অনেকেই গলা খুসখুস, কাশিতে ভোগেন। কিন্তু কাশির আছে ভিন্ন ভিন্ন ধরন। কারণও ভিন্ন ভিন্ন। এর জন্য অবশ্যই ভিন্ন ভিন্ন চিকিৎসা। কফ-কাশি হলেই দোকান থেকে কফ-সিরাপ কিনে খাওয়া কোনো সমাধান নয়। এতে যে কেবল বেশি ঘুম পায় তা নয়, বাজারে চলতি কফ-সিরাপগুলো অনেক সময় খিঁচুনি, ঝিমুনি, অস্বাভাবিক হৃৎস্পন্দন, কিডনি ও যকৃতের সমস্যাসহ নানা ক্ষতি করতে পারে।
শুধু ঘুমই নয় বরং বাজার-চলতি কফ সিরাপগুলো অনেকসময় শরীরে খিঁচুনি, ঝিমুনি, অস্বাভাবিক হৃৎস্পন্দন, কিডনি ও লিভারের ক্ষতিসহ নানা সমস্যা তৈরি করে। কাশির সিরাপে হাইড্রোকার্বন থাকে। মূলত বুকব্যাথা ও কাশি দমনে এটা ব্যবহৃত হয়। কিন্তু হাইড্রোকার্বন একধরনের নারকোটিক, যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। কফ সিরাপের অনেক উপাদান যেমন: গুয়াইফেনেসিন, সিউডোএফিড্রিন, ট্রাইপোলিডিন, ডেক্সট্রো মেথরপেন ইত্যাদিও স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক। সিরাপে বিদ্যমান সিউডোফিড্রিন,ডেক্সট্ররমিথোফরমিন এবং ট্রাইমিথোপ্রলিপ্রিন নামক উপাদানের কারণে রক্ত চাপ বেড়ে যায়, ঝিমুনি আসে, ইউফোরিয়া সৃষ্টি হয় এবং শেষে ঘুমিয়ে পরে সর্দি-কাশিতে আসক্ত ব্যাক্তি ।
আর সিরাপের মরফিন এর কাজ হলো আমাদের স্নায়ু ও মাংশপেশীকে শীথিল করে দেয়া, ইফিড্রিন হাইড্রোক্লোরাইড এর কাজ হলে শ্বাসনালীর শ্লেষ্মাকে শুকিয়ে দেওয়া, প্রমিথিজিন হাইড্রোক্লোরাইড সিডেটিভ হিসাবে কাজ করে | ইফিড্রিন হাইড্রোক্লোরাইড শ্বাসনালীর শ্লেষ্মাকে শুকিয়ে দেয়, প্রমিথিজিন হাইড্রোক্লোরাইড অনেকটা ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে আসে এবং রোগীকে দুর্বল করে তোলে। সাধারণ সর্দি কাশিতে অনেকে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই পাড়ার দোকান থেকে কিনে নেন কাশির ওষুধ, যা মোটেই উচিত নয়।কাশি হলে তার কারণ নির্ণয় করে, রোগের অনুসন্ধান করে চিকিৎসা করাতে হবে। সাধারণ ফ্লু বা ভাইরাসজনিত কাশি হলে তা এমনিতেই সেরে যাবে, কিন্তু আরাম পাওয়ার জন্য কফ-সিরাপ নয়; বরং কিছু উপদেশ মেনে চলতে পারেন।
কফ-সিরাপে থাকা উপাদান যেমন, গুয়াইফেনেসিন, সিউডোএফেড্রিন, ডেক্সট্ররমিথোমরফনি ও ট্রাই মিথোপ্রলিপ্রিন ইত্যাদি কারণে অনেক সময় রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়। ঝিমুনির শুরু হয়। চোখে ঘুম ঘুম ভাব থাকে। সিরাপের মধ্যে বিদ্যমান মরফিন স্নায়ু ও পেশিকে শিথিল করে। আবার ইফিড্রিনের জন্য শ্লেষ্মা শুকিয়ে যায়। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে কাশির জন্য সিরাপ খাওয়া উচিত। তবে কফ-সিরাপ না খাওয়াই ভালো। সিরাপে কাশি দমন থাকলেও চিরতরে কাশি সেরে যায় না।
কাশির সিরাপ কি বাচ্চার জন্য নিরাপদ?
ডা. আবু সাঈদ শিমুল এর মতে।।
ঝামেলা এড়াতে বা অর্থ বাঁচাতে গিয়ে আপনি পড়তে পারেন আরেক ঝামেলায়। কারণ, বেশির ভাগ কাশির সিরাপই খুব ছোট শিশুদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে থাকে।
এসব সিরাপের কোনোটা মাত্রাতিরিক্ত ডোজে, আবার কোনোটা স্বাভাবিক মাত্রায় দিলেও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, কফ সিরাপগুলো শিশুর খিঁচুনি, ঝিমুনি, অস্বাভাবিক হৃদপন্দন, কিডনি ও লিভারের ক্ষতি করতে পারে।
১৯৬৯ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে কফ সিরাপ খেয়ে ৫৪ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। আর সর্দির ওষুধ অ্যান্টিহিস্টামিন খেয়ে মারা গেছে ৬৯ শিশু। অন্যদিকে, সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের হিসাবমতে, ২০০৪ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে কফ সিরাপ খেয়ে দেড় হাজার শিশুর বিভিন্ন স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা হয়েছে।
এ কারণে এরই মধ্যে আমেরিকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন দুই বছরের নিচের শিশুদের জন্য প্রেসক্রিপশন ছাড়া কাশির সিরাপ বিক্রি নিষিদ্ধ করেছে। আর কানাডার স্বাস্থ্য সংস্থা হেলথ কানাডা ছয় বছরের নিচের শিশুদের জন্য প্রেসক্রিপশন ছাড়া কাশির সিরাপ বিক্রি নিষিদ্ধ করেছে।
বছরে একটি শিশু গড়ে ছয় থেকে দশবার সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত হতে পারে। তাই বড়দের চেয়ে শিশুদের জন্য কফ সিরাপের বিক্রি বেশি। এই সুযোগে খ্যাতনামা কোম্পানির সঙ্গে অনেক অখ্যাত কোম্পানিও শিশুদের কফ সিরাপ বাজারে এনেছে।
এসবের মধ্যে হারবাল ও ভেষজ কাশির সিরাপও দেখা যায়। এই সিরাপগুলোর গায়ে অনেক ক্ষেত্রেই উপাদানের নাম লেখা থাকে না। তা ছাড়া এসবের ট্রায়াল বা প্রয়োগ-সংক্রান্ত কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করা হয় না। মূলত এসব সিরাপ খেয়েই শিশুরা আরো অসুস্থ হয়ে পড়ে।
শিশুদের অনেক কাশির সিরাপে হাইড্রোকার্বন থাকে। সাধারণত বুক ব্যথা ও কাশি দমনে এটা ব্যবহৃত হয়। তবে হাইড্রোকার্বন এক ধরনের নারকোটিক, যা শিশুদের জন্য ক্ষতিকর। আবার শিশুদের অনেক সিরাপে বড়দের কফ সিরাপের অনেক উপাদান, যেমন—গুয়াইফেনেসিন, সিউডোএফিড্রিন, ট্রাইপোলিডিন, ডেক্সট্রো মেথরফেন ইত্যাদি থাকে।
এসব উপাদানের সবগুলোই শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। কেউ কেউ ঘরে থাকা বড়দের কফ সিরাপ একটু ডোজ কমিয়ে বাচ্চাদের খাইয়ে দেন। আমেরিকান পেডিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের (শিশু চিকিৎসকদের সংগঠন) পক্ষ থেকে এই পদক্ষেপকে বিপজ্জনক হিসেবে অবহিত করা হয়েছে।
শিশুর ঠান্ডাজনিত যে কাশি, তার বেশির ভাগই ভাইরাস সংক্রমণের জন্য হয়। নিজ থেকে কয়েক দিনেই এটা ভালো হয়ে যায়। তাই এই কাশিতে ওষুধের কোনো প্রয়োজন নেই। এই সময় বরং নাকে লবণ পানি বা নরসল ড্রপ দিন। মধু, গরম পানি, রং চা ইত্যাদি খাওয়ানো যেতে পারে।
এ সময় বুকের দুধ ও প্রচুর তরল খাওয়ানো গেলে এবং আলো-বাতাসপূর্ণ ঘরে রাখলে অল্প কদিনেই শিশু সুস্থ হয়ে ওঠে। তবে শিশুর শ্বাসকষ্ট ও জ্বর থাকলে, বুক নিচের দিকে দেবে গেলে, খিঁচুনি হলে, কিছুই খাওয়ানো না গেলে কিংবা অজ্ঞান হয়ে গেলে দ্রুত চিকিৎসকের পরমর্শ নিতে হবে। তবে নিজ থেকে কিংবা ফার্মেসির দোকানদারের পরামর্শে শিশুদের কাশির সিরাপ কখনো খাওয়ানো ঠিক হবে না।
লেখক : রেজিস্ট্রার ( শিশু বিভাগ ), ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।।
প্রথমেই কাশির কারণ নির্ণয় করুণ, তারপরই রোগের সন্ধান করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিন। তবে ফ্লু বা ভাইরাসজনিত কাশি হলে তা আপনা আপনিই নির্মূল হবে। সে ক্ষেত্রে আরাম পাওয়ার জন্য সিরাপ না খেয়ে কিছু পরামর্শ মেনে চলা যেতে পারে। চলুন নিম্নে সেসব বিষয়ে জেনে নেয়া যাক-
* প্রচুর পরিমাণে বার বার পানি পান করতে হবে। ফলে কফ পাতলা হবে।
* মধ্যম আঁচে পানি গরম করে ভাপ নেয়া যেতে পারে। এতে করেও কফ পাতলা হবে।
* কাশি যদি শুকনো হয়ে থাকে সে ক্ষেত্রে গলায় অনেক সময় খুসখুস করে। এমতবস্থায় হালকা গরম পানিতে একটু লবণ দিয়ে কুলকুচি বা গার্গল করে নিন। এছাড়াও মুখে কোন লজেন্স, লবঙ্গ কিংবা আদা রাখতে পারেন।
প্রসঙ্গত, কাশির সাথে যদি শ্বাসকষ্ট, রক্ত দেখা যায় কিংবা কখনো কখনো কাশতে কাশতে শরীর নীল রং ধারণ করে বা জ্বর আসে তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া জরুরি। অনেক সময় কথা বলতেও সমস্যা হয়। আর কোন কাশি যদি দুই বা তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে অবস্থান করে তাহলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে ভুল করবেন না।
গরম পানির ভাপ নিতে পারেন। এতে কফ পাতলা হবে।
তিন. শুকনো কাশিতে গলা খুসখুস করলে হালকা গরম পানিতে একটু নুন দিয়ে কুলকুচি বা গার্গল করুন। মুখে কোনো লজেন্স, লবঙ্গ বা আদা রাখলেও আরাম পাবেন।
কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন?
কাশির সঙ্গে শ্বাসকষ্ট, রক্ত দেখতে পেলে, কাশতে কাশতে যখন শরীর নীল হয়ে যাচ্ছে বা প্রচণ্ড জ্বর থাকছে, কথা বলতে কষ্ট হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। যেকোনো কাশি দুই বা তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন।
ডা. মোহাম্মদ আজিজুর রহমান
বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ, ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।