ভালোবাসা মানে কি ?
টু বেড , ডাইনিং , কিচেন , টু বাথ , এক খানা দখিনা বারান্দা এই তো !
আজ ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখে, উপরের এই উত্তরটি কারো কাছেই গ্রহণ যোগ্য হবার কথা নয় । মধ্যবিত্ত ভাড়াটিয়া শ্রেণীর কাছে ওই প্রশ্নটি করলে এই উত্তর টি পাওয়ার হয়তো সম্ভাবনা ছিল।
তাদের চিন্তা চেতনায় থাকে এক খানা ভালো বাসা । ভালো বাসার চিন্তায় চিন্তায় তাদের ভালোবাসা নিয়ে চিন্তা করার সময় কই ।
দেখা যাচ্ছে ভালোবাসা জিনিষটা একজনের কাছে এক রকম । আমি বাপু তারুণ্যের কবি শামসুর রহমানের দলের । “ ভালবাসা কি ? এই প্রশ্ন যদি কেউ আমাকে করেন তাহলে আমি সবিনয়ে নিরুত্তর থাকব ।কেউ বেশী পীড়াপীড়ি করলে সেইন্ট অগাস্টিনের মত বলব,এ বিষয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলে আমি জানিনা, জিজ্ঞেস না করলে জানি” ।
ভালবাসার ক্ষেত্রে রুপ-সৌন্দর্য একটি বড় ব্যাপার । অসুন্দর কোন পুরুষের জন্য কোন রমণীর মন আনচান করে না । আবার অসুন্দর কোন রমণীর জন্য পুরুষের মনও ব্যাকুল হয়না । কাজেই ভালবাসায় সুন্দর চেহারা একটি বিশাল ফ্যাক্টর ।সুন্দরের প্রতি মানুষের আকর্ষণ সহজাত । তাইতো, কবি-সাহিত্যিকগণ অকৃপণভাবে সুন্দরের বন্দনা করে গেছেন ।
ইংরেজ কবি কিটস এর ভাষায় , “Truth is beauty, beauty is truth”. তিনি আরও বলেছেন, “A thing of beauty is a joy forever.”
মহামতি এরিস্টটল এর কথা শুনে অনেকেরই মাথায় 'ঠাডা ' পরতে পারে । তিনি বলেছেন, “Beauty is better than all the letters of recommendation in the world”. ।
সুন্দর মুখের জয় যদি সর্বত্রই হয় , তাহলে আমার মত অসুন্দর চেহারা বা সাধারণ চেহারার লোকজনের তো দেখছি কোন 'বেইল'ই নাই । এটা আমাদের জন্য বিরাট আতঙ্কের , আশংকার বিষয়ও বৈকি !তবে এর একটা বিহিত না করে ছাড়ছিনা ।
কাউকে কেবল চেহারা দেখেই বিচার না করার জন্য সকল ধর্মগ্রন্থেই জোর তাগিদ দেয়া হয়েছে ।লালন সাহেব বলেছেন , “প্রেম করো আত্ত্বার সনে, দেহের সঙ্গে নহে” । মজনুকে প্রশ্ন করা হয়েছিল , তুমি লায়লার মধ্যে কি পেয়েছ যার জন্য তুমি পুরো পৃথিবীকে ত্যাগ করতে প্রস্তুত ?
প্রশ্নের জবাবে মজনু বলেছিল, “আমার চোখ দুটো দিয়ে আপনি লায়লাকে দেখলে বুঝতেন ও কত সুন্দর”।
পারস্যদেশীয় এক কবি বলেছেন , “ভালবাসার মুখগুলোকে চন্দ্রালোকিত রাতে দেখতে হয়, যখন প্রেমিক-প্রেমিকা তার মনের মানুষকে দেখে অর্ধেক দৃস্টি আর অর্ধেক কল্পনা দিয়ে”।মহাকবি শেক্সপিয়েরের একটি কথায় এর প্রমাণ মেলে, “love looks not with eyes but with the mind”.চেহারার বিষয়ে আব্রাহাম লিংকনের এই কথার পরে মনে হয় আর কোন কথা চলে না ।
উনার এই ঘটনাটি '' বেইল নাই '' ওয়ালাদের মনে আশার আলো জাগাতে পারে ।
এক জনসভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে আব্রাহাম লিংকনের কানে এলো ভিড়ের মধ্যে কে যেন বলছে, “আরে ইনার চেহারা তো দেখছি একেবারে সাদামাটা”।লিংকন পাশ ফিরে লোকটির উদ্দেশ্য বললেন, “বন্ধু! ঈশ্বর সাদামাটা চেহারার লোকদের বেশি পছন্দ করেন, সেজন্য অধিকসংখ্যক লোকদেরকেই তিনি সাদামাটা চেহারা দিয়ে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন”।
আসলে ভালবাসার ক্ষেত্রে চেহারা গুরুত্ব পূর্ণ হলেও কোনক্রমেই তা অপরিহার্য নয় । ভালবাসার ক্ষেত্রে অপরিহার্য ব্যাপার হল সুন্দর একটি প্রেমিক মন। যে মন শুধু দুধ খেতে চাইবে না,মাংসও দিতে চাইবে।
লাইলী তখন রাজপুত্রের বউ।মজনু যথারীতি জঙ্গলে লাইলী, লাইলী করছে।
লাইলী খাস ভৃত্যকে ডেকে নির্দেশ দিলেন জঙ্গলে লাইলী, লাইলী জপ করা পাগলটাকে যেন প্রতিদিন গোপনে দুধ দিয়ে আসা হয়। ভৃত্য তাই করে যাচ্ছিল। এটা দেখে এক দুষ্ট লোক দুধ খাওয়ার লোভে মজনুর বেশ ধরে লাইলী, লাইলী জপ করা শুরু করলো।পরের দিন ভৃত্য এসে আসল মজনু সনাক্ত করতে ব্যার্থ হয়ে দুজনকেই দুধ দিয়ে গেল।এক এক করে একসময় মজনুর সংখ্যা অনেক বেড়ে গেল। মণ মণ দুধ নিয়েও কুলানো যাচ্ছিল না। নিরুপায় হয়ে ভৃত্য লাইলীকে ঘটনা খুলে বলল। লাইলী ভৃত্যকে একটা বুদ্ধি বাতলে দিল।
পরের দিন ভৃত্য দুধ দেয়ার আগে ধারালো ছুরি হাতে নিয়ে মজনু কে বলল, লাইলী আপনার মাংশ খেতে চেয়েছে, আগে এক টুকরা মাংস নেই। এই শুনে মজনু রুদ্ধশ্বাসে দিল দৌড়। এভাবে একে একে সব মজনু পগার পার,বাকি রইল আসল মজনু। সে বলল, লাইলি শরীরের কোন অংশের মাংসের কথা বলেছে জানিনা, তুমি আমার পুরা শরীরের মাংস ছিলে নাও।
আফসোসের বিষয়, এখন আর মাংস দেয়ার মত মজনু নাই, সব দুদু খাওয়া মজনু।
যাক আগের কথায় ফিরে যাই -
আপনার মনটা সুন্দর হলেই আপনি ভালবাসতে পারবেন । ভালবাসা যেখানে যত গভীর হয় চেহারা সেখানে ততই গৌণ হয়ে পড়ে ।
ভালোবাসার ক্ষেত্রে ব্যর্থরাই সফল ।
ইতিহাস সব সময় জয়ীর পক্ষে । প্রেম ভালবাসার ক্ষেত্রে উল্টো ।তাকিয়ে দেখুন ইতিহাসের দিকে । আপনি চোখ বুজেই বলে দিতে পারবেন লাইলি-মজনু, শিরী-ফরহাদ, রোমিও-জুলিয়েট, কিংবা দেবদাস-পার্বতীদের মত অমর জুটিগুলোর কথা ।এদের ভালবাসার কথা, এদের বিরহের কথা আজও লোক মুখে ঘুরে বেড়চ্ছে । প্রতিটি মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছে ঐ অমর নামগুলো । অথচ এরা কেউই সফল নন । সব ''হারু পার্টি ''।
কিন্তু প্রেম করে সফল হয়েছেন এমন একটি যুগলবদ্ধ নামও আমাদের হৃদয়ে নেই । ইতিহাসেও তাদের কোন নাম নেই ।ব্যর্থরাই সফল এ ক্ষেত্রে অসংখ্য উদ্ধৃতি দেয়া যায় । আমার কাছে সবচেয়ে প্রণিধানযোগ্য দু’টো শের বঙ্গানুবাদসহ শোনাচ্ছিঃ
মেরে রোনেকো জিসমে কিসসা হ্যায়
উমর কা বেহতারিন হিস্যা হ্যায় ।।
বাংলাঃ আমার কান্নার ভাগ যে অংশে রয়েছে, জীবনের সে অংশটাই শ্রেষ্ঠ ।।
জিসনে দিল খোয়া উসী কো কুছ মিলা
ফায়দা দেখো উসী লোকসান মে ।
বাংলাঃ যে হৃদয় হারিয়েছে সেই কিছু পেয়েছে । এটাই পৃথিবীর একমাত্র লোকসান যাতে আসলে লাভই ভাগ্যে জুটে যায় ।।
দুনিয়াটা বিশাল এক প্রেমের ক্ষেত্র । নিজ বাসভূমে আমরা সবাই প্রেমিক । কেউ জেনে, কেউ না জেনে । কেউ ভেবে, কেউ না ভেবে । আমরা সবাই প্রেমে পড়ি, ভালোবাসি ।
আমরা প্রেমে পড়তে ভালোবাসি , ভালোবাসতে ভালোবাসি ।
আসুন আমরা সবাই ভালবাসি । একমাত্র ভালবাসাই পারে পৃথিবীটাকে বাসযোগ্য রাখতে ।
সকলকে Happy Valentine's Day'র শুভেচ্ছা।
সব শেষে হুমায়ুন আহমেদের চিত্রায়নে একটি অসাধারণ কাওয়ালী
( সংগৃহীত তথ্য,কোটেসন আর জোড়া তালির ভিত্তিতে লিখাটি ২০১৪ সালে আমার ফেসবুক পেজে পোস্ট করা)
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:২০