somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আন্দিজের লুলাইলাকো পাহাড় চুড়ায় হতভাগ্য তিন শিশু

১১ ই মার্চ, ২০২২ সকাল ১১:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দুর্গম আন্দিজের লুলাইলাকো শিখর অভিযাত্রায় প্রত্নতত্ববিদ জোহান রেইনহার্ড ও তাঁর সংগীরা

১৯৯৯ খৃষ্টাব্দ নতুন আবিস্কারের নেশায় প্রত্নতত্ববিদ জোহান রেইনহার্ড তাঁর দলবল নিয়ে দক্ষিন আমেরিকার প্রাচীন সভ্যতার দেশ পেরু আর আর্জেন্টিনা সীমান্তের আন্দিজ পাহাড় চুড়োর পথে যাত্রা শুরু করেন। সাদা শুভ্র বরফে ঢাকা ২২,১১০ ফিট দুর্গম সেই পারি দিয়ে হাজির হলো লুলাইলাকো নামে এক আগ্নেয়গিরির শিখরের কাছে। সেই দিনটি ছিল ১৬ই মার্চ, রেইনহার্ডের জীবনের এক বিস্ময়কর দিন। আবিস্কার করলো তারা শতাব্দী প্রাচীন এক ইনকা মন্দির। বন্ধ মন্দিরের দরজা ঠেলে ভেতরের এক ছোট্ট কুঠুরীতে ঢুকে বিস্মিত রেইনহার্ড এমন একটি জিনিস আবিস্কার করেন যা দেখে পুরো বিশ্ব স্তম্ভিত হয়ে পরে, মর্মন্তদ এক বেদনায় আতকে উঠে বিশ্ব হৃদয়। সেই আবিস্কার ছিল পাঁচশত বছরের পুরনো তিনটি শিশুর মমি যা ছিল সম্পুর্ন অবিকৃত। মনে হয় পাহাড়ে উঠতে উঠতে শ্রান্ত ক্লান্ত তারা ঘুমিয়ে আছে বুঝি। এরা লুলাইলাকোর মমি বলে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি লাভ করে।

দড়ি দিয়ে আস্টেপৃষ্ঠে বাধা লুলাইলাকোর মমি এল নিনো আর কিশোরীটি পাহাড় চুড়োয় বসে আছে অলৌকিক কোন মুক্তিদাতার আশায় কি !

স্পেনের দক্ষিন আমেরিকা জয়ের আগে সেখানে ছিল প্রাচীন নৃ গোষ্ঠীর অন্যতম শক্তিশালী একটি গোষ্ঠী ইনকাদের বসবাস। ১৪০০ থেকে ১৫৩৩ খৃষ্টপুর্বে এই ইনকারা বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠিকে পরাজিত করে তারা দক্ষিন আমেরিকার অর্ধেকেরও বেশি জায়গা জুড়ে পত্তন ঘটায় এক শক্তিশালী সাম্রাজ্যের। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ফলে রাস্ট্র, সমাজ ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে ইনকাদের অনেক অবদান ছিল। সমগ্র সাম্রাজ্য জুড়ে তারা যোগাযোগ ও সড়ক ব্যাবস্থা গড়ে তুলেছিল। এছাড়াও স্থাপত্য শিল্পে তাদের ছিল অসামান্য দক্ষতা যা তাদের বিভিন্ন প্রাচীন মন্দসিরে দেখা যায়। ছিল শক্তিশালী এক ধর্ম বিশ্বাস । এই ধর্ম বিশ্বাসের একটি মুল অংগ ছিল দেবতার উদ্দেশ্যে বলিদান আর এতে পশু প্রানী ছাড়াও মানুষকেও উৎসর্গ করা হতো। দেবতাকে খুশী করতে এর মাঝে শিশু বলি ছিল উল্লেখযোগ্য, ইনকা ভাষায় যার নাম ছিল “Capacocha” ।
লুলাইলাকোতে উৎসর্গকৃত এই তিনটি শিশুও ছিল এই “Capacocha”অনুষ্ঠানের বলি। ৫০০ বছরের পুরনো অবিকৃত এই শিশু মমি তিনটির একটি ছিল কিশোরী আর দুট শিশু যাদের মনে হয় কিশোরীর পরকালের খেলার সাথী হিসেবে দেয়া হয়েছে। গবেষকরা পরীক্ষা করে দেখেছেন যে শিশুর মমি তিনটি এতটাই অবিকৃত যে তাদের শরীরের ভেতরের অংগ প্রত্যংগগুলো পর্যন্ত অবিকৃত এবং জায়গামত রয়েছে। এটা হয়তো সম্ভব হয়েছে উচ্চতা, ঠান্ডা আর শুকনো আবহাওয়ার কারনে অর্থাৎ তাদের শরীর পানি শুন্য হওয়ার আগেই তারা জমে গিয়েছিল। এমনকি একটি শিশুর হৃদয়ে জমে যাওয়া রক্ত পর্যন্ত ছিল। সেই মন্দিরে পাহাড়ের দেবতার পক্ষ থেকে তাদেরকে দেয়া হয়েছিল অনেকগুলো সোনা রুপার মুর্তি,কারুকাজ করা কাপড়ের বান্ডিল, জুতো আর মাটির পাত্র যার কোন কোনটিতে খাবারও ছিল।

তিন শিশু মমির পরিচয়


লুলাইলাকোর কিশোরী

১৩-১৫ বছরের এই কিশোরীর সম্পুর্ন অবিকৃত মমিটি দেখে শিউড়ে উঠেনি এমন মানুষ বিরল। উপরের এই ছবিটি প্রতিনিধিত্ব করছে ইনকাদের প্রাচীন সংস্কৃতি আর এক তাদের নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাসের। আর এই বিশ্বাসে ভর করেই তারা এই মেয়েটিকে উৎসর্গ করেছিল পাহাড়ের দেবতার উদ্দেশ্যে। মেয়েটি ছিল তিন শিশুর মাঝে সবচেয়ে বড় এবং তাঁর উৎসর্গকে সেসময়ের ইনকারা বিশ্বাস করতো এটা একটি সন্মানের ব্যাপার। তাকে একটি ছোট্ট মন্দির প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল মৃত্যুর অপেক্ষায়।

উৎসর্গকৃত এই ছেলেটি এল নিনো নামে পরিচিত।

এই ছবিতে যে বাচ্চা ছেলের মমিটি দেখছেন তাঁর বয়স সাত, এল নিনো নামে এই ছেলেটি একমাত্র শিশু যাকে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেধে রাঝা হয়েছিল। এতই শক্ত ছিল সেই বাধন যে এতে করে তাঁর কোমর আর বুকের হাড় সরে গিয়েছিল। চুলে উকুন ছিল বলে গবেষকরা মনে করছেন। এছাড়াও তার কাপড়ে রক্তের দাগ ছিল, ছিল বমির চিনহ যা থেকে ধারনা করা হয় সে আতংকিত অবস্থায় ছিল
এবং নিশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যায়। তাঁর অবস্থা দেখে মনে হয় সে হাত পা ছুড়ে বাচতে চেয়েছিল তাইতে তাকে এত শক্ত করে দড়ি দিয়ে বাধা হয়। কি নিষ্ঠুর।

এই মেয়েটির নাম দেয়া হয়েছে লা নিনা দেল রায়ো
তৃতীয় শিশুটি ছিল একটি ছোট মেয়ে,গবেষকরা যার নাম দিয়েছে লা নিনা দেল রায়ো। উৎসর্গের সময় তাঁর বয়স ছিল ৬ বৎসর। গবেষকরা পরীক্ষা করে দেখেছেন যে তাঁর মাথাটিকে ইচ্ছাকৃতভাবে প্রসারিত করা হয়েছে আর তাঁর মাথায় একটি লোহার আবরণ পরানো। বিজ্ঞানীরা মনে করেন এই লৌহ শিরোস্ত্রানটি বজ্রদন্ড হিসেবে ব্যাবহার করা হয়েছে। কারন তাঁর মুখ,কান ও কাধের একটি দিক
আঘাতপ্রাপ্ত যা দেখে মনে হয় বজ্রাঘাত।

কি ভাবে শিশুদের এই বলিদানের জন্য প্রস্তত করা হয়েছে ?
দেবতার সন্তষ্টির উদ্দেশ্যে বলিদানের জন্য এই কচি শিশুগুলোকে বিশেষ করে ছয় মাস আগে থেকে বিভিন্ন মাদক খাওয়ানো হয়েছে। গবেষকরা তাদের চুল পরীক্ষা করে এটা নিশ্চিত হয়েছে যে এই মাদকের মধ্যে ছিল কোকেইন সমৃদ্ধ কোকো পাতা আর মদ। এদের মাঝে উৎসর্গিতা কিশোরীটিই ছিল প্রধান আর এই কারনেই তাকে আলাদাভাবে পরিচর্যা করা হয়েছিল।ছোট দুই শিশুকে কিশোরীটির পরকালের খেলার সাথী হিসেবে উৎসর্গ করা হয়েছিল।

৫০০ বছরের পুরনো এই মমিগুলোর শরীরের ট্যিসু, অর্গান, জলীয় পদার্থ এবং ডিএনএ স্যাম্পল পরীক্ষা করে গবেষকরা একেছে তাদের শেষ যাত্রার দিনগুলোকে। এক গবেষক বলেছেন তাদের মুখগুলো দেখে তিনি দারুন আঘাত পেয়েছিলেন কারন সে সময় তারও এই বয়সী শিশু ছিল এবং তারা এতটাই সংরক্ষিত ছিল দেখে মনে হয় কয়েক সপ্তাহের।

লুলাইলাকোর কিশোরীকে পরীক্ষা করছে গবেষকরা
৫০০র উপর সিটিস্ক্যান ও বায়োপ্সির মাধ্যমে বোঝা যায় যে শিশুদের জোর করে, আঘাত বিশেষ করে মাথায় আঘাত করে বা মাদকের মাধ্যমে বেহুশ করে লুলাইলাকো পাহাড় চুড়ার বন্ধ মন্দিরে দেবতার উদ্দেশ্যে রেখে এসেছিল, আর সেখানেই তারা দম বন্ধ হয়ে করুন মৃত্যুকে বরণ করেছিল। কিশোরীটিকে পরীক্ষা করে জানা যায় যে বন্ধ মন্দির গৃহে রেখে আসার পরও সে জীবিত ছিল।
কৃষক পরিবারে জন্ম শিশু তিনটি আলু আর অন্যান্য সাধারন শাক শব্জী খেলেও বলিদানের জন্য নির্ধারিত হওয়ার পর তাদের উন্নত খাবার খেতে দিত যাতে স্বাস্থ্যবান হতে পারে। এমনকি গবেষকরা ৫০০ বছর পরেও তাঁর মুখের ভেতর মাঢ়ি ও গালের মাঝখানে কোকো পাতার সন্ধান পেয়েছিল।
উৎসর্গের কারন
ইনকারা বিশ্বাস করতো শিশুরা হচ্ছে কৌমার্য্য আর পবিত্রতার প্রতীক। দেবতাদের উৎসর্গ করার জন্য তারাই শ্রেষ্ঠ। বিভিন্ন কারনে শিশুদের বলি দেয়া হলেও উল্লেখযোগ্য ছিল ইনকা রাজার সুস্বাস্থ্য, সাম্রাজ্যের উন্নতি, ছেলে সন্তান লাভের আনন্দ, সিঙ্গহাসনে আরোহন,প্রাকৃতিক দুর্যোগ ওঁ ভালো শস্য উৎপাদনের জন্যও শিশুদের উৎসর্গ করার প্রথা ছিল ।
লুলাইলিকোর এই তিন শিশুই নয় আরও অনেক ইনকা শিশুর মমি পেরুর পাহাড় চুড়ায় আবিস্কার হয়েছে। বর্তমান ইনকা জাতি এই মন্দির আর এই মমিকে পবিত্র বলে মনে করে সেই সমাধি ক্ষেত্রের পবিত্রতা নষ্ট করার জন্য তারা সোচ্চার হয়েছে।
গবেষকরা বিভিন্ন পরীক্ষা নীরিক্ষা করে ভিডিওর মাধ্যমে দেখিয়েছে সেই চঞ্চল শিশু কিশোরীর স্বল্প জীবনকালের কাল্পনিক ছবি যা দেখে আপনার চোখ ভিজে উঠবেই যেমনটি আমি কেঁদেছি।

সমস্ত তথ্য ও ছবি নেট থেকে নেয়া






সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই এপ্রিল, ২০২২ দুপুর ১:৩৩
২৪টি মন্তব্য ২৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×