ভার্সিটিতে অনেক ছেলে ঢাকার বাইরে থেকে পড়তে আসত। তাদের অনেকেরই থাকার একটা সমস্যা ছিল। ভার্সিটির কাছাকাছি হওয়াতে পরিচিত মহলে আমার বাসাটার বেশ চাহিদা ছিল। ফলে দেখা গিয়েছিল, আমার রুম ও ড্রইং রুম বাদে বাকি সব রুমেই দুইজন বা তিন জন করে থাকত। আমার এক বন্ধুর কাজিন ঢাকায় পড়তে এসেছিল। কিন্তু বেচারা কোথাও থাকার জায়গা পাচ্ছিল না। পরে আমি বন্ধুর অনুরোধে ছেলেটিকে ড্রইং রুমে থাকতে দিয়েছিলাম। আর মূল ঘটনার সূত্রপাত এখান থেকেই।
একদিন সকাল বেলা আমার ক্লাস ছিল। সবাই তখনও ঘুমাচ্ছে। রেডি হয়ে ড্রইং রুমে আসতেই আমার চক্ষু চড়ক গাছ! দেখলাম,বন্ধুর কাজিন জনাব মহাশয়ের লুঙ্গিখানা কোমরের নিচ থেকে উঠে গিয়ে মাথায় অবস্থান করছে এবং "তাল গাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে" টাইপের একটি পরিস্থিতি। আমি কিছুক্ষন পাগলের মত এদিক সেদিক তাকালাম। কি করব ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। সাত সকাল বেলা এই ধরনের একটা দৃশ্য দেখা অত্যন্ত ভয়াবহ ব্যাপার।
থতমত খেয়ে তাড়াতাড়ি করে ছেলেটাকে ডেকে লুঙ্গি ঠিক করতে বললাম। এই ধরনের সিচুয়েশনে পড়লে মানুষের মধ্যে যে স্বভাবজাত তাড়াহুড়া থাকে তার মধ্যে তেমন কিছুই ছিল না। বরং মনে হলো, "কি যন্ত্রনা! একটু আরাম করে যে খোলা মেলা হয়ে ঘুমাব, তারও কোন উপায় নেই" - টাইপের একটি অভিব্যক্তি দিয়ে সে লুঙ্গি ঠিক করে আবার শুয়ে পড়ল।
কিছুটা মেজাজ খারাপ করে আমি ভার্সিটি চলে এলাম। বন্ধুদের সাথে ব্যাপারটা নিয়ে কিছুক্ষন হাসাহাসি করে ক্লাসে গেলাম। ম্যাডাম ক্লাসে একাউন্টিং এর কিছু টার্ম নিয়ে পড়াচ্ছেন। বেশ গুরুত্বপূর্ন ক্লাস। কিন্তু আমি কিছুতেই ক্লাসে মনযোগ দিতে পারছি না। আমার শুধু বার বার সকালের সেই ভয়াবহ দৃশ্যের কথাই মনে পড়ে যাচ্ছে।
পাশে থাকা এক সহপাঠিনী স্লাইডের একটা টার্ম দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, এ্যাই এই টার্মটার পুরো মানে কি?
আনমনে বলে উঠলাম, "তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে....."
সহপাঠিনী ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল মানে??
প্রচন্ড বিব্রত হয়ে হয়ে সাথে সাথে মাথা নেড়ে বললাম, স্যরি, মনে পড়ছে না।
ঐ সপ্তাহে আমার আমার আর কোন ক্লাস ছিল না। বাড়ী চলে গিয়েছিলাম। কয়েকদিন পরে যখন বাসায় ফিরলাম, বাসার বাসিন্দারা বেশ কিছু গুরুতর অভিযোগ নিয়ে আমার কাছে এলো।
বলাবাহুল্য সকলেরই সেই 'তালগাছ দর্শন' সংক্রান্ত অভিযোগ।
জনৈক বাসিন্দা হতাস হয়ে বলল, দোস্ত, সবাই সকাল বেলা কত সুন্দর সুন্দর জিনিস দেখে, পাখি দেখে, আকাশ দেখে, সূর্য দেখে, পাশের বাড়ির মেয়েও দেখে আর আমরা!!! আমরা শুধু সেই ভয়াবহ 'তালগাছ' দেখেই যাচ্ছি। সকাল বেলা যাত্রা করে এই জিনিস দেখার কারনে আমাদের সারাদিন অনেক খারাপ যাচ্ছে। অনেক হওয়া কাজও হচ্ছে না। এর একটা বিহিত চাই।
----- যাই হোক, এর একটা চরম বিহিত করার জন্য রুদ্রমূর্তি ধারন করে ঐ ছেলেটিকে ডাকলাম। তাকে বললাম, এখানে থাকতে হলে তোমার লুঙ্গি পরা চলবে না, প্যান্ট বা হাফ প্যান্ট পড়ে ঘুমাতে হবে।
আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর না যে, তালগাছ দেখে কবিতা লিখে ফেলব। আমরা সাধারন মানুষ।
ছেলেটা মিন মিন করে বলল, ভাইয়া, লুঙ্গি ছাড়া তো ঘুমাতে আরাম পাই না। আমার একটু সমস্যা আছে।
আমি মোটামুটি রক্তচক্ষু করে তাকালাম। কত বড় ফাজিল! আমার চোখ এমনিতেই বড় বড়। তার উপর ভয় দেখাতে গিয়ে আরো বড় বড় করে ফেলায় চোখ টনটন করতে লাগল। আমাদেরকে চরম ধৈর্য পরীক্ষা নিয়ে ছেলেটি বলল, আমাকে লুঙ্গি পরার অনুমুতি দেন ভাইয়া। আমি এখন থেকে ঠিক ঠাক করে থাকব। প্লীজ, আমি লুঙ্গি ছাড়া ঘুমাতে পারি না।
না হবে না। নো লুঙ্গি।
প্লীজ ভাইয়া, একটু কনসিডার করেন।
সবার দিকে তাকালাম। দেখলাম প্রায় সবাই হাসি চেপে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমার সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়। হাসান নামে আমার এক ফ্রেন্ড ছিল। সে বলল, তাইলে এখন থেকে তুমি উপরে নিচে ভালো করে গিট্টু মাইরা তারপর ঘুমাইবা ঠিক আছে? যদি উল্টা পাল্টা হয়, তাহলে সারাজীবন কিন্তু কইলাম জিনিস ছাড়া থাকতে হইব।
ছেলেটা দ্রুত মাথা নেড়ে বলল, ঠিক আছে ভাইয়া, ঠিক আছে।
তার কয়েকদিন পর আমাদের মিডটার্ম শুরু হল। সবাই পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত। এর মধ্যে নতুন করে লুঙ্গি সংক্রান্ত কোন অভিযোগ শুনি নি। আমাদের মনে হল যাক এই সমস্যার বুঝি সমাধান হয়েছে। কিন্তু আমাদের চিন্তা যে ভূল ছিল তা অতিদ্রুত প্রমানিত হল।
শেষ পরীক্ষার আগের রাতে আমার বাসায় কিছু ফ্রেন্ড চলে আসলো, একসাথে থেকে পড়াশুনা করব তারপর সকালে পরীক্ষা দিতে যাব।
সকাল বেলা পরীক্ষার জন্য বিসমিল্লাহ পড়ে যেই ঘর থেকে বেরুতে যাব, ওমনি সেই পুরানো দৃশ্যের অবতারনা, আবারও সেই ভয়াবহ ''তালগাছ দর্শন''।
ছেলেটি ঘুমাত ঠিক দরজার পাশেই। ফলে আমরা যে চোখ বন্ধ করে চলে যাব সেই উপায় আমাদের ছিল না। আমার বন্ধুরা যারা রাতে আমার সাথে থেকেছিল, তারা এই জিনিসের সাথে পরিচিত ছিল না। তারা টাস্কিত! আমার আর হাসানের বিব্রতকর চেহারা দেখে তারা হেসে ফেলল। একজন বলল, মামা চল এখানে মরিচ দিয়া দিই। আর একজন বলল, না না সুপারগ্লু দিয়া দেই, শালা শিক্ষা পাবে।
আমার যে কি ইচ্ছা করছিল তা আসলে ভাষায় প্রকাশ করা ভীষন কষ্টের। যারা গ্রামে বেড়াতে গিয়েছেন তারা নিশ্চয়ই দেখেছেন, রাখালরা গরুর খুটি কিভাবে মাটিতে ঢুকান। খুটি মাটিতে রেখে পা দিয়ে জোরে লাথি মেরে তা ভিতরে ঢুকানো হয়। আমার খুব ইচ্ছা করছিল, আমি "খুটা"পুঁতা রাখাল হই।
প্রচন্ড মেজাজ খারাপ করে পরীক্ষা দিতে গেলাম। পরীক্ষা খুব একটা ভালো হলো না। এমনকি ফেল করারও একটা চান্স ছিল । সমস্ত রাগ এবং ক্ষোভ গিয়ে পড়ল ঐ ধৈঞ্চা ছেলের উপর। সকাল বেলা যারা হাসছিল, তারাও এখন বিরক্ত। আমাদের বদ্ধমূল ধারনা হল, সকাল বেলা যাত্রা করে অশুভ জিনিস দেখে বের হবার কারনেই আমাদের এই অবস্থা।
মাথা ঠান্ডা করার জন্য ভার্সিটির ক্যাফেটেরিয়ার বসলাম। সেখানে টিভিতে একটা এ্যাড দেখাচ্ছিল। একজন ওয়েস্টার্ন কাউবয় দড়ির মাধ্যমে একটা ড্রিংসের ক্যান উদ্ধার করে। এটা দেখে সাথে সাথে মাথায় একটা প্ল্যান চলে আসল। উচিত শিক্ষার জন্য এর চেয়ে সুন্দর প্ল্যান আর হতেই পারে না।
ভূক্তভোগীদের সাথে পরিকল্পনার কথা শেয়ার করলাম। সবাই এক কথায় রাজি। দেরী না করে কাজে নেমে পড়লাম। বনানী বাজার থেকে আমরা থ্রেডবল জাতীয় এক বিশেষ প্রকার বই সেলাই করার সুতা কিনলাম। তারপর বাসায় ফিরে এলাম। তারপর কার কি দায়িত্ব সেটা বুঝিয়ে বলে দিলাম।
ঠিক হলো, আজকে বাসায় বেশ খানা পিনার আয়োজন হবে। ঐ ছেলেটিকে বেশি করে পানি জাতীয় জিনিস খাওয়ানো হবে। কেননা পানির অভাব হলে প্ল্যান বাস্তবায়নে কিছুটা সমস্যা দেখা দিতে পারে।
রাহি এবং সুমন মিলে বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে এবং দড়ির অপর অংশ প্রধান দরজার সাথে টান টান করে লাগানো থাকবে। এই কাজে সাহায্য করবে হাসান এবং তুহিন।
উল্লেখ্য এই বাসার নির্মান জনিত একটা ত্রুটির কারনে প্রধান ফটকটা বাইরের দিকেই খুলত। আমি নতুন একজন বুয়া রেখেছিলাম যিনি সকাল ০৮ টার দিকে এসে রুম ঝাড়ু দিতেন এবং রান্না করে দিতেন। তার বিরুদ্ধেও বেশ অভিযোগ ছিল, তিনি কাজে ফাঁকি দিতেন এবং রান্নাঘর থেকে আলু, পেয়াজ, ডিম ইত্যাদি নিয়মিত সরিরে ফেলতেন। এই প্ল্যানে তার অন্যতম ভূমিকা থাকবে এবং যদি আমরা সফল হই তাহলে তিনিও একটা উচিত শিক্ষা পাবেন ।
যাইহোক, সব কিছু প্ল্যান মোতাবেকই হলো। ঐ ছেলেটিকে ঘুমাতে পাঠিয়ে আমরা অপেক্ষা করছি কখন সেই ভয়াবহ দৃশ্য শুরু হবে এবং আমাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ শুরু করব। কিন্তু আমাদেরকে অত্যন্ত হতাশ করে দিয়ে সে দিন কিছুই হল না। তালগাছ না দেখার কারনে যে আমরা কখনও হতাশ হব সে কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবি নি। মন খারাপ করেই যে যার মত ঘুমাতে গেলাম।
তারপ্রায় দুই দিন পর, মুভি দেখে সকাল বেলা ঘুমাতে গিয়েছি। মাত্র চোখটা লেগে এসেছে, হঠাৎ হাসান এসে ধাক্কা ধাক্কি শুরু করল। অনেকটা কমান্ডোদের মত মাটিতে বসে আমার কানের পাশে ফিস ফিস করে আমাকে ডাকছে। ঐ বেটা জলদি উট!! আইজকা তালগাছ উঠছে রে!!!
আমি লাফ দিয়ে উঠলাম। তুহিনকে ডাকলাম। থ্রেড বল নিয়ে ড্রইং রুমে গেলাম। একটা লুপ বা ফাঁসির দড়ির মত একটা গিঁট বানালাম। তুহিনকে বললাম, যা গাছে দড়ি বেঁধে আয়! বেটা নখরা শুরু করল। বলল, সে পারবে না, তার কেমন যেন লাগছে।
সাফল্যের এত কাছাকাছি এসে এই ধরনের বাহানা অত্যন্ত অমার্জনীয় অপরাধ। হাসান চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, তুই যদি এখন কোন বাহানা বানাস তাইলে সত্যি কইলাম তোর তাল গাছে আমি নিজে রশি লাগাবো । জলদি কাম শুরু কর।
এই ধরনের হুমকির পর আর কারো কিছু বলার থাকে না। ফলে তুহিন দুই আংগুল দিয়ে খুবই হাস্যকর ভাবে বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বেঁধে দিল। আমি রশির অপর প্রান্ত দরজার হুকের সাথে হিসাব করে টান টান করে বেঁধে দিলাম। যেন বুয়া যখন ভিতরে ঢুকার জন্য দরজা খুলবে তখন যেন "সেখানে" টান পড়ে। ঘড়িতে দেখলাম ০৭:৪৫ বাজে। কিছুক্ষনের মধ্যেই বুয়া চলে আসবে। আমরা মেইন গেটটা একটু খুলে রাখলাম, যেন বুয়া এসে বুঝতে পারে দরজা খোলা। তারপর সবাই মিলে আমার রুমে ঢুকে বসে থাকলাম। বুকের ভেতর টিপ টিপ করছে, বুয়া ঠিক সময় আসবে তো? সব ঠিক মত হবে তো। একটু পর পর দরজা ফাঁক করে দেখছি যে সব ঠিক আছে কিনা।
হঠাৎ মনে হল নিচে বুয়ার কন্ঠ শুনলাম। কেয়ারটেকারের সাথে কথা বলছে। আমরা চরম উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করছি আর মনে মনে সময় গুনছি। খালি আমাদের নিশ্বাসের শব্দই শুনতে পাচ্ছি। হঠাৎ দরজা খোলার সাথে সাথে বুয়ার তীব্র চিৎকার!!! ও আল্লাহ গো!!!!!!!!!!! এইটা আমি কি দেখলাম!
সাথে সাথে মহাশয়েরও চিৎকার। আআঊঊঊফফফফফ। আসলে শব্দ কিভাবে লিখে প্রকাশ করতে হয় আমি জানি না। তবে আপনি ভেবে নিন শব্দটা এসেছে বুকের গভীর থেকে এবং যা কিনা মুখের কাছে এসে আটকে গিয়েছে- এমন টাইপের শব্দ।
আমরা দৌড় দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে আসলাম। দেখলাম আমাদের তালগাছ বাবা বিছানায় দুই পা মেলে বসে রয়েছেন।কোন তালগাছ দেখতে পাচ্ছি না। ডাবল পাক দেয়া থ্রেডবল সুতা ছিড়ে পড়ে আছে। তার চোখে হতভম্ব দৃষ্টি। সিড়িতে গেলাম, দেখলাম বুয়া মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। তার মাথায় পানি দিচ্ছে আমাদের কেয়ারটেকার। কেয়ারটেকার বলল, ভাইয়া আপনারা নাকি কোন ভাইয়ার সুন্নতে খাৎনা করাইছেন ? ও তাই দেইখা ভয় পাইছে।
সম্পাদিত পোস্ট।
মুল-মোজাদ্দেদ আল ফেসানী জাদিদ।(''কাল্পনিক ভালোবাসা''
লেখাটি আমি পঞ্চাশের অধিকবার পড়েছি, যতবার পড়ি ততবার হাঁসি!
মজার এ লেখাটি পাঠকের সাথে শেয়ারের লোভ সামলাতে পারলাম না।
আফসোস! অসম্ভব রসবোধসম্পন্ন লেখকের এ ধরনের লেখা এখন আর আমরা পাচ্ছিনা।
পুনশ্চঃবিষয়টা অতীব আনন্দের যে,সুপ্রিয় জাদিদ ভাইয়ের একমাত্র কন্যা ও একমাত্র স্ত্রীর আজ জন্মদিন।
শুভ কামনা সামারা আল ফাসানী ইনায়া মা, শুভ কামনা সামারা আল ফাসানী ইনায়া’র মা।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুন, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:৩৩