somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমেরিকান মুভি-কার্টুনে বর্ণবাদের ইতিহাস(ট্রিভিয়া পোস্ট)

২৪ শে অক্টোবর, ২০১৫ দুপুর ১:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৯৩০ থেকে ১৯৪০ এর মাঝখানে ওয়ার্নার ব্রস, এমজিএম, ওয়াল্ট ডিজনির মত স্বাধীন স্টুডিওগুলো এমন অনেক কার্টুন তৈরি করেছিল যেগুলো মাত্রাতিরিক্ত বর্ণবাদের দোষে দুষ্ট ছিল । শুধু বর্ণবাদই নয় নানা আপত্তিকর বিষয় অনায়াসে স্থান করে নিত কার্টুনগুলোতে । আধুনিক দর্শকদের কাছে কার্টুনগুলো কুৎসিত মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয় ।

১৯৬৮ সালে ইউনাইটেড আর্টিস্ট ১১টা কার্টুন নিষিদ্ধ করে । ঠিক করা হয়, এই ১১টী কার্টুন কোন প্রচারমাধ্যমে প্রচার করা হবে না, কোন পক্ষের কাছে এই কার্টুনগুলো বিক্রি করাও নিষিদ্ধ করা হয় । এই ‘সেন্সরড ইলেভেন’ এর পথ ধরে পরবর্তীতে আরো অনেক কার্টুনে অনেক সংশোধন, পরিমার্জন করা হয়, এমনকি কিছু কার্টুন পুরোপুরি হারিয়ে যায় ।

তবে কালোদের স্টেরিওটাইপ করার ব্যাপারটা কিন্তু কার্টুন থেকে শুরু হয়নি, শুরু হয়েছিল উনিশ শতকে । তখন আমেরিকায় মিন্সট্রেল শো নামে একটি অনুষ্ঠান খুব জনপ্রিয় ছিল(এখনকার দিনের স্ট্যান্ড আপ কমেডির মতো অনেকটা), সেখানে শ্বেতাংগ পারফর্মাররা মুখে কালি, কোকো বাটার, ইত্যাদি মেখে কালো লোকদের ভূমিকায় অভিনয় করে তাদেরকে খেলো করতেন । এই অনুষ্ঠানে কৌতুক, গান, নাচ, নাটিকা ইত্যাদির মাধ্যমে যত অদ্ভুতভাবে পারা যায় আফ্রিকান আমেরিকানদের উপস্থাপন করা হত । প্রথমদিকে তো মুখে কালো রঙ করার পাশাপাশি মুখে টকটকে লাল রঙ দিয়ে ঠোঁট আঁকা হত । ১৮৪০ থেকে ১৮৯০ সাল পর্যন্ত মিনস্ট্রেল শো ছিল আমেরিকার জনপ্রিয়তম বিনোদনের উৎস ।

প্রথমদিকে কালোরং দিয়ে মেকাপ না করে আসলে শ্বেতাঙ্গ দর্শকেরা মিনস্ট্রেল শোতে কালোদের অংশগ্রহণও পছন্দ করতেন না । কিন্তু পরবর্তীকালে উইলিয়াম হেনরি লেন নামে একজন কৃষ্ণাঙ্গ পারফর্মার তাঁর অসাধারণ দক্ষতা ও জনপ্রিয়তার গুণে কোন রঙ না মেখেই শো তে অংশ নিতে সমর্থ হন । পরবর্তিতে অনেক কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতারা মুভিতে, থিয়েটারে সুযোগ পেতে থাকেন, কিন্তু প্রথমদিকে তারা টাইপকাস্ট হয়েই পর্দায় থাকতেন ।





যাই হোক, কার্টুনে ফিরে আসি । টম এন্ড জেরি কার্টুন দেখেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুস্কর! সেখানো নিশ্চয়ই দেখে থাকবেন কোন একটা বিস্ফোরণের পর অথবা গাড়ির ধোঁয়া যাওয়ার পর যেকোন চরিত্রের মুখ কুচকুচে কালো হয়ে যাচ্ছে । ১৯৪৮ সালের একটি কার্টুন “মাউস ক্লিনিং” এ দেখা যায় কোন এক কান্ডে টমের মুখে কালি লেগে গেছে আর সে নিজের পরিচয় লুকাতে গিয়ে আফ্রিকান-আমেরিকান টানে বলছে, “নো ম্যাম, আই এইন্ট সি...... নো ক্যাট ......নো ক্যাট...... নো প্লেস, নো হাউ, নো ম্যাম......” এমন ছোটখাট কিছু থাকলে তা কেটে বাদ করা কোন সমস্যা ছিল না, কিন্তু বেশি হয়ে গেলেই হত সমস্যা ।

কিন্তু সেন্সরড ইলেভেনের ব্যাপারটা ছিল ভিন্ন । কার্টুনগুলো বানানোই হয়েছিল কালারডদের উপজীব্য করে, “স্নো হোয়াইট এন্ড সেভেন ডোয়ার্ফ” এর প্যারোডি করে বানানো হয়েছিল “কোল ব্ল্যাক এন্ড সেভেন ডোয়ার্ফ” । পরবর্তীতে সত্তর-আশির দশকে কার্টুনগুলোর নির্মাতা বলেছেন, এই দুটি কার্টুনের চরিত্রগুলো তার পরিচিত কিছু জ্যাজ মিজিশিয়ানের আদলে তৈরি, কাউকে আঘাত করা এই কার্টুনের লক্ষ্য ছিল না ।

কৃষ্ণাঙ্গদের পরে সবচাইতে বেশি বাজেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে আরবীয় চরিত্রগুলোকে, এমনকি ব্যাক টু দ্যা ফিউচার(১৯৮৫), রেইডারস অফ দি লস্ট আর্ক (১৯৮১), ট্রু লাইস(১৯৯৪) । যদিও হলিউড প্রযোজকরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে আরবদের খারাপভাবে চিত্রায়নের কথা অস্বীকার করেছেন । কিন্তু তা ধোপে টেকেনি । উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯৯২ সালের ডিজনি মুভি ‘আলাদিন’ এর কথা । এখানে আলাদিন আর জেসমিনের ভয়েস আমেরিকান এক্সেন্টে ডাব করা হয়, তাদের গায়ের রঙও অন্যদের থেকে কিছুটা উজ্জ্বল দেখানো হয় । কিন্তু অন্য খলচরিত্রগুলোর সংলাপ আরবি উচ্চারণের ইংরেজি দিয়ে ডাব করা হয় । তাছাড়া গরিব আলাদিনের গায়ের রঙ কিছুটা রোদে পোড়া হলেও রাজপুত্র হবার পর ভোজবাজির মত গায়ের রঙ পালটে উজ্জ্বল হয়ে যায় । শুধু ডিজনির কার্টুনেই নয়, অন্য অনেকজায়গাতেও আরবের মহিলা মানেই বেলি ড্যান্সার অথবা হারেমের বাসিন্দা আর আরবের পুরুষ মানেই সন্ত্রাসী, যুদ্ধবাজ গোত্রপতি, তেল ব্যবসায়ী দেখানো ছিল সাধারণ ঘটনা ।

কমেডিয়ান লরেল এন্ড হার্ডি ‘বিউ হাঙ্কস(১৯৩১)’ এ, বব হোপ এবং বিং কসবি ‘রোড টু মরক্কো(১৯৪২)’ তে, ম্যাক্স ব্রাদার্স ১৯৪৬ সালে ‘নাইট ইন ক্যাসাব্লাঙ্কা’ তে, ফিল সিলভারসের ‘ফলো দ্যাট ক্যামেল’, ডাস্টিল হফম্যানের একটি মুভিতে আরবদের নকল করা হয় । প্রথমদিকে দেখানো হত আরবরা সাদা চামড়ার মহিলাদের অপহরণকারী হিসেবে, যা পরবর্তীতেও এসেছে । এর সবচাইতে ভাল উদাহরণ হল আনফিসিয়াল বন্ড মুভি, ‘নেভার সে নেভার এগেইন(১৯৮৩)’ ।

গোলান এবং গ্লোবাস নামের দুজন ইসরাইলি প্রযোজক ১৯৮০ সালে একটি আমেরিকান সিনেমা কোম্পানি কিনে নেন । এরপর তারা একে একে ২৬টি আরববিরোধী মুভি তৈরি করেন, এগুলোর মাঝে হেল স্কোয়াড, ডেলটা ফোর্স ওয়ান, ডেলটা ফোর্স টু উল্লেখযোগ্য । এগুলোতে আরবদের টেররিস্ট হিসেবে দেখানো হত এবং আরবদের ভূমিকায় অভিনয় করত ইসরাইলি অভিনেতারাই! এই ক্যারিকেচারকে বলা হয় ‘Arab-face’ ।

রুলস অফ এনগেজমেন্ট(২০০০) মুভির মাধ্যমে সম্পূর্ণ নতুন একটা প্রশ্ন চলে আসে । মুভিতে যেকোন যুদ্ধাবস্থায় নিরস্ত্র মহিলা ও শিশুদের ওপর গুলি চালানোর পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হয় । মুভিতে দেখানো হয়, যদি কমান্ডিং অফিসারের মনে হয় ভিড়ের সুযোগ নিয়ে কেউ সেখান থেকে গুলি করছে তাহলে তিনি নির্বিচারে গুলি করার আদেশ দিতে পারবেন, এতে তার কোন অপরাধ হবে না । মুভিতে দেখানো এরকম গোলাগুলির পর ধোঁয়া পরিষ্কার হলে পরে দেখা গেল ৮৩ জন নিহত ও ১০০ জনেরও বেশি আহত হয়েছে । এর মাঝে অসংখ্য নারী-শিশু ছিল । আন্তর্জাতিকমহলে নিন্দার ঝড় বয়ে যাওয়াতে কমান্ডিং অফিসারকে অভিযুক্ত করা হয় ।
এরপরেই বিতর্ক! গুলিবর্ষণের পর একটি বাচ্চা মেয়েকে পঙ্গু হয়ে যেতে দেখানো হয় । পরবর্তীতে কমান্ডিং অফিসার ফ্লাশব্যাকে দেখা যায়, মেয়েটি এবং তার সাথে আরো নারী-পুরুষ আমেরিকান সেনাদের দিকে গুলি ছুড়ছে! ঘটনাটি আসলেই ঘটেছে নাকি কমান্ডিং অফিসার নিজের ওপর খুনের দায় এড়াতে গিয়ে বানিয়ে বলেছে, এই প্রশ্নের উত্তর মুভিতে দেয়া হয়নি । এমনকি অন্য কোন অফিসারও কারও হাতে অস্ত্র দেখেনি । তাছাড়া আমেরিকান সেনারা ছিল দূতাবাসের ওপরে, তাদের ওপর যদি স্নাইপাররা গুলি করে থাকে তাহলে সরাসরি সামনের বিল্ডিং থেকে করবে, সেখানে কেন সামনে না দেখে নিচের পথচারীদের দিকে গুলি চালানো হল তার স্বপক্ষেও কোন যুক্তি দেয়া হয়নি । বরং কমান্ডিং অফিসারকে গণহত্যার অভিযোগ থেকে মুক্তি পেতেও দেখানো হয় মুভিটিতে । আমেরিকান আরব কমিউনিটি মুভিটির তীব্র নিন্দা করে ।


এছাড়া এমন প্রশ্নও ওঠে, যদি বড় একটি ভিড় থেকে মাত্র একজন যদি গুলি করে তাহলে কি পুরো ভিড়ের ওপর গুলি চালানো কি ন্যায়সঙ্গত? মুভিটির ভাষ্যমতে, মাত্র কয়েকজন শূটারের জন্য শয়ে শয়ে মানুষ মেরে ফেললে দোষ নেই, যেহেতু তারা আরব! সাধারণ আমেরিকানরা যখন এসব মৃত্যুর খবর শোনে, তখন তাদের বেশিরভাগের মনে কোন ধরণের অপরাধবোধ জাগ্রত হয় না । এসবই হল গত ১০০ বছরের ঋণাত্নক চিত্রায়ণের ফসল । যার প্রমাণ আপনি পাবেন এইসমস্ত ইউটিউব ভিডিওর নিচে গর্বিত(!) আমেরিকানদের দম্ভোক্তিতে ।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে অক্টোবর, ২০১৫ দুপুর ১:৫৯
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×