সময়গুলো ফুরিয়ে যাচ্ছিল হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো। দেখতে দেখতে নবম শ্রেণিরও ক্লাশ শুরু হয়ে গেল। ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা সব মিলিয়ে একটা ফুটবল টিমের সমান। ১১ জন! কেউ চলে গেল বিদেশে কারো হয়ে গেল সংসার। আটজন ছেলে আর তিনজন মেয়ে! এর মধ্যে আবার ভাগ হয়ে যাবে দুই গ্রুপে। বিজ্ঞান ও মানবিক বিভাগ। বিজ্ঞান বিভাগে স্কুলের মতো পদার্থ, রসায়ন, জীববিজ্ঞান থাকলেও বাংলা আর ইংরেজী ১০০ নাম্বার করে। সাথে আছে, কোরআন (সূরা বাকারা ও সূরা আলে ইমরান), হাদীস (মেশকাত শরীফ), আরবী ১ম পত্র (গদ্য ও পদ্য), আরবী ২য় পত্র (নাহু ও সরফ), ফিকহ ও উসূলুল ফিকহ ( স্কুলের ইসলাম শিক্ষার মত) এবং সাধারন গণিত। বিজ্ঞান বিভাগের সমস্যা ছিল জীববিজ্ঞান আর উচ্চতর গণিত একত্রে নেয়া যেত না। মানবিক বিভাগে পদার্থ, রসায়ন ও জীববিজ্ঞানের পরিবর্তে ইসলামের ইতিহাস, সামাজিক বিজ্ঞান ও কৃষিশিক্ষা। বাকি বিষয় একই। বিজ্ঞান বিভাগে আমি আর হাফেজ দুই ছাত্র। আমাদের ব্যাচ নিয়ে স্যারদের দু:শ্চিন্তা বেশি ছিল। আমাকে ছাড়া আর কাউকে দিয়েই ভরসা পাচ্ছিলেন না। আমার চিন্তা ছিল অন্য জায়গায়। বিজ্ঞান বিভাগের একজন মাত্র ম্যাডাম দিয়ে সব ক্লাশ করানো হতো। সেই ম্যডামও আবার উদ্ভিদ বিজ্ঞানের। আশেপাশে কোন বিজ্ঞানের শিক্ষকও ছিল না সে সময়। কোন সমস্যায় পড়লে গাইড বই ছাড়া আর কেউ বুঝিয়ে দেয়ার মতো ছিল না।
মাদ্রাসার একটা নিয়ম ছিল যে, প্রতিবছর এসএসসি পরীক্ষার্থীদের নিয়ে স্পেশাল কেয়ার নেয়ার জন্য হোস্টেলে রাখা হতো। আমাদেরকেও হোস্টেলে উঠার জন্য বলছেন স্যারেরা। প্রথম সেমিস্টার পরীক্ষার পর আমরা আটজন মিলে হোস্টেলে উঠেছিলাম। তখনো হোস্টেল রুমটি টিনের ঘর এবং ফ্লোরটিও কাঁচা ছিল। হোস্টেলে উঠার পর দেখলাম বেড়ার নিচ দিয়ে পাশের বাসার মুরগি এসে খাবার নষ্ট করে প্রায় প্রায়ই। স্যারদের জানানো হলেও ঠিক করে দিচ্ছে না। আমরা ছাত্রারা মিলে পাশের সংরক্ষিত শালবন থেকে কুচি পাথর এনে নিজেরাই ফ্লোর মেরামত করে নিয়েছিলাম। রান্নার জন্য বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে শালবনের কাঠ কেটে আনতাম। প্রতি সপ্তাহে ৫ কেজি চাল আর ৩০০ টাকা করে উঠাতাম হোস্টেল মেস চালানোর জন্য। কিন্তু তবুও বেশিদিন সেই ম্যাস টিকেনি।
ছাত্ররা হোস্টেলে এসে এখন আগের চেয়ে আরো বেশি ফাঁকি দেয়। পাশের বাসার মুরগি ধরে ধরে খায়। আরো বিভিন্ন অভিযোগ আসতে থাকে স্যারদের কাছে। আমি একা পরেছিলাম ফান্দে। কিছু বলতেও পারছিলাম না, সইতেও পারছিলাম না। অবশেষে হোস্টেল থেকে চলে আসি।
আমার টেস্ট পরীক্ষার সময় দাদা-দাদী দুই সপ্তাহ আগে পরে মারা যায়। এমন পরিস্থিতিতে টেস্ট পরীক্ষা মন মত হল না। তারপরও টেস্টে এ+ পেয়েছিলাম। বাকী সবার পাশ নিয়েই টানাটানি।
আমার ছোট আংকেল তখন উপজেলা শহরে থাকতেন। আংকেল আমাকে এসএসসি পরীক্ষার দুইমাস তার কাছে নিয়ে রাখলেন। ২০০৮ সালে ফেব্রুয়ারীতে পরীক্ষা হয়েছিল। খুবই ভালো পরীক্ষা দিয়েছিলাম। রেজাল্ট বের হবার পর দেখলাম টেব্যুলেশন শিটে আমি এ+ পেয়েছি। মোট পাশ করেছি ৮ জন। ছেলে ১ জন আর মেয়ে দুই জন ফেল। বাকীরা কোনমতে পাশ। রেজাল্ট বলার মতো না। গ্রেডিং পদ্ধতি চালু হবার পর সেবারই প্রথম এ+ আসে আমাদের মাদ্রাসায়। রেজাল্টের পর পরই আমার খুবই জ্বর হয়েছিলো। পনের দিনের মতো জ্বর। কিছুতেই সেরে উঠছিলাম না। ১৫ দিন পর রেজাল্ট শিট বের করে দেখি আমার সব বিষয়েই প্লাস, মানে গোল্ডেন। আমি তো খুশিতে ঘামতে ছিলাম! আমার জ্বর যেন তখনই সেরে গেল। স্যারদের দেখালাম আমার গোল্ডেন এ+ রেজাল্ট। তারাও খুব খুশি। কারন স্যারেরা মনে করেছিলেন আমি শুধু এ+ পেয়েছি। তার দুইদিন পর উপজেলা শিক্ষা অফিসারের কাছ থেকে অভিনন্দন পত্র পেলাম পুরো উপজেলায় মাদ্রাসা বিভাগে ১ম হওয়ার জন্য। কারন মাদ্রাসা বিভাগে আর কেউই গোল্ডেন এ+ পায়নি। জেলা প্রশাসক মহোদয়ও সনদ দিয়েছিলেন। স্যারেরাই আমাকে প্রাইভেট কার ভাড়া করে নিয়ে গিয়েছিলেন সনদ প্রদান অনুষ্ঠানে।
আলিম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলাম জেলা সদর মাদ্রাসায়। আলিম শ্রেণিতে প্রায় ১৫০ জন ছাত্র-ছাত্রী ছিল। সেখানও নিজেকে সেরা প্রমাণ করতে পেরেছিলাম। মাদ্রাসা বোর্ডের বৃত্তিসহ গোল্ডেন এ+ পেয়েছিলাম। সেই বৃত্তির জন্য অনার্স লেভেলে আমাকে কোন ক্রেডিট ফিও দিতে হয়নি। অনার্সে ভর্তি যুদ্ধটা আমার জন্য মোটেই সহজ ছিলো না। আলিম পাশ করার পর ভর্তি কোচিং করার জন্য আমাকে সিলেট যেতে হয়েছিলো। প্রায় ছয়মাস সিলেটে লজিং থেকে কোচিং করেছি। সিলেটে থাকার সেই দিনগুলো নিয়ে লিখবো পরবর্তী কোন লেখায়।
এত দীর্ঘ পোস্টটি পড়ার অনেক ধন্যবাদ। সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ১১:৩২