রহস্যটা রহস্যই রয়ে গেলো, জানা হলোনা সাইত্রিস বছর আগে সেদিনটাতে আসলেই কি ঘটেছিলো। আজ আর জানারও উপায় নেই। উপায় নেই কারন, ঘটনার পাত্র দু’জনের একজন আমি, ভুত-প্রেতের গল্পে জমাট এই দেশে আর অন্যজন এসব থেকে হাযার হাযার মাইল দূরে ।
আমার অনেক লেখা থেকে আপনারা অনেকেই জানেন যে, যৌবন কালে চিকিৎসক হিসেবে আমাকে সেই সুদূর দক্ষিন বঙ্গের খেপুপাড়া (কলাপাড়া) হেলথ কমপ্লেক্সে কিছুদিন চাকুরী করতে হয়েছিলো। রহস্যটি সেই খেপুপাড়ারই।
ব্লগে পরাবাস্তব-ভৌতিক- আধিভৌতিক লেখা যখনই দেখি তখনই আমার এই ঘটনাটা মনে পড়ে। মনে মনে ক’দিন ভেবেছি,. আমিও সেটা লিখে আপনাদের কাছে জানতে চাইবো- আসলে সেদিন ঘটেছিলো কি । ঘটনার পাত্র আমরা দু’জনই একজন আরেক জনের উপর দোষ চাপিয়ে গেছি প্রতিবারই যখন দ্বিতীয়জনের সাথে আমার দেখা হয়েছে ।
আমি ডাঃ আহমেদ জী এস, আমাকে তো আপনারা চেনেনই। অন্যজন ডাঃ মনিরজ্জামান। ডেন্টাল সার্জন। পোংটা নম্বর ওয়ান ! খেপুপাড়া (কলাপাড়া) হেলথ কমপ্লেক্সে একসাথেই আমরা কাজ করি। যদিও পোংটামিতে আমিও কম যাইনে। তাই মনে হয় আমাদের সম্পর্কটা বেশ ফুরফুরে, রেশমী মিঠাইয়ের মতো রঙিন আর মিষ্টি ছিলো। আমি তাকে সম্বোধন করি “মুনির সাব” বলে আর উনি আমাকে ডাকেন কখনও “ ওস্তাদ”, কখনও আমার ঘরের নামের সাথে “ভাই” শব্দটি যোগ করে - “বাবু ভাই”।
তো হয়েছে কি - হঠাৎ করে একদিন জানতে পারলুম, আমাদের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নামে একটি মোটর সাইকেল( হোন্ডা -৫০) বরাদ্দ আছে কমপ্লেক্সের বড় ডাক্তার মানে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা অফিসারের অফিসিয়াল কাজে ব্যবহারের জন্যে। যদিও কখনও সেটা আমরা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দেখিনি বা আমাদের বস ডাঃ আব্দুল জব্বার বিশ্বাসকেও চালাতে দেখিনি। শুনেই, গ্রামগঞ্জে একটি মটর সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছি, এটা ভাবতেই মনখানি উড়িল দিলো আকাশে। মুনির সাব তো আমার চেয়েও বেশী আটখানা। বললো, “ ওস্তাদ চলেন যাই, জব্বার ভাইকে গিয়ে বলি মটর সাইকেলটা আমাদের দিতে।”
তো গেলুম ডাঃ আব্দুল জব্বার বিশ্বাসের কাছে - “জব্বার ভাই, শুনলাম আমাদের একটা হোন্ডা আছে । আপনাকে তো ওটা চালাতে দেখিনা কখনও। তো , সেটা কই ?”
-“সেটা তো পিয়ন জয়নাল( ঠিক নামটি মনে পড়ছেনা এই মূহুর্তে) চালায়।”
- কি ! আমরা কয়জন ডাক্তার থাকতে একজন পিয়ন আমাদের হোন্ডা চালাবে আর আমরা লগি মারবো ( হাটা ) ? কভি নেহী। আমাদের একটা মান সম্মানের ব্যাপার আছে না ? ওটা আনান।”
তো মটর সাইকেল আসলো ক’দিন পরে। আমি ছাড়া বাকী ডাক্তার সাহেবেরা কেউ মটর সাইকেল চালাতে জানেন না। মনির সাহেবের উৎসাহ সব চেয়ে বেশী- ব্যাচেলর মানুষ তো তাই !
তো, বিকেল বেলা আমি হোন্ডার ট্রেনার হয়ে বাকীদের তালিম দেই। আর ট্রেইনিং পিরিয়ড শেষ হলে একজনকে পিছে বসিয়ে আমি নদীর পাড় ঘেসে বেড়ী বাঁধের উপরে যে পাকা রাস্তা সে রাস্তা দিয়ে শিষ দিতে দিতে ফুরফুরে বাতাসে ভেসে চলি।
ক’দিন মকশো করে হাত -পায়ের ছাল ছড়িয়ে মনির সাহেব হোন্ডা চালানো অনেকটা রপ্ত করে ফেললেন। একা একাই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পাশের নির্জন মাটির রাস্তাটি ধরে অনেকদূর অব্দি চালিয়ে আসতেন।
তখন শীতকাল। সন্ধ্যের আগে আগে আমরা মাঝে মধ্যেই দু-তিন কিলোমিটার দূরের উপজেলা কমপ্লেক্সে ব্যাডমিন্টন খেলতে যেতুম। আমার সাথে হোন্ডার পিছনে থাকতো মুনির সাহেব। তার যন্ত্রনায় চালানো মুশকিল হতো।
- “ ওস্তাদ আমারে এট্টু চালাইতে দ্যান”
- “ আরে রাহেন মিঞা,অতো অস্থির হইলেন ক্যা ? শ্যাষ কালে কোতায় এক্সিডেন্ট কইররা বইবেন তহোন মান ইজ্জত লইয়া টানা টানি। হাত আরও পাকুক।”
এমনি একদিন মনির সাহেবকে নিয়ে আমি উপজেলা কমপ্লেক্সে ব্যাডমিন্টন খেলতে গেছি। খেলতে খেলতে রাত প্রায় ৯টা বেজে গেছে। শীতের রাত, হালকা কুয়াশা জমতে শুরু করেছে।
- মনির! চলেন চলেন রাইত অনেক।
- ওস্তাদ, এইবার আমি চালাই।
- মাথা খারাপ হইছে নাকি ? বাজারের মইদ্যে দিয়া রাস্তা। কার ঠ্যাঙ ভাঙাবেন আল্লায় জানে।
- ওস্তাদ, দিয়া দ্যাহেন একবার। আর অনেক রাইত, মানুষজন কম। এক্সিডেন্ট করমু না।
কি ভেবে যেন তাকে চালাতে সায় দিলুম। কমপ্লেক্সের প্রধান ভবনের সামনেই গেটের কাছে আমাদের হোন্ডাটা। ইনি হোন্ডাটাতে ষ্টার্ট দিলেন, আমি পিছনে বসেছি মাত্র এমন সময় উপজেলার একজন কর্মচারী দৌড়ে আমার কাছে এসে থামতে বললেন। তার স্ত্রীর ক’দিন থেকে সর্দি জ্বরের কথা বলে আমার কাছে করনীয় কি জানতে চাইলেন। আমি তার কথার সবটা শোনার জন্যে পা-দু’টো মাটিতে রেখে পিছনের সীট থেকে উঠে দাঁড়ালুম। তার সাথে আমি কথা বলছি আর ওদিকে হোন্ডাটা আমার ছড়ানো দু’পায়ের ফাঁক গলে ধীরে ধীরে বেড়িয়ে যেতে থাকলো। আমি লোকটির সাথে কথা বলছি আর দেখছি, মনির সাহেব গেট পেরিয়ে মেইন রাস্তায় ওঠার যে রাস্তাটা উপজেলা কমপ্লেক্স থেকে বেড়িয়েছে, সে রাস্তায় উঠে গেলেন। এক মিনিট - দু’মিনিট , এভাবে দশ মিনিট হয়ে গেল , মুনিরের পাত্তা নেই। এক্সিডেন্ট করে বসেনিতো কোথাও!! আতঙ্কিত না হলেও উদ্বিগ্ন হলুম। যার সাথে কথা বলছিলুম সে বললো -“ ছার, ঐ ছারে হয়তো হোমকে আম্নের লইগ্যা অপেক্ষা করতেছে।”
কি করা! উপজেলা কমপ্লেক্সের রাস্তা দিয়ে হাটছি, মুনিরের দেখা নেই। শীতের রাত ,রাতও অনেক , কোনও লোকজন নেই এমনকি একটা রিক্সাও নেই। নাক বরাবর সোজা রাস্তা, বেড়ীবাঁধের বড় পাকা রাস্তার সাথে মিশেছে। লাইটের আলো আর কুয়াশা মিলে কেমন কেমন যেন লাগছে কিন্তু মনির সাহেবের ছায়াও নেই কোনখানে। গা ছমছম করলেও মেজাজটা গরম হতে থাকলো । এই রকম ফাজলামো মুনিরের করা উচিৎ হয়নি।
এখন যদি রিক্সা না পাই তো সারাটা পথ আমাকে এই শীতে দু-তিন কিলোমিটার দূরের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে হেটেই যেতে হবে। হাটছি আর আমার মেজাজের ব্যারোমিটার বাড়ছে। কোত্থাও নেই মুনির। কি হলো তাহলে ? পথের পাশে পড়ে গেলে তো দেখতে পেতুম। এক্সিডেন্ট করলে তো সোরগোল পাওয়া যেত! কিন্তু নাহ। নেই। তাহলে কি মুনির সাহেব আমার সাথে মশকারী করছে ? আমাকে হাটতে বাধ্য করে মজা দেখতে চাইছে ? আবার এও ভাবছি, এসব তো তার করার কথা নয়। একজন ডাক্তার তাতে সরকারী অফিসার, কোনটা সঙ্গত কোনটা অসঙ্গত এ বোধটা তো তার থাকা উচিৎ!
হাটছি পনের মিনিট হয়ে গেলো। মুনির যেন হাওয়া হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত আমাকে ফেলে মুনির বাসায় ফিরে গেলো ? শীতের রাতেও রাগে গজগজ করতে করতে মুনির সাহেবের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্বার করতে করতে ঘেমে যাচ্ছিলুম। রাগলেও আশা ছিলো, মুনির ফিরে আসবেই। আমাকে একা ফেলে সে কিছুতেই যাবেনা। এমন বেয়াদবী সে করবেনা আমার সাথে ।
বেড়ীবাঁধের বড় পাকা রাস্তায় উঠে কিছু দূর যাওয়ার পরে একখানা রিক্সা মিললো। যেতে যেতে বাজারের জটলার কাছে আসতেই দেখি বাজারের রাস্তার একপাশে দু’পা ছড়িয়ে হোন্ডায় বসে দু’হ্যান্ডেলে হাত রেখে মুনির সাহেব এদিক ওদিক দেখছেন। দেখেই রক্ত মাথায় চড়লো। আমি এই গ্রামের রাস্তায় হাটতে হাটতে শেষ আর উনি এখানে বসে হাওয়া খাচ্ছেন! কাছে গিয়েই বললুম -
“মিঞা, ফাইজলামিরও তো একটা সীমা থাহে! রিক্সা নাই, আধা ঘন্টা হাটাইলেন! ”
উল্টো মুখ গোমড়া করে আমাকেই ঝাড়ি দিয়ে মুনির বললেন -
-“ বাবু ভাই , আপনের দেরী হইবে কইতেন। আমি একটা বিড়িতে টান দিতে পারতাম এতোক্ষুনে”।
- “ কি উল্ডাপাল্ডা কন ? আমি কই গেছিলাম যে দেরী হইবে ? “
- “ ওস্তাদ ফাইজলামী কইররেন না। আপনে কইলেন এইখানে থামতে। কি জানি কিনবেন বাজার দিয়া। আমিতো সেই থিক্কাই এইহানে বইয়া রইছি। সামনে যাই নাই যদি খুইজ্জা না পান! “
মেজাজ গরম হয়না কার ? এই রাত্তিরে এমন ফাইজলামী ভালো লাগে ?
বললুম - “ আমি এইহানে থামতে বলছি ? ইয়ার্কি করেন ?
মুনিরের সিরিয়াস মুখ, মেজাজও তুঙ্গে - “ আধা ঘন্টা বওয়াইয়া রাকলেন, দোষ তো আপনের আর এহোন মিছা কতা কন?”
মুনির কি ইয়ার্কি করছে আমার সাথে ? করতেও পারে । আমাকে একটু ঘোল খাওয়ালো আর কি!
নরম সুরে বললুম - “ মুনির সাব! আমি তো আপনের সাথেই ছিলাম না। দ্যাকলেন না লোকের সাথে কথা কইতেছিলাম আর আপনি আস্তে আস্তে হোন্ডায় টান দিয়া চইল্লা গ্যালেন।“
- আমার লগে ইয়ার্কি কইররেন না ওস্তাদ। সারা রাস্তা চুপচাপ ছিলেন। এহানে আওয়ার পরে আপনে কইলেন এহানে থামতে। মানুষজনের মইদ্যে আমি কষ্ট কইররা থামাইলাম। আর এহোন কন , আপনে আমার লগে আছিলেন না।“
- আরে মিঞা আমি যদি আপনের পিছনেই থাকতাম তাইলে আমার মতো বকবক করা মানুষ এতোক্ষুন চুপচাপ ছিলো ? এইডা আপনের বিশ্বাস হয় ? আপনের হয় হ্যালুসিনেশান হইছে নয় আপনেরে ভুতে ধরছে! ”
- ভুতে ধরলেতো ভালোই হইতো, এইহানে আধাঘন্টা বইয়া থাকতাম না। একটানে হেলথ কমপ্লেক্সে চইল্লা যাইতাম।“
যাক, আমরা কেউই কাউকে বোঝাতে পারছিলুম না। মুনির সাহেবের বিশ্বাস, আমি ওনার সাথে ইয়ার্কি করছি তেমনি আমারও বিশ্বাস, মুনিরও আমার সাথে বেশ বড় ধরনের একটা ফাইজলামি ফাইজলামি খেলা খেলছে। বেশ কিছুদিন এটা নিয়ে আমরা কেউ কাউকে ছাড় দিচ্ছিলুম না। আমিতো জানি সত্যটি কি, কি কি ঘটেছে। কিন্তু মুনিরের ঐ একই কথা, আমি থামতে বলাতেই সে নাকি বাজারে থেমেছে আর অপেক্ষা করেছে আমার ফিরে আসার। হ্যালুসিনেশান হয়নি তার। বাইকের শব্দের কারনে সে আমার কথা শুনতে পাবেনা বলে আমি নাকি তার কানের কাছে মুখ নিয়ে থামার কথা বলেছি!
এরপরে আমি দেশের বাইরে লিবিয়াতে চলে যাই, মুনির সাহবেও চলে যান আমেরিকাতে। আমি দেশে ফিরে আসি ৯৫ সালে। ৯৬ সালে এবং পরে আরেকবার মুনির সাহেব ছুটিতে দেশে এলে ঢাকাতে আমার বাসায় এসে দেখা করেন। দু’বারই আলাপ করতে করতে আমি খেপুপাড়ার সেই ঘটনা মনে করিয়ে জানতে চেয়েছিলুম - সত্যটা কি ? এতোদিন পরে বলা যায় নিশ্চয়ই ?
মুনিরের ঐ একই কথা - আমি নাকি তার সাথে আগামাথা ইয়ার্কি করেছি সেই দিনটাতে। সত্যটা না বলে এখনও সেই ইয়ার্কিই নাকি করছি।
আর আমিও ভাবছি, মুনির এখনও ইয়ার্কি ছাড়তে পারলোনা!
আজ সাইত্রিশ বছর হয়ে গেলো সেই রহস্যের জট আর খুললো না।
আরও আশ্চর্যের ব্যাপার হলো রাতে এই লেখা টাইপ করতে গিয়ে বারে বারেই অক্ষরগুলো উল্টে পাল্টে যাচ্ছিলো। “ত” এর বদলে “থ” বা “দ” , “চ”-য়ের জায়গায় “ট” বা “ঠ” হয়ে যাচ্ছিলো। স-য়ের জায়গায় ‘ম’ আর ন-য়ের জায়গায় ‘র”। এমনি প্রায় প্রতিটি শব্দেই। এমনটা আমার আগে হয়নি কখনও।
আরও একটা রহস্য ??????
কাল্পনিক_ভালোবাসাকে ভালোবেসে এই রহস্যময় ঘটনাটি পত্রস্থ করা গেল।
ছবি সূত্র - ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে আগস্ট, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:০৩