সেদিন খুব ভোরে প্রতিবেশী একজন মহিলা লাইলিদের বাড়িতে গিয়েছিলো খাবার দিতে। গিয়ে দেখে লাইলির বাবা কপালে হাত দিয়ে উঠানে বসে আছে। লাইলির মা বাঁশ দিয়ে বানানো চৌকির এক পাশে আরাম করে তখনো ঘুমোচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে তাদের বাড়িতে কিছুই হয়নি। এমন পরিস্থিতিতেও কি করে ঘুমোয় এভাবে! কথায় বলে না, "মায়েরা সাত জাত, মাছের মা হলে তো কথাই নেই!"
লাইলিকে বাড়িতে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। কোথায় গেছে তা প্রথমবার জিজ্ঞেস করে লাইলির বাবার কাছ থেকে কোন উত্তর পাওয়া গেলো না। দ্বিতীয় বার জিজ্ঞেসেও এমনভাবে উত্তর দিলো, শুনে মনে হলো কতদিনের না খাওয়া।
- "ওর মামুর বাড়ি গেছে।"
কথাটা বলতে যেন খুব কষ্ট হলো। গতকাল সকালবেলা সেই প্রতিবেশীর ঘর থেকে এক সের চাল এনেছিলো লাইলির মা। সেও লুকিয়ে। যদি আবার দেখে ফেলে লোকজন, তাহলে তো যাদের কাছ থেকে সাহায্য নিচ্ছে তাদেরও বিপদ হবে। কাপড়ের আঁচলের নিচে লুকিয়ে এনেছিলো।
প্রতিবেশী মহিলা একটু আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
- খান নাই কিছু?
- ক্যাইলক্যা বিহানে খাইছিলাম। এতো মাইনসের মধ্যে কয় নলা ভাগে পরে কও?
লাইলির বাবার শুকনো মুখের এমন কথা শুনে মহিলার মনে খুব মায়া জন্মালো। কিন্তু কয়দিনই বা এভাবে চলবে? বাড়ির কর্তাকে লুকিয়ে দুইবেলা খাবার দিয়েও ছিলো। শেষমেশ রাতে খাবার দিতে গিয়ে কর্তার কথা শুনে আর দিতে পারেনি।
লাইলির মামা বাড়ি বেশি দূরে নয়। মিনিট বিশেকের পায়ে হাঁটার রাস্তা। লাইলি তার মামার বাড়ি গেছে সপ্তাহ হয়ে এলো। এর মধ্যে লাইলির মামা লাইলিকে থানায়ও নিয়ে গেছিলো। ঘটনা বৃত্তান্ত শুনে লাইলির মামাকে আলাদা রুমে ঢাকলো থানার ওসি। কি যে বলছিলো তা এ রুম থেকে লাইলি স্পষ্ট বুঝতে পারলো না। পাশের রুম থেকে শুধু দু'জনের হাসার শব্দ ভেসে আসলো লাইলির কানে। এমনিতেই বাচ্চা হবার সময় হয়ে এলো, তার উপর হাতে পায়ে পানিও এসেছে ক'দিন ধরে। বসে থাকতে খুবই কষ্ট হচ্ছে লাইলির। তার সামনে এমন হাসির আওয়াজ কানে বিষের মতো বিঁধছিলো!
গ্রামে তখনো ডিশ লাইন যায়নি। উপরে অ্যান্টেনা লাগানো বিটিভিই ভরসা। টিভিতে একটা নাটক হচ্ছিলো তখন। সেই নাটকই দেখছিলো লাইলি। মা ও শিশুর স্বাস্থ্য সচেতনতা বিষয়ক নাটক। নাটকে দেখানো হচ্ছে একজন গর্ভবতী মায়ের কতটা যত্ন নেয়া প্রয়োজন, কতবার ডাক্তারের কাছে যাওয়া প্রয়োজন, কিভাবে শিশুর যত্ন নিতে হয়.... এইসব আর কি। লাইলির মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেলো। কই, তাকে তো কেউ এমন যত্ন নিচ্ছে না। ডাক্তারের কাছে চেকআপ করার বদলে তাকে দৌঁড়াতে হচ্ছে থানার বারান্দায়! ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! না জানি এই ভুলের জন্য আরো কত খেসারত দিতে হবে.....। ভাবতে ভাবতে চোখটা ঝাপসা হয়ে এলো লাইলির।
ওর মামা বাড়িতে খাওয়া পড়ার কোন অভাব নেই। কিন্তু কখনো নিজের বোন-ভাগ্নিদের একটু খোঁজও নেয় না। বাড়িতে বিড়াল-কুকুর থাকলেও তাদের প্রতি একটা মায়া জন্মে। মামার মনে তেমন কোন দয়া কখনোই দ্যাখেনি লাইলি। হঠাৎ করে কেমন যেন বদলে গেছে ওর মামা, যেন একটু বেশিই খেয়াল রাখছে লাইলির দিকে। যদিও আগের মতোই বেখেয়াল লাইলির মামা তার নিজের বোন, মানে লাইলির মায়ের প্রতি!
লাইলির মামা পাড়ার মাতাব্বর ডেকে শালিসের আয়োজন করলো একদিন। গ্রামের মাতাব্বার টাইপের লোকজন সবাই উপস্থিত। ফরহাদও আছে শালিসে। ফরহাদের পক্ষ থেকেও এসেছে অনেকে। প্রথম দফায় ফরহাদকে ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলো। ফরহাদ অকপটে সব স্বীকার করে নিলো। সে এও বললো, আমি লাইলিকে বিয়ে করতে চাই। লাইলিকে বলা হলো তার কোন কথা আছে কি না। সে শুধু "আমার মামা যা বলবে তাই" কথাটা বলেই থেমে গেলো। কিন্তু আপত্তি জানালো লাইলির মামা। সে স্রেফ জানিয়ে দিলো, "ঐ বাড়িতে নিজের ভাগ্নিকে কিছুতেই বিয়ে দিবো না। এর ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। আমাদের অনেক বড় ক্ষতি করেছে ফরহাদ। আমরা এক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করছি।"
পাশ থেকে লাইলির বাবা বলে উঠলো "আমি এই বিয়াতে রাজি!" কথাটা শুনে লাইলির মামার সে কি রাগ! মনে হচ্ছে তার বড় কোন ক্ষতি হয়ে গেলো। রাগে গড় গড় করতে করতে উঠে গেলো শালিস থেকে। যাওয়ার সময় বলে গেল, "মাইয়ারে আর আমার বাড়ি পাঠাইয়ো না। আমার উপর মাতাব্বরি করলা, তোমরাই বুঝো বাকিটা। আমি নাই এর মধ্যে।"
চলবে......
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই এপ্রিল, ২০১৯ রাত ৮:১৩