ধানের ছড়াগুলো অনায়াসে সামনে এসে যায়। ইঁদুরগুলো তাকে কতটা ভর্ৎসনা করল বোঝা মুশকিল। সে পাদ্রীশিবপুর গ্রামের ধুলট ক্ষেতের পাশ দিয়ে হাঁটতে থাকে। তার বিচলিত মন পৃথিবী থেকে অন্য দূরে অচেনা জগতে চলে গেল। আর তাকে পেছনের দিনগুলো দারুণভাবে নষ্টালজিক করে তুলল। একদিন পুরো দুপুর ঘুরে ঘুরে কোনো গর্তের সন্ধান না পেয়ে ধুলট ক্ষেতের কাছে একটা খোড়লে আধমন ধান পেল সে। আর সে খুঁড়তে খুঁড়তে ক্ষেতের অবস্থা এমন করল, দূর থেকে দেখা যায় শরীরে অসংখ্য বড় সাইজের আচিলঅলা মানুষের মত এবড়োঁথেবড়ো হয়ে পড়ে আছে জমিনটা। জমিনের মালিক টের পেয়ে কালীসাঝের সময় এন্তার মার মারল আবদুল গনিকে। তারপর চার পাঁচদিন সে কোথায় গর্ত খুঁড়তে যেতে পারলনা।
আবদুল গনি নিজ গ্রামের বিলগুলো খোঁড়ার পর দূর গ্রামে যাওয়ার চিন্তা করল। অবশ্য মাঝেমাঝে সে শহরেও চলে যায়। তখন নিঃসঙ্গ বাড়িটিতে নিস্তব্ধতা নামে। গাছের বিবর্ণ পাতাগুলো খড়ের চালের ওপর থেকে গড়াতে গড়াতে উঠানে জমা হয়। মানুষের অভাবে বাড়িটা কেঁদে কেঁদে গাইতে থাকে চিরন্তন সঙ্গীত। আর সেই সঙ্গীতের অদ্ভুত মায়াবী টানে বাড়িটিতে ছুটে আসে বেওয়ারিশ কুকুরগুলো।ওরা বাড়িটার চারপাশে নির্দ্বিধায় ঘুরে বেড়ায়। আরেকদল রাতজাগা যুবক খালি বাড়িটার শূন্যতা পুরন করতে নিশিকন্যা ভাড়া করে আনে। মাঝরাতে আবদুল গনির ঘরের বেড়া ভেদ করে উড়ে যায় মিলনোন্মত্ত মেয়েটির কাঁপা কাঁপা গোঙানির শব্দ। ছেলেগুলো মোমবাতির আলো জ্বেলে বিড়ি ধরায়। তখন বিলের ওপারের বাড়ির মানুষগুলো টিপটিপে লালচে আলো দেখে বাড়িটিকে ভুতের আখড়া ভেবে ভুল করে।
ফাল্পুনের শেষভাগের এক বিকেলে আবদুল গনি পুইয়াউটা গ্রামের দিকে হাঁটা ধরল। বিলের ছিলাপথ ধরে সোয়া মাইল হেঁটে সে এসে ওয়াপদার রাস্তায় দাঁড়ায়। রাস্তার ঢালের পর সমতল জমিটা মরা শ্রীমন্ত নদীর চর। নদীটা এখন আর তরগা যুবকের মত জোয়ান নাই। শোনা যায় বৃটিশ পিরিয়ডে এখানকার গুদিতে উস্তর কুমিড়ের দেখা মিলত। সেসব এখন ইতিহাস মাত্র। আবদুল গনি শ্রীমন্ত নদীর ওপারে তাকিয়ে দেখল, দীর্ঘ বিলটা বিছানো একটা ঘাসের জমিন। কোথাও ধুলট ক্ষেতের চিহ্ন নেই। দূরের আকাশটা নির্মল, পরিস্কার। কয়লার মত দাঁড়কাকগুলো বিলের উপর দিয়ে উড়ছে। আবদুল গনি ভাবল, তার জীবন ওই কাকগুলোর চেয়ে বেশি কিছু নয়। সে নদীটার ধার ঘেঁষা কেয়া ঝোপের আড়ালে বিশ্রাম নেয়ার জন্য কিছুক্ষন বসল। তখন ঝোপের আড়াল থেকে শুনতে পেল ইঁদুরের কিচকিচ। সে দেয়াশলাইটা বের করে বিড়িটা জ্বালিয়ে হুসহুস করে তাড়া করল ইঁদুরগুলোকে। অমনি ঝোপের ভেতর একটা গর্তের গভীরে ইঁদুরগুলো অদৃশ্য হয়ে গেল। সে গর্তটার মুখে ধানের ছড়া দেখে ভাবল, এটা খুঁড়ে কমছে কম দশ সের ধান পাওয়া যাবে। সে হাতের পিঠ দিয়ে মুখের ঘাম মুছে গর্তটার চারপাশ সাফ করার কাজে লেগে গেল।
আবদুল গনি নিশ্চিন্তে বিরামহীন শাবল চালাতে থাকল। তখন ঝোপের আরেকটু দূরে কয়েকটি ইঁদুর ওদের ঘর ভাংতে দেখে ঘাড় নাড়িয়ে বিড়বিড় করতে থাকে। আবদুল গনি দু’হাতে থুত্থুরি দিয়ে শাবলটা শক্ত করে ধরে মুখে মুখে ছড়া কাটল,-
ও উন্দুর, অদের মধ্যে কি
উন্দুর কয়, তোর মাথার ঘি।
ইঁদুরের এই ছড়ার মানে বোঝার উপায় নেই।অথবা আবদুল গনির অনুভূতি নেই বোবা প্রণিটির ছোট্ট বুকের ভেতর টিপটিপরত হৃদযন্ত্রটির আকুলতা।তবু ইঁদুর আর মানুষের চোখে চোখে কথা হল কিছুক্ষণ।

সন্ধ্যায় বাসন্তী আকাশ থেকে ফুরিয়ে যেতে থাকল তৃষিত সূর্যের প্রাণ।মাটি থেকে গরম ভাপ উঠে মিশে যেতে থাকে ফাল্গুনের ঘূর্ণি বাতাসের সাথে।বাতাসটা দোল খেয়ে খেয়ে মায়া আর সুখ রচনা করে।আবদুল গনি ফুরফুরে মেজাজে শাবল চালাতে লাগল।ধীরে ধীরে বিকেলটা নিঃশব্দে মিলিয়ে যেতে থাকল সন্ধ্যার আঁধারের সাথে। সে বড় একটা মাটির চাকার নিচে আড়আড়িভাবে শাবল ঢুকিয়ে চাড়ি মারল।তাতে সহসাই ঝলমল করে উঠল তার চোখদুটো। সে আগে কখনো এতগুলো শীষের খনি আর দেখেনি।শ্রীমন্ত নদীর জল শুষে ধানগুলো যৌবন অটুট রেখেছে। কিন্তু রাত্তিরটা বেরহম নিষ্ঠুর! শ্রীমন্ত নদীর ওপার থেকে ধীরে ধীরে উঁকি মারতে লাগল রাত্রিকালীন আঁধার। আবদুল গনি পানির পিপাঁসায় ঢোক গিলতে গিলতে দূরের আকাশটার দিকে তাকাল। তার মনে হল, শ্রীমন্ত নদীর ওপারের গ্রামটা যেন ছোট্ট একটা নিঝুম পৃথিবী। এপারের মানুষগুলো কুপি জ্বালিয়ে ঘর-গেরস্থ সামলায়। আর ফুলি মেয়েটা ফেকু মুন্সীর আপারে শুয়ে ফ্যাসফ্যাস গলায় গান করে। আবদুল গনি ভাবল, এতবড় ধানের খনি ফুলিকে না দেখিয়ে তুলে ফেলা ভারি অন্যায়! ফুলি নতুন কিছু দেখলে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে আর বলে- রে অউদ্যা গনি, বিয়ার আলতা স্নো কিছু কেনছ?

আবদুল গনি শাবল আর ঝুলিটা কেয়া ঝোপের আড়ালে রাখল। সে কিছুক্ষণ শ্রীমন্ত নদীর ওপারের দিকে তাকিয়ে বালকের মত শান্ত করে হাসল। তারপর মালকোচা খুলে লুঙ্গিটা ছেড়ে দিয়ে হাঁটতে শুরু করল পাদ্রিশিবপুর গ্রামের দিকে। আবদুল গনি যখন পাকা সড়কে উঠল, তখন দূরে কালিগঞ্জ বাজারের আলোয় তার সামনের শূন্যপথ ফর্সা হয়ে উঠল। দোকানের ঝুলন্ত বাতিগুলোর আলো এতদূরেও নিষ্প্রাণ হয়ে চোখে পড়ল তার। সে দূরের সড়কটির দিকে তাকিয়ে দেখল বাস গাড়ির হেডলাইটের ক্ষুধার্ত আলো। সে টের পেল তার ক্ষুধার্ত পেটটা অনায়াসে দু’এক প্লেট ভাত সাবাড় করে দিতে পারবে। কিন্তু কালিগঞ্জ বাজারে কারো চোখের সামনে পড়লে আর রক্ষা নেই। বিলের পর বিল ইঁদুরের গর্ত খুঁড়ে সে সকলের কাছে অপরাধী। এত রাতে কেউ তার শরীরে ধুলোর চিহ্ন দেখলে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে বিপর্যস্ত করে তুলবে। আর যে কেউ চোর সাব্যস্তও করতে পারে তাকে। সে রহমগঞ্জ ভাঙাপুল পেরিয়ে সুপারি বাগানের ভেতর দিয়ে সংক্ষিপ্ত পথে চলল।আবদুল গনি কয়েকটা বিল পেরিয়ে ফেকু মুন্সীর উঠানে দাঁড়িয়ে চিকন স্বরে ডাকল,-ফুলি?
ফুলি উত্তর দিলনা।
তখন ঘোর শূন্যতায় ফেকু মুন্সীর উঠানটা খা খা করছে। আকাশে উঠেছে কমলার চাঁদ। আবদুল গনি ঠোঁট চেপে শিস বাজাল। ফুলি বাইরে এসে দেখল, সারা দিনের ঘর্মক্লান্ত পিরিতের আবদুল গনি জলজ্যান্ত সামনে দাঁড়িয়ে তার। ফুলি ফ্যাসফ্যাসিয়ে বলল, মাডে-ঘাডে আর মন টিকলনারে হউদ্যা গনি। খালি ফুলির লগে কুতকুত হরতে মন চায়?
আবদুল গনি ফুলির মুখ চেপে উঠান পেরিয়ে নিঃশব্দে বাইরে চলে এল।তারা বিলের সরল পথ ধরে পুইয়াউডা গ্রাম নিশানা করে হাঁটতে থাকল। মনে হল মরুভূমির ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে দূরে কোথাও। আকাশের কমলার চাঁদ হঠাৎ গোলাপী হয়ে উঠল।দম বন্ধ করে থেমে গেল বাতাসের গতিপথ। আবদুল গনি ফুলিকে বাহুর ভেতর চেপে ধরল। ফুলির শরীরের গন্ধ ভুরভুর করে ঢুকে পড়ল আবদুল গনির নাকের ভেতর। তারা সদ্য ফাটল ধরা মাটির ওপর কিছুক্ষণ নীরাবতা পালন করল।তারপর পরস্পর শুষে নিল ভালোবাসার বিষ।
ঘুরপথে আবদুল গনি ও ফুলি কেয়া ঝোপের আড়ালে দাঁড়্ল। তারা দেখল, একটা চৌকো গর্তের কিণারে কয়েকজন লোক গোল হয়ে আছে। দূর থেকে ওদের সনাক্ত করা সম্ভব নয়। তারা চুপ করে কিছুক্ষণ বসে রইল আর ওদের অনুচ্চস্বর কথাগুলোর অর্থ উপলব্ধি করার চেষ্টা করল। তখন চৌকো গর্তের চারপাশ থেকে একজন হঠাৎ চিৎকার করে উঠল-পিলার! চিৎকার শুনে ফুলির বুকের ভেতর ভয়ংকর আতংক গ্রাস করল। সে আবদুল গনির শরীর জাপটে ধরল আর অতি আশ্চর্য হওয়ার ভঙ্গিতে বলল, পিলার! আবদুল গনি ফুলিকে থামিয়ে নষ্টালজিক হল। তার মনে পড়ল বহু বছর আগে হাতের গাজীর সঙ্গে ঘটে যাওয়া বিবাদের কথা।
আবদুল অনেক ছোট ছিল তখন। পরিচ্ছন্ন আর দায়হীন জীবন ছিল তার। প্রতিবেশি হাতেম গাজীর সঙ্গে তার বাবার জমিজমা নিয়ে চরম বিবাদ। গাওয়ালের আমিন শেকল ধরে মেপে মেপে আবদুল গনিদের উঠানে আইল গাড়ল। কি দুর্দশা আর দুর্দিন ছিল তখন। হাতেম গাজী পয়সাঅলা মানুষ, গ্রামের প্রায় সকলেই তার পক্ষে কথা বলল। একটা অসহায়, বিভ্রান্ত মুখ নিয়ে চুপ তরে বসে রইল তার বাবা। হঠাৎ ঈশ্বরের দূতের মত একজন প্রতিবেশি তাদের পক্ষ নিয়ে পরতাল আমিনের কথা তুলল। আর সেই পরতাল আমিন নকশার কাগজে পিলারের চিহ্ন দেখে সঠিক সীমানা নির্ধারণ করল। বেঁচে গিয়েছিল আবদুল গনিদের পরিবার। বাড়ি লাগোয়া বাগানের শেষ মাথায় ছিল হুড়মুড়িয়া গাছ। গাছটা বহু বছরের বয়সের ধকলে জরাজীর্ণ কিন্তু ওর পায়ের কাছে পোতা ছিল সীমানার পিলার।
আবদুল গনির কাছে পিলারটা জনগনের জন্য আশীর্বাদ। ওটা ব্ল্যাকের বাজারে কত দামে বিক্রি হতে পারে সেটা তার কাছে বিচার্য বিচার্য নয়। সে মধ্যরাতের চোরদের কিছুতেই পিলার নিতে দেবেনা। আবদুল গনি ও ফুলি শাবলটা মাটিতে কোপ দিয়ে চৌকো গর্তটার কাছে থির হয়ে দাঁড়াল। তাদের চারপাশ থেকে ঘিরে ধরল একপাল অসাধু লোক। আর ওদের লিডার সফেজ গনিকে দেখে দাঁত কিড়মিড় করতে বলল- কিরে হউদ্যা গনি, ফুলির প্যাট বাজাইতে পারলি?
আবদুল গনি রাগে গজগজ করতে করতে বলল, অ, পাল্লাম। তাইতে তোর কিরে ঘুঘুধরা সবেইজ্যা?
এটা একটা নিস্তব্ধ আঁধার রাতের বাৎচিত। তবু আবদুল গনি আর ফুলির ভেতর তীব্র অপমানের জ্বালা চেপে বসল। বলা হয়ে থাকে, অপবাদটা বড় লজ্জার। সফেজ আবদুল গনির কথা অগ্রাহ্য করল। ক্যাপসুলের মত দেখতে পিলারের শরীর থেকে কাদা ছাড়াতে ছাড়াতে তাদের শক্তিকে তুচ্ছ করল। আর এতে হঠাৎ চরমে উঠল বিবাদটা। সেদিন ধানক্ষেতে যে ঘটনা ঘটিয়েছিল সফেজ তাতে ওকে আর নিস্তার দেয়া যায় না। আবদুল গনি সাবলটা হাতে তুলে গর্জে উঠে বলল, পিলার মাডির মধ্যে রাখ কইলাম সবেজ। নাইলে গারমু তোরে।

সফেজ নিজের দলের লোকজনের শক্তিতে বলিয়ান হয়ে হিংস্র আলিঙ্গনের উদ্দেশে হাতাতে লাগল ফুলির শরীর। আবদুল গনির রক্ত চড়চড় করে সমস্ত ধমনীতে তীব্রবেগে ছুটে চলতে লাগল। সে সাবলটা তুলে সফেজের মাথায় এক’ঘা দিয়ে আশ্চর্য হয়ে নিজের কীর্তির দিকে নিজে তাকিয়ে রইল। একটা দাঁড়িয়ে থাকা যুবক এক বাড়িতে মাটিতে পড়ে কেমন ছটফট করছে। ওর মাথা দিয়ে স্রোতের ধারার মত নামছে তাজা রক্ত। আকস্মিক খুন খারাবি ভেবে সুবিধাবাদী লোকগুলো মুহূর্তে সটকে পড়ল।
আবদুল গনি ঝোঁপের ভেতর থেকে ঝুলিটা বের করে শক্ত করে হাত ধরল ফুলির । এতে খুব মুষড়ে পড়ল আবদুল গনি। রাস্তার দুধারের ছোট-বড় গাছ, সামনের বিরাট চর আর শ্রীমন্ত নদী। এক মুহূর্তের জন্য এসবের কিছুই সে তফাৎ করতে পারল না। যেন সবকিছু তার কাছে একটা সমতলভূমি। সে সম্বিত ফিরে ক্রাচে ভর দেওয়া মানুষের মত খোঁড়াতে খোঁড়াতে রাস্তার ওপর উঠল। ফুলির হাত ধরে ঠুকঠুকিয়ে হাঁটতে শুরু করল উত্তরের পথ ধরে।তখন আধমরা শ্রীমন্ত নদীর ওপারের বাড়ির দিকে তাকাল আবদুল গনি।সে দেখল গাছপালার উপরে ঝুলে আছে ফাল্গুনের কলঙ্কিত চাঁদ। দূরে বেওয়ারিশ কুকুরগুলো উ-উ বিলাপে আনন্দমুখর।শহরমুখী পা চালাতে লাগল আবদুল গনি আর ফুলি।
নদীঘেঁষা রাস্তাটির পাশে পাতলা একসারি বাড়ি।সামনে মৃত মানুষের দেশের মত নিস্তব্ধ বাগান।একটু পরপর সমতল মাঠ। আবদুল গনির এখানে ওখানে চোখে পড়ল গেরস্থের খড়ের গাঁদা। তারা রাস্তার ধারে অচেনা বাড়িটির দিকে উঁকি মেরে দেখল, এক দম্পতি ঝুপঝুপ করে গোসল করছে পুকুরে। হতে পারে এটা তাদের সঙ্গমের গোসল। ফুলি দম ফেলতে লাগল আর আবদুল গনি ফুলির মাথাটা চেপে ধরল তার বুকের সাথে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা একটা গাছের ছায়ার আঁধারে পরস্পর চুমু খেলো তারা।আঁধার থেকে পথ চলা শুরু তাদের ।তারা এই গন্তব্যহীন অমসৃণ, ক্লেদাক্ত বন্ধুর পথেও নিজেদের মত সুখ রচনা করতে জানে। তাদের এই পথ চলা হয়ত ফুরাবে না বহুদিন।


সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মে, ২০২১ রাত ১২:৫৯
৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×