আজ ১১ই নভেম্বর ২০১৮ সালে। বিশ্ব ইতিহাসে এই দিন স্বরণীয়। কেননা ইউরোপে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তি হয়েছিল নভেম্বর ১১,১৯১৮ সালে। আজ থেকে একশত বছর আগে। এই দিনে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণা করা হ্য়। যুদ্ধ বন্ধের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ইউরোপজুড়ে তৎকালীন শত্রুমিত্র পক্ষ আজ এই যুদ্ধের স্বরণ করছে।পরস্পর পরস্পরের প্রতি বন্ধুত্ব, সহযোগিতার মনোভাব প্রদর্শন করছে। শান্তি সম্বৃদ্ধি উন্নতি একতার মনোভাব প্রকাশ করছে। অথচ এই ইউরোপই ছিল মহা যুদ্ধ সমূহের প্রধান কেন্দ্রভূমি, প্রধান রঙ্গমঞ্চ। কিন্তু এই যুদ্ধের পরিণতি বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে ছিল ব্যাপক, সূদুর প্রসারি। বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে এই যুদ্ধের ফলাফল ছিল অত্যন্ত মর্মান্তিক। যে যুদ্ধ ডেকে আনে আরেক যুদ্ধ। যুদ্ধের পরের যুদ্ধ। যার শুরু হয়েছিল প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের মধ্যদিয়ে; বিগত এক বছর ধরেই চলছে যুদ্ধ। এক যুদ্ধের শেষ আরেক যুদ্ধের সূচণা। এইভাবেই চলে আসছে বিগত একশ বছর। যে মধ্যপ্রাচ্য ছিল একক এক ভূখন্ড, সেখানে কলমের খোঁচায় দাগ কাঁটা হয়েছে। মানচিত্র বদল হয়েছে। জাতি বিভক্তি হয়েছে। অবিশ্বাস বেড়েছে। আরব ভূখন্ডে নতুন এক সংঘাতের চারা রোপন করে দিয়েছে। যুদ্ধে বিজয়ী পক্ষ সমূহ। ইউরোপীয় শক্তি ইংল্যান্ডের প্রত্যক্ষ সহযোগীতায় জন্ম নিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের স্থায়ী সংকট। ইসরাইল এই সংঘাত আর যুদ্ধের আসল কারণ। পশ্চিমা শক্তি আরবদের মাঝে নানা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত রাখার কাজটি করে যাচ্ছে। কখনও নিজেরা সরাসরি যুদ্ধে যোগ দিচ্ছে। আবার কখনও প্রক্সি দিচ্ছে। অস্ত্র দিচ্ছে। ইসরাইল কে মদদ দিচ্ছে। অস্ত্র অর্থ দিচ্ছে। ইসরাইলের অমানবিক যুদ্ধ অপরাধের কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। শক্তি দিয়ে অন্যের ভূমি দখল করাকে সরাসরি মদদ দিচ্ছে। এইভাবে চলে আসছে বিগত একশ বছর। এই যুদ্ধের সমাপ্তি কোথায় কেউ জানেনা। এর মাঝেই বিশ্ব আজ স্বরণ করছে প্রথম মহা যুদ্ধের একশ বছর।
প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ আরম্ভ হয় ১৯১৪ সালে। সমাপ্তি ১৯১৮ সালে। চার বছর ধরে চলে এই যুদ্ধ। এই যুদ্ধ ইউরোপের নিরবিচ্ছিন্ন পরিখার যুদ্ধ নামে খ্যাত। কিন্তু এটি ছিল অনেক যুদ্ধের যুদ্ধ। এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল নানা ফ্রন্টে। মূলধারার ইউরোপীয়দের গল্পের বাইরে অন্য আরেকটি গল্প আছে। এই গল্প কে উপেক্ষা করা হয়। যুদ্ধের প্রাক্কালে এই গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এমনকি যুদ্ধের পরেও তার ভূমিকা ছিল অনেক ব্যাপক। এটি হচ্ছে আরব সৈন্যদের গল্প। এই আরব সেনাদের দুঃখ হচ্ছে।প্রথম মহা যুদ্ধে উভয় পক্ষে যুদ্ধ করতে হয়েছে। তাদের বীরত্বের কথা ভুলে যাওয়া হয়েছে। তাদের দুর্ভাগ্য এই যে, মিশর, মরক্কো আর তিউনিসিয়ার অধিবাসিরা ইউরোপীয় উপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্স আর ইংল্যান্ডের পক্ষে অন্যদিকে জার্মানী ও কেন্দ্রীয় শক্তি পাশে অটোমানদের জন্য যুদ্ধে লড়তে হয়েছে। উভয় ক্ষেত্রেই এই সেনারা ছিল জোর জবরধ্বস্তির আওতায় তৈরি বাহিনী।অথচ যুদ্ধোত্তর বন্দোবস্ত পরবর্তি শত বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যও বদলে দিয়েছে। জার্মানি প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে বিষাক্ত গ্যাস ব্যবহার করে। উত্তর আফ্রিকার আরব সেনারাই প্রথম এই তথ্য প্রকাশ করে। কিছু কিছু প্রতিবেদনে আরো ব্যাপক মর্মান্তিক তথ্য দেয়। উত্তর আফ্রিকার নিয়োজিত বাহিনির উপর চালানো হত প্রাচীন রোমানদের সামরিক কৌশল। তাদের কৌশলে ছিল ধ্বংস করণ প্রক্রিয়া। ডেসিমেশন প্রক্রিয়া প্রয়োগ। সেনা সদস্যদের যৌথশৃংখলার ব্যর্থতার অভিযোগে জন্য এই কৌশল ব্যবহার করা হত। প্রতি দশজনের একজন কে দৈব চয়ন প্রক্রিয়ায় হত্যা করা হত। ফরাসিরা তাদের উত্তর আফ্রিকান সৈন্যদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছিল বলে অভিযোগ আছে।
অন্যদিকে গ্যালিওপোলি যুদ্ধের অন্যতম বিষয় ছিল মিত্রশক্তির পরাজয়। গুরুত্বপূর্ণ এই যুদ্ধের আরেকটা দিক হচ্ছে, অটোমানদের পক্ষে অর্থাৎ মোস্তফা কামাল পাশার অটোমান বাহিনীতে ৩০০,০০০ এর বেশি আরব সেনা যুদ্ধ করে। এই সকল সেনারা বৃত্তহর সিরিয়ার আরব আরব, বর্তমান সিরিয়া, লেবালন, জর্ডান এবং ফিলিস্তিনি আরবরা। অধিকন্তু অটোমানদের পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য ইস্তাম্বুলের গ্র্যান্ট মুফতি জিহাদের ডাক দিয়েছিলেন। মুসলমানদের কে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করানো হয়েছিল। জার্মান প্রচার মাধ্যম জোটের জন্য যুদ্ধরত উত্তর আফ্রিকার সেনাদের মনোবলকে ভেঙ্গে দেয়। তাদের মাঝে হতাশার সঞ্চার করেছিল। এই কারণে আরব বিশ্বে ছিল এক উত্তেজনা কর পরিস্থিতি।
এমনকি জার্মানীতে আটক মুসলিম বন্দিকে দেয়া হচ্ছিল বিশেষ সেবা। জার্মানির জশনের কাছে নির্মিত সেনা বন্দি শিবির ছিল। সেখানে মিত্র বাহিনীর পক্ষে কাজ করা মুসলিম সেনাদের মত পরিবর্তন করার জন্য নানা উদ্যোগ গ্রহন করে। তাদেরকে অগ্রাধিকার মূলক চিকিৎসা সেবা দিচ্ছিল। অর্ধচন্দ্রাকৃতির এই বন্দি শিবিরে মসজিদ স্থাপন করে। এই মসজিদ ছিল জার্মানীতে নির্মিত প্রথম মসজিদ।অটোমানদের সাথে জার্মানীর মিত্রতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ১৯১৪ সালে। ফলে অটোমানরা জার্মানীর পক্ষে যুদ্ধে যোগদেয়। অন্যদিকে উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলে জাতীয়তাবাদের জন্ম নেয়। কিন্তু অটোমান প্রতিক্রিয়া ছিল চরম প্রকৃতির। সিরিয়ার আরবদের উপর চাপানো হয়েছিল কঠোরভাবে দমন করা; হত্যা, নির্যাতন, জেলজুলুম, দেশান্তর ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। অনেক নের্তৃস্থানীয় বুদ্ধিজীবিকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। জামাল পাশার শাসন ছিল অত্যন্ত কঠোর। কিন্ত অটোমানদের পরাজয়কে রোধ করতে পারেনি। সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামিদের পরজায় হয়। সাম্রাজ্য ভেঙ্গে যায়। শেষ পর্যন্ত কামাল পাশার নের্তৃত্ব তুরস্ক কে রক্ষা করা গেলেও বিশাল খেলাফত হাতছাড়া হয়। আরব বিশ্ব বিভক্ত হয়ে যায়।
অন্যদিকে পর্দার আড়ালে রচিত হয় আরবদের ভাগ্যলিপি। অত্যন্ত গোপনে বৃটেন আর ফ্রান্স স্বাক্ষর করে এক গোপন দলিলে। এই গোপন চুক্তি ইতিহাসে সাইকস –পিকট চুক্তি নামে পরিচিত। এই দুই সাম্রাজ্যবাদি শক্তির হাতে আরবদের ভাগ্য বদলে যায়। চিরদিনের সংঘাতের পথে পা যাত্রা করে আরবরা। আরবদের অধিকার খর্ব করে; তাদের জাতীয়তাবাদি আন্দোলন, অধিকার, নিজেদের কে শাসন করার মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়। দুই শক্তি আরব ভূখন্ড কে ভাগ করে। পিঠাপুলি ভাগ করার মত। আর পিঠা পুলি খেতে আমন্ত্রণ জানায় বিশ্বব্যাপী নির্যাতিত ইহুদিদের কে। তাদের জন্য তৈরি করে এক মুক্ত, স্বাধীন দেশ। যারা আরবদেরকে আরব ভূখন্ড থেকে বিতাড়ন করে। মিশরে বিপ্লব আর ইরাকে বিদ্রোহ সত্ত্বেও অটোমান শাসিত আরব ভূখন্ড একাধিক অছি রাষ্ট্রে ভাগ করা হয়। বৃটেন ও ফ্রান্স নিজেদের উচ্চাকাক্ষা, স্বার্থ এবং তাদের প্রবেশকাধিকার নিশ্চিত করে। মূল্যবান সম্পদ জব্দ করে, পাচার করে, শোষণ করে। এই অঞ্চলের মূল্যবান তেল সম্পদকে নিজেদের দখলে নেয়। দীর্ঘদিন নিজেরা সরাসরি শাসন করে।
পরিশেষে এই যুদ্ধ তুর্কি জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয়। আধুনিক তুরস্কের জন্ম এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পথ ধরেই তৈরি হয়। ইউরোপে জন্ম নেয়া রাজনৈতিক জায়নবাদের ভিত্তি মজবুদ হয়। বেলফোর ঘোষনা ছিল সেই জায়নবাদ কে মদদ দেয়া। প্রত্যক্ষভাবে বৃটেন এই কাজে সহায়তা করে। ইউরোপের ইহুদিদের কে ফিলিস্তিনে আসার রাস্তা করে দেয়। যার হাত ধরে মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি চিরকালের জন্য উধাও হয়ে যায়। যুদ্ধ আর অবিশ্বাস জায়গা নেয়। রক্তপাত হয়ে উঠে প্রতিদিনে কর্মকান্ড। ১৯১৮ সালে যুদ্ধ বিরতি চুক্তি হয়। আর ১৯১৯ সালে ফ্রান্সের ভার্সাই চুক্তিকে জার্মান- অটোমান জেনারেলরা শান্তি চুক্তি হিসাবে মেনে নিতে নারাজ ছিল। তাদের মতে এই চুক্তি মাত্র বিশ বছরের জন্য অস্ত্রসংবরণ হিসাবে দেখে থাকে। ইতিহাসে তাই সত্যি প্রমাণিত হয়। যুদ্ধের ঢংকা আবার বাজে। আরম্ভ হয় দ্বিতীয় মহা যুদ্ধ। মাঝখানে বিশ বছর শান্তির নামে চলে ভয়াণক আরেক মহা যুদ্ধের রণ প্রস্তুতি !!