বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষা ৯১ বর্গ কিলোমিটারের ছোট্ট সবুজ ভূখন্ডটি। নাম তার নিঝুম দ্বীপ। এখানে এক সাথে সমুদ্র তীরের সাদা বালু আর সবুজ ছায়ায় ঘেরা ম্যানগ্রোভ বনের ছোঁয়া পাওয়া যায়। না দেখলে বিশ্বাসই করা যাবে না সবুজ গালিচায় মোড়ানো এই দ্বীপটি কতো সুন্দর হতে পারে!
কেওড়া বনের মাঝে পাতার ফাঁকে ফাঁকে চিত্রা হরিণের দেখা মিলে সাথে শীতের পাখির এক অভয়ারণ্য। আর গভীর অরন্যে দেখা পাওয়া যাবে বন্য মহিষের। কক্সবাজারের মতো আকর্ষণীয় বীচেও এখানে সময় কাটানো যাবে।
ইতিহাসঃ
এটি এককালে বাউলার চার নামে পরিচিত ছিল। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে দ্বীপের সব মানুষ মারা যাওয়ার পর এর নাম রাখা হয় নিঝুম দ্বীপ। তখন পরীক্ষামূলক ভাবে ৪ জোড়া হরিণ ছাড়া হয়। বর্তমানে সেখানে হরিণের সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। আইলাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল এখানে।
যাওয়ার উপায়ঃ
লঞ্চে গেলে ঢাকার সদরঘাট থেকে যেতে হবে - ঢাকা থেকে হাতিয়ায় যাওয়ার জন্য প্রতিদিন ১ টা লঞ্চ বরাদ্দ রয়েছে - দুইটা লঞ্চ রোটেশন পদ্ধতিতে ডেইলি ১ টা করে ছেড়ে যায়, প্রতিদিন বিকাল ৫.৩০ মিনিট, লঞ্চ ১ মিনিট ও লেট করে না
একটার নাম "এম.ভি ফারহান - ৩" অন্যটা "এম.ভি ফারহান - ৪"। দুইটাই লাক্সারিয়াস লঞ্চ । এদের মধ্যে প্রতিদিন ১টা করে লঞ্চ হাতিয়ার উদ্দেশ্যে সদরঘাট থেকে বিকেল সাড়ে ৫ টায় ছেড়ে যায়। সেটি কালিগঞ্জ (মেহেন্দীগঞ্জ) - বিশ্বরোড (ভোলা) - দৌলত খাঁ (ভোলা) - মির্জাকালু - শরাশগঞ্জ - ভোলা তজুমুদ্দিন - মনপুরা (রামনেওয়াজ লঞ্চ ঘাট) হয়ে হাতিয়ার তমুরদ্দী ঘাটে পৌঁছবে পরদিন সকাল ৮-৯ টায়। আপনাকে নামতে হবে হাতিয়ার তমুরদ্দী ঘাটে ।
লঞ্চে গেলে ভাড়া পড়বে- ডেকে ৩৫০ টাকা, ২৫০ টাকা দিয়াও যাওয়া যায়। কেবিন সিঙ্গেল- ১২০০ টাকা, ডাবল-২২০০ টাকা, ---- হাতিয়া এর তমুরদ্দী ঘাট পর্যন্ত।
(ঢাকায় ফেরত যাবার লঞ্চ ছাড়ে দুপুর ১২ টায়)
এম.ভি ফারহান ৩- ০১৭৮৫৬৩০৩৬৬।
এম.ভি ফারহান ৪- ০১৭৮৫৬৩০৩৬৮, ০১৭৮৫৬৩০৩৬৯, ০১৭৮৫৬৩০৩৭০।
তমুরদ্দী ঘাট নেমে ট্রলারে করে নামার বাজার যেতে হবে। আমরা ১৪ জন গিয়েছিলাম রিজার্ভ ট্রলার ৩৫০০ নিয়েছিল।প্রায় ৩ ঘণ্টা লাগে যেতে। দরদাম করে নিবেন।
থাকার ব্যবস্থাঃ
১. নিঝুম রিসোর্ট (অবকাশ হোটেল) নামার বাজারঃ এটা অবকাশ পর্যটন লিমিটেড এর একটা রিসোর্ট। নামার বাজার সী বীচ এর কাছে অবস্থিত। নিঝুম রিসোর্ট নামে নিঝুম দ্বীপে থাকার জন্য একটি ভালো মানের রিসোর্ট।
এখানে ২ বেড এর VIP রুম ভাড়া ২০০০ টাকা, ২ বেড এর Executive রুম ভাড়া ১৫০০ টাকা, ৩ বেড এর Executive রুম ভাড়া ১৮০০ টাকা, ৪ বেড এর Executive রুম ভাড়া ২০০০ টাকা, ৫ বেড এর ফ্যামিলি রুম ভাড়া ৩০০০ টাকা এবং ৫ বেড এর ডরমেটরি রুম ভাড়া ১৮০০ টাকা ও ১২ বেড এর ডরমেটরি রুম ভাড়া ৩০০০ টাকা।
(আমরা ১৪ জন ১২ বেডের ডরমেটরি তে ছিলাম)
* সব গুলো রুম এ এটাচ বাথ রুম আছে।
* ডরমেটরি রুমে এক্সট্রা প্রতি জন থাকলে ২০০ টাকা করে দিতে হবে।
* দুপুর ১২ টার আগে চেক আউট করতে হবে।
* অফ সিজনে রুম ভাড়ায় ৫০% ডিসকাউন্ট পাওয়া যায় ( এপ্রিল ১৫- সেপ্টেম্বর ৩০ )।
* জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুৎ পাবেন সন্ধ্যার পর থেকে রাত ১০.৩০ পর্যন্ত। এছাড়া সারা রাত লাইট ইউজ করতে পারবেন সোলার প্যানেল থেকে। এছাড়া সারাদিন ১-২ ঘন্টা পর পর ৩০ মিনিট এর জন্য বিদ্যুৎ পাবেন।
যোগাযোগঃ ঢাকা অফিসঃ অবকাশ পর্যটন লি., আলহাজ সামসুদ্দিন ম্যানসন (নবম তলা), ১৭ নিউ ইস্কাটন রোড, ঢাকা। ফোন : ৮৩৫৮৪৮৫, ৯৩৪২৩৫১, ৯৩৫৯২৩০, ০১৫৫২৩৭২২৬৯।
নিঝুম দ্বীপ অফিসঃ সবুজ ভাইঃ ০১৭২৪-১৪৫৮৬৪, ০১৮৪৫৫৫৮৮৯৯ , ০১৭৩৮২৩০৬৫৫২.
সামনেই ব্যাডমিন্টন খেলার কোর্ট কাটা থাকে। সারা দিন ঘুরে সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত গা গরম করার সুযোগ পাবেন
২. হোটেল শাহিন, নামার বাজার। ফোন নম্বরঃ ০১৮৬৩১৫০৮৮১
৩. মসজিদ বোর্ডিং, নামার বাজার। এটা সবচেয়ে সস্তায় থাকার ব্যবস্থা। স্থানীয় মসজিদ থেকে এই ব্যবস্থা করেছে, এক্সট্রা দুটা সিঙ্গেল এবং দুটা ডবল রুম আছে, আর সব ডরমেটরি । ডরমেটরি - ভাড়া ২০০ - ৩০০ টাকা।
এই বোর্ডিং-এ কোনো এটাচ্ট বাথরুম এবং জেনারটরের ব্যবস্থা নাই। এখানে ২টি কমন বাথরুম এবং একটি টিউবওয়েল আছে।
এই বোর্ডিং-এ থাকার জন্য বুকিং করতে যোগাযোগ করুন: মোঃ আব্দুল হামিদ জসিম, কেন্দ্রিয় জামে মসজিদ, নামার বাজার, হাতিয়া, নোয়াখালী। ফোনঃ ০১৭২৭-৯৫৮৮৭৯
৪. নিঝুম ড্রিম ল্যান্ড রিসোর্ট, বন্দরটিলা।
যোগাযোগঃ
ঢাকা বুকিং অফিসঃ০১৮৪৭১২৩৫৭৩
নিঝুমদ্বীপ বুকিং অফিসঃ০১৮৪৭১২৩৫৭২
৫. হোটেল দ্বীপ সম্পদ, (সৈয়দ চাচার থাকা ও খাওয়ার হোটেল) নামার বাজার। ফোনঃ ০১৭২০ ৬০১ ০২৬, ০১৭৬০ ০০৮১০৬।
৬. হোটেল শেরাটন, বন্দরটিলা বাজার ।
৭. জেলা প্রশাসন ডাক বাংলো।
খাবার দাবারঃ
খাবার দাবার বেশি একটা ভালো পাবেন না, সামুদ্রিক মাছ, মাংস, মোটা চালের ভাত, রুটি সব ই পাবেন, তবে প্রি - অর্ডার করে রাখা ভালো। খবার খাবেন আমার সাজেস্ট মতে আলতাফ চাচার হোটেল আশিক সেকেন্ড অপশন হোটেল দ্বীপ সম্পদ, (সৈয়দ চাচার খাওয়ার হোটেল), নামার বাজার। সামুদ্রিক মাছ এবং চিংড়ী খাবেন ভালো লাগবে। ডাব খাবেন গাছ থেকে পেড়ে, ২০-২৫ টাকা। নিজে পেড়ে খেলে ২০ টাকা।
দর্শনীয় স্থানঃ
১. কমলার দ্বীপঃ সেখানের কমলার খালে অনেক ইলিশ মাছ পাওয়া যায় ।এছাড়াও আশে পাশের দ্বীপগুলো সুন্দর ।পুরো দ্বীপটা হেঁটে হেঁটে ঘুরে আশা যায়, মন ভরে যাবে
২. চৌধুরী খাল ও কবিরাজের চরঃ যেতে হবে বিকেল এ সন্ধ্যার আগে, চৌধুরীর খাল নেমে ঘন্টা খানেক হাঁটলেই বনের মধ্যে হরিন এর পালের দেখা পেতে পারেন। একটা ট্রলার রিজার্ভ নিন ১০-১৫ জনের গ্রুপ এর জন্য ১০০০-১২০০ টাকা ওরাই হরিন দেখিয়ে আনবে।
৩. চোয়াখালি ও চোয়াখালি সী-বিচঃ চোয়াখালি তে গেলে খুব সকালে হরিন দেখা যায় । মটর সাইকেল ওয়ালাকে বলে রাখুন খুব সকালে আপনাকে হোটেল থেকে নিয়ে হরিন দেখিয়ে আনবে । ভাগ্য ভালো থাকলে সকালে উঠেই অবকাশ হোটেলের সামনে ১-২ খানা হরিণ দেখলেও দেখতে পারেন।
৪. ম্যানগ্রোভ বনঃ নিঝুম দ্বীপ বনায়ন প্রকল্প । নিঝুম দিপে ছোট ছোট ছেলেরা গাইড এর কাজ করে, এদের সাথে নিয়ে সকাল বেলায় বনের ভেতর ঢুকে পড়ুন। হরিন দেখতে পারবেন।
৫. নামার বাজার সী-বিচঃ নামার বাজার থেকে হেঁটে যেতে ১০ মিনিট লাগে। এখান থেকে সূর্য উদয় ও সূর্যাস্ত দেখতে পাবেন, এখানে বারবিকিউ করে মজা পাবেন।
৬. দমার চরঃ এই চরের দক্ষিন দিকে নতুন একটা সী বিচ আছে যাকে বলে "ভার্জিন আইসল্যান্ড" । এখানে অনেক নাম না জানা পাখির দেখা পাবেন খুব সকালে যদি যান। অনেক টুরিস্ট দের কাছে এখনও অজানা এই জায়গাটা। ট্রলার ভাড়া ৩০০০-৩৫০০ টাকা।
ট্রলার এর মাঝির নম্বরঃ জাকির - ০১৭৮৭ ৬০৫ ৪৪৪ ।
সকালে ও সন্ধায় ওয়াচ টাওয়ার এবং রিসোর্টের সামনে হরিণ বেড়াতে আসে। ইচ্ছা হলে হরিণের সাথে সেলফি তুলে বিস্কুট খাওয়াতে পারবেন। আর সাবধান ম্যান গ্রোভ বনে চুপি চুপি হরিণ দেখবেন। শব্দ শুনলে হরিণ লুকিয়ে যাবে।
শীতকাল হচ্ছে নিঝুম দ্বীপ যাওয়ার বেস্ট সিজন। পুরো দ্বীপটি যেন পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন -এরকম একটি ফিলিংস পেতে একবার হলেও ঘুরে আসুন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা এই অপরূপ দ্বীপটিতে।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৯ দুপুর ১:০৯