somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ট্রিভিয়া পোস্টঃ ভাওয়াল সন্ন্যাসীর অন্তর্ধান, প্রত্যাবর্তন এবং একটি বিখ্যাত মামলা (শেষ পর্ব)

১৫ ই এপ্রিল, ২০১৩ রাত ৮:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

২য় পর্ব

১৯৩৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গুরু ধর্মদাশ নাগা সাক্ষ্য দিতে এসে পড়েন । দোভাষীর মাধ্যমে তিনি জানান যে, ভাওয়াল সন্ন্যাসী হলো তাঁরই পূর্বতন শিষ্য সুন্দরদাস। পূর্বে মাল সিং নামধারী এই ব্যক্তি জাতিগতভাবে পাঞ্জাবী এবং লাহোরের নিবাসী শিখ ধর্মাবলম্বী । সাক্ষ্য দেয়ার সময়ে গুরু অসুস্থ্য হয়ে পড়েন, এবং তাঁর জেরা আদালত কক্ষের বাইরে নিতে হয়েছিলো । সন্ন্যাসীর সমর্থকেরা গুরু ধর্মদাসকে ভন্ড অভিহিত করে । উভয় পক্ষের সমাপনী যুক্তিতর্ক চলে ছয় সপ্তাহ ধরে। মামলার রায় দেয়ার পূর্বে শুনানি মুলতুবী করা হয় ১৯৩৬ সালের মে ২০ তারিখে।
বিচারক পান্নাবল বসু তিন মাস ধরে চুড়ান্ত রায় নিয়ে কাজ করেন। ১৯৩৬ সালের আগস্ট ২৪ তারিখে তিনি বিস্তারিত ব্যাখ্যা সহ রায় প্রদান করেন, এবং সন্ন্যাসীর পক্ষে রায় দেন। এসময় মামলার রায় জানতে বিশাল জনসমাগম হয়। মামলার রায় দেয়ার পরেই পান্নাবল বসু বিচারকের পদ থেকে অবসর নেন।
ভাওয়াল এস্টেটে রমেন্দ্রনারায়ণের সম্পত্তির ভাগ থেকে দাবিদার সন্ন্যাসীকে টাকা নিতে অনুমতি দেয়া হয়। তিনি অন্যান্য বিষয়ের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত অর্থ গ্রহণ স্থগিত রাখেন, এবং এই সম্পত্তির কর্তৃত্ব কোর্ট অফ ওয়ার্ডসের হাতেই রাখেন। একই সময়ে তিনি বিয়ে করেন।
রাজস্ব বোর্ড মামলা নিয়ে কার্যক্রম বন্ধ রাখে তখনকার মতো। এ এন চৌধুরী মামলা থেকে সরে দাঁড়ান। তবে বিভাবতী দেবী হাল ছাড়তে রাজি হননি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে মামলার আপিল ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত বন্ধ থাকে। ঐ বছর বিভাবতী দেবীর আইনজীবীরা হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিলে আপিল করে। জার্মান বিমান হামলায় কাউন্সিলের কক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় প্রিভি কাউন্সিলের অধিবেশন ঘটে হাউজ অফ লর্ডসে, ১৯৪৫ সালে সেখানেই শুনানি শুরু হয়। ডি এন প্রিট দাবিদারের পক্ষে এবং ডব্লিউ ডব্লিউ কে পেইজ, কোর্ট অফ ওয়ার্ডসের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন।
প্রিভি কাউন্সিল আপিল শুনতে রাজি হয়। লর্ড থাঙ্কের্টন, লর্ড হার্বার্ট ডু পার্স্ক, এবং স্যার চেতুর মাধবন আপিলের বিচার করেন। ২৮ দিন ধরে শুনানি চলে। ১৯৪৬ সালের জুলাই ৩০ তারিখে বিচারকেরা দাবিদারের পক্ষে রায় দেন, এবং আপিল নাকচ করে দেন। পরের দিন কলকাতায় টেলিগ্রাফ মারফত মামলার রায় জানানো হয়।
ফরেনসিক বিজ্ঞানের জন্য এই মামলাটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এই মামলাতে মানুষের পরিচয় বের করার কলাকৌশলের যথেষ্ট প্রয়োগ ঘটেছে। কুমার নরেন্দ্রনারায়ণ এবং ভাওয়াল সন্ন্যাসীর দেহের নিম্নলিখিত সাদশ্য ছিলো।
S.No পরিচিতি চিহ্ন কুমার নরেন্দ্রনারায়ণ রায় ভাওয়াল সন্ন্যাসী
1 বর্ণ গোলাপী ও শ্বেত গোলাপী ও শ্বেত
2 চুলের বর্ণ হালকা বাদামী হালকা বাদামী
3 চুলের ধরন ঢেউ খেলানো ঢেউ খেলানো
4 গোঁফ মাথার চুলের চাইতে পাতলা মাথার চুলের চাইতে পাতলা
5 চোখের বর্ণ বাদামী বাদামী
6 ঠোঁট নীচের ঠোট ডানদিকে কুঞ্চিত নীচের ঠোট ডানদিকে কুঞ্চিত
7 কান কিনারার দিকে চোখা কিনারার দিকে চোখা
8 কানের লতি গালের দিকে সংযুক্ত না, ছিদ্র যুক্ত গালের দিকে সংযুক্ত না, ছিদ্র যুক্ত
9 কণ্ঠমণি প্রকট প্রকট
10 উপরের বাম দিকের মাড়ির দাঁত ভাঙা ভাঙা
11 হাত ছোট ছোট
12 বাম হাতের তর্জনী ও মধ্যমা ডান হাতের চাইতে কম অসম আকারের ডান হাতের চাইতে কম অসম আকারের
13 ডান চোখের নীচের পাপড়ির আঁচিল বিদ্যমান বিদ্যমান
14 পা খসখসে, জুতার আকার ৬ নাম্বার খসখসে, জুতার আকার ৬ নাম্বার
15 বাম গোড়ালির উপরের দিকে ক্ষত বিদ্যমান বিদ্যমান
16 সিফিলিস বিদ্যমান বিদ্যমান (বিতর্কিত)
17 সিফিলিসের ক্ষত বিদ্যমান বিদ্যমান (বিতর্কিত)
18 মাথা ও পিঠে ফোঁড়ার দাগ বিদ্যমান বিদ্যমান
19 কুঁচকিতে অস্ত্রোপচারের দাগ বিদ্যমান বিদ্যমান
20 ডান বাহুতে বাঘের থাবার আঘাতের দাগ বিদ্যমান বিদ্যমান
21 শিশ্নের নিম্নভাগে আচিল বিদ্যমান বিদ্যমান
এ ছাড়াও এই দুই ব্যক্তির আলোকচিত্রে যথেষ্ট মিল আছে। হাঁটার ধরণ, গলার স্বর, এবং ভাবভঙ্গীতেও মিল রয়েছে। আঙুলের ছাপ নেয়ার পদ্ধতি এই মামলার সময়ে চালু ছিলো, কিন্তু কোনো অজ্ঞাত কারণে তা ব্যবহৃত হয়নি। ধারণা করা হয়, কুমার নরেন্দ্রনারায়ণ ১২ বছর আগে নিখোঁজ হওয়াতে তাঁর হাতের আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করা সম্ভব ছিলো না।
প্রিভি কাউন্সিলের রায়(এটাই শেষ রায়) বেরনোর পর দিন খবর পৌঁছল কলকাতায়। সে দিনটা ছিল ১৯৪৬-এর ৩১শে জুলাই। কুমার রমেন্দ্র নারায়ণ রায় শেষ পর্যন্ত তিনটি কোর্টে নিজের পরিচয় প্রমাণ করতে সক্ষম হলেন। পর দিন যখন খবরটা শহরের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে গেল, তাঁর ধর্মতলা ষ্ট্রিটের বাড়িতে তখন শয়ে শয়ে লোকের ভিড়। সবাই তাঁকে অভিনন্দন জানাতে চায়। সেই দিন সন্ধ্যাতেই, কুমার যাচ্ছিলেন কর্নওয়ালিস ষ্ট্রিটের ওপর ঠনঠনিয়া কালীবাড়িতে পুজো দিতে। ঠিক রাস্তায় বেরনোর সময়ে, তাঁর হৃৎযন্ত্র গেল বন্ধ হয়ে। কুমার অচেতন হয়ে পড়ে গেলেন। তৎক্ষণাৎ তাঁকে বাড়িতে নিয়ে আসা হল। বয়স তখন তাঁর তেষট্টি। পর দিন হিন্দুস্থান স্ট্যাণ্ডার্ডে ছোট্ট মৃত্যু-সংবাদ বের হল— ‘‘তাঁর শরীর কিছু দিন ধরেই ভাল যাচ্ছিল না। হেমোটিসিসে আক্রান্ত হয়ে ১ অগস্ট তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।
প্রিভি কাউন্সিলের রায় জেনে বহু লোক তাঁর বাড়িতে অভিনন্দন জানাতে গিয়ে তাঁর মৃত্যু-সংবাদ শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেছেন। জানা গিয়েছে যে, বন্ধুবান্ধব ও প্রজাদের সঙ্গে দেখা করতে এ মাসের মাঝামাঝি জয়দেবপুর যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন কুমার।’’
কুমারের শ্রাদ্ধ হল কলকাতায়, ১৩ অগস্ট, ১৯৪৬। সাঁইত্রিশ বছরের মধ্যে তাঁর দুই নম্বর শ্রাদ্ধ। তিন দিন পর কলকাতা শহর ডুবল তার ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দাঙ্গার বীভৎসতায়। ‘দি গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস’— পরের চার দিনে নিহত হল প্রায় ৪০০০ মানুষ।
রানি বিভাবতী আর যে কুড়ি বছর বেঁচেছিলেন, পুরো সময়টা জুড়েই অত্যন্ত জোরের সঙ্গে বলতেন যে, যদিও পৃথিবীর সব আদালতের রায়েই তিনি পরাজিত, সবার উপরের বিচারকের বিচারে কিন্তু তাঁর হার হয়নি। বহু বছর আগেই যাঁর মৃত্যু হয়েছে, তাঁর পরিচয় ভাঁড়িয়ে যে ব্যক্তি চলেছিল দেবীর পুজো দিতে, দেবী তাঁকে সমুচিত শাস্তি দিয়েছেন। বিভাবতী দেবী না কি প্রিভি কাউন্সিলের রায়ে আশ্চর্য হন নি। কাশীর জ্যোতিষীরা তাঁকে বলেছিল যে তিনি হারবেন। কিন্তু তার সঙ্গে তারা এ-ও বলেছিল যে ওই ব্যক্তি কোনও দিন সম্পত্তিভোগ করতে পারবে না। জ্যোতিষীদের গণনাই ঠিক বলে প্রমাণিত হল।
১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইস্ট বেঙ্গল এস্টেটস অ্যাকুইজিশন অ্যাণ্ড টেনান্সি অ্যাক্ট পাশ করল পূর্ব পাকিস্তান সরকার। এই আইনে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হল। জমিদারদের বদলে এখন থেকে কৃষকপ্রজার সঙ্গে রাষ্ট্রের সরাসরি সম্পর্ক। জমিদারি বিলোপের ফলে স্থির হল যে, এখন থেকে জমিদার মাত্র তেত্রিশ একর জমি নিজের অধিকারে রাখতে পারবেন। অবশিষ্ট জমির উপর তাঁর আর কোনও অধিকার থাকবে না। সে জন্য অবশ্য ক্ষতিপূরণ মিলবে সরকার থেকে। বহু জমিদার এই আইনের বিরুদ্ধে আদালতের শরণাপন্ন হলেন, দাবি করলেন যে এই আইন ‘রাইট অব প্রপার্টি’ বা নাগরিকের সম্পত্তির অধিকারের বিরোধী। জমিদারদের কাছে লর্ড কর্নওয়ালিস যে প্রতিজ্ঞা করেন, এ আইন তারও বিরুদ্ধে। আমরা আগেই বলেছি, ভাওয়াল কুমারের হয়ে মামলা লড়েছিলেন যে ডি এন প্রিট, তিনিই এই সময়ে ঢাকায় আসেন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের পক্ষ হয়ে জমিদারদের মোকাবিলা করতে।
প্রিভি কাউন্সিলের রায় বেরনোর পর কিছু দিনের জন্য তৃতীয় রানি আনন্দকুমারীর দত্তকপুত্র রামনারায়ণ রায় তাঁর অংশের জমিদারির মালিক হয়েছিলেন। ১৯৫০ সালে যখন জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হল, একেবারে সরাসরি নিজস্ব অংশটুকু বাদ দিয়ে জমিদারির বাকি অংশের অধিকার তাঁকে ছেড়ে দিতে হল। সেই বছরেরই মাঝামাঝি, মাকে1_80 সঙ্গে নিয়ে তিনি চলে এলেন কলকাতায়।
জমিদারিতে রমেন্দ্র নারায়ণের যে অংশ ছিল, সেট্লমেন্ট-এর সময়ে কোর্ট অব ওয়ার্ডস মৃত কুমারের অন্যতমা রানি হিসেবে বিভাবতী দেবীর প্রাপ্য ধার্য করল আট লক্ষেরও কিছু বেশি টাকা। উকিলরা রানিকে বোঝালেন, এ তাঁরই টাকা, আপিল শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেবল এই টাকা কোর্ট অব ওয়ার্ডস তাদের নিজেদের কাছে রেখে দিয়েছিল। কিন্তু বিভাবতী তা মানলেন না, তাঁর যুক্তি— ‘‘ওরা তো ওই মৃত ব্যক্তির বিধবা ভেবেই আমাকে এই টাকা দিতে চাইছে! সে ক্ষেত্রে ও টাকা নিলে তো এত দিন পর্যন্ত যেটাকে আমি মিথ্যে বলে জেনে এসেছি, সেটাকেই এখন আবার স্বীকার করে নিতে হয়!’’ টাকা তিনি প্রত্যাখ্যান করলেন।
ভাওয়াল সন্ন্যাসীর এই আশ্চর্য কাহিনির মধ্যে থেকে যদি কোনও একজন মূল নায়ককে বেছে নিতে হয়, তিনি বিচারক পান্নালাল বসু, ঢাকা আদালতের সাবঅরডিনেট জজ। তাঁর রায়ের ওপরেই ভিত্তি করে উচ্চতর আদালতের বিচারকরা এ মামলার পুনর্বিচার করেন। একটা আশ্চর্য রহস্য সমাধানের প্রবল ইচ্ছা তো বটেই, তা ছাড়াও বসুর এই বিচারের মধ্যে ছিল অনেক অতিরিক্ত অনুপ্রেরণা। তিনি সেই জাতীয়তাবাদী প্রজন্মের বিচারক, বিদেশি শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যাঁরা তাঁদের দৃষ্টিকে সচেতন ভাবে আলাদা করতে চেয়েছিলেন, বিদেশি সরকারের নথিপত্রকেও যাঁরা প্রবল সন্দেহের চোখে দেখতেন। পূর্ব জীবনে দর্শনশাস্ত্রের শিক্ষক ছিলেন বসু। তাঁর চাকরি জীবনের এই শেষ মামলাটিতে তাঁর সেই দর্শনবোধও দারুণ ভাবে কাজে লেগে যায়। ভাওয়াল সন্ন্যাসীর মামলা প্রমাণ করে যে, মানুষের আত্ম-পরিচয় আসলে অর্থহীন, আকস্মিক। মানুষ যা বিশ্বাস করে, বিশ্বাস করতে চায়, তাকেই বলে ‘পরিচয়’। পান্নালাল বসু বাংলাদেশের এক বিস্মৃত নায়ক। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত উচ্চশিক্ষিত জাতীয়তাবাদী ‘এলিটে’র প্রতিনিধি তিনি ।
জয়দেবপুরের রাজবাড়িতে এখন বাংলাদেশের গাজিপুর জেলার সরকারি অফিস। যে বড় দালানে জমিদারির সাহেব অতিথিরা এসে বসতেন, সেখানে এখন বসে গাজিপুরের ডেপুটি কমিশনারের অফিস। রাজবিলাসের একতলায় কুমারদের বৈঠকখানায় এখন পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্ট। ওপরে রানিদের ঘরগুলোতে বসেন গাজিপুরের যত হাকিমরা। মেঝের মার্বেল আর নেই, এখন সেখানে সাধারণ সিমেন্টের আস্তরণ। বড় বড় পুরনো ভারী কাঠের দরজাগুলো শুধু এখনও রাজকীয় মহিমা নিয়ে দাঁড়িয়ে। …আর দাঁড়িয়ে রাজবাড়ির বিশালাকার লোহার সিংদরজা। দরজার সামনে আগে ছিল পোলো খেলার মাঠ, যেখানে এক দিন হাজার মানুষের সামনে হাতির পিঠে জয়দেবপুরের সাধুর ঐতিহাসিক আবির্ভাব ঘটে। সেই মাঠ এখন ফুটবল স্টেডিয়াম ।
ছুটির দিনে কোর্ট কাছারি যখন ঝাঁপে ঢাকা, আজও দলে দলে কৌতূহলী মানুষ এসে দর্শন করে রাজবাড়ি। সরকারি অফিসের কর্মচারীরা যত্ন ও ধৈর্য সহকারে তাদের ঘুরিয়ে দেখায়। সেই বিখ্যাত মামলার কাহিনি শোনায়। রানি বিভাবতী আসলে তলে তলে ডাক্তারের সঙ্গে প্রেম করছিলেন— তারা বলে। ওই যে পুকুরটা এখন নোংরা আর কচুরিপানায় ঢাকা, তারই ধারে ছিল ডাক্তারের বাড়ি। প্রতি দিন সকালে, ডাক্তার এসে দাঁড়াতেন বাড়ির ছাদে। আর রানি দাঁড়াতেন রাজবিলাসের ওপরের বারান্দায়। দুজনের মধ্যে চলত সঙ্কেত বিনিময়। সম্পত্তির লোভে একসঙ্গে ফন্দি এঁটে তাঁরা কুমারকে বিষ খাওয়ান। মানুষের কল্পনায় কিন্তু আশ্চর্য ভাবে এ গল্পের বিশাল ভৌগোলিক বিস্তার কমে গেছে, একেবারে তাদের চেনা চৌহদ্দিতে এখন সে গল্পের পটভূমি। অতিথিরা যে গল্প এখন শোনে, সে গল্পের কুমারের মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হয়েছিল চিলাই নদীর পারে যে শ্মশান, সেইখানে— সে জায়গা এখান থেকে — ওই দিকে, মাইল খানেক মতো হবে! সে ছিল এক ঝড়ের রাত, শ্মশানে হঠাৎ কী করে যেন কুমারের দেহ উধাও হয়ে যায়! পরিচিত গল্প, বার বার বলা, বার বার শোনা। কোনও কোনও বয়স্ক অতিথি হয়তো বলে ওঠেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, এ গল্প তো চেনা চেনা, — একটা যাত্রা হয়েছিল না একবার? না কি যাত্রা নয়, কলকাতার কোনও ফিল্ম?
বুড়িগঙ্গার ধারে ঢাকার নলগোলায় ভাওয়াল জমিদারির বাড়ি থেকে পুরনো কালের নবাবদের প্রাসাদ আহসান মঞ্জিল বেশি দূর নয়। আহসান মঞ্জিল এখন মিউজিয়ম। আর নলগোলার বাড়ি এখন জবরদখলকারীদের আস্তানা। একদিকের কড়িকাঠ তার ভাঙা, বাকি অংশটা গুদাম, পাঁজা পাঁজা পাটের বস্তার স্তূপ জমিয়ে রাখা। এখানেও একটি মাত্র বৃহদাকার কাঠের দরজা জমিদার বাড়ির অতীত ঐশ্বর্যের শেষ চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আজকের ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী। যে অঞ্চলের ওপর এই মহানগরী গড়ে উঠেছে, আগে সেই সব জায়গা ছিল ভাওয়াল জমিদারির অন্তর্গত— বেশি দিন আগের কথা নয়। সোনারগাঁও হোটেল থেকে মগবাজার রোড ধরে উত্তরে ময়মনসিংহ হাইওয়ের দিকে গেলে রাস্তার দু দিকে দেখা যায় নতুন নতুন অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং, বসবাসের নতুন সব অঞ্চল, এ সবই যে জমিতে গড়ে উঠেছে, মাত্র কয়েক দশক আগেই সেই সব এলাকা ছিল ভাওয়ালের রানির তরফে কোর্ট অব ওয়ার্ডসের অধীন। অর্থাৎ— উন্নয়নের ফল সেখানে আর যে-ই পেয়ে থাকুক, ভাওয়ালের রানিরা অন্তত পাননি।
কলকাতায় ১৯ নম্বর ল্যান্সডাউন রোডও এখন বিশাল বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং। সেই পোর্টিকো আর কৃষ্ণচূড়ার বাড়ির আজ আর চিহ্নমাত্র নেই। সত্যেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির নাতিনাতনিরা থাকেন পাশেই একটা গলিতে। কিন্তু মহামূল্যবান সম্পত্তির মতো বিভাবতী দেবীর স্মৃতিকে তাঁরা সর্বদা আঁকড়ে আছেন। তিনি প্রায় ওই পরিবারের কুলমাতার সমান। তাঁরা বলেন, সাদা থান পরা, ব্রাহ্মণ বিধবার ছোট করে ছাঁটা চুলেও বিভাবতী দেবী ছিলেন সম্রাজ্ঞীর মতো। তাঁর স্নেহ, যত্ন বা মর্যাদা বোধের কোনও তুলনা মেলা ভার।
উত্তরাধিকার-সূত্রে ব্যানার্জি পরিবার আরও একটা জিনিস লালন করে চলেছে। সেটা হল, ভাওয়াল মামলার অভিযুক্ত ব্যক্তিটির ‘আসল’ পরিচয় কাহিনি। তাঁরা আজও বিশ্বাস করেন যে ওই ব্যক্তি আসলে জয়দেবপুরের আস্তাবলের সহিসের ছেলে। আর তাই গোটা রাজবাড়ির ইতিহাস তার নখদর্পণে। আসল রহস্য তার পিতৃ-পরিচয়ের মধ্যে। আগেকার দিনে সব জমিদার বাড়িতেই যেমন ঘটত, এখানেও তাই, এই ব্যক্তির বাবা স্বয়ং রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ। এর থেকেই বোঝা যায় কেন দ্বিতীয় কুমারের সঙ্গে ওই ব্যক্তির শারীরিক সাদৃশ্য এত বেশি। দার্জিলিং-এ দ্বিতীয় কুমারের মৃত্যু আর তার পর রহস্যময় ব্যক্তিটির আবির্ভাব, দুইটি বিষয়কে একত্র গেঁথে নিটোল গল্প তৈরির এ আর এক নমুনা।
দার্জিলিং-এর ‘স্টেপ অ্যাসাইড’ বাড়িটি এখনও একটি অতি দর্শনীয় স্থান। ভারি সুন্দর সেই বাড়ি এখন মেটার্নিটি কেয়ারের কেন্দ্র, বাড়ির মালিক স্বয়ং সরকার। বাড়ির সামনে বিরাট একটা ফলকে লেখা, এখানে দেহত্যাগ করেছিলেন বাংলাদেশের বিখ্যাত রাজনৈতিক নেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। দার্জিলিং শহরে কোথাও আর আজ কেউ ভাওয়ালের দ্বিতীয় কুমারের কথা জানে না ।
(এই পোস্টটি উইকিপিডিয়ার তথ্য ও পার্থ চ্যাটার্জীর ইংরেজি আর্টিকেলের সংকলন । )২য় পর্ব
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×