somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বৈশাখ এবং তাঁদের গল্প

১৯ শে জুন, ২০১৬ দুপুর ২:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আজ শরীরটা কেমন অবশ হয়ে এসেছে। সারা শরীরে একটু আধটুকু ব্যাথাও অনুভব করছে সে। এখনো এশার আযান পড়েনি তবুও সে আজ আর জেগে থাকতে পারছে না। ক্ষিধেও পেয়েছে প্রচন্ড তাই নিজের অজান্তে বারবার চোখ বন্ধ হয়ে আসলেও ঘুমোতে যাচ্ছে না হাবিব। আসলেই প্রচন্ড ক্ষিধে পেয়েছে, এ ক্ষিধে নিয়ে ঘুমোনো যায় না।
এদিকে এখনো রান্না শেষ হয়নি। এমনিতেই বৃষ্টিতে উনুন ভিজে গেছে, যা প্রায় প্রতিদিনই হয়। যার কারণে উনুনে আগুন ধরাতে সময় লাগে আবার আগুন ধরলেও উনুনে ঠিকমতো আগুন হয়না চারপাশ ভেজা বলে। তার উপর এখন বাতাসও প্রচন্ড। রান্নাঘরের বেড়ার ফাঁক দিয়ে বাতাস ঢুকছে। এরি মধ্যে কূপির আগুন কয়েকবার নিভেও গেছে। বাতাস উনুনের আগুনে এসেও প্রভাব ফেলছে। তাই আজ রিয়াদের মা জহুরার রান্না করতে দেরি হচ্ছে। অথচ আজ তার সকাল সকাল রান্না করাটা প্রয়োজন। আজ রাত আটটার আগেই খাওয়া শেষ করে হাবিবের বাবাকে পাহারা দিতে যেতে হবে।
রান্না তেমন কিছু না। দুমুঠো ভাত আর আলু ভাঁজি। বৈশাখ মাসে এছাড়া আর কিই বা রান্না করা যায় ? সারাদিন খলাতে ( "খলা" হলো বাড়ির সমনের একটা খোলা জায়গা যেখানে ভাটি অঞ্চলের মানুষেরা বৈশাখ মাসে ধান শুকায়। আর বর্ষার সময় এই জায়গাটা পানির নিচে চলে যায়।) থাকতে হয়, অনেকদিন তো সন্ধ্যার পরেও খলাতে থাকতে হয়। সারাদিনে রান্নার কোনো জোগাড়যন্ত্রই করা যায় না। সন্ধ্যের পর ঘরে এসে যা পাওয়া যায় তাই রাতে খাবারের জন্য রান্না করা হয়। আবার রাতেই পরদিন সকাল আর দুপুরের খাবার জোগাড় করে রাখা হয়।
দেউড়িতে কাঠের তৈরী লম্বা বেঞ্চিতে ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে বসে অপেক্ষা করছে হাবিব। চোখে ঘুম থাকলেও তার কান খাড়া। বাহিরে প্রচন্ড জোরেশোরে বাতাস বয়ে যাচ্ছে। দক্ষিণ পশ্চিম কোণ দিয়ে ঝড়ো বাতাস বয়ে আসছে। এ বাতাস বড়ো সাঙ্গাতিক। যখন ভালো করে ঝড় আসে তখন মনে হয় এ বাতাসেই পৃথিবীতে কিয়ামত হবে। এই বাতাস যে কিছু সময়ের মধ্যেই প্রবল ঝড়ে পরিণত হবে সেটা বুঝতে হাবিবের বেগ পেতে হয় না। এক প্রবল ঝড়ের আভাসে হাবিবের ঘুমকাতুরে চোখ প্রদীপের ন্যায় জ্বলে উঠে।
হাবিবদের উঠানে অনেক ধরনের গাছ আছে। দুটো আম গাছও আছে। তাঁদের উঠানের পাশেই কলিম চাচাদের উঠানে একটা সূর্যমুখী আম গাছ আছে।
হাবিবদের নিজেদের অনেকগুলো আম গাছ আছে। বাড়ির সামনে যেমন আছে তেমনি বাড়ির পেছনে তালাব পাড়েও অনেকগুলো আম গাছ আছে। কলিম চাচাদের গাছের আম যেমন বৈশাখের মাঝামাঝিতেই পেকে যায় তেমনি তাঁদের গাছের আমও আগে আগে পেকে যায়। তাঁদের আম খেতেও কম মিষ্টি না, রসালোও। কিন্তু হাবিবের তাঁদের আমের প্রতি কোনো আগ্রহ নেই।
নিজেদের গাছের আমের প্রতি হাবিবের কোনো অাগ্রহ না থাকলেও কলিম চাচাদের সূর্যমুখী গাছের আমের দিকে সে প্রায়ই লোভাতুর চোখে থাকিয়ে থাকে। কলিম চাচারা যখন আম পারেন তখন আশেপাশের কাউকে একটা আমও দেন না, হাবিবদেরও না। তাই যা একটু ঝড়ের সময় কুড়িয়ে পাওয়া যায় তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। অন্য বছরগুলোতে অবশ্য ঝড়ের মধ্যেও কুড়িয়ে নেওয়া যেত না। কলিম চাচার মা হাসির বুড়ি ঝড়ের মধ্যেও দেউড়ির দরজার সমনে এসে দাড়িয়ে থাকতেন। কেউ আম কুড়াতে আসলেই চেঁচিয়ে উঠতেন। আর তার হাড় বজ্জাত নাতি তায়েফ তো যত ঝড়ই থাকুক না কেন উঠানের মাঝে পাঁচ বছরের পুরোনো ভাঙ্গা ছাতা মাথায় নিয়ে একটা বালতি হাতে দাড়িয়ে থাকবে। একটা আম গাছ থেকে পরলেই দৌড়ে গিয়ে বালতিতে ঢুকিয়ে ফেলবে। আর কাউকে তো তাঁদের উঠানের কাছে ঘেঁসতেই দেয় না। কিন্তু এবার এই দুজনকে নিয়ে হাবিবের কোনো চিন্তা নেই ! হাসির বুড়ি দুমাস আগে সাতদিনের জ্বরে মারা গেছে। যদিও শন্তিতে আম কুড়াতে পারবে বলে হাবিব খুশি তবুও বুড়ির জন্য হাবিবের কষ্ট হয়। বুড়িটা কথায় কথায় হাসাতে পারত। তার কথা শুনে হেসে গড়াগড়ি না খেয়ে উপায় ছিল না। নিজে কথা বলে বুড়িও যখন তার দাঁতবিহীন মাড়ি বের করে হাসত তখন তাকে অদ্ভুতরকমের দেখাত। এ দৃশ্য এখনো হাবিবের চোখে ভেসে উঠে।......
আর ঐ বজ্জাত তায়েফ কিছুদিন হলো মামার বাড়ি গেছে। এমনি এমনি এই আমের মৌসুমে মামার বাড়ি যায়নি, অসুখে পড়ে গেছে।
ঝড় আসে, প্রচন্ড ঝড় আসে। হাবিবের মা জহুরা রান্না ঘরে। তার ভাত রাঁধা শেষ হয়েছে। তিনি এখন আলু ভাঁজি রাঁধছেন। এমন সময় প্রচন্ড শব্দে রান্নাঘরের চালে গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়ল। রান্নাঘরের বেড়াটা তেমন ভালো না। বাঁশ আর ছন দিয়ে তৈরী। যেদিনই ঝড় আসে সে দিনই বেড়ার কোনো না কোনো অংশ ভেঙ্গে যায়। ঝড় শেষ হলে আবার তা মেরামত করতে হয়।.... বেড়াটা ভেঙ্গে নতুন করে টিনের বেড়া দিবেন বলে সেই ফাল্গুন মাস থেকে ভেবে আসছেন জহুরা। হাবিবের বাবাকেও বলেছেন। কিন্তু কি করবেন? সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুড়ায়। অনেক কষ্ট করে তিন মণ ধান আগলে রেখেছিলেন, ভেবেছিলেন চৈত্র মাসে যখন ধানের দাম বাড়বে তখন হয়ত এগুলো বিক্রি করে বেড়া দিতে পারবেন। কিন্তু ধানের দাম আর বাড়েনি বরং কমেছিল। তবে সেদিন হাবিবের বাবা বলেছেন এবার বৈশাখী তুলেই টিনের বেড়াটা দিবেন, গোয়ালঘরের চালের টিনও একদম নষ্ট হয়ে গেছে সেটাও ঠিক করাবেন।
ঝড়ের বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে বারবার মেরামত করা রান্নাঘরের বা'পাশের বেড়াটা আর দাড়িয়ে থাকতে পারেনি। সেটা ধপাশ করে রান্নাঘরের মেঝের ওপর এসে পড়ে যায়।
রান্নাঘরটা কেমন জানি উলঙ্গ উলঙ্গ মনে হচ্ছে। বেড়ার খোলা অংশ দিয়ে ঝড়ো বাতাস ঢুকছে। মুহুর্তেই উনুনের পাশে কাঠের তৈরী "কাছা" 'র উপর রাখা পীতলের কূপির আগুন সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো কয়েকবার উঠা - নাম করে ধপ করে নিভে যায়। সাথে সাথে অন্ধকারে ছেয়ে যায় রান্নঘর। রান্নাঘরের চালে ঝুমঝুম শব্দে অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। মাঝেমধ্যে বজ্রপাত হচ্ছে, তার সাথে উনুনের উপর কড়াইয়ে ভাঁজি "ভাগার" 'র শব্দ অদ্ভুত এক সুরের সৃষ্টি করছে। বিদুৎ চমকানোর সাথে সাথে ঘরময় ছড়িয়ে পড়ছে এক পবিত্র অথচ ক্রুদ্ধ আলো। সে আলো কখনো অন্ধকারে সাহস জোগায় আবার কখনো এ আলোই অনধিকার শাসন করে যায় !!
নাহ্ ! এতক্ষণ অপেক্ষা করে হাবিবের কোনো লাভ হয়নি। ঝড় শুরু হওয়ার সাথে সাথেই হাবিব দেউড়ি ছেড়ে উঠানের এক কোণে তৈরী হাঁস মুরুগ রাখার খোঁয়াড়ের পাশে বড় কাঠাল গাছটার পাশে এসে দাড়ায়। এখানে দাড়ালে বৃষ্টির ফোঁটা শরীরে এসে পড়েনা। অথচ কলিম চাচাদের গাছের অাম পড়লে সহজেই কুড়িয়ে নিতে পারবে। কিন্তু সেখানে দাড়িয়ে তার কোনো লাভ হয়নি। কয়েকটা কাঁচা আম পেয়েছে, একটা পাঁকা আমও গাছ থেকে পড়েনি। হাবিব বুঝতে পারে গাছে যা পাঁকা আম ছিল তা আগেই ঝরে গেছে। আজ দুপুরে যে ঝড় দিয়েছিল তাতেই সবকটি পাকা আম ঝরে গেছে। নয়ত এখন কেন কোনো পাঁকা আম পড়বে না ? হাবিবের হৃদয়ের মধ্যে আম না পাওয়ার জন্য চাপা আক্ষেপ দানা বাঁধে।
গত কয়েকদিন ধরে খুব ভোরে হাবিব তার বাবার সাথে বের হয়। বয়সের হিসাবে হাবিব নিতান্তই ছোট। বয়স মাত্র ১২। তবুও এই সময়ে এভাবে কোনো কাজ না করে ঘরে বসে থাকা যায় না। কোন সময় হাওড় পানিয়ে নিয়ে যাবে সেটা বলা যায় না। আজ এই বাঁধ তো কাল এই বাঁধে ফাটল দেখা দেয়। মসজিদের মাইকে বাঁধ ফাটলের ঘোষণা আসতেই আবাল বৃদ্ধ সবাই টুকরি আর কোদাল হাতে বাঁধের দিকে দৌড়ায়। পঞ্চায়েতের ঘোরতর নিষেধ বাঁধে মাটিকাটা রেখে কোনো জোয়ান মরদ লোক ধান কাটতে যেতেতে পারবে না। ক্ষেতে যত পাঁকা ধানই থাকুক না কেন, বাঁধে মাটি কাটতে যেতেই হবে। নয়ত জরিমানা দিতে হবে।
এই সময় একমুঠ ধান কাটলেই যেন মনে হয় অনেক। তাই গত কয়েকদিন ধরেই ধান কাটতে ছেলেকে নিয়ে যান হাবিবের বাবা রহমান। রহমান অবশ্য ছেলেকে দিয়ে তেমন ধান কাটান না। এই ছেলের হাতে ধান কাটার গতি নাই। শ্লথ গতিতে ধান কাটে। তাই তিনি নিজে একাই ধান কাটেন আর ছেলেকে দিয়ে মুঠ আনা নেওয়া করান।
রহমান ধান কেটে ক্ষেতের পাশেই পতিত জায়গায় ধানের মুঠ এনে তেরপালের উপর রেখেছেন। হাওড়ে পানি ঢুকে গেলেই মুঠগুলো পানিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। তাই কাটা ধানের মুঠ হাবিব নৌকা দিয়ে বাড়ির সামনের মাঠে এনে রাখছে। গতকালও এমনি নৌকা দিয়ে ধানের মুঠ নিয়ে আসছিল। দুপুরবেলা, আকাশে ঘন কালো মেঘ যেন গোল্লাছুট খেলা খেলছিল। ঝিরঝিরানি বৃষ্টির সাথে হালকা বাতাসও ছিল।
নদীর পানি তার আশেপাশের সব ডোবা আর মাঠ ডুবিয়ে বড় সড়কটায় এসে লেগেছে। নদীতে ঢেউ ছিল। দূর থেকে সর্পিল গতিতে ঢেউ এসে আস্তে করে পড়ছিল নৌকার ডান পাশের কাঠে। কিন্তু এ অবস্থা বেশি সময় থাকে নি। পশ্চিম আকাশে ঝড় শুরু হয়। মুহুর্তেই পৃথিবীটা গাঢ় অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে যায়। পৃথিবী কাঁপিয়ে শুরু হয় একের পর এক বজ্রপাত। এতক্ষণ সর্পিল গতিতে যে ঢেউগুলো এসে অাছড়ে পড়ছিল নৌকায়, তা তাঁর আদিম রূপ ধারণ করে। ঢেউয়ে নৌকার হাল ঠিকমতো ধরে রাখতে পারছিল না হাবিব। ঢেউয়ের সাথে সাথে নৌকোতে পানি উঠছিল প্রচুর। দেখতে দেখতেই নৌকার তলা পানিতে ভরতি হয়ে যায়। একদিকে নৌকার হাল ধরে রাখা অন্যদিকে নৌকার ভেতরের পানি সেঁচে ফেলতে গিয়ে দারুন বিপাকে পড়ে যায় হাবিব।
দুপুরের ঝড়ের কথা মনে পড়ে হাবিবের কান্না পায়। মনেমনে ভাবে সে যদি তখন নৌকাতে না থেকে বাড়িতে থাকত তাহলে হয়ত সে কলিম চাচাদের গাছের পাঁকা আম পেত।
অনেক্ষণ হলো ঝড় থেমেছে। মেঘেঢাকা অন্ধকার রাতে কাঠাল গাছটার নিচেই দাড়িয়ে থাকে হাবিব। এতক্ষণ সে তার পায়ের কাছে থাকা ঝড়ে পড়ে যাওয়া একটা ছোট কাঠাল নিয়ে পা দিয়ে খেলা করছিল। নিজের অজান্তেই কখন যে তার পায়ের আর কাঠালের অন্তরঙ্গতার মধ্যে সে ঢুকে যায় তা সে বুঝতেই পারে নি। হঠাৎ সে অন্তরঙ্গতার মাঝে ছিড় ধরে। রহমান তাকে ঘর থেকে খাবার খেতে আসার জান্য ডাকছেন।
বাবার ডাক শুনার সাথে সাথে এত সময় ধরে চেপে থাকা ক্ষিধেটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠে।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে হাবিব তার তিন বছরের বোন আবিদার গলা জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ল । আর তাঁর বাবা রহমান কাঁথা বালিশ নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। আজ রহমানের ঘাগটিয়ার বাঁধে পাহারা দেওয়ার পালা পরেছে। তিনি সহ আরো দশবারো জন মিলে আজ সারারাত বাঁধ পাহারা দিবেন। বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে তিনি হাবিবকে বলে গেছেন যে সে যেন ভোরে কাস্তে আর নৌকা নৌকা নিয়ে ক্ষেতে চলে যায়। তিনি সেখানেই থাকবেন।
আকাশে তখন ভোরের সূর্যের লালচে আভা মিলিয়ে গেছে। সূর্য হয়ে গেছে প্রখর সোনালি। হাবিবদের ঘরের একমাত্র জানালা দিয়ে রোদ এসে পড়ছে খাটে শুয়ে থাকা আবিদার উপর। তার মুখে জমে থাকা ঘামের বিন্দুর উপর রোদ এসে পড়ে চিকচিক করছিল। এমন সময় হাবিবের ঘুম ভাঙ্গে। বিছনা থেকে নেমে উঠানে যেতেই রোদে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসে। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থেকে সে আবার তাকায়। এবার কিছুটা তাকানো যাচ্ছে। চোখ মেলে হাবিব দেখলো উঠানে হালকা কাদার সাথে প্রচুর গাছের পাতা মিশে আছে। আর এদিকে ওদিকে অনেক গাছের ডাল ভেঙে পড়েছে। অথচ হাবিব যখন গত রাতে আম কুড়াতে বাহিরে ছিল তখন এসব ভাঙা ডাল ছিল না। এবার হাবিব বুঝতে পারে গত রাতে সে ঘুমিয়ে পড়ার পর আবারো ঝড় এসেছিল।
হাবিবের অবাক লাগে এত সকাল হয়ে গেল অথচ আজ তার মা তার জাগানি ! প্রতিদিন ভোরেই তো তিনি তাকে ডেকে তুলে দেন।
হাবিব পুকুর থাকে হাত মুখ ধুয়ে এসেও দেখে তার মা এখনো ঘরে ফিরেন নি। ঘুম থেকে উঠার পর একবারও সে তার মাকে দেখেনি। হাবিব একবার জোরগলায় তার মাকে ডাকলো এই ভেবে যে আশেপাশের কারো ঘরে গেলে তার ডাক শুনে তিনি চলে আসবেন।... কিছু সময় সে তার মায়ের জন্য অপেক্ষা করে সে নিজেই রান্নাঘরের এক কোণে রাখা পান্তা ভাত খেয়ে, কাস্তে বৈঠা - লগি নিয়ে সে বেরিয়ে যায়।
হাবিব বাংলাঘরের উঠানে যেতেই দেখে তার মা উঠানে দাড়িয়ে আছেন। মায়ের সামনে একটা গাছের গুড়ির ওপর, মাথায় দুহাত দিয়ে বসে আছেন জমির চাচা। তিনি কিছুক্ষণ পর পর মাথা ডানে বামে নাড়াচ্ছেন আর তার মায়ের সাথে কথা বলছেন। জমির চাচাকে এখানে বসে থাকতে দেখে হাবিব অবাক হয় ! এই সময়ে তো জমির চাচার বাড়িতে থাকার কথা না। তাদের অনেক জমির ধান পেকে আছে কিন্তু কাটতে পারছেন না লোকের অভাবে তাই তাকে আর তার দুছেলে সারাদিনই ধান কাটতে হয়।
হাবিব তার মায়ের পাশে এসে দাড়ায়। তার মা তার দিকে ভাবলেশহীন চোখে তাকান। হাবিব তার মাকে বলে সে নৌকা নিয়ে ক্ষেতে চলে যাচ্ছে।
জমির চাচা এতক্ষণ তার মাথা দুহাত দিয়ে চেপে ধরে মাটির দিকে তাকিয়ে ছিলেন। হাবিবের কথা শুনে তার দিকে তিনি ফিরে তাকান। হাবিব দেখে জমির চাচার চোখ যে অন্যরকম, লালচে। তার মুখের ভাষাও অন্যরকম, এ যে হাবিবের পরিচিত জমির চাচা নন। এক রাতেই যেন তিনি বুড়ো হয়ে গেছেন। হাবিবের কথা শুনে তার মা ও যেন কেমন হয়ে যান। অনেক্ষণ ধরে তাঁরা দুজনই একইভাবে হাবিবের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে তাদের মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের হয়নি। তাঁরা যেন বোবা পাথর হয়ে গেছেন। এই পাথরদের সমনে হাবিব নিজেকে বড়ো অসহায় মনে করে ।
হাবিব জানেনা কি ঘটেছে। নয়ত এমন কথা সে তাঁর মা আর জমির চাচার সমনে উচ্চরণই করত না।....... হাবিব হয়ত ধান কাটতে ক্ষেতে যাবে কিন্তু সে জানেনা এবার আর তাদের কাউকে ধান কাটতে হবে না ! সে জানে না যে ধান এই অঞ্চলের মানুষদের কাছে নিয়ে আসে হাসি - আনন্দ সেই আনন্দ আর এবার কারো কাছে আসবে না।...
যে বাঁধ ভেঙে যাওয়ার অাশঙ্কায় সবাই আতঙ্কিত ছিল, যে বাঁধে যেন কারো অজান্তে ফাটল দেখা না দেয়, সেজন্য রাত জেগে মানুষ পাহারা দিত, সেই বাঁধ আর এ বৎসর কেউ পাহারা দিবে না।.... বাঁধ হাবিবদের মতো লাখো পরিবারের শক্তির সামনে ভেঙে যেতে পারেনি, বাঁধ ভেঙে তাঁদের ভাগ্যের ছিড় ধরাতে পারেনি। কিন্তু তাঁদের কপালে দুর্ভিক্ষের চিহ্ন এঁকে দিয়ে গেছে, তাদের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়ে গেছে গতকাল রাতের কালবোশেখির মিনিট বিশেক সময়ের শিলা বৃষ্টি।
এই অঞ্চলের মানুষের কাছে বৈশাখ আসে তাঁদের বুকে স্বপ্নের জাল বুনতে, বৈশাখ আসে তাঁদের কাছে আশা ভরসার প্রতীক হয়ে। বৈশাখে তারা আগামী দিনে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে।...... জমিতে দু'মণ বেশি ধান ফলবে, দু'পয়সা বেশি ধরে ধান বিক্রি করবে, চৈত্রের বিভীষিকাময় দিনগুলোতে ঘরে খাবার চাল থাকবে। ব্যাস এতটুকুই তাঁদের স্বপ্ন। অন্যকোনো বিলাসিতা এদের নেই। এদের স্বপ্নের শুরু ধান দিয়েই আর স্বপ্নের শেষ এই ধান দিয়েই।.....
কিন্তু তাঁদের বুকেই বৈশাখ আসে দুর্ভিক্ষের অন্যনাম হয়ে। ভগ্ন হৃদয় আর ভেঙে যাওয়া স্বপ্নের প্রতিনিধি হয়ে। হয়ত কোন এক ভোর রাতে বাঁধ ভেঙে যায় নয়ত কোনো এক সন্ধ্যার শিলাবৃষ্টি, মুহুর্তেই সারা বছরের পরিশ্রম, সারা বছর ধরে স্বপ্ন বুনার চরকা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। ভেঙে দিয়ে যায় তাদের মেরুদণ্ডকে, পঙ্গু করে দিয়ে যায় মাঠে দিনরাত আরবী ঘোড়ার মতো দৌড়ানো মানুষগুলোকে।
হাবিব হয়ত ধান কাটার আশায় ঠিকই ক্ষেতে যাবে। কিন্তু দেখবে তার বাবার মতো আরো অনেকেই ক্ষেতের আলে দাড়িয়ে আছেন। কেউ হয়ত কাদামাখা আলে বসে আছেন। আর তাঁদের চোখের ধূসর দৃষ্টি দিগন্ত ঘুরে বারবার এসে পড়বে শিলার আঘাতে খন্ড খন্ড হয়ে যাওয়া ধানের শীষগুলোর উপর।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুন, ২০১৬ দুপুর ২:৫২
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×